#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৮
🍁
নতুন জামাতার আগমনের খবর শুনেই ভাইয়ের বাসায় ছুটে এসেছেন সানজিদা বেগম। একমাত্র ভাতিজিকেও দেখতে তার মন আকুপাকু করছিলো সকাল থেকেই। এসেই খাদিজা বেগমের সাথে লেগে পরেছেন রান্না বান্নায়। শওকত রহমান বাজার করে এনেছেন ব্যাগ ভরে। আপাতত গরুর গোস্ত আর কাবাবের লোভনীয় সুস্বাদু ঘ্রাণ মৌ মৌ করছে পুরো বাসায়।
নিজ রুমে বসে থাকা শওকত রহমান হাঁক ছুটালেন উচ্চ আওয়াজে, ডেকে উঠলেন প্রিয় সহধর্মিণীকে। খাদিজা বেগম আসলেন, ঘর্মাক্ত মুখ শাড়ির আঁচলে মুছে তাগদা দিলেন কি জন্য ডেকেছে সেটা বলতে।
শওকত রহমান পাশে বসালেন, ফোনটা হাতে নিয়ে বাড়িয়ে দিলেন স্ত্রীর দিকে। বললেন,
-‘রাইফের আম্মাকে ফোন দিয়ে আসতে বলো। সবাই আছে, উনিও আসুক। একা একা কি করবে বাসায়।’
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ। দেন, তাড়াতাড়ি কল দেন। কথা বলছি।’
কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই কল রিসিভ হলো। রাজিয়া বেগমের সহিত খাদিজা বেগম কুশলাদি বিনিময় করলেন খোশ মেজাজে। অনুরোধের সুরে বাসায় আসার আমন্ত্রণ জানালেন, কিন্তু রাজিয়া বেগমের ইচ্ছা থাকা স্বতেও আসতে পারবেন না বলে জানিয়ে দিলেন। হাঁটুর ব্যাথা চরম আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে তার৷ রেস্ট করছেন শুয়ে শুয়ে। না আসতে পারার জন্য ক্ষমাও চেয়ে নিলেন বিনীতস্বরে।
🔹
মীরার হাতের চা খাওয়ার সৌভাগ্য আর হয় নি রাইফের। হবে কি করে? নববধূ মীরাকে যে ভাবে কথার জালে জব্দ করে যাচ্ছে একের পর এক, সামনে মুখ দেখানোর মতো আর সাহস পায় নি মীরা। প্রখর জ্ঞানসম্পন্ন রাইফও জানে মীরা আর আসবে না। লজ্জাবতী লাতার ন্যায় চুপসে যাওয়া মীরার ছোট্ট কোমল হৃদয়ে যে এখন তুখোড় গতিতে ডামাডোল বাজছে তা সে খুব ভালো করেই জানে। রাইফ ফ্রেশ হয়ে গা এলিয়ে দিয়েছে বিছানায়। তার ক্লান্ত দেহ মীরার নরম বিছানা পেয়ে প্রশান্তিতে চোখ বুজে নিলো। খুব বেশি সময় লাগলো না, মূহুর্তেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো রাইফ।
একটু আগে রাইফের কথার বাণে বি’দ্ধ হওয়া মীরা ঘুরঘুর করছে কিচেনে, খাদিজা বেগমের আশেপাশে। কাজ না থাকা স্বতেও একবার এটা ধরছে তো আরেকবার ওটা। ব্যাস্ত হাতে কাজ করা খাদিজা বেগমের চার পাশে ঘুরঘুর করাতে তার মাথা ঘুরছে। বিরক্তি ভরা চোখে তাকালেন তিনি, মীরাকে ধমকে উঠলেন কিঞ্চিৎ। মেয়েকে স্থির থাকতে বলে রুমে গিয়ে রাইফের কি লাগে দেখতে বললেন। মীরা তো যাবে না কিছুতেই, এমন পরিস্থিতির পর কিভাবে যাবে মীরা রাইফের সামনে? রাইফের কাছ থেকে গা ঢাকা দিতেই তো এখানে ঘুরঘুর করছে আর উনি কিনা বলে রাইফের কাছে যেতে। অসম্ভব, এখন যাওয়া মানেই আরেক বার উনার বেফাঁস কথায় কান গরম হওয়া। মীরা আমতা আমতা করল, মিনমিন করে বলল,
-‘উনার মনে হয় কিছু লাগবে না আম্মা।’
-‘লাগবে না মানে কি? চা নিয়ে যা।’
মীরা মাথা চুলকালো। ইনিয়ে বিনিয়ে বলল,
-‘চা খাবে না।’
-‘কি খাবে?’
