#মুখোশের_আড়ালে
#পর্ব_৩
#Saji_Afroz
.
.
সারাদিনের ক্লান্তি ভারাক্রান্ত শরীর নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছে ফাহাদ । আজ তার কলিংবেল চাপতে হলোনা । দরজা খোলাই ছিলো । ভেতরে প্রবেশ করেই ডাইনিং টেবিলে দেখা পেলো পৌষীর । ভাত খাচ্ছে সে । সবেমাত্র রাত ৯টা বাজতে চললো । পৌষী এতো তাড়াতাড়ি ভাত খায়না । ফাহাদকে ছাড়াতো একদমি না । ফাহাদ যতো রাত করেই বাসায় ফিরুক না কেনো, পৌষী না খেয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতো । তবে আজ কি হলো?
ফাহাদকে দেখে কোনো কথাও বলছেনা পৌষী । ফাহাদ হালকা কেশে তার উপস্থিতি জানান দিতে চাইলো । কিন্তু পৌষীর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই । সে খেয়েই চলেছে! অবশেষে ফাহাদ বলেই ফেললো-
আজ কি তোমার খিদে বেশি পেয়েছে?
.
মুখে থাকা খাবার শেষ করে পৌষী জবাব দিলো-
না । টিভিতে একটা প্রোগ্রাম আছে । ওটা দেখার জন্যই তাড়াতাড়ি খেয়ে নিচ্ছি ।
.
টিভির প্রতি এতো আশক্ত পৌষীকে কখনো হতে দেখেনি । সময় কাটানোর জন্য তাকে কাঁথা সেলাইসহ নানারকমের হাতের কাজ করতে দেখেছে ।
ফাহাদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পৌষী বললো-
খাবার সব গরম আছে । খেতে চায়লে ফ্রেশ হয়ে আসুন ।
.
.
রুমের মাঝে পায়চারি করছেন মিয়াজ শেখ । আমেনা বেগম বললেন-
পৌষীকে নিয়ে চিন্তা করছো তাইনা?
.
দাঁড়িয়ে পড়লেন মিয়াজ শেখ । উল্টো প্রশ্ন করলেন-
কি করে বুঝলে?
-আমি না বুঝে কে বুঝবে! একটা কাজ করলেই পারো ।
-কি?
-রবিনকে ফোন দিয়ে পৌষীর ফোন নাম্বার নিতে পারো ।
-খারাপ বলোনি ।
.
কথামতো রবিনকে ফোন দিলেন মিয়াজ শেখ । রবিনের কাছ থেকে জানলেন, পৌষী বিবাহিতা ।
পৌষীর ফোন নাম্বার না পেলেও তার স্বামীরটা পেলেন মিয়াজ শেখ । তবে এই সময়ে ফোন করাটা অনুচিত মনে হলো তার কাছে । কাল সকালেই নাহয় করা যাবে ভেবে শুয়ে পড়লেন তিনি ।
.
.
টিভির দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে পৌষী । ফাহাদ এসে তার পাশে বসেছে বেশকিছুক্ষণ হলো । পৌষীর সেদিকে খেয়ালই নেই ।
গতকালের উষ্ণ মাহমুদের সাক্ষাৎকারের অনুষ্ঠান পুনরায় দেখানো হচ্ছে টিভিতে । সেই অনুষ্ঠানটিই দেখছে আবার পৌষী । একই অনুষ্ঠান আবার দেখার কারণ কি বোঝার চেষ্টা করছে ফাহাদ । পৌষীর উদ্দেশ্যে সে বললো-
এটা তো কালও দেখেছিলে । রিমোটটা আমায় দাও । ১০টার সংবাদ দেখবো ।
.
গলার স্বর খানিকটা গম্ভীর করেই পৌষী বললো-
উষ্ণকে দেখার সময় আমাকে কোনোভাবে বিরক্ত করবেন না প্লিজ ।
.
