মুখোশের আড়ালে শেষ পর্ব

0
1026

#মুখোশের_আড়ালে
#পর্ব_১৯ (অন্তিম পর্ব)
#Saji_Afroz
.
.
চার দিন কেটে গেলো । পৌষীর পান্ডুলিপি করাও শেষ । মিয়াজ শেখ জানিয়েছেন, চুক্তিপত্রও তৈরী হয়েছে ।
তবে চুক্তিতে সাক্ষর করা পৌষীর উদ্দেশ্য নয় । তার উদ্দেশ্য অন্যকিছু । যা আজ সফল হতে চলেছে । কথাটি ভেবেই একটা মিষ্টি হাসি দিলো পৌষী ।
ফাহাদ বসে ছিলো বিছানায় ।
ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসা পৌষীকে দেখছে সে । পৌষী আয়নার দিকে তাকিয়ে হাসছে কোনো কারণ ছাড়াই । অদ্ভুত না?
একপর্যায়ে ফাহাদ প্রশ্ন করেই বসলো-
কি ব্যাপার? এতো খুশি খুশি লাগছে আমার বউকে?
-আজ আমি চুক্তিপত্রে সাইন করবো । পান্ডুলিপি জমা দিবো । আমার স্বপ্নের এক ধাপ পার হবে । খুশি হবোনা?
-অবশ্যই! কিন্তু আমাকে বললেনা আজ করবে ।
-বলে কি হবে?
-আমিও তোমার সাথে যেতাম ।
-প্রয়োজন নেই । আপনি বরং অফিসেই যান । অফিস খোলা ।
-আজ তোমার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন । এই দিনে আমি তোমার পাশে থাকতে চাই পৌষী । তোমার সাথে আমিও যেতে চাই ।
.
ফাহাদের সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে পৌষী ড্রয়ার খুলে একটা সাদা শাড়ি বের করে নিলো । ফাহাদের দিকে দেখিয়ে বললো-
এটা সুন্দর না?
-সুন্দর তবে আজকের দিনে উজ্জ্বল রঙের শাড়ি পরতে পারো ।
.
সাদা শাড়িটা রেখে হলুর রঙের একটা শাড়ি বের করতেই ফাহাদ বলে উঠলো-
এটা ঠিক আছে!
.
শাড়ি পরে তৈরী হয়ে নিলো পৌষী । ফাহাদও তৈরী হয়ে আসলো পৌষীর পাশে । পৌষী শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে বললো-
সত্যিই যাবেন আপনি?
.
ফাহাদ নিচু হয়ে বললো-
আমি কুচি ঠিক করে দিচ্ছি ।
.
ফাহাদ খুব যত্নসহকারে পৌষীর শাড়ির কুচি ঠিক করছে । ফাহাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকাতেই পৌষীর চোখের কোণে পানি চলে এলো ।
ফাহাদের দৃষ্টি তা এড়ালো না । সে দাঁড়িয়ে পৌষীর চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো-
তুমি যা দেখাতে চায়ছো তা তুমি নও । আমি জানি তুমি আমাকেই ভালোবাসো । আমি সবটা জানতে চাই পৌষী ।
-জানতে চান? তবে আমি যা বলি তা আজ করতে হবে ।
-কি করতে হবে?
-বলছি । তার আগে আরেকটা কাজ বাকি আছে ।
.
পৌষী মোবাইল হাতে নিয়ে ডায়েল করলো উষ্ণের নাম্বারে ।
উষ্ণ শুয়ে ছিলো । পৌষীর ফোন পেয়ে রিসিভ করে বললো-
তিশানী কেনো আমায় এভাবে কষ্ট দিচ্ছো? আর কেনোই বা পৌষী ও ফাহাদকে কষ্ট দিচ্ছো? ওরা হ্যাপি কাপল । ওদের মাঝে দুরত্ব সৃষ্টি করছো তুমি । কি চাও তুমি? এর শেষ চাই আমি । প্লিজ থামাও এসব । নাহলে আমি ফাহাদকে বলতে বাধ্য হবো ।
.
