#মুঠোবন্দী_লাজুকলতা
#অপরাজিতা_মুন
#পর্ব_১২
🍁
‘আমার থেকে পালিয়ে আর কতো দিন থাকবা মীরা? তোমার নীরবতা পীড়া দিচ্ছে আমাকে। আমার হয়ে যাও প্লিজ।’
ফিসফিস করে বলা কথাটা কর্ণকুহরে পোঁছা মাত্রই মীরা তেলে বেগুনে জ্ব*লে উঠলো। বিরক্তির রেখা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে মুখাবয়বে। দু ভ্রু কুঁচকানোর ফলে কপালে সুক্ষ্ণ ভাঁজেরও সৃষ্টি হয়েছে। আচ্ছা বেহায়া তো লোকটি। পেয়েছে কি উনি, যখন তখন যা খুশি তাই বলে দিবে? আজ উনার ফুরফুরানি বের করে ছাড়বে মীরা। যা ভাবনা সেই কাজ। ফট করে দাঁড়িয়ে পরল সে। দাঁতে দাঁত চেপে গোলাপী আভা ফুটে ওঠা মুখটা ঘুরিয়ে আ*গ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করল। চাপা স্বরে দাঁতে দাঁত চেপে শুধালো,
-‘সমস্যা কি আপনার?’
এবং তৎক্ষনাৎ মীরার নজরে এলো শুভ্র পাঞ্জাবী পরা সুঠাম দেহি শ্যামবর্ণের পুরুষটিকে আজ কেমন স্নিগ্ধ সুন্দর এবং পবিত্র লাগছে। চুল গুলো বেশ পরিপাটি। গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গুলোও আজ খুবই ছোট। দেখতে কেমন বাচ্চা বাচ্চা লাগছে যেনো। মনে হচ্ছে কয়েক দিনের ব্যাবধানেই তার বয়স চার-পাঁচ বছর কমে গিয়েছে। দৃষ্টি এদিক সেদিক ঘুরিয়ে আবারও বেহায়া নজর গেলো রাইফের কপাল, নাক, মুখ, গলা এবং সবর্ত্র। মীরার এমন চাহনি দেখে ঠোঁট বাঁকিয়ে মৃদু হাসলো রাইফ। গলার স্বর অনেকটাই খাদে নামিয়ে মুখ টা এগিয়ে আনলো মীরার দিকে। সাথে সাথে মীরা পেছন দিকে নিজেকে ঠেলে দূরত্ব বজায় রাখল। যদিও দুজনের মাঝে এক হাত পরিমাণ ফাঁকা, তবুও পুরুষালী ঘ্রাণ মীরার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে। রাইফ দু ভ্রু উঁচু করে ভরাট কন্ঠে শুধালো,
-‘ওভাবে চোরা চোখে তাকিয়ে কি দেখছ? তুমি বললে আজকেই ব্যাবস্থা করি। মন ভরে দেখতে পারবা। ভয় নেই, একটুও গুনাহ হবে না। একটা বার অনুমতি দাও, শুধু একটা বার।’
মীরা চোখ গোল গোল করে বিস্ফোরণ নেত্রে তাকাতেই রাইফ পিঠ টান টান করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মীরা যতোই বুঝদার এবং আত্মবোধ সম্পন্ন মেয়ে হোক না কেনো, এমন পরিস্থিতি তার জন্য নতুন এবং এটাই প্রথম। কেউ যে তাকে পছন্দ করে নি তা নয়, কিন্তু এতোটা কাছে আসার দুঃসাহস পূর্বে কেউ করে নি। মাথাটা গোলমাল লাগছে তার কাছে। মনের ভেতর শব্দ গুলো জমাট বেঁধে আছে। শুষ্ক গলাটা ঢোক গিলে ভেজানোর বৃথা চেষ্টা করল। দুরুদুরু বুকে সাত পাঁচ ভেবে অগোছালো কথাগুলো গুছিয়ে আনল। শুষ্ক অধর যুগল জিহ্বার ডগার সাহায্যে ভিজিয়ে নিয়ে জবাব দেওয়ার উদ্দেশ্যে কিঞ্চিৎ ফাঁক করতেই রাইফ বলে উঠলো,
-‘আর কতো নীরব থাকবে? আমি আর পারছি না মীরা। সত্যি পারছিনা। তোমার কি সম্মতি আছে আমার প্রস্তাবে? আম্মাকে পাঠাবো? পাঠাই?
