#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৯
🍁
রাতের আঁধার দূরীভূত করে ধরণীর বুকে সবেমাত্র সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে পরতে শুরু করেছে। এতো সকালেই রাজিয়া বেগমের পুরো কিচেন খাবারের ঝাঁঝালো ঘ্রাণে ভরে গেছে। দুই চুলায় ঝমঝম আওয়াজ তুলে পুরোদস্তুর রান্না করছে মীরা। পাশেই উঁচু মোড়ায় বসে আছেন রাজিয়া বেগম।
ফজরের সালাত আদায় করেই মীরা চলে এসেছিলো পাঁচ তলায়। শাশুড়ীর অসুস্থতার খবর শুনে গতরাতেই একবার দেখতে আসতে চেয়েছিলো মীরা, কিন্তু রাইফের বারণে আসতে পারেনি। ভোরেই ঘুম থেকে উঠে ফজরের সালাত আদায় করেই সোজা উপরে চলে এসেছে সে।
মীরার কঠোর বারণ রাজিয়া বেগমের প্রতি। কোনো ভাবেই যেনো উনি রান্না-বান্নার কাজে হাত না লাগায়। রাজিয়া বেগম বেশ কয়েক বার বাঁধা দিয়েছেন মীরা যেনো রান্না না করে৷ কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় নি। গতরাতে রাইফ চলে আসার সময় রাজিয়া বেগমের জন্য খাবার প্যাক করে পাঠিয়েছিলেন মীরার মা। সেই খাবার থেকে অল্প একটু খেয়েছেন তিনি৷ সেটা দিয়েই চালাতে চেয়েছিলেন আজকের সকালের খাওয়া-দাওয়া পর্ব। সেই সকাল থেকে বলেই যাচ্ছে মীরা যেনো খাবার রান্না না করে, কিন্তু মীরা মানতে নারাজ। শাশুড়ীর কি খেতে ইচ্ছা করছে তা পেট থেকে বের করেই ছেড়েছে। বিয়ের দিন থেকে গোস্ত, পোলাও, কোরমা খেতে খেতে মুখের রুচি কমে গেছে রাজিয়া বেগমের। তাই মীরাকে বলেছে অল্প কিছু ভর্তা করার জন্য।
মীরা আলু ভর্তা, ডাল ভর্তা, তিল ভর্তা শেষে এখন ইলিশ মাছ ভাজছে আর অন্য চুলায় ওদের বাড়ি থেকে পাঠানো খাবার টুকু গরম করছে। মীরা ফল কে/টে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে শাশুড়ী আম্মাকে এবং একটু পর পর ই তাগদা দিচ্ছে খাওয়ার জন্য। রাজিয়া বেগম এক টুকরো খাচ্ছেন তো দুই টুকরো মীরার মুখেই তুলে দিচ্ছেন। মীরা না করলেও শুনছেন না তিনি। শাশুড়ী-পুত্রবধু যেনো একে অপরকে খাওয়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে আজ সাত-সকালে।
______________
মীরা পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। বদ্ধ রুমের দরজা খানিক খুলে উঁকি দিলো রুমে। রাইফ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শব্দ বিহীন পায়ে রুমে প্রবেশ করল সে। ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রাইফের পাশেই বসে আধোশোয়া হয়ে হেলান দিলো বিছানায়। মোবাইলে চোখ বুলাল, সময় সাতটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। ডেকে তোলা প্রয়োজন রাইফকে। অফিসের সময় হয়ে এলো, কিন্তু মীরার ডাকতে ইচ্ছা করছে না একটুও। কি সুন্দর ভাবে ঘুমাচ্ছে রাইফ, শ্যমবর্ণের মুখটায় মায়া ছড়িয়ে পরেছে সর্বত্র। লাজুক মীরার খুব করে ইচ্ছা করছে রাইফের এলোমেলো চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে, আংগুলের সাহায্যে অগোছালো চুল গুলোকে আরেকটু এলোমেলো করতে।
গত তিনদিনেই মীরার অভ্যাস টাও কেমন পালটে গেছে হুট করে। রাইফের আংগুলে আংগুল রেখে রাত্রিযাপন করা মীরার গতরাতের ঘুমে বার বার খুঁজছিলো রাইফের শক্তপোক্ত হাতটা। লোকটা ভালো, ভীষণ রকমের ভালো। কিন্তু মীরার অস্বস্তি ওই এক যায়গাতেই। হুটহাট কথা বলে লজ্জায় ফেলে দেয় সুযোগ পেলেই।
