মুঠোবন্দী লাজুকলতা পর্ব ৭

0
111

#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৭

🍁
বছর তিনেক আগের কথা। মীরা তখন অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। পড়াশোনার জন্য ঢাকা থাকে। মাসের অর্ধেক যদি কলেজের হলে থাকে তো বাকি অর্ধেক পরিবারের সাথে। পরিবার এ চার জন সদস্য। বাবা, মা, দাদী আর মীরা। দাদা রহমত আলী গত হয়েছেন অনেক বছর আগে। মীরার স্মৃতিতে খুব একটা জায়গা নেই তার। কিন্তু দাদী নূরজাহান বেগম হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্থান দখল করে আছে। শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যুবতী। পুরোটা সময় জুড়েই মীরার জীবন জুড়ে পদচারণা ছিলো তার দাদীর। মীরার চেহারার নব্বই শতাংশ নূরজাহান বেগমের সাথে মিল। যার কারণে শওকত রহমান মেয়ের মাঝে মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। নূর জাহান বেগমকে জীবিতকালে আম্মাজান, মীরাকে ছোট আম্মাজান বলে ডাকতেন। চেহারার এই মিলটা কে নিয়ে মাঝে মাঝেই মীরা ফায়দা লুটত। দাদীর শুভ্র সাদা শাড়ি পেঁচিয়ে, ঢিলা-ঢোলা ব্লাউজ পরে লাঠিতে ভর করে আব্বাজানের সামনে বসে পরতো। খুক খুক করে কেশে দাদীর মতো অনুকরণ করে বলত,

-‘আমার বাপজান গো, পানের ডালা কই। দাও তো দেহি।’

শওকত রহমান মেয়ের কান্ডকৃত্তি তে হো হো করে হেসে দিতেন। মীরা চোখ রাঙ্গিয়ে বুঝিয়ে দিতো তাকে যেনো নূর জাহান বেগম ই ভাবা হয়। আবারো ভাব-সাব নিয়ে আঁচল টা কাঁধে টেনে নিয়ে বলত,

-‘শোনো বাপজান, এতো আনন্দিত হইয়ো না। আমার সমস্ত সম্পত্তির এক আনাও তুমি পাইবা না এই বলে রাখলাম। সব আমার দুই নাতনী পাইবো। তুমি এখনি ওসব এর আশা ছাইড়া দাও।’

শওকত রহমান ও তখন মীরার দুষ্টমিতে সায় দিতেন।
বলতেন,

-‘আম্মাজান, আপনার নাতনীদের তো বয়স হয় নায় তেমন। ওরা সামলাইতে পারবো না। আমাকে আপনি নিশ্চিন্তে দ্বায়িত্ব দিতে পারেন। আমি দেখে শুনে রখবো’

-‘তোমার ওসব বুঝা লাগবো না। আসছে মাতব্বর। ওরা যখন বুঝবো তখনি সামলাবো।’

মীরার নূর জাহান বেগমের মতো হুবুহু অভিনয় দেখে শওকত রহমান থ মেরে গেলেন। মীরা পাশের টেবিল থেকে একটা পান তৈরি করতে করতে বলত,

-‘আমার তিনডা শাড়ি কিনন লাগব বুঝছ। তোমার আব্বাজান থাকতে আমার শাড়ি কিনার কথা কওন লাগতো না। দাও ক্যাশ থাইকা টেকা দাও পাঁচ দশ হাজার যা পাও।’

-‘আসলেই নিবেন আম্মাজান?’

মীরা চুপি চুপি নিরবে ঠোঁট চেপে হাসে। দাদীর অনুকরণ করে শওকত রহমান কে যে কঠিন জব্দ করা গেছে এটা ভেবে তুমুল বেগে হাসি পায় তার। ঠোঁট চেপে হাসি নিয়ন্ত্রণ করে। হুঙ্কার দিয়ে বলে,

-‘আসল নকল কি বাপজান। টাকা বাইর করো। তোমার আব্বা আমারে একা ফালাইয়া গেছে, আমার হইছে যতো জ্বা’লা।’

শওকত ওসমান মেয়ের দুষ্টমিতে এবার ও তাল মিলাতেন। পাঞ্জাবির পকেট হাতরে সাড়ে তিন হাজার টাকা মেয়ের হাতে পুরে বলতেন,

-‘এটাতেই কিনে ফেলেন আম্মা। যেদিন আপনার সম্পত্তির দ্বায়িত্ব দিবেন ওইদিন আপনাকে লাড্ডু খাওয়াবো।’

মীরা টাকা পেয়ে পান টা হাতে নিয়েই দিক-বিদ্বিক ভুলে দৌড় লাগাতো নূর জাহান বেগমের রুমে। লাফ দিয়ে বিছানায় বসে জাপটে ধরতো শক্ত করে দাদীজান কে। হৈ হৈ করে বলত,

-‘পেয়ে গেছি দাদীজান, পেয়ে গেছি। আজকেই শপিং এ যাবো। ইয়াহুউউউউ!!’

