#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_২
🍁
রাত এগারো টা বেজে ত্রিশ মিনিট। নূরজাহান ভিলায় সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন। চারিদিকে পিনপিতন নিরবতা। জেগে আছে শুধু অস্বচ্ছ মায়াবী দুটি চোখ। রাতের আঁধারে শব্দবিহিন পায়ে একটা রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো কেউ। মুষ্ঠিবদ্ধ চাবিটা জায়গা মতো ঘুরিয়ে ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ তুলে দরজাটা সর্তকার সহিত ধাক্কা দিলো। উন্মুক্ত হলো রুমের দরজা। ভেতরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই ভ্যাপসা গন্ধ নাকে হুরমুর করে ঢুকে পরলো তার। অন্ধকার হাতরে লাইট ফ্যানের সুইচ অন করে দিলো মীরা। আলোকিত হলো রুম। দৃশ্যমান হলো সামনের সব কিছু। মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো রুমের জিনিসপত্র অবলোকন করতে থাকলো। সব আছে, সব। কিন্তু তার প্রিয় ব্যাক্তিটিই শুধু নেই৷ যার বুকে মাথা পেতে রাতের পর রাত যাপন করেছে সে। মুখ দু হাত দিয়ে ঢেকে হু হু করে কেঁদে ফেললো। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে তার বুকের বা পাশে। অশ্রুভেজা নয়নে দাঁড়ালো কাঠের তৈরি আলমিরার সামনে। ডান হাতের সাহায্যে খট করে খুলেও ফেললো। তাকে তাকে শাড়ি ভাঁজ করা। হাত দিয়ে ছুঁয়ে অনুভব করছে তার প্রিয় মানুষটিকে। চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে নিলো। এই সেই গন্ধ, যে গন্ধের পরশে প্রতিটি রাত ঘুমাতো সে। উপরের তাকে শাড়ির উপর আংগুল রাখলো। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই আংগুল নিচে নামাতে নামাতে একটা শাড়িতে এসে থেমে গেলো। চোখ খুলে দেখলো সাদা রংয়ের একটা সুতি শাড়ি। টেনে বের করে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। গায়ের উপর জড়িয়ে ধরে অপর দিকে অনুভব করছে তার দাদী নূরজাহান বেগম কে। কান্না গুলো বার বার দলা পাকিয়ে আসছে মীরার। কিন্তু সে এখন আর ভেঙ্গে পরবে না। মাসের পর মাস নিজেকে শক্ত করেছে। এখন নিজেকে সামলাতে জানে মীরা। সুইচ অফ করে বেরিয়ে এলো রুম থেকে।
_______________
রুটির মতো গোল রুপালি চাঁদ তার আলো ছড়াতে ব্যাস্ত। মীরা ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। দাদীজানের মৃত্যুর পর কতো রজনী এখানে কাটিয়েছে তার হিসাব নেই। মাঝে মাঝে তো এখানেই ঘুমিয়ে যেতো। বাবা এসে ভোরে নিয়ে যেতেন। মেয়ের এহেন অবস্থা দেখে উপায়ন্তর না পেয়ে রেখে আসেন কলেজ এর হোস্টেল এ। কিন্তু যখনি বাড়িতে আসে তখনি আবার শুরু হয় মীরার পাগলামি। ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত নূরজাহান বেগমের স্নেহ আদরেই তো এতো বড় হয়েছে সে। তার অনুপস্থিতি মীরার জন্য যেনো কঠিন বাস্তবতা।