একনাগাড়ে উষ্ণের এতোগুলো কথা শুনে হাসলো পৌষী । উষ্ণ বললো-
আমার মনেহচ্ছে তুমি হাসছো!
-আমি কেনো এমন করছি তুমি জানতে চাও তাইনা? ঠিক আছে, এখুনি মিয়াজ আঙ্কেলের বাসার সামনে চলে এসো । আমি বাসার সামনে দেখা করবো ।
-ওখানে কেনো?
-রহস্যের উদঘাটন করার ইচ্ছে নেই?
.
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে উষ্ণ বললো-
আসছি ।
.
ফোন রাখতেই পৌষী দেখলো, ফাহাদ তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ।
পৌষী বললো-
ওভাবে তাকানোর কিছু নেই । চলুন । যেতে যেতে যা যা বলবো মন দিয়ে শুনবেন । আজ সবকিছু পরিষ্কার হবে ।
.
.
শান্তি নিবাস…
মিয়াজ শেখের বাড়ি । বাড়িটা আজ পুরো ফাঁকা । কাজের লোকরাও আসেনি । আসলে তিনিই নিষেধ করেছেন তাদের । কেননা আজ এই বাড়িটা ফাঁকাই প্রয়োজন!
কিন্তু যার অপেক্ষা তিনি করছেন, সে এখনো আসছেনা কেনো?
ভাবতে ভাবতেই পৌষীর আগমন ঘটলো ।
পৌষীকে দেখে তিনি বললেন-
এসেছো!
-জ্বী ।
-ফাহাদ আসেনি?
-এতোদিনে এটাও বুঝেন নি? ফাহাদ আসবেনা । সে আমার সাফল্য চায়না ।
-হ্যাঁ তুমি আমায় বলেছো সব, ফাহাদ তোমাকে যথারীতি নির্যাতন শুরু করেছে তাও বলেছো । তবুও আমি ভেবেছিলাম তোমার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে । আজকের দিনে অন্তত ফাহাদ আসবে!
.
পৌষী মিয়াজ শেখের সামনে এসে বসলো । আজ হলুদ শাড়িটায় তাকে দেখতে ভারীই সুন্দর লাগছে । মিয়াজ শেখ তার দিকে তাকিয়ে বললেন-
এতো সুন্দরী একটা বউ কে এভাবে কেউ অবহেলা কিভাবে করতে পারে!
.
আচমকা ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো পৌষী । মিয়াজ শেখ বললেন-
কান্না থামাও পৌষী । তোমার জন্য আমি তো আছি!
.
শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে পৌষী ব্যাগ থেকে পান্ডুলিপি বের করলো । তা মিয়াজ শেখের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো-
আমার পান্ডুলিপি ।
.
মিয়াজ শেখ তা হাতে নিয়ে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে বললেন-
ফ্রিতেই কি স্বপ্ন পূরণ করবে?
.
পৌষী অবাক হয়ে বললো-
মানে?
-মানে কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয় । তুমি এখন অসহায় । বাবার বাড়িতে কোনো দাম নেই তোমার । স্বামীর বাড়িতেও নেই । একমাত্র আমিই পারি তোমাকে তোমার প্রাপ্য সম্মান দিতে । তাই আমাকে খুশি করা তোমার দায়িত্ব । আশাকরি বুঝতে পেরেছো আমি কি বলতে চাইছি!
.
কিছুক্ষণ মিয়াজ শেখের দিকে তাকানোর পর পৌষী হেসে বললো-
আগে বললেই পারতেন । এতোদিন ফাহাদের কাছে পড়ে থেকে সময় নষ্ট করতাম না ।
.