সময় পেরোলো মিনিট দশেক। মীরার মনে রাইফকে ঘিরে হাজারও ভাবনা প্রজাপতির ন্যায় ডানা ঝাপ্টাচ্ছে এমন সময় পাশে রাখা মুঠোফোনটায় কর্কশভাবে বেজে উঠলো এলার্ম ধ্বনি। মীরা বতিব্যাস্ত হলো এলার্ম অফ করার জন্য। বালিশের পাশে পরে থাকা মুঠোফোনটায় হাত দিতেই রাইফের হাতটাও মীরার হাতের উপর স্পর্শ করল। আচানাক কারো হাতের সংস্পর্শে রাইফ ভ্রু কুঁচকালো এবং সেকেন্ড পাঁচেক পার হতেই কুঁচকানো ভ্রু সোজা হলো। বদ্ধ চোখের মুখটাতে ফুটে উঠল মুচকি হাসি। শক্ত করে আবদ্ধ করে নিলো মীরার হাত। উপুর হয়ে শুয়ে থাকা রাইফ পাশ ফিরলো মীরার দিকে। চোখ খুলল, সকাল বেলায় অপ্রত্যাশিত ভাবে কাঙ্ক্ষিত নারীর মুখটা দেখে প্রশান্তি ছেয়ে গেলো তার হৃদয় জুড়ে। মীরা রাইফের চাওনিতে ফেরত দিলো মুচকি হাসি। টিকটিক করে বেজে যাওয়া এলার্ম টা অফ করার জন্য হাত ছেড়ে নিতে চাইল মীরা। রাইফ বাঁধা দিলো,হাত ছাড়ল না। উপায়ন্তর না পেয়ে মীরা বা হাতের সাহায্যে এলার্ম অফ করে চাইল রাইফের পানে। সাধারণত স্বাভাবিক সময়ে মীরা নিঃসংকোচে তাকায় রাইফের পানে, চোখে চোখ রেখে কথা বলে কোনো অস্বস্তি বিহীন। কিন্তু রাইফের কিছু দৃষ্টি আছে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, গভীর থেকে গভীরতর দৃষ্টি। সেই দৃষ্টিতে শুধুই মুগ্ধতার ছড়াছড়ি। সেই গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টিতেই মীরা নজর রাখতে পারে না। দৃষ্টি রাখবে কি করে? রাইফের এই দৃষ্টিতে যে এক আকাশ সম প্রেম স্পষ্ট দেখতে পায় মীরা, অনুভব করে শিরা উপশিরায়।
রাইফ ইশারা দিলো মীরাকে পাশে পুরোপুরি ভাবে শোয়ার জন্য। কিন্তু মীরা ইশারার সঙ্গ দিলো না। বুঝেও না বোঝার ভান ধরল তৎক্ষনাৎ। ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্নাত্মক ইশারায় জিজ্ঞাসা করল “কি?”
রাইফ আবারও ইশারায় বলল শুয়ে পরার জন্য। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হলো না তার। মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে যাওয়া মীরা আবারও না বোঝার ভান ধরল, আবারও ইশারায় বোঝালো রাইফের ইশারা বোঝেনি সে। প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন রাইফ ধরে ফেলল মীরার চালাকি। রাইফ পুনরায় ইশারা দিলো মীরাকে যার অর্থ “আমার ইশারা কি বোঝো নি?”
মীরা ইশারাতেই বলল বোঝে নি সে। রাইফ বিস্তৃত হাসল। ঠোঁট চেপে মিটিমিটি হাসছে মীরাও। লাজুকলতার মিঠে মুচকি হাসি রাইফের মন শীতল করে তুলল। এই মেয়েটা জানেই না হাসলে কতো সুন্দর লাগে তাকে। রাইফের সঙ্গ পেয়ে মীরাও যে দুষ্টুমি আয়ত্ত করে ফেলছে সেটাও ধরে ফেলল সে।
এ পর্যায়ে এসে শেষ টোপ টা ফেলতে চায় রাইফ। ওস্তাদের সাথে পাঙ্গা নিয়েছে, খেল তো জমাতেই হবে। কেননা না, লাটাই তো তার ই হাতে। আংগুলে আংগুল রাখা মীরার হাতটা আরো শক্ত করে ধরল। ধারালো চোখে তীক্ষ্ণ এক ইশারা দিলো যার অর্থ এবার পাল্টে গেছে। এবার আর পাশে শুতে বলে নি রাইফ, এবার সোজা তার বুকে মাথা রাখতে বলেছে মীরাকে। এবং পরক্ষণেই এটাও ইশারা করেছে, এর ব্যত্যয় ঘটলে তার মুঠোয় আবদ্ধ হওয়া হাতটা টেনে কাছে টানবে মীরাকে।
রাইফের শেষ ইশারায় মীরার হাসিহাসি মুখটা থেকে ফুরুৎ করে উড়ে গেলো মুচকি হাসিটুকু। কিছুটা লজ্জায় গোমড়া হলো চেহারা। রাইফের বুকে যাওয়ার ভয়ে ফটাফট আগের ইশারা মতো শুয়ে পরল দ্রুত। এই লোকের এক বিন্দুও গ্যারান্টি নায়। কখন যে হেঁচকা টানে কাছে নিবে বলা যায় না। মীরার এমন আচরণে রাইফের পেট ফেটে হাসি পেলো, এতোক্ষণের চেপে চেপে মুচকি হাসি শব্দ হয়ে বেরিয়ে এলো। রাইফের খলখল হাসির শব্দে ভরে গেলো পুরো রুম। মীরার কিঞ্চিৎ রাগ হলো। এভাবে হাসার কি আছে? আজ তাকে আলাভোলা পেয়ে এভাবে হাসছে তো, সেও একদিন দেখে নিবে। হুহ!
