মায়ায় ভরা সেই দিনে
পর্ব ১
ছিমছাম ছোট্ট একটা গ্রাম খাসকান্দি। মুন্সীগঞ্জ জেলায় অবস্থিত ছোট স্বপ্নের গ্রাম। হাজার খানিক লোকে জমজমাট তা। ক্ষেত খামার পদ্মার শাখা বেয়ে আসা গাং নিচু নিচু যায়গায় বর্ষায় পানি এসে চিকুন খাল হয়ে রয়েছে একেক স্থানে। গ্রামের অবলা মূর্খ লোকের ভাষায় যা চিমা খাল নামেই পরিচিত। আখ ক্ষেত এর গা ঘেঁষে ছড়ানো ছিটানো যায়গায় বড়বড় ঘাাঁসের মাথায় সাদা ছোট্ট ঘাসফুল । শরৎ এর কাশফুলের সেকি অপারূহ্ মেলা কি শান্ত সৌন্দর্যের অপূর্ব লিলা প্রভুর। এই গ্রামের মেম্বার হচ্ছেন রোমেল দেওয়ান। সাদা মনে কঠোর নীতিবান একজন মানুষ। তার সৎ ব্যাবহার আর অমায়িক আচরণে পুরো গ্রামের মানুষ তার উপর সন্তুষ্ট। সাধারণত রাজনীতি অর্থ গ্রামের লোকদের কাছে ঘোলাটেই বটে। তারা তাদের অসহায় মুহূর্তে চেয়ারম্যান মেম্বারের সহযোগিতা পান না। ঐ এক ভোটের সময়ই যা উপরি দরদ। তবে সেই হিসেবে এই মেম্বার রোমেল দেওয়ান তাদের কাছে ফেরেশতার ন্যায়। গ্রামের হতদরিদ্র লোকদের দোয়ায় সর্বপ্রথম তার নামটাই আসে। সে রাজনীতি ছাড়া একজন বড় ব্যাবসায়ী। নিজের কানি কানি জমি তে আলু, মরিচ, ধান, পাট, পেঁয়াজ, রসুন লোকদের দিয়ে চাষ করান তিনি পরে এগুলো নিজের আড়ৎ এ সংরক্ষন করে তা ঢাকার বড় আলু বাজারে তা বিক্রি করেন। প্রচুর টাকা পয়সার মালিক তিনি তাও অহংকার এর লেশ মাত্র নেই তার ভিতর। ঢাকার কারন বাজারেও তার নিজের তিনটে দোকান রয়েছে। তিন সন্তানের পিতা রোমেল দেওয়ানের মন মায়ায় ভরা তার। বড় দুই মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন আরো বছর কয়েক আগেই। একমাত্র ছেলে রাজবীর দেওয়ান যেন বাবারই প্রতিচ্ছবি বা তার থেকে ও এগিয়ে। সুদর্শন লম্বাটে ছেলেটাকে প্রথমে দেখলে বিদেশি বলে ভ্রম হয়। ঢাকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে এখন বাবার ব্যাবসা বাণিজ্যিক বিষয়ে হাত দিয়েছেন। রোমেল দেওয়ানের স্ত্রী আফিয়া বেগম একজন র্ধার্মিক মহিলা।
রোমেল দেওয়ান চারটা গরু কোরবানি করেছে এই ইদে। তার বড় বাড়ির আঙ্গিনায় মানুষের সেকি মেলা। সব মানুষদের আত্বীয় স্বজনদের গরুর মাংস পাঠিয়ে পরে একটু সস্তির শ্বাস ফেললেন। বয়স হয়েছে
ভাড়ী কাজকর্মের ধকল শরীরে কি নিতে পারে?