পৌষীর কথা শুনে অবাক হলেন মিয়াজ শেখ । পৌষীর মতো মেয়ে তার প্রস্তাবে এতো তাড়াতাড়ি সাড়া দেবে ভাবতে পারেননি তিনি । ভেবেছিলেন, সেও ঝামেলা করতে চায়বে । তাতেও কিছু যায় আসতোনা । কারণ প্রমাণ দেবার মতো কিছু তার কাছে থাকবেনা । তাই চেষ্টা করতে ক্ষতি কি!
.
মিয়াজ শেখ বললেন-
বুদ্ধিমতী!
-অবশ্যই । আমি তিশানীর মতো বোকা নয় ।
.
পৌষীর মুখে তিশানীর নাম শুনে চমকে উঠলেন মিয়াজ শেখ । আমতাআমতা করে বললেন-
কে, কে তিশানী?
-সে কি! মনে করতে পারছেন না? আমি করিয়ে দিই?
-তুমি কি বলতে চাইছো পৌষী? কার কথা বলছো?
-আমি সেই মেয়েটির কথা বলছি, যাকে আপনি স্বপ্ন দেখিয়ে এই বাড়িতে এনেছিলেন । আমি সেই মেয়েটির কথা বলছি, যার সরলতার সুযোগ নিয়ে তার আপনজন সেজেছিলেন । আমি সেই মেয়েটির কথা বলছি, যাকে হাজারো আশা দিয়ে আশা ভঙ্গ করেছিলেন । শুধু তাই নয়! যার থেকে তার ভালোবাসার মানুষের ভরসা তুলে নিয়েছিলেন আপনি । আর যাকে আপনার জন্য অকালে আত্মহত্যা করতে হয়, আমি সেই মেয়েটির কথা বলছি । কি ব্যাপার মিয়াজ সাহেব? কিছু কি মনে পড়ে?
.
পৌষীর কথা শুনে থরথর করে কাঁপতে থাকলেন মিয়াজ শেখ । মনে পড়ে গেলো তার সেদিনের কথা!
.
তিশানী তার পান্ডুলিপি নিয়ে এসেছে এই বাড়িতে । বাড়িটা ফাঁকা দেখে মিয়াজ শেখকে বললেন-
কেউ নেই আঙ্কেল?
-না নেই । আজ সবার ছুটি ।
-কেনো?
-তুমি আসবে বলে ।
.
তিশানী হেসে বললো-
আমি কি চা বানিয়ে দিবো?
-নাহ । আমার অন্য কিছু চাই ।
.
নিজের দিকে মিয়াজ শেখকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে উড়না ঠিক করতে লাগলো তিশানী । তার কেমন যেনো অস্বস্তি কাজ করছে । আজ মিয়াজ শেখের চাহনীর মাঝে লোভ কেনো দেখতে পাচ্ছে সে!
কথা ঘুরিয়ে তিশানী বললো-
সাক্ষরের কাজটা শুরু করা যাক?
-এতো তাড়া কিসের?
– উষ্ণ আমার জন্য অপেক্ষা করছে । তাড়াতাড়ি যেতে হবে । যদিও ও আসতে চেয়েছিলো এখানে । শরীর ভালোনা বলে আমিই এতোদূর আসতে নিষেধ করেছি ।
.
কথাটি শুনে উচ্চশব্দে হেসে উঠলেন মিয়াজ শেখ ।
তিশানী বললো-
কি হলো?
– উষ্ণ তোমাকে বিয়ে করবে! আর এটা তুমি বিশ্বাস করলে?
-কেনো?
– উষ্ণ তোমাকে ইউজ করতে চায় । আমাকে নিজে বলেছে ।
.
মিয়াজ শেখের কথা শুনে তিশানীর পায়ের নিচ থেকে যেনো মাটি সরে গেলো ৷ ছলছল করে উঠলো তার চোখ জোড়া ।
মিয়াজ শেখ বললেন-
তার বিয়ে অন্য জায়গায় ঠিক হয়ে আছে । নাহলে সে তোমাকে তার মা-বাবার সাথে এখনো পরিচয় কেনো করিয়ে দেয়নি?