বদ্ধ রুমে রাইফের হাসি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে। মীরা ধ্যান দিলো রাইফের হাস্যজ্বল মুখাবয়বে। শ্যাম সুন্দর পুরুষটার এমন হাসি দেখেনি সে আগে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে সঙ্গ দিলো রাইফের, শেষ পর্যন্ত হেসে উঠল মীরা নিজেও।
রাইফের হাসি থামল, এগিয়ে এলো মীরার দিকে। চিত হয়ে শুয়ে থাকা মীরার মুখ থেকে হাসি উবে গেলো রাইফের হঠাৎ কাছে আসাতে। পর্দার ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের সোনালী ঝলমলে রোদ্দুর্র মীরার মুখে পরেছে তীর্যক ভাবে। মীরার ফর্সা মুখে লেপ্টে যাওয়া সোনালী আভা এ মূহুর্তে যে কারো বক্ষ পিঞ্জরে মুগ্ধতা ছড়ানোর জন্য যথেষ্ট। রাইফের হাসি হাসি মুখটা ধীরে ধীরে গম্ভীর হলো। হালকা করে মাথায় পেঁচানো ওড়না টার ফাঁক দিয়ে কিছু চুল পরে আছে মীরার গোলাপী আভা যুক্ত গালে। শান্ত স্থির মুখাবয়বে রাইফ মীরার মুখে সম্পুর্ন দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তাকিয়ে আছে উপুড় হয়ে বুকে ভর দিয়ে। মীরার একটা হাত এখনও মুঠোয় তার। অন্য হাতে গালে পরে থাকা চুল গুলো সরিয়ে দিলো আলতো করে। নরম গালে রাইফের হাতের স্পর্শ পেয়ে মীরা হৃদয় থমকে গেলো, চোখ বুঝে গেলো সয়ংক্রিয় ভাবে। মীরা অশান্ত মন বলছে রাইফ আজ কিছু করবেই করবে। আচ্ছা এতো যে ধ্যান মে/রে তাকিয়ে আছে তার মুখে, সেই মুখটাতেই অধিকার ফলাবে না তো! অধিকার ফলালে ফলাবে, এতে মীরার আপত্তি নেয় একটুও। রাইফ তার স্বামী, সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে মীরার প্রতি। রাইফকে বাঁধা দেওয়া অনুচিত তবুও নতুন জন্ম নেওয়া গোলমালে অনুভূতি গুলোই বার বার মীরাকে আরষ্ঠ করে তুলছে। রাইফ মীরার ছোট গোলগাল মুখটায় হাত রাখল। নরম গাল টা ঘষে দিলো আলতো করে। মীরার নিশ্বাস ক্রমশ ভারী হতে থাকলো রাইফের স্পর্শে, চোখ বুজেই বিছানায় পরে রইলো শক্ত হয়ে। বালিশের উপর মীরার মুঠোবন্দী হাতটা টেনে তুলল রাইফ। মেহেদীর রঙ এখনও শোভা পাচ্ছে মীরার হাতে। মেহেদীর গাঁঢ় খয়েরী রংটা একদিনে এখন হালকা লালে পরিণত হয়েছে। মীরার হাতের উল্টো পাশটায় রাইফ খুব যত্ন করে বৃদ্ধাংগুল ঘষলো বার কয়েক। মীরার বদ্ধ চোখে আরেকবার নজর বুলাল। ছোট একটা ঢোক গিলে মুঠোয় রাখা মীরার হাতের উলটো পাশে অধর ছোঁয়ালো ছোট্ট করে। মীরার অন্তরাত্মা ধরাম করে উঠল, বদ্ধ নয়ন কুঁচকে আরো ভেতরে গেলো। হৃদ স্পন্দন এক সেকেন্ডের জন্য থেমে গিয়ে বেগতিক হাড়ে ছুটতে শুরু করলো। রাইফের অধরের ছোঁয়ায় মুঠোয় পরে থাকা হাতটা দিয়ে রাইফের হাত শক্ত করে চেপে ধরল মীরা। রাইফের মন অশান্ত হলো। এতো ছোট চুম্বনে মনটা কিছুতেই শান্ত করা সম্ভব না, কিছুতেই না। বুকের ভেতর যে ঝড় উঠেছে সেটা থামানো প্রয়োজন, খুবই প্রয়োজন। বেশি সময় নিলো না, সাত-পাঁচ ভাবার সময় নেই তার এখন। সম্মুখে ধরে রাখা হাত টাতে পুনরায় অধর ছোঁয়ালো। এক বার, দু বার, তিন বার এবং পর পর অনেক বার৷ অজস্র চুমুতে ভরিয়ে তুলল মীরার মেহেদী রাঙা হাত। কখন বা স্বশব্দে কখনও বা শব্দ বিহীন।
চলবে………
(মন্তব্য চাই ছোট করে হলেও)
ভালোবাসা💛💛💛