পৌষীর কথায় যেনো ধাক্কা খেলো ফাহাদ । কি বললো সে! আর কিভাবে কথাটা বললো! এমন করে গম্ভীর স্বরে পৌষীকে কখনো কথা বলতে শুনেনি সে ।
.
টিভি দেখার এক পর্যায়ে বিজ্ঞাপন শুরু হলে
টেবিলের উপরে রাখা ডায়েরী ও কলম নিয়ে লেখা শুরু করলো পৌষী——————————–
জানি হারিয়েছো তুমি ভিড়ের আড়ালে,
তাও প্রতি রাতে চলে তোমাকে খোঁজার ব্যর্থ প্রচেষ্টা।
নোনা পড়া চোখের ভাজে
জানি হারিয়েছি আমি আবারো তোমার স্মৃতির মাঝে,
তাও খুঁজতে চায়না আজ নিজেকে।
হারিয়ে যাওয়ার এই খেলায়
জিতেছো তুমি, হেরেছি আমি।
খুশি তো?
তাও আজ হারাতে যে মন চায়, সেই তোমাতেই!
.
আঁড়চোখে পৌষীর লেখা দেখতে থাকলো ফাহাদ ।
কোনো কিছু না ভেবেই একনাগাড়ে কবিতাটি লিখে ফেললো পৌষী ।
তাতে ফাহাদ অবাক হলোনা । হলো পৌষীর হাতের লেখা দেখে । এতো সুন্দর হাতের লেখা তার! তবে আগে ওমন বাজেভাবে লিখতো কেনো সে?
.
বিজ্ঞাপন শেষে পৌষী আবারো টিভির দিকে মনোযোগ দিলো ।
ফাহাদ খেয়াল করলো, পৌষীর চোখ জোড়া ছলছল করছে ।
ফাহাদ বললো-
মনমরা লাগছে কেনো তোমাকে?
-উষ্ণ…
.
আর কিছু না বলে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেললো পৌষী ।
ফাহাদ বললো-
বলো?
-আমি বলেছিলাম, উষ্ণকে দেখার সময় কোনো ধরনের ডিস্টার্ব আমি চাইনা ।
-এমন করে বলছো যেনো উষ্ণ তোমার প্রেমিক ছিলো!
.
কিছু বলছেনা পৌষী । নিরবতা সম্মতির লক্ষণ এমনটায় জানে ফাহাদ । তবে কথাটি সত্য?
পরক্ষণেই মাথাটা ঝেড়ে নিলো ফাহাদ । এটা কি করে সম্ভব! পৌষীর মতো একজন সাধারণ মেয়ের সাথে উষ্ণ মাহমুদের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারেনা । বরং উষ্ণ মাহমুদের ভক্ত হতে পারে সে ।
.
.
-তুমি কি ফোন করতে চাচ্ছো? রাত বেশি হয়নি । করতে পারো ।
.
আমেনা বেগমের কথা শুনে মুচকি হাসলেন মিয়াজ শেখ । এ মহিলাটি কিভাবে তার মনের কথা জেনে যায়? বেশি ভালোবাসে বলে?
স্ত্রীর কথায় সম্মতি জানিয়ে ডায়েল করলেন তিনি ফাহাদের নাম্বারে ।
.
রিং বেজে উঠলে ফাহাদ মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো অপরিচিত নাম্বার । একটু দূরে এসে রিসিভ করে বললো-
হ্যালো আসসালামু-আলাইকুম । কে বলছেন?
-ওয়া আলাইকুমুস-সালাম । আমি মিয়াশ শেখ বলছিলাম । রবিনের চাচা ৷ কালই দেখা হয়েছে আমাদের ।
-জ্বী চিনেছি ৷ আপনাকে না চেনার কারণ নেই!
-চেনারও কোনো বিশেষ কারণ নেই ।
-হাসালেন! অবশ্যই আছে । বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই চেনে আপনাকে । তবে এই অধমকে ফোন দিলেন হঠাৎ?
-অধমের স্ত্রীর সাথে কথা বলার জন্য ।
.