-আমার মামাকে সাথে নিয়ে বলবে বলেছে তাদের ।
-সবটায় ওর নাটক । আমাকে সবটা শেয়ার করেছে ও । ও তোমার রূপে মুগ্ধ । তোমাকে তার বিছানার সঙ্গী বানাতে চায় কিন্তু জীবন সঙ্গী নয় ।
-এসব আপনি কি বলছেন!
-আমি ঠিকই বলছি তিশানী । তুমি নিজেই ভেবে দেখো । তোমার মতো একজন সাধারণ মেয়েকে কেনো সে বিয়ে করবে!
.
মিয়াজ শেখের কথা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো তিশানী । ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে সে বললো-
উষ্ণ আমার সাথে এতোবড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আর আমি কিনা বুঝতেই পারিনি!
.
মিয়াজ শেখ তার পাশে কাধে হাত রেখে বললেন-
আমি আছি তোমার পাশে তিশানী! একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেবো তার সাথে তোমার । না দরকার তোমার ওই মামা-মামীকে না দরকার উষ্ণকে । শুধু আমার একটা চাহিদা পূরণ করলেই হলো ।
.
তার দিকে তাকিয়ে তিশানী বললো-
কি?
-আজকের দিনটা তুমি আমার সাথে কাটাবে, রাতটাও । একদিন আমাকে খুশি করলে সারাজীবন খুশিতে থাকতে পারবে । বাড়ি, গাড়ি, নাম সব হবে তোমার! কারো পরোয়া করার প্রয়োজন নেই ।
.
মিয়াজ শেখের মুখে এমন কিছু শুনবে আশা করেনি তিশানী । দাঁড়িয়ে পড়লো সে । কষিয়ে তার বাম গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে বললো-
বাবার মতো সম্মান করতাম তোকে । তুই যখন সেই সম্মানের কদর রাখলিনা আমিই বা কেনো রাখবো! এখন বুঝলাম, উষ্ণের নামে যা বলেছিস তা সবটায় বানানো । তুই কি করে ভাবলি? আমি এসব নোংরা কাজে রাজী হবো? আমি এখুনি উষ্ণকে সবটা জানাবো । শুধু উষ্ণকে নয় । পুরো মিডিয়ায় জানাবো । তোর মতো নষ্ট লোককে সবার চেনা উচিত । জানা উচিত, ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে এক জঘন্য মানুষ রয়েছে!
.
মিয়াজ শেখ নিজের গালে হাত দিয়ে বললেন-
কেউ বিশ্বাস করবেনা এসব । ভুল করছিস তুই তিশানী ।
.
তিশানী আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালোনা । দ্রুতবেগে বেরিয়ে পড়লো সে শান্তি নিবাস ছেড়ে ।
.
.
তিশানীর অপেক্ষায় পার্কে বসে ছিলো উষ্ণ । তার শরীরটা ভালোনা বিধায় বাড়ির পাশের পার্কটাতে এসেছে সে ।
তিশানী দৌড়ে তার কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো-
উষ্ণ আমার কিছু কথা বলার আছে তোমাকে ।
.
তিশানীর দিকে তাকালো উষ্ণ । তিশানী দেখলো উষ্ণের দুচোখ লাল । তা দেখে তিশানী বললো-
তোমার কি হয়েছে উষ্ণ? শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?
.
উষ্ণ দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বললো-
আমার কি টাকাপয়সা কম আছে তিশা? কেনো তোমার নিজের শরীর বিলিয়ে দেয়ার অফার দিতে হলো মিয়াজ শেখকে?
.
উষ্ণের কথা শুনে তিশানী যেনো আকাশ থেকে পড়লো । থমকে গেলো সে!