আফিয়া বেগম রান্নাঘরে ব্যাস্ত। বড় বড় ঢেক পাতিলে রান্না চড়িয়েছেন তিনি। এলাকার মান্যগণ্য লোকের সমাগমে আজ পুরো হম্বিতম্বি কান্ড।
কাজের ছেলে অলক দৌঁড়ে বাড়ির ভিতর আসলো। জোড়ে হাঁক ছাড়লো বড় আম্মা ও বড় আম্মা চাচায় কইছে জলদি কইরা বারো কাপ দুধ চা কইরা দিতে লগে একটা রং চা চিনি ছাড়া। কোন বেডার লগে জানি ডায়বেটিক আছে হেতের লিগা।
আফিয়া বেগম ব্যাস্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো মুখে বললো দিচ্ছি দিচ্ছি একটু অপেক্ষা কর।
অলক তার স্বরে বললো জে আম্মা
আফিয়া বেগম বিরক্ত হলো এই ছেলেটা কবে যে একটু সুন্দর ভাষায় কথা বলবে? কত করে বলেন একটু সুন্দর মতোন কথা বল কে শুনে কার কথা
কাজের মহিলারা হাতে হাতে সাহায্য করছেন আফিয়া বেগম কে। এত এত কাজ তো তার একার দ্বারা সম্ভব না।
ওনি দুধের কেটলি গ্যাসের চুলোয় বসিয়ে অলকের দিকে ফিরলেন। বললেন কিরে তোদের নবাব পুত্র কোথায়? সেই যে গরু কাটার পর বন্ধুদের নিয়ে বের হলো আর তো তার টিকিটির নজরও এলোনা। কোথায় সে??
অলক তার দাঁত গুলো বের করে হাসলো বললো আম্মা হেয় তো শহরের ভাই সাব গো লইয়া গ্রাম ঘুরতে গেছে।
আফিয়া বেগম তার জ্বলন্ত চোখে তাকালেন চেতে উঠে বললেন তার গ্রাম ঘোরা হয়নি এখনও সেই কোন সকালে বেরিয়েছে। আজকের দিনে তো তার বাড়ি থাকা উচিত। এই যে একটু পর পর লোকজন আসছে তারা এসেই তো জিজ্ঞেস করছে মেম্বার সাব রাজবীর কই? একটু ঘনিষ্ঠ লোকেরা ভাইরবেডা কই বলে বলে মুখে ফেনা তোলছে। বসার ঘর থেকে একটুপর পরই রোমেল দেওয়ান তাকে ফোন দিচ্ছেন। ছেলে কখন আসবে জানতে চাচ্ছেন অথচ নবাবপুত্রের সেখানে কোন খবরই নেই। শহর থেকে এসে কয়টা বাঁদর জুটেছে লাল সাদা চুল ওয়ালা। কি হুরুমদারুম তাদের আল্লাহ্ গো। মনে হয় লন্ডন থেকে এসেছে একেকটা। কথায় কথায় ইংরেজি আর কি পোশাকের বাহার। তারা গ্রাম দেখবে যেন জীবনে দেখেনি হুুহ
চায়ের কাপের ট্রে অলকের হাতে তুলে দিয়ে পুনরায় রান্নায় মনযোগ দিলেন আফিয়া বেগম। ছেলের কান্ডজ্ঞান দেখে হতবাক তিনি।
_________________________
আসাদ হক সাহেবের ব্যাস্ত একটা দিন কাটল আজ ইদের দিন অনেক ঝামেলা। ড্রয়িং রুমে স্ত্রীর সাথে বসে বসে গল্প করছেন তিনি। ঢাকা কেরাণীগঞ্জ নিজ বাড়িতে বসবাস করেন তিনি ফ্যামিলী নিয়ে। ছেলে তার বউ কে নিয়ে শশুর বাড়ি গিয়েছেন বিকেলে।
গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে আসলো ইশিতা।মা বাবার দিকে তাকিয়ে চমৎকার সুন্দর হাসিটা হাসলো সে। বললো কফি করবো আমার জন্য তোমাদের চাই?
