মায়ায় ভরা সেই দিনে পর্ব ৫

0
798

মায়ায় ভরা সেই দিনে
পর্ব ৫

রুমঝুম ঝুমঝুম আবেশনীয় মোহনীয় বৃষ্টির শব্দ। রাত থেকেই বৃষ্টির উত্তাল পাতাল। সকাল থেকেও ঝুম বৃষ্টির ছটা। স্নিন্ধ ধোয়ামোছা পরিবেশ। প্রকৃতি আজ গোসল করেছে। তাই বুঝি তাদের রূপের বাহার আজ ফুলেফেপে উঠেছে।
আফিয়া বেগম রাবেয়া হক রান্নাঘরে চিতই পিঠা করছেন সাথে হাঁসের মাংস। বৃষ্টির শীত শীত সকালে চিতই পিঠা আর হাঁসের মংস তো খুবই স্বাদনীয় একটা খাবার। তাছাড়া রোমেল দেওয়ান আর আসাদ হকের খুব পছন্দের। তারা বসার ঘরে বসে চা নাস্তা করছে আর বিভিন্ন আলাপ আলোচনা সাড়ছে।
আফিয়া বেগম অলক কে পাঠিয়ে রাজবীরদের সবাইকে ঘুম থেকে জাগানোর কথা বললেন। ব‍ৃষ্টি হলে রাজবীর ছোট বাচ্চাদের মতো গোঁ ধরে শুয়ে থাকে। তাই ফজর নামাজ পড়ে আবারো শুয়ে পড়েছে সবগুলা। অন‍্য দিন ব‍্যায়াম করবে দৌড়াতে বের হবে। ছেলেটা হয়েছে একদম দাদার মতো। রাজবীরের মরহুম দাদা রাফেদ দেওয়ান ছিলেন এই ধাঁচের। বৃষ্টির দিন তাকে খাবারের জন‍্য ও তার ঘর থেকে বের করা সম্ভব হয়নি। তখন তার বেডরুমে খাবার দিয়ে আসতে হতো। তার কথা ছিল বউমা বৃষ্টি আসেই তো রহমত বর্ষন হয়ে। এই দিনে সব বাদ দিয়ে ঘরে শুয়ে বসে আল্লাহ্কে ডাকো তার ইবাদত করো ঘুমাও। আফিয়া বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মন দিলেন। তার শ্বশুর ছিলো ভিষণ ভালো একজন মানুষ।
◆◆ ◆◆
অলক নেমে আসলো।আফিয়া বেগম টেবিল সাজাচ্ছেন। অলকের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি হানলেন তিনি।
বড় আম্মা হেরা তো মোড়ামুড়ি করতাছে। আমারে রাগ দেহাইলো।
রাবেয়া হক পাশ থেকে হেসে ফেললেন বললেন। থাক আপা আর একটু ঘুমাক।
কি বলো রাবেয়া। গরম গরম না খেলে মজা পাবে দাঁড়াও তোমার ভাইকে পাঠাচ্ছি।
রোমেল দেওয়ান ছাদে উঠে আসলেন ছেলের ঘরের সামনে এসে কলিংবেল টিপলেন। রাজবীর তার বন্ধুদের অলকের ডাকেই ঘুম ভেঙ্গেছে। তাও আরামদায়ক বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। কলিং বেলের শব্দে ধড়ফড় করে উঠে বিছানা ছাড়লো রাজবীর। বাবা বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। তার বাবা ছাড়া কলিং বেল আর কেউ চাপে না। গায়ের গেঞ্জি প‍্যান্ট হাত দিয়ে ঠিক করলো। সাথে চুলের ভিতর হাত বুলিয়ে চুল গুছালো। দরজা খুলে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দিলো।
রোমেল দেওয়ান মৃদু হেসে সালামের উত্তর দিলেন। রাজবীর এক পাশে সড়ে দাঁড়ালো। সুন্দর করে বললো ভিতরে আসুন আব্বা।
না বাপ ভিতরে যাবো না তোমরা ফ্রেশ হয়ে নিচে আসো অপেক্ষা করছি আমি।
রাজবীর মাথা নাড়লো বললো জি আব্বা

