#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_৩২
রাজিয়া বেগম এশার সালাত আদায় করেছেন কিছুক্ষণ হলো। বেশ কিছুক্ষণ জায়নামাজে বসে থাকার পর উঠেই মুঠোফোন টা হাতে নিয়ে বিছানায় বসেছেন ছেলে আর পুত্রবধুর খোঁজ নিতে। রাইফ সেই যে সন্ধ্যায় কলে জানিয়েছিলো তাদের ফিরতে দেড়ি হবে, রাত্রী প্রায় সাড়ে নয়টা বেজে যাচ্ছে এখনও ফেরার নাম নিচ্ছে না। ছেলে রাত বিরাতে বাসায় দেড়িতে ফিরলেও মীরাকে নিয়ে বেশি ক্ষণ যেনো বাহিরে না থাকে তা পই পই করে বলে দিয়েছিলেন তিনি। এতো দেড়ি তো হওয়ার কথা না!সন্তানের কথা ভেবে কিঞ্চিৎ চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠেছে তার মুখাবয়বে। রাইফের নাম্বারে কল দিয়ে লাউড স্পিকার অন করলেন, পর পর রিং হয়ে কল এর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। আবারও কল দিলেন এবং পূর্বের ন্যায় এবারও কোনো সাড়া পেলেন না অপর প্রান্ত থেকে। ছেলেকে না পেয়ে তিনি একমাত্র পুত্রবধু মীরার নাম্বারে কল দিলেন, কিন্তু এবারও হতাশ হলেন। দুজনের একজন ও কল রিসিভ করলো না। মনের মাঝে উঁকি দেওয়া ঈষৎ চিন্তা এবার গাঢ় হতে শুরু করল রাজিয়া বেগমের। পরক্ষণেই কল দিলেন নতুন সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়া বেয়াইন খাদিজা বেগম কে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাবধানেই সাড়া দিলেন, খাদিজা বেগম কল রিসিভ করলেন হাসি মুখে। খোশ মেজাজে কুশলাদি বিনিময়ের মাধ্যমে কথোপকথন শুরু হলেও শেষ হলো দুজনের দুরুদুরু বুকে কপালে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে। দু প্রান্তের দুই মা’য়ের মনেই এখন সন্তানের
বি/পদের আশংকা জেঁকে বসেছে, ছটফট করছে ছেলে মেয়েকে কাছে পেতে। আকুল নিবেদনে সন্তানের মঙ্গল কামনা করছেন মহান আল্লাহর দরবারে। সহি সালামতে কোলের সন্তানকে ঘরে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা দুজনের মাঝে।
____________
কিয়ৎক্ষণ পূর্বে গগণ বিদারী চিৎকারে ভারী হওয়া রাতের আকাশ-বাতাস এখন শান্ত, নিরবতায় আচ্ছন্ন, থম
মে/রে আছে যেনো। বেপরোয়া গতিতে দ্বিকবিদিক ভুলে রাইফ-মীরার দিকে ছুটে আসা মালবাহী ট্রাক ব্রিজের রেলিং ভে’ঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে ছিটকে গিয়ে বিশাল গর্জন তুলে নদীর টুইটুম্বুর জলে পতিত হয়েছে, সাথে সাথেই নদীর শান্ত জল কে করেছে অশান্ত। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পরেছে তার দুই কূলে। ট্রাকের ভা’ঙ্গাচুরা কিছু ধ্বং/সাবশেষ ভাসছে পানির উপরে। নদীর অতল গহব্বরে ডু’বে যাওয়া ট্রাকের ভেতর থেকে কোনো রকমে জান টা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে ড্রাইভার এবং হেলপার দুজনেই। নদীর টুইটুম্বুর জলে হাঁপাতে হাঁপাতে সাঁতরে এসেছে পাড়ে।
রাস্তার মাঝে পরে আছে একটা মুঠোফোন, উপরের গ্লাস ফেঁটে তার চুরমার অবস্থা। অদূরে পরে থাকা ফোনটায় একটানা রিং হচ্ছে উচ্চ শব্দে, ডিসপ্লে তে জ্বল জ্বল করে শো করছে “আম্মা” লেখাটি। কালো রংয়ের ছোট হ্যান্ড ব্যাগ এবং এক জোড়া জুতাও এলোমেলো হয়ে পরে আছে অবহেলায়। ইট-সিমেন্টে তৈরি রেলিং এর সাথে ধাক্কা লেগে গাড়ির সামনের গ্লাস ভেঙ্গে চুর্ণ বিচূর্ণ কাঁচ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ব্রিজের মাঝের অনেকটা অংশ জুড়েই। ভয়ে গুটিয়ে নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা শেষে এক লহমায় কি হতে কি হয়ে গেলো বুঝতে পারছে না রাস্তায় পরে থাকা এক জোড়া কপোত-কপোতী। শুধু নিথর দেহ পরে আছে পাশাপাশি, আঁকড়ে ধরে আছে একে অপরের হাত।