আসাদ হক মেয়ের দিকে তাকালেন লাল জামদানি শাড়ি পড়েছে মেয়েটা। হলুদ চন্দন রঙ্গের গায়ে তা ফুটে উঠেছে। ইস্ কি সুন্দর অপরূপ লাগছে দেখতে মাশাল্লাহ্।
হ্যা চাই তো মা করে দেবে ছেলে মেয়ের তো চাই।
ইশিতা ফের মিষ্টি হাসি হাসলো। হাসলে তার ঠোঁটের দুই কোনে গর্ত হয় তখন ভাড়ি চমৎকার মিষ্টি দেখায় মেয়েটাকে।
চটজলদি কফি করে মা বাবা কে তাদের টা দিয়ে উপরতলায় পা বাড়ালো ইশিতা।
পেছন থেকে শাসালেন রাবেয়া হক। ইশিতা খবরদার ছাদের দিকে পা বাড়াবেনা।
ইশিতা তার সুন্দর টানা চোখ নিয়ে বাবার দিকে চাইলো তার দৃষ্টির মানে হচ্ছে বাবা দেখেছো। আম্মুকে কিছু বলো।
আসাদ হক মেয়ের মনোভাব বুঝতে পারলেন। আদুরে গলায় বললেন যাও আম্মু তুমি কোথায় যাবে যাও।
রাবেয়া হক অসন্তোষ নিয়ে তাকালেন স্বামীর দিকে।
ইশিতা বিশ্বজয়ের হাসিটা হাসলো।ছাদের দিকে যাত্রা তার অব্যাহত থাকলো। ছাদের খোলামেলা যায়গায় প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিলো সে। ছাদে রাখা স্টীল এর দোলনাটায় বসলো সে চারদিকে তাকিয়ে দেখে দেখে কফিতে সীপ নিচ্ছে সে। ছাদে রাখা টবের গোলাপ গাছটায় কলি থেকে ফুল বেরিয়েছে। বাতাসের ঝাপটায় মিষ্টি গন্ধ নাকে ঠেকছে। মন শরীর চাঙ্গা হয়ে উঠছে।এমনিতেও মনটা ভালো তার। অনেক দিন বাদে কাল গ্রামে বেড়াতে যাবে তারা। তার বাবার বন্ধুর বাসা মুন্সীগঞ্জে। শহরে থাকতে থাকতে দম বন্ধকর অবস্থা একটু গ্রাম থেকে ঘুরে এলে মাইন্ড ফ্রেশ হবে। ঘুরাঘুরি করা ইশিতার পছন্দের। তা যদি হয় গ্রামঞ্চলে তাহলে তো কথাই নেই। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সে। কেরাণীগঞ্জের একটা সরকারি কলেজে পড়ে সে। বর্তমান সময়ের দুরবস্থার জন্য যা বিগত দিন যাবত বন্ধ। আর এতে করে হাতে প্রচুর সময়। যখন যা খুশি করা যায়। একমাত্র মেয়ে হবার সুবাধে বাবার আদরের দুলালি সে। বড় ভাই ইশতিয়াক ও বোনকে মাথায় করে রাখে। মার্স্টাস কমপ্লিট করে একটি মাল্টিনাশনাল কোম্পানি তে ম্যানেজার পদে আছে সে। ভালো বেতনের চাকুরী। পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করেছে। দাম্পত্য জীবনে সুখী একজন মানুষ তার ভাই।
টুং করে একটা টোনের শব্দ হলো ফোনে। মোবাইলে ম্যাসেজ এসেছে। অত জরুরি মনে হয় না। আজকাল অসংখ্য ম্যাসেজ সিম কোম্পানি থেকে আসে। কপাল কুঁচকে একটু ভাবলো ইশিতা। সে কি ম্যাসেজ দিতে পারে। কফির মগ হাত থেকে দোলনায় নামিয়ে রাখলো। ফোন হাতে নিলো হ্যা যেমনটা ভেবে ছিলো ঐ অসভ্যটার ম্যাসেজ। একটা মানুষ এতটা ছ্যাচড়া হয় কি করে ভেবে পায়না ইশিতা। ছেলেটা ইশিতার বেস্ট ফ্রেন্ড এর কাজিন পাবেল। ইশিতাকে পছন্দ করে এবং ফোনে নানা