দশ মিনিটের মধ্যে টেবিল লোক সমাগমে ভরে উঠলো। রাজবীর তার বন্ধুরা একসাথে পাশাপাশি বসেছে। তাদের সামনে রোমেল দেওয়ান আসাদ হক আফিয়া বেগম রাবেয়া হক বসেছেন।ইশিতা এখনও আসেনি। সোমা এসে চায়ের ফ্লাক্স টেবিলে রেখে গেলো। আফিয়া বেগম হটপট থেকে গরম তুলতুলে সাদা চিতই পিঠা সবার প্লেটে তুলে দিলেন। ছোট ছোট বাটিতে মাংস তুলে দিয়ে সবার টা সার্ভ করলেন। বন্ধুদের দলটা লোভনীয় হাসলো সকালের নাস্তায় তারা সন্তুষ্ট। ইশিতা নেমে আসলো টেবিলে বসে গুড র্মনিং জানালো সবাইকে। আসাদ হক খেতে খেতে রাজবীরের দিকে তাকালো। ছেলেটা সবদিক থেকে পার্ফেক্ট।সব ঠিকঠাক থাকলে খুব জলদি তারা বিয়ের কাজ টা সেড়ে ফেলবেন। তবে মনের কোনে কোথায় যেন একটা কিন্তু থেকেই যায়। রাজবীর কি এখন বিয়েতে রাজি হবে? তিন বছর পূর্বের কথা তুলবে না তো আবার। এই জেনারেশনের মেয়ে ছেলেদের বুঝা বহুত দায়। রাজবীর ছেলেটা কে হুট করে পড়া যায়না। দেখতে শুনতে আদব কায়দা আচার আচরণ সব কিছুইতে যোগ‍্যতা সম্পূর্ণ একজন ছেলে। এরকম একজন ছেলের কাছে সব মেয়ের বাবারাই কন‍্যা সমাপন করতে চাইবে। আসাদ হক এসেছেন মাত্র কয়েকদিন এর মধ্যেই রাজবীরের জন‍্য ভীষণ ভালো ভালো মেয়ে পক্ষ হতে সমন্ধ আসছে। রোমেল দেওয়ান তা নাকচ করে দিচ্ছেন। তবু ও লাখ লাখ টাকার প্রোলোভন দেখিয়ে তারা পিছনে ছুটছেন। এরকম ছেলে হাজারে একটা হয়। যে যার সামর্থ‍্য অনুযায়ী চেষ্টায় মত্ত। তাদের ধারণা মেম্বার সাহেব জণ দরদি মানুষ মন গললে রাজি হতেও পারেন। তারা তো আর জানেন না মেম্বার সাহেব বহু আগেই তার ছেলের জন‍্য আসাদ হকের কাছে মেয়ের হাত চেয়ে আছেন।
রাজবীরের চোখ পড়লো তার দিকে তাকিয়ে থাকা আসাদ হকের দিকে ভদ্র হেসে আংকেল কিছু বলবেন জিজ্ঞাসা করলো সে।
হ‍্যা ইয়ে তা আজ তোমাদের প্ল‍্যান কি কোথাও যাবে নাকি?
রাজবীর মৃদু হেসে মাথা নাড়লো বললো বৃষ্টির দিন কই বেরোবো। বাসায়ই থাকবো।
ইশিতা তাকায় রাজবীরের দিকে বলে কাল তো বললেন নদীতে ঘুরতে যাবেন
বৃষ্টি হচ্ছে বৃষ্টির দিন নদীতে ঢেউ অনেক।তুমি জিসান জিহাদ সাঁতার কাটতে জানো না। রিস্ক হয়ে যায়। আর এমনিতেও ঘুরে ভালো লাগবে না বৃষ্টির জন‍্য সব স‍্যাঁতসেতে। বন্ধুদের সবাই হ‍্যা হ‍্যা করে উঠলো বললো বৃষ্টির দিন বের হবো না। ঘরে থেকে মুভি দেখবো। এটাই জোস হবে।
ইশিতার মুখে মলিন ছঁটা পড়ে। আফিয়া বেগম সেদিকে লক্ষ্য করে রাজবীরকে বলেন।
বৃষ্টি কমলে নৌকায় করে ঘুরে এসো সবাই আশেপাশে ভালো লাগবে।
ইশিতা খুশিতে ডগমগিয়ে উঠলো বললো আচ্ছা আচ্ছা।
রাজবীর ইশিতার পাগলামি দেখলো বললো ব‍ৃষ্টি কমুক।পরে বের হবো নে।
রাবেয়া হক বিরক্ত হয়ে মেয়ের দিকে চাইলেন বললেন ছেলেগুলো কে বিরক্ত করছো কেন ইশিতা। ওরা যখন যাবে তখন নিয়ে যাবে তো।
ইশিতা রাজবীরের দিকে আদুরে ভঙ্গিতে তাকালো চোখ দিয়ে তার আম্মুর দিকে ইশারা করলো। রাজবীর বুঝলো ওর দিকে চেয়ে চোখ টিপে মাথা নাড়িয়ে রাবেয়া হকের দিকে তাকালো। বললো