-‘কিছুই খাবে না।’
-‘এসব কি ধরণের কথা বার্তা মীরা। নতুন জামাই, না দিলে খাবে কি করে। এই নে ট্রে, যা নিয়ে যা।’
মীরা যে আজ কঠিন বি’পদে পরেছে তা একদম হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। রাইফ এর বলা একেকটা কথা যে তার ভেতর কম্পন সৃষ্টি করে তা তো আর কেউ জানে না। মীরার মনে হচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে সে আর বেশি দিন বাঁচবে না। এমন দুরুদুরু বুকে ভয়ে ভয়ে আর কতো দিন ই বা থাকা যায় দুনিয়ায়। রাইফের হুট হাট কাজে মীরার হৃদ স্পন্দন থেমে যায় তো কখনও বেগতিক ভাবে চলে। কথাতেই এমন, কাজে কর্মে না জানি কেমন হবে এটা ভেবেই দিশেহারা সে। কঠিন শঙ্কায় মীরা, কবে জানি হার্ট এট্যাক করে বসে রাইফের এমন আচরণে। এলোমেলো চিন্তা মনের মাঝেই চাপা দিয়ে দুরুদুরু বুকে নিজ রুমে উঁকি দিলো মীরা। ওই তো বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে রাইফ। মীরার কপালে খানিক চিন্তার ভাঁজ পরল। এই কয় দিনে রাইফকে সন্ধ্যার পর কখনও ঘুমাতে দেখেনি সে। শরীর খারাপ করে নি তো? ট্রে টা টি টেবিলের উপর শব্দহীন ভাবে রেখেই মৃদু আওয়াজে ডেকে উঠলো মীরা,
-‘শুনছেন?’
মীরার মিহি ডাকে ঘুমন্ত রাইফের ঘুম পাতলা হলো, কিন্তু জবাব দিলো না। ওভাবেই পরে রইলো বিছানায়। জড়তার সাথে কথা বলা মীরা আরেকটু এগিয়ে এলো। কন্ঠে উৎকন্ঠা মিশিয়ে ডেকে উঠল পুনরায়,
-‘এই যে শুনছেন? আপনার কি শরীর খারাপ?’
রাইফ যেনো এটার ই অপেক্ষায় ছিলো। ঘুম ভে/ঙ্গে গেলো পুরোপুরি, বালিশে গুঁজে দেওয়া মুখটায় ফুটে ওঠলো দুষ্ট বাঁকা হাসি। নড়াচড়া না করে ওভাবেই ঘুম জড়ানো কন্ঠে জবাব দিলো রাইফ,
-‘হুম। ব্যাথা, বুকের বা পাশে ব্যাথা, তোমায় কাছে না পাওয়ার প্রচন্ড ব্যাথা।’
রাইফের নিচু স্বরে বলা কথার শেষ অংশ টুকু শুনতে পেলো না মীরা। যতোটুকু শুনল তাতে ব্যাথা শব্দটা শুনে ধরে নিলো রাইফের সত্যি সত্যি শরীর খারাপ। মীরা উৎকন্ঠিত হলো, ব্যাতিব্যাস্ত কন্ঠে শুধালো,
-‘কোথায় ব্যাথা? মেডিসিন দিবো? দেই একটা?’
তড়িৎগতিতে মাথা উঁচু করে তাকাল রাইফ। মুখে তার বিস্তর হাসি। কপালে পরে থাকা এলোমেলো চুল গুলো এক হাতের সাহায্যে গুছিয়ে নিয়ে উঠে বসল ধীরে সুস্থে। মীরার মুখ বরাবর মুখ এনে চাপা আওয়াজে বলল,
-‘মেডিসিন লাগবে না মীরা। বুকে আসো, বিশ্বাস করো কোনো ব্যাথা থাকবে না। একটুও না। এন্টিবায়োটিক তুমি, ভিটামিন, ব্যাথানাশক সব তুমি।’
মীরার তনুমনে শিহরণ বয়ে গেলো। শীতল স্রোত বয়ে গেলো শিড়দাড়া দিয়ে। শেষের কথাতে মীরার অবশ্য হাসিও পেলো বেশ। এই লোক সভ্য হবে না কখনও। সিরিয়াস সময়েও কেমন অসিরিয়াস কথাবার্তা! হাতাশার শ্বাস ফেলে রাইফের সামনে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
-‘আপনার সাথে কথা বলাই বৃথা। সব সময় কথা উল্টান। সোজা কথা কবে বলবেন?’
রাইফের এবার পুরো মুখ জুড়ে হাসি ফুটালো। আরাম করে বসে মীরার গোলগাল মুখটায় নজর বুলিয়ে ভ্রু জোড়া কিছুটা উপরে তুলে বলল,
-‘সোজাসাপটা কথা হজম করতে পারবা তো মীরা? তাহলে বলি শোনো, তোমার ওই গোলাপি ঠোঁট টার জন্যও….