উষ্ণ আরো বললো-
আমি কি আমার মা বাবার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিতাম না? সামান্য এই বিষয় নিয়ে তুমি আমাকে ভুল বুঝলে! আমার উপর ভরসা না করে মিয়াজ শেখ…
ছিঃ তিশা ছিঃ! আমি তোমার মতন একটা মেয়েকে ভালোবেসেছি! আমি! কিভাবে! নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে আমার । আরে আমাকে তোমার বিশ্বাস না হলে মুখ ফুটে বলতে পারতে । পুরা পৃথিবী তোমার পায়ের নিচে এনে দিতাম । আর তুমি কিনা…
.
আর কোনো কথা বললোনা উষ্ণ । মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলো ।
তিশানী শান্ত স্বরে বললো-
মুখ ঘুরিয়ে নিলে উষ্ণ?
.
জবাব দিলোনা উষ্ণ । তিশানীও নীরবতা পালন করে চলে যেতে থাকলো ।
.
.
বাসায় প্রবেশ করতেই তিশানীর মামী চেঁচিয়ে বললেন-
আমরা তোরে খুব জ্বালাতন করি তাইনা? তাই আমাদের বিরুদ্ধে মিয়াজ শেখকে বুঝিয়েছিস । নিজের শরীর বিলিয়ে দিতে চেয়েছিস । হায় হায়! উষ্ণের মতো ভালো একটা ছেলে পেয়েও এসব তুই কিভাবে করতে পারলি? লজ্জা করছেনা তোর?
.
তিশানীকে নিশ্চুপ দেখে তার মামী বললেন-
এই মেয়ে কথা বলনা?
.
কোনো কথা বললোনা তিশানী । রুমের ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করতেই ফোন বেজে উঠলো তার । রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তার বান্ধবী বললো-
ফেসবুকে এসব কি দেখছি তিশানী! তুই মিয়াজ শেখকে…
.
একটু থেমে সে বললো-
তুই এমন আমার জানা ছিলোনা । এসব কি সত্যি?
.
তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে তিশানী বললো-
যাক! কেউ তো জানতে চায়লো এসব সত্যি কিনা!
.
ফোন কেটে ফেসবুকে এলো তিশানী ।
মিয়াজ শেখ তার বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দিয়েছে । যেখানে রয়েছে হাজার হাজার লাইক ও কমেন্ট । তিশানী দেখতে থাকলো এসব-
নিচু জাতের মেয়েরা এমনি হয় ৷ একটু প্রশ্রয় দিলে মাথায় চড়ে বসে ।
.
খুব ভালো হয়েছে স্যার । তিশানীর মতো মেয়ের চরিত্র তুলে ধরেছেন আপনি ।
.
এই মেয়েটার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন স্যার ।
.
এমন মেয়ের জন্য যেকোনো বয়সের লোকের মাথা খারাপ হয় । আপনি নেহাত ভালো মানুষ বলে…
.
আর পড়লোনা তিশানী । চোখ জ্বালাপোড়া করছে তার । তার বন্ধুবান্ধবরা ইনবক্সে নানা কথা লিখে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছে তাকে । কেউ কেউ ব্লকও করেছে ৷
এসব দেখে হেসে উঠলো তিশানী । হাসতে হাসতে বললো-
যার নাম আছে তার সব আছে! আমি অসহায় ছিলাম অসহায়ই রয়ে গেলাম । অন্য কেউ কিছু ভাবুক আমার তাতে যায় আসেনা । কিন্তু উষ্ণ! উষ্ণ কিভাবে ভুল বুঝলো আমাকে! তার কি মিয়াজ শেখের থেকে টাকা পয়সা কম! হায়…
এই কথাতো কেউ জানেনা, আমি উষ্ণের প্রেমিকা । হ্যাঁ প্রেমিকাই রয়ে গেলাম । ভালোবাসার মানুষ হতে পারলাম না হয়তো!