রাইফের চোখ মুখ ভর্তি কি আকুল আবেদন! কাছে পাওয়ার কিংবা দুচোখ ভরে প্রেয়সীকে দেখে তৃষ্ণা মেটানোর। মীরা এমন কথার অর্থ সাথে সাথেই অনুধাবন করতে সক্ষম হলো না। অন্য সময় হলে ঠিকই বুঝতে পারত। কিন্তু রাইফের একের পর এক কথার বাণে সত্যি আজ অসহায় লাগছে তাকে। নিজেকে শান্ত করতে কিছুক্ষণের জন্য নেত্র পল্লব বন্ধ করল। অধরের মাঝে হালকা ফাঁক করে ভেতরে জমা রুদ্ধশ্বাস বের করে দিয়ে পিটপিট চোখে আরেকবার রাইফের পানে তাকানোর উদ্দেশ্যে চোখ খুলল। দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখতে পেলো সম্মুখে সে নেয়। এক মূহুর্তের মাঝেই কোথায় হাওয়া হলো ভেবে মীরা এবার আরো বেশি হতভম্ব হলো। ইনি কি পাগল নাকি ছাগল! জ্বীন নাকি ভূত! কখন কি করে বোঝা মুশকিল। আকস্মিক পেছন থেকে ভেসে আসা কন্ঠস্বরে চমকে উঠলো মীরা। আব্বাজান এখানে? কখন আসলেন? সব শুনে ফেলেন নি তো? কথা বলতে দেখে কি মনে করবেন তিনি? ভুল বুঝবেন না তো? এরকম অনেক প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে মীরার মনে।
মনের প্রশ্ন মনের মাঝেই চা’পা দিয়ে চট করে পিছু তাকিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। শওকত রহমানের হাসি হাসি মুখে রাইফের সাথে হ্যান্ড শ্যাক অবস্থায় সালাম এবং কুশল বিনিময় করতে দেখে মীরার অশান্ত মন খানিক শান্ত হলো। পরিস্থিতি যে নিয়ন্ত্রণে আছে সেটাও জানান দিলো তার মস্তিষ্ক। শওকত রহমান হাস্যজ্বল মুখে রাইফের উদ্দেশ্যে বলছেন,
-‘নামাজে যাচ্ছো রাইফ?’
রাইফের বেশভূষা দেখেই বোঝা যায় নামাজের পূর্ব প্রস্তুতি তার মাঝে। তাই প্রশ্ন করে আর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলেন না। পর মূহুর্তেই বললেন,
-‘আচ্ছা চলো এক সাথেই যাই।’
রাইফ গালভর্তি হাসি দিলো। শ্রদ্ধার সহিত বলল,
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ চাচা। চলেন।’
নীচে নামার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে বাড়াতে শওকত রহমান মীরাকে বললেন,
-‘আম্মাজান, এখন এগুলা রাখেন। গোসল করে সালাত আদায় করেন। যান, ভেতরে যান’
মীরা এক পলক শওকত রহমানের দিকে তাকিয়ে নীচু আওয়াজে বলল,
-‘জ্বী আব্বাজান। সাবধানে যাবেন।’
শওকত রহমান এবং রাইফ নিচে নেমে গেলেন খোশমেজাজে গল্প করতে করতে। মীরার ও এতো কিছুর পর এখন আর ইচ্ছা করছে না এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। এমনিতেই আজ তীব্র গরম তার উপর রাইফের আজগুবি কথাবার্তা শুনে মাথা এবং কান থেকে ধোঁয়া বের হবে বলে মনে হচ্ছে। শরীর ঘেমে একাকার। ফিনফিনে শরীর টার সাথে লেপ্টে আছে পিত রঙের উপর হালকা প্রিন্টের জামাটা। কোনো রকমে জুতা গুলো উপরে তুলে ময়লা গুলো ঝাড়ুর সাহায্যে বেলচা তে তুলেই বড়বড় পা ফেলে ভেতরে প্রবেশ করল। দরজা আটকে দিলো শব্দ করে। রাইফের উপর জমানো ক্ষো’ভ দরজায় প্রয়োগ করলো কি না কে জানে!
