#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২৫
🍁
বাসা ভর্তি মেহমান গিজ গিজ করছে। হৈ হুল্লোড় এ মেতে উঠেছে সবাই। খুশির ঝিলিক চোখে মুখে উপচে পরছে বর পক্ষ এবং কনে পক্ষের সকলের মুখেই। কেউ খোশ গল্পে মেতে ওঠেছে তো কেউ কেউ ব্যাস্ত তার নিজ কর্মে।
কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে নিজের রুমে খুবই সাধারণ ভাবে বধু সেজে বসে আছে মীরা। লাল রঙের জমিনের উপর সোনালী রংয়ের কারুকার্য করা বেনারসি টা মীরার অঙ্গ জুড়ে জড়িয়ে আছে, অপরূপ সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তুলেছে। চোখ ধাঁধানো, মন মাতানো রূপ ঠিকরে পরছে মাথায় দেওয়া ছোট্ট ঘোমটার মাঝে ফর্সা আদল টুকুতে। টানা টানা চোখ দুটোই হালকা করে দেওয়া কাজল লেপ্টে আছে। গোলাপি সরু অধরে হালকা কৃত্রিম গোলাপি আভা লাগিয়ে মীরার সৌন্দর্য আরো দ্বীগুণ করে তুলেছে।
টকটকে লাল মেহেদী দেওয়া হাত টা কোলের উপর রেখে কঁচলে যাচ্ছে অনেক ক্ষণ। সকাল থেকেই কয়েক চোট কান্না করে লাল করে ফেলেছে দু চোখ। ফোলা ফোলা চোখ দুটোই কাজল দেওয়াতে মীরার চেহারায় অন্য রকম মায়া সৃষ্টি হয়েছে আজ।
উর্মি আজ ভীষণ খুশি। সুন্দর একটা ড্রেস পরে মীরার আশে পাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। রাজিয়া বেগম মীরার এমন রূপ দেখে অনেক ক্ষন ধ্যান মে/রে তাকিয়ে ছিলেন। ছেলে যে তার এমনি এমনি পাগল হয় নি তার আজ খুব করেই টের পাচ্ছেন। মেয়েটা গুণেও যেমন গুণবতী, রূপেও তেমন রূপবতী। কোনো অংশই যেনো কমতী নেই মীরার মাঝে।
শওকত রহমান গলা খাঁকারি দিয়ে প্রবেশ করলেন মীরার রুমে। বিয়ে পড়ানোর আগে তিনি একান্ত সময় কাটাতে চান মীরার সাথে। প্রাণের আম্মাজান কে কাছে টেনে শেষ মুহুর্তে আরেকটু আপন করে নিতে চান তিনি। মীরা বাদে রুমের সবাই চলে গেলো বাহিরে।
মীরার বউ সাজার মুখটা দেখে শওকত রহমান যেমন খুশি হলেন তেমনি ভাবে বুকটাও হু হু করে উঠলো। একমাত্র কন্যাকে আজ অন্য ঠিকানায় পাঠাবেন তিনি। এতো দিনের আগলে রাখা মেয়েটাকে অন্য কোথাও পাঠাতে হবে ভেবে ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠল তার। মেয়েকে বুঝতে দিলেন না, প্রকাশ করলেন না কিঞ্চিৎ পরিমাণও। মীরা তার আব্বাজানের আগমনেও আজ নীচু করেই রেখেছে মুখটা। আব্বাজানের সাথে চোখে চোখ মেলাতে পারবে না কিছুতেই। কঠোর ভাবে অশ্রু গুলোকে ব/ন্দী করে রেখেছে আঁখি কোঠরে। আব্বাজানের পানে তাকালেই যেনো অশ্রু গুলো মুক্তি পাবে, চোখের কোণ দিয়ে ঝর ঝর করে বর্ষণ ধারা ঝরে যাবে কপোল ছুঁয়ে।
শওকত রহমান ভ’ঙ্গুর হৃদয়ে মীরার পাশে বসে ফাঁকা জায়গাটুকু দখল করে নিলেন। মীরার মাথায় হাত রাখতেই কান্না গুলো দলা পাকিয়ে গলায় আঁটকে গেলো শওকত রহমানের। নীজের ভেতরের ব্যাথাতুর অনুভূতি গুলোকে সন্তর্পণে লুকিয়ে ফেললেন ছোট এক শ্বাস ছেড়ে। মীরা পিতার কাঁধে মাথাটা হেলান দিলো। আব্বাজানের খসখসে হাতটা টেনে নিলো, নিজের দু হাতের মুঠোয় পুরে তাকিয়ে রইল সম্মুখে। নীরব দুজনেই। টিক টিক করে সময় কে/টে গেলো মিনিটের পর মিনিট। শওকত রহমান ছোট্ট করে চুমু খেলেন মীরার মাথায়। নিরবতা ভেঙ্গে মোলায়েম স্বরে বললেন,
-‘ইমাম সাহেব আসছেন আম্মাজান। ওদিকের কাজ শেষ। অপেক্ষা করছেন আপনার জন্য। ডাকবো উনাকে?’