পাশ্ববর্তী লাইটের অল্প আলোতে মীরার আবয়ব আবছায়া লাগছে। শুভ্র শাড়ির আঁচল ছুয়েছে ছাদের ফ্লোর। লাল রঙের ব্লাউজ মীরার সৌন্দর্য কে আরো কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। দু হাত প্রসারিত করে ঘন পল্লবের নয়ন জোড়া বন্ধ করলো সে। মৃদু বাতাসে উড়ছে আঁচল। সময়ের পর সময় অতিবাহিত হচ্ছে, কিন্তু মীরা ঠাঁই দাঁড়িয়ে। উর্ধ্ব গগনে দৃষ্টি তার। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দে ধ্যান ভাংলো। এদিক সেদিক তাকিয়ে শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টা করছে সে। দ্রুত নিচে নামার জন্য সিড়ির দিকে অগ্রসর হলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। শাড়ির কুচি এক হাতে ধরে উপরে একটু উপরে তুলে নিলো। নিচে নামার জন্য দ্রুত পা ফেলে দুই-তিন ধাপ করে অতিক্রম করতে থাকলো। শওকত রহমান জানলে আজ আর রক্ষা নায়। মেয়ে যে এখনও ট্রমা থেকে বের হতে পারেনি তা জানলে তিনি এবার একেবারেই মুষড়ে পরবেন। শওকত রহমানের মুখোমুখি হলে মীরা কি জবাব দিবে তার আব্বাজান কে।
দিশেহারা অবস্থা তার। সামনের কোনো কিছুর ধ্যান জ্ঞান নেই একটুও। আকস্মিক শক্তপোক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খেলো, নিচে পরে যাবে ভেবে চোখ বন্ধ করে আশে পাশে যা পেলো ধরে ফেললো। কিন্তু ভাগ্য আর সহায় হলো না। ধপাস করে নীচে পরে গেলো। চোখ মুখ কুঁচকে ‘আহ’ শব্দ করে ব্যাথা টুকু হজম করে নিলো। কোমড়ে হাত রেখে ধীরে ধীরে চোখ খুললো, সামনে যা দেখতে পেলো এতে মীরার মুখে হতভম্ব আর ভয়ের সংমিশ্রণ ঘটেছে। একজন উজ্জ্বল শ্যামবর্নের সুঠাম দেহি পুরুষ বিস্ফোরণ চাহনি তে দাঁড়িয়ে আছে। চৌকস তার চেহারা। কপালে বিরক্তির সুক্ষ্ণ ভাঁজ। শক্ত পেশির হাত ফুলে ফেঁপে আছে। কালো টাউজার পরনে। নগ্ন তার বুক। চোখে মুখে গাম্ভীর্যতা। হাতে ভাংগা বালতির হ্যান্ডেল ঝুলছে শুধু। চারিদিকে ভেজা কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মীরা নির্বাক হয়ে পরখ করছে সব। শ্যাম সুন্দর পুরুষটি এগিয়ে এলো মীরার দিকে। মীরা দুরুদুরু বুকে তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি ঝুঁকে ফেলল। খাঁমচে ধরলো শাড়ির আঁচল। এই বুঝি গালে সাপটে এক চড় পরে কিংবা বজ্রপাতের মতো রাম ধমক। লোকটি হালকা ঝুঁকে মীরার চোখে চোখ রাখলো। চোয়াল শক্ত করে ক্ষিপ্রগতিতে মিরার হাত থেকে টেনে নিলো তার ছেঁড়া টি-শার্ট টি। বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে আছে মীরা লোকটির হাতের দিকে। কপালে আংগুল ঘষে বোঝার চেষ্টা করছে একটু আগে কি ঘটেছে। ত্রিশ সেকেন্ড সময় এর ব্যাবধানে যখন বুঝে গেলো তখন ঝটপট উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত মাথায় একপ্যাচ দেওয়া সাদা হিজাব টা ঠিক আছে কিনা তা ডানহাতে পরখ করে নিলো। মাথা নিচু করে মিনতি সুরে জড়ানো কন্ঠে বলল,
-‘মাফ করবেন মহাশয়, আমি খেয়াল করি নি। পরে যাচ্ছি ভেবে হাতের কাছে যা ছিলো তাই টেনে ধরেছিলাম। ওটা যে আপনার টি-শার্ট ছিলো বুঝতে পারি নি।’
উশখুস করছে মীরার মন। লোকটা কি চিৎকার চেঁচামেচি করবে নাকি আব্বাজান কে বিচার দিবে?
