মিঠা রোদ পর্ব ২৬

0
2323

#মিঠা_রোদ
#পর্ব:২৬
#লেখা:সামিয়া_খান_প্রিয়া

“না আমি আপনার প্রাক্তন।না আপনার বর্তমান।তবে কেন প্রত্যেক দিন ঘন্টায় ঘন্টায় নিজের হয়ে জবাবদিহিতা করার জন্য ফোন করেন আমাকে?”

আসিফ মৃদু হাসলো।ক্লান্ত হয়ে থাকা শরীরটা চেয়ারে এলিয়ে দিলো,

“একজন সচেতন মন্ত্রী হওয়ার দরুণ দেশের নাগরিকের খোঁজ খবর নেওয়া কর্তব্য।তাছাড়া তোমাকে বোঝানোর জন্য চারটে বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি তাহিয়া।এতোদিনে তো পাহাড় কেঁটে পাথরও তৈরী করা যায়।”

“হায়া হীন কথাবার্তা।আপনার বয়স নিশ্চয় তোশামণির মতো নয়?”

“তা অবশ্য নয়।মেয়ে কোথায়?”

“বান্ধুবীর বাড়ীতে গিয়েছে।”

“তাদের চিনো?”

“হ্যাঁ।”

ক্ষণকাল দুজনে মৌন থাকলো।আসিফ যে ক্লান্ত তা খুব ভালোমতন উপলব্ধি হচ্ছে তাহিয়ার।কিন্তু একটা অদৃশ্য পর্দার আড়ালে রয়ে গিয়েছে তারা।

“ঘর পো ড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায় প্রবাদের অনুসারী তুমি তাহিয়া।অথচ দেখো মায়ানকে কিন্তু এতোদিন সময় দাও নি।চট করে বিয়ে করে নিয়েছিলে।সেই তো সংসারটা টিকলো না।কী লাভ হলো?অথচ আমি অভাবী অনাহারে থেকে গেলাম।”

“আমি নিশ্চয় কোনো খাদ্য বস্তু নই।যাই হোক মায়ানের কথা না উঠানো ভালো।”

“কেন নয়?জানো গতকাল মায়ানের সঙ্গে ফোনে কথা হলো।স্ত্রী,সন্তান নিয়ে প্যারিসে বেড়াতে গিয়েছে।আইফেল টাওয়ারের সামনে ফটোও তুলেছে।দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে।ইয়াং লাগছে।স্ত্রী ও সুন্দর।আসলে কী সব গরু জীবনে ভালো থাকে।কিন্তু কিছু ছোটখাটো গরু আছে যারা ভালো থাকতে ভয় পায়।”

থমথমে কণ্ঠে তাহিয়া জবাব দিলো,

“অপমান করার হলে সরাসরি করুন।এভাবে গরু বলবেন না।আমি চল্লিশ বছর বয়সী একজন নারী।কোনো টিনেজার নই।”

“সেটাই আমার মন্দ ভাগ্য।তবে টিনেজারের থেকে প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছি।ঠিক এই বয়সে ভাবা যায়?”

“আসলেও যায়না।অল্প বয়সী মেয়েদের এমনিতেও মাথা খারাপ থেকে।নিজের থেকে এতো বছর বেশী কাওকে কীভাবে যে পছন্দ করে বুঝে আসেনা।এমন মেয়েদের দেখতে পারি না আমি।”

নিশ্চুপ হয়ে গেলো আসিফ।কবীর ও তোশার মুখটা ভেসে উঠলো।সামনে ঝড়,টর্নেডো সব আসছে।এই কারণে সময় থাকতে তাহিয়াকে নিজের দিকে টেনে নিতে চায়।অথচ মানুষটা বুঝেও না।ওপাশের মানুষটা নিশ্চুপ দেখে তাহিয়া ডাকলো,

“আসিফ ভাই।”

“হু বলো।”

“খেয়ে নেন।আমি রাখছি।আর এতোবার ফোন করবেন না।”

আসিফ আচ্ছা বলে ধণাত্মক প্রতিক্রিয়া জানালো।তাহিয়া নিষেধ করার পরেও রাতে আরেকবার ফোন করবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো।এখন সে ভেতরে ভেতরে আসন্ন সময় নিয়ে চিন্তিত।

(***)

কবীরকে দেখে দৌড়ে তার কাছে গেলো টিকু।লোমশ তুলতুলে দেহটি দিয়ে পুরুষটির গায়ে এসে পড়ছে।মিষ্টি হেসে টিকুকে কোলে তুলে নিলো।বিড়ালটির সঙ্গে টুকটাক কথা বলার মাঝে তোশা সেখানে উপস্থিত হলো।গাঢ় দৃষ্টিতে মেয়েটিকে একবার অবলোকন করে গাড়ীতে গিয়ে বসলো।তোশা কিন্তু এমন অবহেলায় বিন্দুমাত্র দমে গেলো না।বরং মলিন মুখে গাড়ীতে উঠে বসলো।

“আমরা কোথায় যাবো তোশা?”