.
আবারো নীরব হয়ে গেলো তিশানী । তার মামীর চেঁচানোর শব্দ বাইরে থেকে ভেসে আসছে ।
সবাই ভুল বুঝলো তাকে । তার কি আসলেই এসব প্রাপ্য!
আয়নায় চোখ পড়লো তিশানীর । কাছে এসে গ্লাসে হাত রেখে বললো-
এই রূপই আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী । কি দরকার এই রুপ নিয়ে বেঁচে থাকার? ভালো কেউ বাসবেনা । এখন আরো বেশি ব্যবহার করতে চায়বে আমায় । আমি কারো ব্যবহারের পাত্রি হতে চাইনা । চাইনা!
.
ড্রয়ার খুলে একটা শাড়ি বের করলো তিশানী ।
সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো-
তোর কাছে ঠাঁই চাই । দিবি কি?
.
মিয়াজ শেখ পান্ডুলিপিটার দিকে তাকিয়ে আছেন ।
পৌষী বললো-
এখনো মনে পড়ছেনা কিছু?
.
তিনি পান্ডুলিপিটা হাতে নিয়ে উল্টাতে লাগলেন । দেখলেন তিশানীর লেখা সেই পান্ডুলিপি এটি!
এই শীতের মাঝেও ঘামতে শুরু করলেন তিনি । পৌষীর দিকে তাকিয়ে বললেন-
তুমি কে?
.
পৌষী শব্দ করে হাসতে শুরু করলো ।
মিয়াজ শেখ রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললেন-
তুমি আমাকে এসব বলে ভয় দেখাতে পারবেনা পৌষী । কেউ বিশ্বাস করবেনা তোমার কথা । এই মিয়াজ শেখের কথায় বিশ্বাস করবে সবাই ।
-আপনি স্বীকার করলেই হবে ।
-দেখো পৌষী, তিশানীর সাথে এতো কিছু করার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিলোনা । অফার দিয়েছি রাজী না হলে নেই । জোরদবস্তি তো করতাম না! কিন্তু সে আমাকে থাপ্পড় মারলো, উষ্ণকে জানাতে গেলো সব । মিডিয়াতে জানাবে বলেছে । উষ্ণ সবটা জানলে আমাকে কি ছেড়ে দিতো! অনেক বেশি ভালোবাসতো সে তিশানীকে । সবটা বলতো বলে আমি জানতাম ।
-আর আপনি তাদের সুন্দর জীবনটা নিয়ে ছিনিমিনি খেললেন ।
-রাগের বসে…
-রাগের বসে!
-ওহ প্লিজ পৌষী থামো! তুমি কিভাবে এতো কিছু জানো আমি জানিনা । তবে তুমি তিশানীর মতো বোকামি করতে যেওনা । নয়তো কোনো একটা সিলিং ফ্যানের সাথে তোমাকেও ঝুলতে হবে ।
-আমি অবশ্যই তিশানীর মতো বোকা নয় । আগেই বলেছি ।
.
কথাটি বলেই দাঁড়িয়ে পৌষী বললো-
সবাই ভেতরে আসুন প্লিজ ।
.
একেএকে ভেতরে এলো ফাহাদ, উষ্ণ, আমেনা বেগম, মুহিত, পুলিশ ও সাংবাদিক ।
.
তাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি ।
আমেনা বেগমের কাছে এসে মিয়াজ শেখ বললেন-
আমেনা তুমি!
.
তিনি বললেন-
তোমাকে আমি ঠিক চিনতে পারিনি! তুমি আমার ভালোবাসার যোগ্য নও মিয়াজ শেখ!
.
উষ্ণ বললো-
আমার ভালোবাসাকে বিশ্বাস না করে বিশ্বাস করেছি আপনাকে । আর বিশ্বাসের এই প্রতিদান দিলেন আপনি? আপনি মিয়াজ শেখ! আপনি!