” ইয়া আল্লাহ, আমাকে রক্ষা করুন, আপনার বান্দা মসিবতে আপনি সহায় হন”
মনে মনে আল্লাহ কে স্মরণ করলো। নিজের উপর ও তার ভীষণ রাগ হচ্ছে। কি করে এতো বড় ভুল টা করলো সে। এমন পরিস্থিতিতে যে কখোনও পরতে হয় নি তার। মীরার মনে হচ্ছে মাটির নীচে লুকাতে পারলে ভালো হতো। আগাগোড়া পরখ করে নিরবতা ছেদন করলো পুরুষটি। গলা খাঁকারি দিয়ে তার পুরুষালী গলার গমগমে কন্ঠে শুধালো,
-‘মেহেরবানী করে যদি মাথাটা একটু উপরে তুলতেন তাহলে আমার বড়ই উপকার হতো। অলরেডি তো উপকার করেই ফেলছেন, এইটুকু উপকার করে আমাকে ধন্য করেন”
মীরা নিজেকে আরো আড়ষ্ট করল। ধুকপুক করছে অন্তরাত্মা। তাকাবেনা ভেবেও ধীরে ধীরে মাথা তুললো। পিটপিট চোখে চোখ রাখলো দীর্ঘকায় পুরুষটির চোখে। কি ধারালো তার দৃষ্টি! লোকটি তার ডান হাত তুলে সামনে ধরলো। ভাঙ্গা বালতির হ্যান্ডেল দুলছে দুজনের মাঝে। বালতির ভাংগা অংশ আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড় গুলোর দিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইশারা করলো লোকটি। তার চোখের ইশারা এতোই তীক্ষ্ণ ছিলো যে মীরা সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে মাথা ঝুঁকে ফেললো। চোরা দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো। অপরাধী লাগছে নিজেকে। কাচুমাচু করে আমতা আমতা স্বরে জবাব দিলো মীরা,
-‘আমি সত্যি বুঝতে পারিনি। আমার বেখায়ালী কাজের জন্য আমি লজ্জিত। ক্ষমা করেবেন প্লিজ। আসছি।’
কথাটুকু বলেই হন্তদন্ত পায়ে নিচে নামতে শুরু করলো। এখান থেকে পালাতে পারলেই যেনো বাঁচে।কিন্তু বিপত্তি ঘটলো আবারো, হোঁচট খেলো শাড়িতে পা বেজে৷ দেয়াল ধরে সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিলো। নিজের আহাম্মকি তে এবার তার সত্যি সত্যি জ্বীন পরী দের মতো হাওয়ার সাথে মিশে যেতে ইচ্ছা করছে। পেছন ফিরে তাকানোর মতো সাহস হলো না তার। দ্রুত জায়গা ত্যাগ করল। লোকটি ঘুরে দাঁড়ালো, রেলিং এ হেলান দিয়ে ঘাড় কাত করে নিচে তাকালো। ধপা-ধপ পা ফেলার শব্দ আসছে। খট করে দরজা খোলার আওয়াজ করে পায়ের শব্দ হারিয়ে গেলো। আঁখিযুগল বন্ধ করলো সুঠাম দেহের শ্যাম সুন্দর পুরুষটি। ভেতরের দিকে শ্বাস টেনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুধাবন করছে মিষ্টি মেয়েলি মিঠে ঘ্রান। ধ্যান ফিরলো লোকটির। ভেজা কাপড় গুলো কাঁধে নিয়ে ছাদের দিকে অগ্রসর হলো।
গুন গুন করে গান ধরলো শ্যাম সুন্দর পুরুষ টি
“দুধে আলতা গায়ের বরন, রূপ যে কাঁচা সোনা
আঁচল দিয়া ঢাইকা রাইখো, চোখ যেন পড়ে না”
মীরা ফিরে তাকালে দেখতে পেতো শক্ত গম্ভীর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি যা তার অগোচরেই রয়ে গেলো।
চলবে….