কি বলছেন আন্টি এখানে বিরক্তির কি হলো। কোন ব‍্যাপার না। আশেপাশে নৌকায় করে ঘুরতে কোন সমস্যা হবে না। আর আমরা পদ্মা নদীর ঐ পারে বাহাদুরপুর, মোহনপুর ঘুরতে যাবো স্টীল বডি করে। কাল পরশু বৃষ্টি না হলে যেতে পারবো বৃষ্টি হলে প্ল‍্যান ক‍্যানসেল করতে হবে। তাই এখন আশপাশ ঘুরি ওর ও ভালো লাগবে। আমাদের ও
রোমেল দেওয়ান সহমত প্রকাশ করলেন বললেন তাই বেশ তাই বেশ।
বন্ধুদের মতও ঘুরলো বললো তাহলে তো খুব ভালো হলো নৌকায় ঘুরে নদীতে গোসল করে ফেলবো কি বল রাজবীর?
আচ্ছা ভালো তবে জ্বর ঠাণ্ডা হলে আমার ঘরে তোমাদের জন‍্য বন্ধ। এতো দ্রুত মরার ইচ্ছে নাই আমার।
রাজবীরের দুষ্টুমি তে টেবিলে বসে থাকা সবাই হুু হা হাসিতে ফাটলেন।
_______________________
বেলা এগারো টার দিকে বৃষ্টি কমলো। অলক নৌকায় পাটি বিছিয়ে বসে সে বৈঠা বাইবে। ইশিতা নীল থ্রি পিস পড়নে। চুল গুলো বিনুনী করা। ওড়না শালীন ভাবে গায়ে ছড়ানো। কানে ছোট সাইজের সাদা পাথরের ঝুমকো। মেয়েটাকে মেঘলা দিনে মেঘ কন‍্যার মতো সচ্ছ সুন্দর লাগছে দেখতে। বন্ধুদের সবাই নৌকায় উঠে বসলো। রাজবীর উঠে হাত বাড়িয়ে দিলো ইশিতার দিকে। ইশিতা সাবধানে উঠে আসলো। নৌকা ঢুলে উঠতেই সে ভয়ে রাজবীরের বাহু খামচে ধরলো। ওর অঙ্গি ভঙ্গিমায় সবাই খুব করে হাসলো। রাজবীর আস্তে করে নৌকার মধ‍্যখানে ওকে বসিয়ে দিলো। অলক নৌকা বাইতে শুরু করেছে। নৌকা হেলে দুলে চলছে। মৃদু ঠান্ডা বাতাস নদীতে কচুরিপনা ভাসছে। নদীর দুই পাশে সবুজ গাছ পালা ভরপুর। মাঝ খানে শান্ত নদীর অথই পানি। আখ ক্ষেতের শাড়ি সবুজের সমারোহ সেকি শোভনীয় রূপ প্রকৃতির। ইশিতা দু নয়ন ভরে দেখছে চারদিকে। সবাই যখন প্রকৃতির পরিবেশ দেখতে ব‍্যাস্ত রাজবীর তখন ইশিতাকে দেখতে ব‍্যাস্ত। কি কারন কি জন‍্য সে জানে না তবে তার এই সরল মিষ্টি হাসির মেয়েটাকে দেখতে ভালো লাগে। অপলক চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। এটা কি ভালোলাগা নাকি ভালোবাসা বা মায়া কি তা রাজবীর জানতে চায় না। তার ভালোলাগে ব‍্যাস। অনেকক্ষণ ঘুরেফিরে নৌকা নিয় ফের ঘাটে আসলো। নৌকা থেকে নেমে ইতরদের বাঁদরামী শুরু হলো লাফিয়ে দাপিয়ে। সাঁতার কাটা। কি ফাজলামি তাদের। ইশিতা বড় কড়ই গাছের নিচে বসে বসে ভিডিও করছিলো। রোহান দ্বায়িত্ব দিয়েছে তাকে। রাজবীর নৌকায় বসে পা ভিজিয়ে রেখেছে নদীতে সে এখনও নামেনি পানিতে। আকস্মিক পায়ে টানে পড়াতে হকচকিয়ে উঠে রাজবীর । কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই তার স্থান হয় পানিতে। হো হো হাসিতে ভারি হয়ে উঠছে নদীর ঘাট। ইশিতা খিলখিলিয়ে হাসছে। এই ছেলেগুলা এতো পাজি কেন?
বহু হুরুমদারুম শেষে বাড়ি ফিরলো সবাই। দুপুরের মেনুতে মেঘলা দিনে খিচুড়ি, মাংস, ইলিশ ভাজার মজাদার ভোজন সেড়ে ভাত ঘুমে কাদা হয়ে পড়লো রাজবীর তার বন্ধুরা। বৃষ্টির দিন কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমের মতো আর কিছু হয় নাকি।

চলবে
জান্নাত রেশমি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here