মীরা বাবার প্রশ্নে উত্তর দিলো না। মৃদু ভাবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো শুধু।
শওকত রহমান গলা উঁচু করে ডেকে ইমাম সাহেব কে রুমে আসতে বললেন। ইমাম সাহেবই প্রথম প্রবেশ করলেন। তার পেছন পেছন এক এক করে মীরার মা, ফুপু-ফুপা, রাজিয়া বেগম, উর্মি এবং রাইফের বড় চাচা-চাচি সহ বয়োজ্যেষ্ঠ সম্মানিত ব্যাক্তিগণও প্রবেশ করলেন। পিতার কাঁধ থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসলো মীরা। বুকের বা পাশে ধুকপুকুনি বেড়ে গেছে হাজার গুন। কেঁপে কেঁপে উঠছে বার বার৷ শরীর টাও কেমন ঝিমিয়ে গেছে যেনো। এই বোধ হয়ে নেতিয়ে পরবে শরীর টা। বয়োবৃদ্ধ ইমাম ইসলামি ধর্ম মোতাবেক বিয়ে পড়ানো শুরু করেছেন। শেষ সময়ে এসে যখন মীরাকে বলতে বললেন কবুল, মীরা দুচোখ বন্ধ করে কেঁপে উঠল। শওকত রহমান ঠাহর করলেন পাশে বসে থাকা আদুরে কন্যার অবস্থা। বরাবরের ন্যায় শওকত রহমানের ভরসার হাত টা মীরাকে পেছন থেকে জাপটে নিলো তৎক্ষনাৎ। কোমল কন্ঠে নিচু আওয়াজে মীরাকে বললেন,
-‘আমার সাহসী আম্মাজান, ভয় নেই। আপনার আব্বাজান সব সময় আপনার পাশে ছিলো, আছে এবং থাকবে।’
মীরা ছলছল নয়নে মুখ তুলে শওকত রহমানের পানে তাকাল। যতই চেষ্টা করুক অশ্রু লুকানোর, কিন্তু ভেজা নয়ন স্পষ্ট বলছে মীরা কেঁদেছে যার ছোঁয়া এখনও আঁখি পল্লবে লেগে আছে। শওকত রহমান মেয়ের মুখের পানে তাকালো। মুখে মুচকি হাসি লেপ্টে ঘাড় নাড়িয়ে চোখের পাতা এক বার বন্ধ করে আবারও খুলল। পিতার নিকট থেকে সাহস পেলো মীরা। কিন্তু ধুকপুকানি কমছে না কিছুতেই। খাদিজা বেগম মেয়ের একটা হাত মুঠোয় নিলেন। মায়ের সংস্পর্শে মীরা এবার আর নিজের সংযত করতে পারল না। গুঙিয়ে কেঁদে উঠলো, হুরমুর করে ধেয়ে আসা অশ্রু গুলো চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পরল। কান্নারত মীরা কাঁপা কাঁপা স্বরে জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে মৃদ্যু আওয়াজে বলল ‘কবুল।’
আলহামদুলিল্লাহ জয়ধ্বনীতে শুকরিয়া আদায় করলো সবাই। হাসি ফুটলো সকলের মুখে। উর্মির হাতে রাখা মোবাইল টাতে ফোনকলে বর বেশে থাকা সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত সুপুরুষটির মুখেও বিস্তর হাসি ফুটল তৎক্ষনাৎ। স্বস্তি পেল, শুকরিয়াও আদায় করলো। বুকের ভেতর পাথরের মতো বোঝা সৃষ্টি করে জমে থাকা কয়েক দিনের দীর্ঘশ্বাস টাও দুঠোঁটে ফাঁক দিয়ে ছেড়ে দিলো চোখ বন্ধ করে।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে চলে এসেছে বিদায় মুহুর্ত। মীরা ছোট বাচ্চার ন্যায় অনবরত কান্না করেই চলেছে শওকত রহমানের বুকে মাথা গুঁজে। একবার তো বলেই ফেলেছে সে যাবে না এখান থেকে। শওকত রহমান সহ সবাই সবার মতো বুঝিয়েই যাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই মীরাকে সামলানো যাচ্ছে না। নীরবে অশ্রুপাত করে পিতার বুক ভিজিয়ে ফেলেছে। শওকত রহমান আর নিজেকে খোলসে আবৃত করে রাখতে পারেননি, পারেননি পরিবারের কেউ ই। বিদায় বেলায় হু হু করে কেঁদেছেন সকলে।
_________________
রাইফের খোলা বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে মীরা। আকাশে আজ মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। জ্ব/লজ্ব/ল করে আলো ছড়িয়ে রাতের নিকষ কালো অন্ধকার দূর করেছে ধরণী থেকে। মীরার মুখটাও উজ্জ্বল হয়েছে জ্যোৎস্নার রুপালি আলোয়। শিরশিরে হাওয়া এসে শরীর-মন দুটোই জুড়িয়ে দিচ্ছে মীরার।
হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পরিহিত মীরার রাইফের সাথে প্রথম দেখা হওয়া থেকে শুরু করে বর্তমান, সব কিছুই তার অকপটে ভেসে আসছে মনে।
নিয়তি আজ ঠিক সেখানেই দাঁড় করিয়েছে মীরাকে যেখানে সে রাইফকে স্নিগ্ধ ভোরে দেখেছিলো একদিন। ভাবুক মীরা ভাবছে আরো অনেক কিছুই। এই তো ঘন্টা খানেক আগেই যখন মীরা বধু বেশে সিঁড়ি দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে উপরে উঠছিলো রাজিয়া বেগমের সাথে, হুট করেই রাইফ এসে মীরার বাম দিকটা দখল করেছিলো সর্তপনে। মীরার সহিত পায়ে পা মিলিয়ে সামনে দৃষ্টি রেখে হাঁটছিলো রাইফ। কান্না করার ফলে মীরার ফর্সা মুখ এবং চোখ দুটো লাল বর্ণের তখন।
মীরার নিজ পরিবার ছেড়ে নতুন ঠিকানায় যেতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো, নরম হৃদয়টা ছে/দন হচ্ছিলো মারাত্নক ভাবে। অসাড় হয়ে আসা টালমাটাল পা দুটো যখন কোনো রকমে এগিয়ে যাচ্ছিলো তখনি রাইফের আগমন আরো বেশি ধরাক করে তুলেছিলো মীরার কোমল হৃদয়। র*ক্তিম হয়ে আসা চোখ দুটি তুলে আড় দৃষ্টিতে একটু রাইফ কে দেখে আবারও সামনে দৃষ্টি দিয়েছিলো সে। রাইফ দাম্ভিকতার সহিত হেঁটে যাচ্ছে পাশে, কোনো হেলদোল নেই তার। ধ্যান জ্ঞান পুরোটুকুই সামনের দিকে। খুব একটা মাথা ঘামায় নি মীরা। স্বাভাবিক ভাবে ছোট ছোট পা ফেলে চুপটি করে হেঁটে যাওয়া মীরা আচানাক তার কনিষ্ঠ আঙুলে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠেছিলো। পাশে ফিরে তাকাতেই রাইফের তী/ক্ষ্ণ নজর ভ্রু উঁচিয়ে সামনে তাকাতে হুকুম করেছিলো সাথে সাথেই। মীরা শুষ্ক অধরে দাঁত কা/মড়ে মাথাটা নুইয়ে নিয়েছিলো তখনি। প্রচন্ড ভাবে কাঁপছিলো মীরার হাত। টালমাটাল পা দুটো থেমে যাবে যেকোনো সময়। রাইফ বুঝেছিলো মীরার কাঁপুনি। রাইফ তার খসখসে কনিষ্ঠ আংগুল দিয়ে আঁকড়ে ধরা মীরার কোমল কনিষ্ঠ আংগুল টা ছেড়ে দিয়েছিলো তক্ষুনি। মীরা হাফ ছেড়ে বাঁচলো এবার। চোখ বন্ধ করে স্বস্তির শ্বাস ফেলবে তক্ষুনি মীরার কোমল হাতটা শ’ক্তপোক্ত হাতে ব/ন্দি হয়েছিলো। মীরার ছোট ছোট আংগুলে রাইফ আংগুল গুঁজে দিয়েছিলো মূহুর্তেই। মীরার বন্ধ আঁখিদুটি আরো খিঁচে কুঁচকে গিয়েছিলো ভেতরের দিকে, পা দুটো থেমে গিয়েছিলো সাথে সাথেই। মীরার এমন অবস্থা দেখে রাইফের বৃদ্ধাঙুল মীরার হাতের উল্টো পাশে এদিক ওদিক বুলিয়ে দিচ্ছিলো। সহজ করে তুলতে চেষ্টা করছিলো সে। মীরার নরম হাতে শ/ক্ত একটা চা/প প্রয়োগ করেছিলো মীরার ধমকে যাওয়া পা দুটোকে আবারও সচল করার উদ্দেশ্যে।
মৃদুমন্দ বাতাসে সামনের ছোট চুল গুলো মীরার মুখে এদিক ওদিক খেলা করছে। গোলাকৃতির চাঁদের দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হওয়া মীরা কপালের কাছে কারো স্পর্শ পেয়ে শিউরে উঠল। তড়িৎগতিতে পাশে তাকাতেই রাইফ কে দেখে বুকে জমা রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে দিলো। মীরার উড়ন্ত খোলা চুল গুলো কানের পিঠে গুঁজে দিলো রাইফ। শ্যমবর্ণের মুখটা মীরার কানের কাছে এনে ঠোঁটের কোণে অমায়িক হাসি ফুটিয়ে ভরাট গলায় বলল,
-‘জানো মীরা, তুমি আমাকে ওই চাঁদের আলোর মতোই আলোকিত করেছো। আমি আজ পূর্ন মীরা, আমার লাজুকলতা কে পেয়ে আজ আমি সম্পূর্ণ।’
চলবে…..
(কি লিখলাম জানি না। আজ এতো সময় লাগলো লিখতে কি বলবো। যাই হোক, মন্তব্য জানাতে ভুলবেন না। ভালোবাসা💛💛)