#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_১৫
🍁
দিনের শেষভাগ। গোধুলি লগ্নে পশ্চিমাকাশে সূর্য ঢলে পরেছে। ধারণ করেছে র’ক্তিম আভা। পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ। মেঘপুঞ্জ বিভিন্ন রঙে রঙ্গিন হয়েছে, সেজেছে আজ নতুন রূপে। শিরশির করে মৃদু হাওয়া বইছে। শীতল করছে মন-প্রাণ।
মীরা ছোট্ট বারান্দায় খুব ব্যাস্ত সময় পার করছে। বেতের মোড়ায় বসে সামনের টেবিলে ঝুঁকে রয়েছে সে। কানে ফোন এঁটে ডান হাতে কলম গুঁজে সাদা পাতায় হরহর করে লিখে যাচ্ছে মিডটার্ম পরীক্ষার সাজেশন। শর্টকাট সাজেশন হওয়াতে আর ছবি সংগ্রহ করে নি। কলের মাধ্যমেই ফটাফট লিখে নিচ্ছে সাদা কাগজে। দ্রুত লেখার ফলে খসখসে আওয়াজ হচ্ছে।
এমনিতে তার মন মেজাজ খুব একটা ভালো না তার উপর আবার পরীক্ষার তারিখ পরাতে আরো বিষণ্ণ হয়ে আছে মীরার কোমল হৃদয়খানা। গতরাতে বেশ ঝড় ঝাপ্টা গিয়েছে মীরার উপর দিয়ে। কিন্তু এখনও মাকে মানাতে পারেনি। কি করে সমন্ধটা আটকাবে সেটাই মস্তিষ্কের নিউরনে বাজছে। অতিরিক্ত চিন্তার দরুন খাওয়া দাওয়ার রুচিও নেয় তার। কিভাবে নাকচ করবে সে এই সমন্ধ? কোন পন্থা অবলম্বন করলে রেহায় পাবে? ঝামেলা আর ভালো লাগে না তার। বিয়েই কেনো দিতে হবে! বাবা মা এর সাথে থাকলে কি খুব অসুবিধা হবে? কতো টুকুই আর খায় মীরা? ওইতো দুই লুকমা দিয়েও দিন চলে যায়। তবে কেনো এতো তাড়া তাদের! সাজেশন নেওয়া শেষ হলে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রুমে এসে বিছানার উপর দু পা ভাঁজ করে বসল। ঢিলে হয়ে আসা খোঁপাটা খুলে পুনরায় বেঁধে নিলো শক্ত করে। একটা সোনালী রঙের কাঠিও গুঁজে দিলো খোঁপার মাঝে যাতে নিপুণ কৌশলে করা চমৎকার কারুকার্য শোভা পাচ্ছে।
পাশে রাখা ফোনটা মিনিট খানেক সময় পেরুতেই বেজে উঠলো। সেভ করা নাম্বার এবং প্রিয় জনের ই নাম্বার। কিন্তু আজ কেনো যেনো কিছুতেই ফোন তুলতে ইচ্ছে করছে না মীরার। মীরা জানে অপর প্রান্তের ব্যাক্তিটাও তার মঙ্গল কামণা করে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার বন্দোবস্ত করছে জোর তাগিদে। ইন্ধন দিচ্ছে আম্মা এবং আব্বাজান কেও। এমন মঙ্গল পছন্দ হচ্ছে না কিছুতেই। ঠিক করছে না এটা ফুপু। কেনো শুধু শুধু জোর করছে? অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি ব্যাতিত আর কিছুই মনে হচ্ছে না তার। এর মাঝে শান্তু হয়ে যাওয়া ফোনটায় পুনরায় রিংটোন বেজে উঠলো। এবার আর নিরব থাকতে পারলো না সে। এতো চিন্তা আর নিতে পারছে না কিছুতেই। যা হবার হবে, হু হা বলে কথা শেষ করবে ভেবে ফোন রিসিভ করলো। ধীর স্থির ভাবে কথা বলা শুরু করল সে,
-‘আস সালামু আলাইকুম ফুপুজান।’
-‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। সারাদিন কই থাকিস তুই? ফোন দিলে পাওয়া যায় না কেনো।’
-‘ব্যাস্ত ছিলাম ফুপু। কেমন আছো?’
ছোট্ট একটা ঢোক গিলে না চায়তেও আমতা আমতা করে মিথ্যা কথা টুকু বলেই ফেলল সে। কিসের ব্যাস্ত, আজ তো সে সারা দিন শুয়ে বসেই ছিলো মীরা। সানজিদা বেগমের কলও সে দেখেছে। সকালে দু বার, দুপুরে তিন বার আর বিকেলে দুই বার কল দিয়েছেন সে। মীরা একবার কল দিলেই রিসিভ করার মেয়ে কিন্তু সে।রেসপন্স করলো মাত্র। তাই সানজিদা বেগম খানিক বিশ্বাস করেও করতে পারলেন না ভাতিজির কথা। খুব ভালো করেই চিনেন মীরাকে এবং তার অভ্যাসকে। তাইতো শক্ত কন্ঠে বললেন,
-‘যা খুশি তাই বুঝাস না আমাকে। তোর আম্মা কি বলছে কিছু?’