__________________
শওকত রহমান এবং রাইফ বিভিন্ন বিষয়াদী নিয়ে আলোচনা করছেন আর পায়ে পা মিলিয়ে এগুচ্ছেন। বাসা হতে মসজিদ বেশি দূর না। এই তো দুই তিন মিনিট হাঁটলেই মসজিদ। তিন রাস্তার মোড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তার নিজস্ব স্বত্তায়।
মধ্য রাস্তায় এসে শওকত রহমান পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢুকালেন। শূন্য পকেট। সাথে সাথে অন্যটাতে হাত দিলেন। পকেট হাতরে মুঠোফোন, তসবিহ এবং কিছু টাকা ব্যাতিত অন্য কিছু পেলেন না। নাহ, টুপিটা এটাতেও নেয়। খাদিজা বিছানার উপরেই তো রেখেছিলো পাঞ্জাবী পায়জামার সাথে। সঙ্গে নিতে একেবারেই ভুলে গেছেন। ভুলটা বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছে ভেবে রাইফের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-‘দেখেছো অবস্থা, টুপিটা রেখে আসছি। বয়স হচ্ছে তো, তুমি যাও। আমি গিয়ে আনছি।’
কথাটা বলে মুঠোফোন টা বৃদ্ধাঙুলির মাধ্যমে অন করলেন। কয়েক সেকেন্ড এর ব্যাবধানে কল করলেন কারো নাম্বারে। কানে ফোন রেখে অপেক্ষা করতে করতেই রিসিভ হওয়ার সাথে সাথেই বলে উঠলেন,
-‘টুপিটা নিয়ে নিচে আসেন তো আম্মা। আপনার ছেলে বুড়ো হয়েছে, সব কিছু ভুলে যায়।’
অপর পাশে কি কথা বলল তা মৃদু আওয়াজেও শুনতে পারল না রাইফ। শওকত রহমান ফোনটা কান থেকে নামিয়ে পকেটে রেখে রাইফের উদ্দেশ্যে বললেন,
-‘তুমি যাও, আমি আসছি।’
রাইফ সাথে সাথেই বাধাপ্রদান করলো। গদগদ কন্ঠে বলল,
-‘আপনি কেনো কষ্ট করবেন চাচা। আমি যাই। এক মিনিট ও লাগবে না আনতে। এক কাজ করেন, অনেক গরম তো। আপনি বরং এই দোকানে বসেন।’
শওকত রহমানকে নিষেধ করারও সুযোগ দিলো না রাইফ। হনহন করে সামনের দিকে এগুতে থাকল। কোনো ভাবেই পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না। পিছু ফিরলেই যেনো মহাবিপদ। যা খুশি তাই হয়ে যাক, আজ আর তাকে আঁটকাতে পারবে না কেউ। বেশ দূরে চলে আসার পর চোরা চোখে তাকিয়ে দেখল শওকত রহমান বসেছেন দোকানে। যাক, উনি তবে আর আসবেন না। এই সুযোগে যদি আরেক বার, হ্যাঁ আরেক বার হৃদয় দিয়ে বসা রমনীর সান্নিধ্য লাভ করা যায় তবে মন্দ কি!
চলবে….