.
মুহিত মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । জন্মদাতা পিতার এই রূপ দেখে বড়ই লজ্জিত সে ।
.
আমেনা বেগম কেঁদে বলে উঠলেন-
ভালোই হলো আমাদের কোনো মেয়ে মেই । ভালোই হলো । ওসি সাহেব নিয়ে যান এই ব্যক্তিকে এখান থেকে । প্লিজ নিয়ে যান ।
.
মিয়াজ শেখকে পুলিশের হাতে হস্তান্তর করা হলো । তারা চলে যেতেই পৌষীর দিকে তাকিয়ে আছে সকলে ।
পৌষী বললো-
ভয়ের কিছু নেই । আমি তিশানী নয়, পৌষী । হ্যাঁ শুরুতে তিশানী আমার শরীরে ভর করলেও আমার এক্সিডেন্টের পর এই আমার শরীর থেকে বেরিয়ে যায় সে । আমরা বাড়ি বদলাতে চায়লে তিশানীর আত্মা আমাকে সবটা খুলে বলে । সাহায্য চায় ।
.
ফাহাদ বললো-
কিন্তু তুমি আমাকে সবটা জানাওনি কেনো? আর কেনোইবা আমাকে জঘন্য বলেছিলে?
-কারণ আপনাকে সবটা জানালে আপনি আমায় এসব করতে দিতেন না । আর আপনাকে না জানিয়ে এসব করা আমার পক্ষে সম্ভবও ছিলোনা । তাই এসব বলা এবং এমন ব্যবহার করা । যাতে করে আপনি আমার কাজে বাঁধা সৃষ্টি না করেন ।
.
উষ্ণ বললো-
ফাহাদ সত্যিই তোমার তুলনা নেই । এতো কিছুর পরেও তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে বোঝার চেষ্টা করেছো তুমি । অন্য কেউ হলে হয়তো তা করতোনা । যেমন আমিই…
.
কথা শেষ না করেই অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকলো উষ্ণ । ছেলেদের সচারাচর এভাবে কাঁদতে দেখা যায়না ৷
ফাহাদ তাকে শান্তনা দিয়ে বললো-
প্লিজ শান্ত হোন আপনি ।
-কি করে হবো! তিশা আমাকে ক্ষমা করে দিও । আমার জন্যই তোমার এই দশা ।
.
পৌষীর ঠিক পাশে তিশানীর আত্মা । পৌষীকে সে বললো-
আমার কাজ শেষ! তুমি আমায় সাহায্য করেছো যার জন্য তোমায় অনেক ধন্যবাদ । আরেকটা কাজ করে দিও । উষ্ণকে বলো, ওর প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই আমার । কেননা আমি মৃত্যুর পরে জেনেছি, ও আমায় অনেক বেশিই ভালোবাসতো এবং বাসে! তাইতো তোমার ভেতরে আমার উপস্থিতি সেই টের পেয়েছিলো ।
.
পৌষী মৃদু হাসলো । ধীরেধীরে অদৃশ্য হয়ে গেলো তিশানীর আত্মা । উষ্ণের উদ্দেশ্যে পৌষী বললো-
আপনি তিশানীকে এখনো ভালোবাসেন জেনেই তার আত্মা শান্তি পেয়েছে ।
-তিশানী কি আছে?
.
ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে পৌষী বললো-
নাহ ।
-আপনার জন্য সব সত্যিটা সামনে এলো পৌষী । আপনি যা করেছেন তা কেউ করবেনা । কি করে আপনাকে ধন্যবাদ দেবো!
বলুন কি করতে পারি আমি আপনার জন্য?
.