ভাবে ডির্স্টাব করে। তবে ইশিতার তাকে অসহ্য ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। প্রেম টেম নিয়ে অত সিরিয়াস কখনই ছিলো না ইশিতা তবে এক্সপেরিয়েন্ট এর জন্য তার শখ হয়েছিল। পাবেল প্রোপোজ করার পর সে তার ভাবি কে বলেছিল ছেলেটা চেনাজানা আছে একটা চান্স দিয়েই দেখি না। ভাবি তখন কিছু বলেনি তবে এরপরের দিন ভাই ইশতিয়াক যখন বরফ শীতল গলায় বললো ইশিতা সব বিষয়ে তোমার স্বাধীনতা দিয়েছি তবে তোমার বিয়ের বিষয়টা আমরাই দেখবো। কখনো কোন রিলেশনে যেওনা।
ভাইকে যতটা না ভয় পায় তার চেয়ে বেশি ভালোবাসে ইশিতা। তাই পাবেল কে প্রত্যাখ্যান করেছে ইশিতা যা পাবেল মেনে নেয়নি। তাই তো একের পর এক ডিস্টাবনেন্স চালু রেখেছে। ফুস করে একটা নিশ্বাস ফেললো ইশিতা। তার একুশ বছরের জীবনে একটা প্রেমও তার দ্বারা হয়নি। ফ্রেন্ডরা দুষ্টুমি করে বলে কিরে ইশিতা তুই তো সুন্দর আছিস তবুও এখন পর্যন্ত একটা প্রেমও করলিনা। তুই তো সুন্দর জাতির কলংক রে। ইশিতা তখন খিলখিলিয়ে হাসে তার ভীষণ মজা লাগে তখন।
__________________________
রাজবীর তার বন্ধুদের নিয়ে গ্রামের আনাচে কানাচে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সে কি উল্লাস ছয় যুবকের। রাজবীরের জীপে ছয় বন্ধু ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে শুয়ে বসে হেলান দিয়ে আছে। গাড়ি করে যাবার সময় এক বাড়ির পাশে পেয়ারা বাগান দেখেছে। ব্যাস তখনই সব কটা বাঁদরের মতো লাফিয়ে দাপিয়ে এতোগুলা ছিড়ে এনেছে। বন্ধু মুন্না হাসলো ফাজিল হাসিটা। গানের সুরে বললো কি মামারা কেমন লাগে চুরির ফল?
চিকন ফর্সা লম্বাটে ছেলেটা রোহান গেজ দাতের ঝিলিক দেওয়া হাসি হাসলো বললো অসাম মামা অসাম।
একটু সময় কাটলো। ফর্সা মুখের তীক্ষ্ণ সরু নাকের লম্বা বিদেশীদের ন্যায় দেখতে রাজবীর এক ভ্রু উঁচালো। ঠোঁট বাকিয়ে বাঁকা হাসলো। সবার দিকে চেয়ে বললো শালারা আমার বাপজান জানলে জুতা পেটা করবো সবগুলারে।
জিসান জিহাদ ধরফরিয়ে উঠলো বন্ধুত্ব সম্পর্ক ছাড়া ও তারা দুজন আপন ভাই। জিসান ফর্সা মতন দেখতে একটু স্ব্যাস্থ ভালো মায়াবী ধারালো চেহারার গড়ন তার।জিহাদ শ্যামলা স্ব্যাস্থ ভালোই অসম্ভব মায়াময় চেহারা তার। তারা দুজনে ফিসফিসিয়ে রাজবীরের দিকে চেয়ে বললো কও কি মামা? আংকেল শুনলে কি করবো তখন?
রাতুল ফোন থেকে নজর সড়ালো। পেয়ারায় বাইট বসিয়ে পায়ের উপর পা তুলে দিলো। দেখতে কালো তবে নিদারুণ মায়ার মুখের হাসিটা অসম্ভব সুন্দর। আয়েশি ভঙ্গিতে বললো চিল মামা চিল।
অতপর সবগুলো ইতর হো হো হাসিতে ফেটে পড়লো। ইস্ বন্ধুদের সম্পর্কটা এতো সুখের কেন??
চলবে
জান্নাত রেশমি