বলেই কচকচে সাতটা পাঁচশত টাকার নোট সামনে মেলে ধরত। নূর জাহান বেগম খুক খুক করে কেশে গালা ঝেড়ে বলতেন,

-‘আমার শাড়ি, আমার লাঠি নিয়ে তুই এতো গুলা টাকা হাতায়ে নিলি হতচ্ছাড়ি। এক হাজার টাকা নিয়ে বাকি টাকা আমাকে দে। দে দেখি, দে।’

মীরা জানে দাদী এই টাকা নিবে না কখনও। তবুও সে মিছেমিছি ভান করে অসহায় কন্ঠে বলত,

-‘দাদীজান, আমার স্বামী সন্তান কেউ নাই। সাথে টাকা পয়সাও নাই। খুব কষ্ট করে তোমার অভিনয় করছি। আব্বাজান কে পটানো সহজ ছিলো না। তুমি তোমার ছেলের কাছে গিয়ে চাও যাও।’

-‘আমার হয়েই তো টাকা গুলা আনলি। আমি গেলে এখন কি দিবো রে ছেমড়ি।’

-‘না দিলো। টাকা দিয়ে কি করবা? এই নাও পান, মিষ্টি পান। গালে দিয়ে মুখ টা লাল করে ফেলো। ‘

নূর জাহান বেগম এক গাল হেসে মুখে পান ঢুকালেন। ধীরে ধীরে চিবিয়ে পানের স্বাদ গ্রহন করতে থাকেন। কিছুক্ষণের মাঝেই লাল হয়ে ওঠে তার ঠোঁট। মীরা বিছানায় এক কাঁধে ভর দিয়ে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে নূর জাহান বেগমের পানে। নূর জাহান বেগম ইতস্তত বোধ করেন। পানের পিক কৌটায় ফেলে জিজ্ঞাসা করেন,

-‘কি দেখতাছস এমন কইরা?’

-‘তুমি এতো সুন্দর করে পান খাও কিভাবে দাদী?’

-‘তুই ও খা। আয় শিখায়া দেই’

-‘পান খেলে যে বুকে জ্যাম হয় আমার।’

-‘আমি শিখাইয়া দিলে হইবো না। তোর জন্য একটা রাজপুত্তুর আনুম। এক লগে বইয়া পান খাবি।’

-‘ইস, তোমার রাজপুত্তর এর সাথে আমি পান খাবো কেনো! দুনিয়াই আর কিছুই নায় নাকি!’

-‘আহা, এক লগে বইয়া পান চিবাবি। ঠোঁট লাল কইরা ভালোবাসার মানুষটার লগে প্রেম বিনিময় করবি আর সুখ দুঃখের আলাপ করবি। মহব্বত বাড়বো।’

-‘আসলেই বাড়বো?’

-‘হ রে দিদিভাই। তোর দাদাভাই তো আমারে রোজ রাতে এক খিলি পান আইনা কইতো “নূর, পান খাইয়া মুখটা লাল করো তো দেহি। এই ধলা মুখটাই পান ছাড়া তোমারে পাইনসা লাগে দেখতে”।’

-‘মহব্বত করতো তোমাকে অনেক তাই না।’

নূর জাহান বেগম এই বয়সেও স্বামীর ভালোবাসার কথা শুনে একটু লজ্জা পেতেন বোধ হয়৷ মিহি সুরে বলতেন,

-‘মহব্বত করতো কি না জানি না। তয় আমারে ছাড়া উনার চলতো না। দিন শেষে আমারে ধইরাই ঘুমাইতো। শান্তি লাগতো নাকি তার।’

নূর জাহান বেগমের খোলা মেলা কথাতে লজ্জা পায় মীরা। দাদীর মুখে একটুও লাগাম নায়। হুটহাট কি সব বলে ফেলে। লজ্জামাখা বদনে মিন মিন কন্ঠে বলত,

-‘তুমি অনেক সুন্দর দাদী। এখন তখন সবসময়। আমার জন্য যে রাজপুত্তুর আনবা সেও পাগল হবে তোমার জন্য। ‘

মীরার কথা শুনে উচ্চ স্বরে হেসে উঠতেন নূর জাহান বেগম। মীরার থুতনিতে হাত রেখে বলতেন,

-‘আমার দিদিভাই এর উপর থাইকা নজর ফেরানো মুশকিল হবে যে কোনো রাজপুত্তুর এর। এক নজরেই আইটকা যাইবো তার হৃদযন্ত্র। তোরে ছাড়া ওই যন্ত্র আর চলবো না। হা হুতাশ কইরা বেড়ান লাগবো।’

-‘ইস! কখনও না।’

-‘হ রে ছেমড়ি। তুই হইছস আমার লাহান টুকটুকে সুন্দর। আর গুণ তো মাশাল্লাহ আমার থাইকাও এক কাঠি উপরে। বাঁইচা থাকতে তোর কদর করবার পাইবো এমন একজনের হাতে উঠায়া দিবার পাইলে শান্তি পাইতাম।

-‘দাদীজান, এভাবে বলো কেনো? আল্লাহ তায়ালা তোমার নেক হায়াত বৃদ্ধি করে দিক।’

-‘আমিন। এবার ক শান্তি দিবি?’

-‘আমি এখানে থাকলে তোমার অশান্তি হয়? দূরে ঠেলতে চাচ্ছো কেনো?’

-‘না রে বুবু। মাইয়াগো স্বামীর সংসার ই সর্বসুখ। আইজ নয়তো কাল যাওয়াই লাগে। আমি বাঁইচা থাকতে তোগো চার হাত এক করবার পারলে, দেইখা যাইবার পারলে চোখ দুইডা জুড়াই যাইতো।

মীরা ছলছল নয়নে তাকায় নূর জাহান বেগম এর দিকে। সে জানে একদিন না একদিন ঠিক আপন জনকে ছেড়ে যেতে হবে। নিজের ঠিকানা গড়ে তুলতে হবে নতুন করে। কেমন হবে দাদীজানের রাজপুত্তুর! যদি ঠিকানা গড়তে সাহায্য না করে সে, তখন কি হবে! পারবে কি সে নিজের জন্য শক্ত জায়গা করে নিতে?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here