“মণি বললেন না যে।রাগ করে আছেন?”

“কোথায় যাবে সেটা বলো।কান্না করে মুখের অবস্থা করুণ কেন করেছো?কী এমন করেছিলাম আমি?”

“পাগলের ডাক্তারের কাছে যাবো।নিয়ে যাবেন?”

“সম্ভব না।কারণ আমি জানি তুমি সুস্থ।মিছে মিছে শুধু চিন্তা করে লাভ নেই।”

“রাগলে আপনাকে ভীষণ সুন্দর দেখা যায় কবীর শাহ।”

কথাটার বিপরীতে কবীর সৌন্দর্যের দুই চারটে বাক্য বলতে পারতো।কিন্তু ওইযে মাঝেমধ্যে মনের ভাবনাকে দমিয়ে রাখতে হয়।তা নয় ভীষণ বিপদ হয়ে যায়।

“আমি সুন্দর সেটা বহু পুরোনো কথা কমলা সুন্দরী।আমরা এখন গাজীপুর যাচ্ছি।”

“ওইযে আপনার সেই বাসায়?যেখানে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল?”

“হ্যাঁ।”

তোশা উচ্ছাসিত হয়ে হাত তালি দিয়ে উঠলো।অভিনয় দ্বারা মাঝেমধ্যে দারুণ কিছু পাওয়া যায়।না সে তার এই প্রতিভাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।

গাজীপুর পৌঁছাতে তাদের তিন ঘন্টার মতো সময় লাগলো।এই সময় পুরোটা দুজন মানুষ নিশ্চুপ ছিল।যেন নীরবে বোঝাপড়া চলছে।তোশা অবশ্য পাশে বসে থাকা মানুষটিকে বুঝতে পারছেনা।রেগে যে আছে তা স্পষ্টত।আচ্ছা রাগ দেখাবে কীভাবে? মা র বে না সেটা তোশা জানে।আবার মনে পড়ে গেলো।একবার চুল মুঠোয় ভরে ব্যাথা দিয়েছিল।

“বাড়ীটা অনেকদিন ধরে বন্ধ ছিল।দেখেশুনে ঢুকবে।”

“এইযে আমাকে নিয়ে নির্জনে এলেন ভয় লাগছে না কবীর শাহ?”

ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে উঠলো কবীরের।প্রশ্নটি কী তার শুধানো উচিচ ছিল না?গম্ভীর সুরে বলল,

“আমার ভয় কেন লাগবে?”

“আমি লাবণ্যময়ী রম্ভা।খুব বেশী দূরে থাকা দুষ্কর।অবশ্য আপনি তো মানুষ নয়।মহাপুরুষ।”

“সোফায় গিয়ে বসো।আমি মূলত তোমাকে এখানে কিছু কথা বলতে ডেকেছি।যদিও এসব বলতে বলতে আমার শক্তি প্রায় শেষ হয়ে আসছে।”

“তো কেন বলতে যান সবসময়?কেন মেনে নিতে পারেন না?আজ যদি আমার জায়গায় কোনো নিপিড়ীত নারী থাকতো তবে মহৎ হওয়ার জন্য এক চান্সে রাজী হয়ে যেতেন।চিনি তো পুরুষদের।”

তোশার কণ্ঠ বেশ উচ্চ শোনা গেলো।কবীরের ভেতর সুপ্ত অবস্থায় জমতে থাকা রাগ এবার আরো বড় হয়ে বের হয়ে এলো।

“চিল্লিয়ে কথা বলবেনা।বেয়াদব মেয়ে।তাহিয়া যদি সময় থাকতে শাসন করতো তবে আজ এমন পরিস্থিতি কখনো আসতো না।”

“করেনি শাসন।করবেও না।বরং আমি ভালোবাসার জিনিস।”