বেগতিক ভাবে ছুটে আসা ট্রাক আর অর্ধাঙ্গিনীর আঁকড়ে জড়িয়ে ধরা দু হাত বলছিলো এখান থেকে সরে যেতে হবে যে করেই হোক। মস্তিষ্কের নিউরন সেকেন্ড এর মাঝে রাইফকে জানান দিয়েছিলো, তীক্ষ্ণ ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলো বাঁচতে হবে দুজনকে। এই সুন্দর ধরনীতে হাতে হাত রেখে পথচলা তাদের এখনও বাকি, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে জীবনকে উপভোগ করার ইচ্ছেটাকে এতো দ্রুত দেওয়া যায় না ফাঁকি! এতো তাড়াতাড়ি প্রেয়সীর হাতে হাত রেখে বৃদ্ধ হওয়ার ইচ্ছে নিঃশেষ হতে পারে না রাইফের। না না, কিছুতেই না।
তুমুলবেগে ধেয়ে আসা ট্রাক দেখার সাথে সাথেই রাইফের বলিষ্ঠ পুরুষালী বাহু দুটো মীরাকে শক্ত করে জড়িয়ে বক্ষে আবদ্ধ করেছিলো, ইট সিমেন্ট এর ব্রিজ থেকে তার লাজুকলতার ছোট্ট দেহটাকে শূন্যে তুলে নিয়েছিলো তাৎক্ষণিক। বড় বড় পা ফেলে এক প্রকার ছিটকে সরে গিয়েছিলো উচ্চ আওয়াজে হর্ণ বেজে বেপরোয়া গতিতে আসা ট্রাকের সামন হতে। তাড়াহুড়ায় সরে আসাতে রেলিং এর নিচে সিঁড়ির মতো উঁচু করে বাঁধায় করা জায়গাটাতে পা বেজে হোঁচট খেয়ে ছিটকে নিচে পরে গিয়েছিলো মধ্য সড়কে। আল্লাহ সহায় ছিলো তাদের উপর। গ্রাম্য রাস্তায় যানবাহনের চলাচল খুবই কম, শহুড়ে ব্যাস্ত রাস্তা হলে এতো ক্ষণে হয়ত দুটো দেহ পিষ্ট হতো গাড়ির চাকায়।
.
মাথার পেছন দিকে চরম ভাবে আঘাত প্রাপ্ত রাইফ মৃদু শব্দ করে ডেকে উঠলো মীরার নাম ধরে। পাশেই পরে থাকা মীরা রাইফের ডাকে সাথে সাথেই সাড়া দিতে পারল না। রাইফের হাতে রাখা হাত টা ঈষৎ নাড়িয়ে চিনচিনে ব্যাথায় শুধু হালকা আর্তনাদ করে উঠলো সে। রাইফের টনক নড়ল মীরার আর্তনাদে। পাশেই চিৎ হয়ে পরে থাকা দেহটার দিকে পাশ ফিরে তাকাতেই বুকের বা পাশটা মোচড় দিয়ে উঠল তার। দ্রুত উঠতে গিয়ে শরীরের তীক্ষ্ণ ব্যাথায় মুখ কুঁচকে চোখ খিঁচল, হজম করে নিলো মুখ ফুটে বেরিয়ে আসা ‘আহ্’ শব্দটুকু। এক হাত দূরত্বে পরে থাকা মীরার ব্যাথাতুর চেহারা রাইফের ভীত কাঁপিয়ে দিলো, নড়বড়ে করল, বিপদের আশংকা জেঁকে বসলো মনে। দ্রুত কাছে এলো মীরার, শিয়রে বসে রাস্তায় পরে থাকা মীরার মাথাটা কোলে তুলে নিলো আলতো হাতে। এতোক্ষনের বদ্ধ চোখ জোড়া পিটপিট করে খুলল মীরা। ভয় মিশ্রিত ব্যাথাতুর মুখটায় চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পরা ভেজা পল্লব খুলল, ঝাপসা দৃষ্টিতে রাইফকে দেখে বেদনা ভরা মুখশ্রী তে মৃদু হাসি ফুটলো মীরার সরু গোলাপি ঠোঁটের কোণে। পিচ ঢালা সড়কের মাঝে ছিটকে পরে গিয়ে ছিলে যাওয়া কোমল হাত টা উর্ধ্বে তুলে ছুঁইয়ে দিলো রাইফের গাল। শুষ্ক গলাটা ছোট্ট ঢোক গিলে ভিজিয়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে মীরা ধীর কন্ঠে নিস্তেজ গলায় শুধালো,
-‘ঠিক আছেন তো আপনি? কিছু হয় নি তো আপনার?’