-‘হু’
মীরার অন্তর ছে’দ হচ্ছে এ পর্যায়ে এসে। সে জানে ফুপুর পরের কথাটুকু কি হবে। সানজিদা বেগম আদেশের স্বরে বলে উঠলেন,
-‘শোন, কাল ওরা আসবে। ঠিকঠাক তৈরি থাকবি। আমার মীরা কোটিতে একটা।’
অপর প্রান্তে পিনপতন নীরবতা। নিশ্বাসের শব্দটুকুও শুনতে পাচ্ছেন না তিনি। ধমকে উঠলেন সানজিদা বেগম,
-‘কি হলো? শুনেছিস আমার কথা?’
-‘হু।’
-‘ওরা তোকে পছন্দ করেছে। শুধু ফরমালিটি করতে আসবে। তুই ও দেখ। ভালো লাগবে।’
-‘ভালো লাগা কোথা থেকে আসছে ফুপু! আমি তো বিয়েই…’
মীরার কথার মাঝের ফোঁড়ন কা’টলেন সানজিদা বেগম,
-‘মীরা, নিজের ভালো বুঝতে শেখ এখন। এভাবে আর কতো দিন? তোর মা, আমি যেমন বিয়ে করে সংসার করছি, তোকেও করতে হবে। তোর দাদীও কিন্তু বিয়ে করছিলো মনে রাখিস। আসছে, সন্ন্যাসী হবে।’
বকবক করতে করতেই ঝাড়ি দিয়ে কলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেন সানজিদা বেগম। মীরা কানে ফোন রাখা অবস্থাতেই ঠাঁই বসে। মাথা এতো টাই নিচু যে ফর্সা আদল টুকুও দেখা যাচ্ছে না। একটা হাত কোলের উপর রাখা। ক্ষাণিক সময় পেরুতেই টুপ করে এক ফোঁটা স্বচ্ছ জল পরলো সেখানে। বুকের ভেতর জমে থাকা রাগ, ক্ষো’ভ কিংবা অসহায়ত্ব গুলো জল হয়েই কি গড়িয়ে পরছে তবে?
বিকেল হতে সন্ধ্যা নেমেছে পৃথিবীতে, সাথে আঁধারও। অন্ধকার কে ঠেলে দিয়ে আলো ছড়াতে চারিদিকে কৃত্রিম আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে সবাই। কিন্তু মীরার রুম এখনও অন্ধকার। বাহির হতে কিছু আলো তীর্যক ভাবে রুমে ঢুকে মীরার চোখে মুখে রাজত্ব বসিয়েছে।
খাদিজা বেগম নামাজ শেষে মেয়ের রুমের দিকে উঁকি দিলেন। কি ব্যাপার? অন্ধকার কেনো? ঘুমিয়ে পরেছে নাকি? অসময়ে তো শোয়ার কথা না। নামাজ পড়বে না? এরকম অনেক গুলো প্রশ্ন মনে জাগলো তার। ত্রস্ত পায়ে রুমে দরজায় আসলেন তিনি।
আচমকা রুম উজ্জ্বল হওয়াতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল মীরা। টিপটিপ করে ফোলা ফোলা লাল বর্ণের চোখ দুটো ধীরে ধীরে সয়ে নিলো আলো টুকু। খাদিজা বেগম ডেকে উঠলেন মেয়ের নাম ধরে। একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে সে। এই যেমন, অন্ধকার করে রেখেছে কেনো? কি হয়েছে? শরীর খারাপ? ইত্যাদি।
মীরা তাকালোনা মায়ের দিকে। চুপিসারে চোখের শুকনো জলগুলোই মুছে নিলো। ভেতরের চিনচিনে ব্যাথাটা সে আর কাওকে দেখাতে চায় না। মন খারাপের কথা টুকু কেউ না জানুক। ঝটপট উঠে দাঁড়াল সে। খাদিজা বেগমের মুখোমুখি যেনো না হতে হয় তাই কোনো রকমে কাঁপা গলায় নিচু স্বরে বলল,
-‘আম্মা, নামাজ টা পড়ি। অজু করে আসি।’
-‘এদিকে তাকা।’
মীরা তাকালো না। দ্রুতপদে ওয়াশরুমের দিকে হাঁটা ধরল। খাদিজা বেগম চুপটি করে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন। অপেক্ষা করতে থাকলেন মীরার জন্য। মেয়ের মনের অবস্থা যে ভালো না তা তিনি ঠাহর করতে পেরেছেন বোধহয়।
_______________
অনেক দিন পর আজ আবারও আড্ডার পসরা বসেছে রাইফের বন্ধুমহলের৷ টান টান উত্তেজনা নিয়ে একেক জন বাক বিতন্ডায় ব্যাস্ত। রাইফের ধ্যান সকালের ঘটনায়। খাবার টেবিলে রাজিয়া বেগম যখন মীরার ব্যাপারে জানতে চাইলো রাইফের কাছে তখন ছোট খাটো একটা বিষম খেয়েছিলো সে। মাকে চিনে সে, যে কোনো মূহুর্তে তোরজোড় লাগিয়ে দিবে ছেলের পছন্দ করা মেয়েকে পুত্রবধু করার জন্য। এবং হলোও সেটা। হুট করে প্রশ্ন করে বসলেন,
-‘হ্যাঁ রে রাইফ, মীরাকে বাসায় আনছিস না কেনো?’