“চুপ ইডিয়ট।সোফায় গিয়ে বসো।খুব রাগ লাগছে আমার কিন্তু।”

তোশা নিশ্চুপে সোফাতে গিয়ে বসলো।মনে মনে সে ভীষণ বিমর্ষ হয়ে উঠলো।ভেবেছিল অতীতের মতোন আজ কিছু সময় অতিবাহিত করবে তারা।কিন্তু সেসব তো কিছু হচ্ছে না।বরং মন খারাপের বাক্সের ভার বেড়ে যাচ্ছে।কবীর নিজেকে শান্ত করার দরুণ পায়চারি করছে।গলায় সুন্দর করে লেগে থাকা টাইয়ের বাঁধন ঢিলা করে দিলো।তাকে দেখতে ছোটখাটো আগুনের গো লা লাগছে।তোশার মনে পড়ে গেলো সংগীত শিল্পী মমতাজের সেই বিখ্যাত গানের লাইনটি।’পোলা তো নয় যেন আগুনের গোলা’।কিন্তু আফসোস সেটা যদি এখন গায় তো কবীর তার হাতের ব্যায়াম তোশার গালে করতে পারে।মিনমিন কণ্ঠে যুবতী শুধালো,

“আমার খুদা লাগছে।শুনেনা ফুড পান্ডায় অর্ডার দেই।”

“সিরিয়াস একটি পরিবেশ তোশা।কীভাবে মজা করো?”

“তাহলে দেন আপনাকে খেয়ে ফেলি।”

“তুমি আমাকে বলো না যে খেয়ে ফেলার ভয়ংকর অর্থটি তোমার জানা নেই।”

কবীর এগিয়ে এসে তোশার সামনে বসলো।হাতের আজলায় ছোট্ট তুলতুলে মুখটা তুলে বলল,

“কেন এমন করো সবসময়?আমার সাথে তোমার যায় বলো?বুড়োতে কী মজা পেয়েছো তাই বলো?”

“ভালোবাসা চিনেন কবীর শাহ?”

“চিনিনা এবং চিনতেও চাইনা।শুধু আমার জীবন থেকে সরে যাও।চারটে বছর তো দূরে ছিলে।আবার কেন সব এলেমেলো করছো?”

অধর দ ং শ ন করে তোশা।অশ্রুপূর্ণ দৃষ্টি মেলে তামাটে পুরুষটিকে দেখছে।পোড়াখাওয়া কপালের ঘামগুলো হাত দ্বারা মুছে দিলো।

“আপনি চান আজীবন প্রথম চাওয়া পাওয়া কিংবা ভালোবাসা ছাড়া বেঁচে থাকি আমি?”

“প্রথম কিংবা শেষ প্রেম বলে কিছু হয়না তোশামণি।তুমি ভুল।ওয়াদা করো আমাকে আজকের পর সব ভুলে যাবে।যেমন এই কয়দিন চললো।”

“সম্ভব না।”

“আমার বয়স বেশী।দুদিন পর চামড়া ঢিলা হওয়া শুরু করবে।মজা নাও আমার সাথে?এসব ভালোবাসা তোমার মতো সুন্দরী মেয়ের কাছ থেকে পাওয়া আমার জন্য উপহাস বৈ কি কিছু নয়।আজ জিম করা,নিয়ন্ত্রিত খাদ্যভাস পাল্টে দিলে চলে যাবে সব।ধরো সম্পর্ক হতো।তোমার আশেপাশে আমাকে তুমি ঠিক দশ বছর পর সহ্য করতে পারবে?আমার স্পর্শ পারবে মেনে নিতে?”

তোশা জবাব না দিয়ে কাঁপা কাঁপা অধরযুগল তামাটে কপালে ঠেকালো।কবীর তৎক্ষনাৎ ছিটকে দূরে সরে গেলো।যেন এই মুহুর্তে কয়েক হাজার ভোল্টেজ তার শরীর দিয়ে বয়ে গেলো।

“এটা কী করলে তোশা?”

“আপনাকে দেখে লোভ সামলাতে পারিনি।ভীষণ আদুরে আপনি।কথা বলেন সুন্দর করে।যেন হাজার বছরের পুরনো কাব্য।কবীর শাহ আপনাকে নিয়ে বলতে গেলে দেখা যাচ্ছে আমার সময় শেষ যাবে।কিন্তু অনুভূতি মিটবেনা।”

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here