রাইফ জবাব দিতে পারল না, কোন শব্দ কন্ঠ গহ্বর থেকে উচ্চারিত হতে পারল না। যেনো কঠিন ধারা জারি করা হয়েছে রাইফের কণ্ঠনালীতে। কন্ঠস্বর এ যেনো কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে উচ্চারিত না হওয়ার।
মীরার এই একটা কথায় কি ছিলো
জানে না রাইফ, শুধু জানে তার মতো এই নারীটাকেও সঙ্গী হারানোর ভয় মুষড়ে দিয়েছে, চুরমার করে দিয়েছে বুকের বা দিকে থাকা ছোট্ট হৃদ পিন্ডটাকে।
মীরার নিস্তেজ দেহটাকে টেনে তুলে কোলের উপর বসালো রাইফ। দুজনের মাঝে থাকা দূরত্ব টুকু ঘুচিয়ে নিলো, মীরার নরম দেহটাকে নিজের শক্ত দেহের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো ব্যাক্তিগত ভাবে। এই সংকট ময় সময়ে নতুন জীবন পাওয়া দম্পতির মেলবন্ধনের সাক্ষী হলো মাথার উপর থাকা গোলাকৃতির চাঁদ, উঁকি দিয়ে দেখতে ভুলল না জ্ব’লজ্ব’ল করা ছোট্ট ছোট্ট নক্ষত্ররাজিরাও।
রাইফের থেকে সবসময় সংকোচ হোক কিংবা লজ্জায় পালিয়ে থাকা মীরা সব ভুলে গেলো। তার ছিলে যাওয়া ক্ষ’ত বিক্ষ’ত র/ক্তিম দু হাত রাইফের পুরুষালী পিঠ জড়িয়ে নিলো, খাঁমচে ধরল রাইফের সাদা রংয়ের শার্ট। শক্ত বুকটায় মুখ গুঁজে দিলো মীরা। এতোক্ষণ স্বামীকে হারানোর চেপে রাখা ভয় টুকু অশ্রু হয়ে ঝড়ে পরল, নিরবে ভিজিয়ে দিলো রাইফের বুক। নিরব কান্না বেগতিক হারে বাড়তে শুরু করেছে স্বামীর সংস্পর্শে, কেঁপে কেঁপে উঠছে রাইফের দু হাতের মাঝে আব’দ্ধ থাকা মীরার কোমল দেহটা। রাইফের হাত আলতো করে বুলিয়ে দিচ্ছে মীরার ফিনফিনে পিঠ। এই মুহূর্তে ভীতসন্ত্রস্ত আদুরে বউটাকে শান্ত করার জন্য এই পদ্ধতি তার কাছে সঠিক মনে হলো। হুম, সঠিক ই হলো। ক্রন্দনরত মীরার কান্নার বেগ কমলো, কেঁপে কেঁপে ওঠা দেহ টা স্থির হয়ে পরে রইল রাইফের বলিষ্ঠ বুকে। মীরাকে আরেকটু চেপে ধরল নিজের দেহের সাথে, কন্ঠনালীর সাথে যু/দ্ধ করে জয়ী হয়ে ভরাট কন্ঠে থেমে থেমে কয়েকটি শব্দ উচ্চারিত করল রাইফ,
-‘ভয় নেই, এইতো আমি। আছি, তোমার সাথেই আছি। খুবই নিকটে, এই আমি পুরোটাই তোমার হয়ে।’
….
মূহুর্তেই লোক জন ভীর করে জটলা পাকলো দুজন কে ঘিরে। জাপটে ধরে থাকা মীরাকে সরিয়ে নিলো রাইফ। লোকজন ও ব্যাস্ত হলো তাদের কে নিয়ে, সাহায্যের হাত এগিয়ে দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করতে তাদের নিয়ে ছুটল নিকটস্থ কোনো ফার্মেসী তে। এলাকার চেয়ারম্যান ও চলে এসেছে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ট্রাকের হেল্পার কে পেলেও পেলো না ড্রাইভার কে। নে/শাগ্রস্ত ধুরন্ধর ড্রাইভার পালিয়ে গিয়েছে জন সমাগম হওয়ার আগেই।
চিকিৎসার সহিত রাইফ-মীরাকে বাসায় ফেরার ব্যাবস্থা করলেন চেয়ারম্যান নিজেই। এই পরিস্থিতে তিনি নিজের বাসাতেই দুজন কে থেকে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু রাইফ সম্মতি দেয় নি মায়ের কথা ভেবে। অশান্ত মনটাকে স্থির করতে এখন আপন নীড়ে ফেরা তার জন্য খুবই জরুরি।
চলবে……
(খুশি? আপনারা খুশি তো আমিও খুশি)
💛💛💛