মিয়াজ শেখের কথায় নিশ্চুপ হয়ে গেলো ফাহাদ ।
তিনি হেসে বললেন-
আমি মজা করলাম! আমি পৌষীর সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম । আসলে কাল ওর সাথে কথা বলে ভালো লাগলো ।
-পৌষী ঘুমিয়ে পড়েছে ।
-ওহ আচ্ছা! তাহলে তোমার সাথেই বলি ।
-জ্বী ।
-পৌষীকে নিয়ে আমার বাসায় আসো কাল । আমার মিসেস ভালো চা বানাতে পারে ।
-কাল না! আমার অফিস আছে । আমি জানাবো আপনাকে ।
-ঠিক আছে । আমি মেসেজে আমার বাসার ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছি । এসো কিন্তু অবশ্যই ।
-ইনশাআল্লাহ ।
.
পৌষীর দিকে চোখ পড়তেই ফাহাদ দেখলো, তার মনোযোগ এখনো টিভিতেই ।
এই অনুষ্টান শেষ না অব্দি তাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করেছে সে । তাই পৌষীকে ডাকলোনা ফাহাদ । তবে মিয়াজ শেখ কেনো পৌষীর প্রতি এতো আগ্রহ দেখাচ্ছেন?
পৌষীকে কিছু বলতে চেয়েও বললোনা ফাহাদ । নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো সে ।
.
.
ঘড়িতে সময় রাত ১টা…
পৌষীর চোখে ঘুম নেই । বিছানার ঠিক মাঝখানে বসে সে পেন্সিল দিয়ে ডায়েরির পাতায় ছবি আঁকছে ।
হঠাৎ ঘুম ভাঙলো ফাহাদের । পানি খেতে উঠে দেখলো, জগে পানি নেই । ডাইনিং রুমে আসতেই পৌষীর রুমের দিকে চোখ পড়লো তার । রুমের আলো জ্বালানো । এতো রাতে পৌষী করছেটা কি?
ফাহাদ ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে ।
ফাহাদ ভেতরে এসে দেখলো, পৌষী ছবি আঁকছে ৷ আরেকটু খেয়াল করতেই বুঝলো, ছবিটি উষ্ণ মাহমুদের ।
ভ্রু জোড়া কুচকে ফাহাদ প্রশ্ন করলো-
এতো রাতে পরপুরুষের ছবি আঁকার কোনো মানে হয়?
.
এতোরাতে ফাহাদকে নিজের রুমে দেখে অবাক হলোনা পৌষী । খুব স্বাভাবিকভাবেই বললো-
জেলাস?
-মোটেও না! ঘুম নষ্ট করে এটা করার কারণ কি বুঝলাম না ।
.
পৌষী ফাহাদের দিকে ছবিটি দেখিয়ে বললো-
আমি ভালো আঁকতে পারি তাইনা? তাইতো আপনি বুঝলেন, এটা উষ্ণ!
-তুমি আঁকতেও জানো, এটাও আজ দেখলাম ।
-আপনি চাইলে আপনারও একটা ছবি এঁকে দিতে পারি আমি ।
-কোনো দরকার নেই! ঘুমিয়ে পড়ো । অসুখ সেরেছে ২দিনও যায়নি ।
-এতো ভাবেন আপনি আমাকে নিয়ে!
-আমার উপরই তো ঝামেলা যায় ।
-সেটা হলে আর ভাবার দরকার নেই । আপনি যেতে পারেন ।
.
ফাহাদ নড়লোনা। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে সে বললো-
উষ্ণকে ভালো লাগে?
-বড় ভক্ত বলতে পারেন ।
.
কথাটি শুনে ফাহাদ পা বাড়ালো নিজের রুমের উদ্দেশ্যে ।
তার পথের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে পৌষী বললো-
সরি ফাহাদ! সময় আসেনি সবটা জানার ।
.
চলবে
.
বি:দ্র: উল্লেখিত কবিতাটি নিশা আপুর লেখা।