উষ্ণের হাতে দুটো পান্ডুলিপি দিয়ে পৌষী বললো-
এখানে তিশানীর একটা কবিতার ও একটি উপন্যাসের পান্ডুলিপি রয়েছে । যেটা তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে ।
তিশানীর এই উপন্যাসের বইটা প্রকাশ করুন । জীবিত থাকা অবস্থায় তাকে সবাই ভুল বুঝেছিলো । আমি চাই তার লেখা পড়ুক সবাই । বুঝুক তারা মুখোশের আড়ালে তিশানী নয়, মিয়াজ শেখ ছিলেন!
.
.
প্রায় একমাস পর….
আজ শুক্রবার । ফাহাদ ও পৌষী ঠিক করেছে, তার আজ লালমাই পাহাড়ে যাবে । তাই তৈরী হচ্ছিলো পৌষী । এমন সময় কলিংবেলের শব্দ শুনে ফাহাদ রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে । একটু পরে রুমে আসতেই পৌষী বললো-
কে এসেছে?
.
পৌষীর দিকে দুটো বই দেখিয়ে দিয়ে ফাহাদ বললো-
উষ্ণ পাঠিয়েছে । তিশানীর বই । একটি কবিতার ও একটি উপন্যাসের ।
.
উপন্যাসের বইটার দিকে চোখ পড়তেই পৌষীর দুচোখ ছলছল করে উঠলো । বইটির নাম ‘মুখোশের আড়ালে’ ।
ফাহাদ বললো-
সব মনে পড়ে গেলো, তাইনা?
-হু ।
.
বইগুলো একপাশে রেখে পৌষীকে জড়িয়ে ধরলো ফাহাদ ।
পৌষী বললো-
মুখোশের আড়ালে শুধু মিয়াজ শেখ নন, তুমিও আছো ।
-মানে?
.
ফাহাদকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পৌষী বললো-
তোমাকে আমি ভীষণ খারাপ ভাবতাম, আমাকে পাত্তা দিতেনা তাই । কিন্তু তুমি অনেক বেশিই ভালো । তাইতো আমার এতো পাগলামি সহ্য করেছিলে ।
.
ফাহাদ খেয়াল করলো, এই প্রথম পৌষী তাকে তুমি করে বলেছে ।
সে বললো-
তুমি আমাকে তুমি করে বলেছো পৌষী?
-কেনো পারিনা বলতে?
-অবশ্যই পারো ।
.
কিছুক্ষণ এভাবে কাটার পর ফাহাদ বললো-
আজ তাহলে বাইরে যাওয়া হচ্ছেনা ।
.
ফাহাদকে ছেড়ে পৌষী বললো-
কেনো?
-চলো ছোট্ট পৌষী আসার ব্যবস্থা করি ।
-আইডিয়া মন্দ না, তবে..
-কি?
-আমাদের মেয়ের নাম তিশানী হবে । কারণ তিশানীর জন্যই তুমি আমার প্রেমে পড়েছো । এটা কিন্তু অস্বীকার করতে পারবেনা ।
.
পৌষীর কথা শুনে ফাহাদ হেসে বললো-
হুম । ভুতনী তিশানীর জন্যই…
.
কথা শেষ না হতেই বারান্দায় কিছু পড়ার শব্দ শুনতে পেলো ফাহাদ ।
পৌষী কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললো-
ভুত ডেকে দিলে তো তিশানীকে রাগিয়ে?
.
ফাহাদ ভয়ার্ত মুখ নিয়ে বললো-
ও এখনো আছে?
.
ফাহাদের কথা শুনে হাসতে হাসতে পৌষী বললো-
দিলাম তো বোকা বানিয়ে!
.
পৌষী হাসছে । তার দিকে তাকিয়ে আছে ফাহাদ । এভাবে যেনো অনন্তকাল তাকিয়ে থাকতে পারবে সে!
খুব বেশিই ভালোবাসে কিনা সে তার পৌষীকে…
.
(সমাপ্ত)
.
বি:দ্র: বিরতিহীনভাবে গল্পটা লিখে শেষ করেছি। কেমন লেগেছে জানাতে ভুলবেন না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here