মীরা বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিয়ে, চোখ কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসার জোগার। কি বলছে এসব? সর্বনাশ! পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে উপস্থিত বুদ্ধি মাথায় যা আসলো তাই করলো। হাতে থাকা চায়ের গরম কাপ টা রাইফের বকবক করে বলতে থাকা ঠোঁটে ছোঁয়ালো। রাখঢাক না রেখে বেঁফাস কথা বলা রাইফের জবান বন্ধ হলো চায়ের কাপের গরম ছ্যাঁ/কে। মৃদু আর্তনাদ করে উঠল রাইফ, ঠোঁটে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
-‘কাপ না ছুঁইয়ে তোমার গোলাপি ঠোঁট দুটোই ছুঁইয়ে দিতা। তিল তিল করে না পু’ড়ে একেবারেই না হয় পু’ড়ে যেতাম। বুকের ব্যাথা তো কমে যেতো।’
🔹
ভাতিজি জামাই এর সাথে গল্প জুড়েছেন সানজিদা বেগম। আলাপ আলোচনায় বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন তিনি। রাইফ ও সুন্দর ভাবে একেকটার জবাব দিয়েই যাচ্ছে। উর্মি হুটহাট আসে, আবার হুটহাট চলে যায়। এই তো একটু আগে এসে যখন রাইফ আর সানজিদা বেগমের আলাপচারিতায় বাগরা দিয়ে তার বিয়ের কথা বলে আফসোস করতে থাকল, সানজিদা বেগম নিজের জেগে ওটা রাগ কোনো রকমে চেপে গেছেন সামনে বসে থাকা রাইফের জন্য। রাইফ না থাকলে এই মেয়েকে আজ উনি কিছু একটা করতেন ই করতেন। এতো ধিঙ্গিপণা মেয়েকে নিয়ে তিনি খুব বিপাকে পরেন আজকাল। এবার মনে হচ্ছে নিজের মেয়ের বিয়ের কথা ভাবতে হবে অচিরেই। তবু যদি একটু শুধরানো যায়।
_____________
সবাই নৈশভোজ সেরেছে কিছুক্ষণ হলো। রাইফ তখনি জানিয়ে দিয়েছে সে আজ থাকতে পারবে না। শওকত রহমান এবং খাদিজা বেগম অনেক জোরাজুরি করেছেন, কিন্তু রাইফ অনুরোধ করেছে না থাকার জন্য। অন্য দিন অবশ্যই থাকবে। মীরার মনটা পরিবার কে পেয়ে প্রফুল্ল হয়েছে। রাইফ থাকলে মেয়েটার একটু হলেও অস্বস্তি হবে। থাকুক সে, পরিবারের সাথে একান্ত সময় কাটাক। তার উপর মায়ের অসুস্থতার কারণেও বাসায় যেতে ইচ্ছুক সে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাইফ, চলে যাবে এখনি। উর্মিকে দিয়ে মীরাকে ডেকে পাঠিয়েছে কয়েক বার। আহম্মকি কাজ করায় মীরার খুব সংকোচ হচ্ছে রাইফের সামনে আসতে। কেনো যে তখন কাপ টা রাইফের ঠোঁটে লাগালো। ছিহ্, নিজের উপর ই তার বিরক্ত লাগছে তখন থেকে। ছোট ছোট কদমে জড়সড় হয়ে রাইফের সামনে এসে দাঁড়ালো মীরা। এই লোকটার সামনে আসতে তার অন্তর কাঁপে, ভীত নড়বড়ে হয়। আলোছায়ায় ঘেরা বারান্দায় রাইফ গম্ভীর মুখে তাকিয়ে দেখছে মীরাকে। মীরা পিটাপিট করে তাকাচ্ছে এদিক সেদিক। ঘন পাপড়ির ওঠানামা রাইফের হৃদয়ে ব্যাকুলতা সৃষ্টি করছে। ডাগর ডাগর চাওনি দেওয়া চোখটাতে আলতো করে অধর ছোঁয়ার তীব্র বাসনা চেপে বসেছে মনের মধ্যিখানে। মীরার একটা হাত টা টেনে নিলো রাইফ, দুহাতের মুঠোয় চেপে গাঢ় স্বরে বলল,
-‘ধীরে ধীরে সংকোচ দূর করো মীরা। তোমাকে মা ডাক শোনানোর তীব্র বাসনা জেগেছে আমার মনে।
ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। তোমার এই ছোট্ট দেহ টাকে বুকে আগলে নিতে দিনকে দিন সত্যি বেহায়া হচ্ছে আমার মন।’
চলবে………