রাজিয়া বেগমের এমন কথাতে খাওয়া বন্ধ করে রাইফ মায়ের দিকে শান্ত চোখে ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে ছিলো অনেকক্ষণ। সবাই কিভাবে তাকে? আজব কাজকারবার! শুধু বলেছে পছন্দ করে তার মানে তো এই না যে তাকে কোলে নিয়ে ঘুরতেছে। যখন তখন এখানে সেখানে হাজির করবে৷ নিজেই দেখার জন্য মাথার ঘাম মাটিতে ফেলছে তবু দেখা পাচ্ছে না। আর এরা উল্টো আবদার করে বসে আছে। রাইফ বিরক্ত হয়ে উদাস কন্ঠে বলল,
-‘তুমি গিয়ে দেখে আসো।’
-‘আমি তো দেখেছি রে ওকে। কি সুন্দর মায়া মায়া চেহারা, ভীষণ চুপচাপ।’
রাইফ আগ্রহের সহিত জিজ্ঞাসা করল,
-‘তুমি কিভাবে দেখলা?’
-‘একই বিল্ডিংয়ে থাকি, দেখবো না?’
‘সবাই দেখে, ভালো তো খুব ভালো। আমি দেখি নি কেনো তবে? আমার থেকে লুকিয়ে ছিলো নাকি এতো দিন? ঠিক করে নি লুকিয়ে থেকে৷ আগে দেখা হলে নিশ্চয় এতো দিন বিয়ে হয়ে যেতো আমাদের। জীবনের কতোগুলো দিন পিছিয়ে গেলাম। ধ্যাত!’
মাথা নেড়ে আফসোস করতে করতে রাইফ নিরবে আওড়ালো কথা গুলো। কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ মনে পরলো একটু আগের কথা। বেখেয়ালি ভাবে মাকে বলেছে মীরাদের বাসায় গিয়ে দেখে আসতে। স’র্ব’নাশ করেছে সে। শ্রদ্ধেয় জননী যে অতি উত্তেজনায় এই কাজ ও করতে পারে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা আছে তার। তড়িঘড়ি করে রাজিয়া বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘শোনো আম্মা, বেশি এক্সাইটেড হয়ে ওদের বাসায় যেয়ো না আবার। তোমার চুপচাপ মীরা এখনও কোনো ইঙ্গিত দেয় নি।’
রাজিয়া বেগম কিছুটা অবাক হলেন ছেলের শেষ কথায়। হাতে তোলা খাবারের লুকমা টা আর মুখে পুরলেন না। ভ্রুকুটি করে বললেন,
-‘এখনও পাস নি? তুই কি রে রাইফ! তোর বাবা আমাকে দেখার এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে করছিলো। আর তুই কিনা..!’
-‘আম্মা, তুমি কলেজে যাইতে আসতে বাবা তোমারে লেইন মা*রত। কিন্তু তোমার হবু পুত্রবধু ঘর থেকে বের হয় না। বের হলে রাইফ নামক ভূত ধরবে ওকে। ভয়ে লেজ গুটিয়ে আছে। ‘
রাইফের কথা শুনে রাজিয়া বেগম ছেলের অবস্থা বুঝতে পারলেন। ছেলে যে মীরার উপর চরম ভাবে ফেঁ’সে গেছে এটা ভেবেও মুচকি হাসলেন। রাইফ তাকিয়ে দেখে উনি হাসছেন। কপট রাগ দেখিয়ে বলল ‘আম্মা’। রাইফের আসহায় মুখটা দেখে এবার আর হাসি আটকাতে পারলেন না। উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন মা, খানিকক্ষণ পর তার সাথে যোগ দিলো ছেলেও।
চলবে….
কেমন লাগলো বলে যাবেন। ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিবেন।
ভালোবাসা নিবেন।