মায়ারণ্যে ২

0
936

#মায়ারণ্য
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
#পর্ব-২

★একঝাক কাজিনদের আবদার পুরণ করে শেষমেশ নিজের বাসর ঘরে ঢোকার সুযোগ পেল অরণ্য। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলো বেডের ওপর ওর বউ ঘোমটা টেনে বসে আছে। অরণ্যের হৃৎস্পন্দন দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করলো। কাঙ্ক্ষিত খুশির দমকা হাওয়ায় ভরে গেল মনটা। আজ ফাইনালি অরণ্য ওর সন্ধ্যামালতীকে দেখতে পাবে। শুধু দেখতেই না হাত বাড়িয়ে ছুঁতেও পারবে। এখন যে সে তার বউ।তার পুরো অধিকার আছে এই মেয়েটার ওপর। কথাগুলো ভাবতেই মনের ভেতর অনুভূতিরা ডানা মেলে উড়ছে।

অরণ্য দরজা লাগিয়ে দিয়ে বেডের কাছে এসে মেয়েটার মুখোমুখি হয়ে বসলো।ঠোঁটে ঝুলছে তার প্রাপ্তির হাসি। রাজ্যের উৎসাহ আর খুশির সহিত মেয়েটার ঘোমটা টেনে ধীরে ধীরে উপরে তুললো অরণ্য। ঘোমটা পুরোপুরি তুলে মেয়েটার মুখদর্শন করলো সে। তবে রিয়াকে দেখে কেমন যেন ভ্রু কুঁচকে আসলো অরণ্যের। হঠাৎই ঠোঁটে ঝুলে থাকা হাসিটা গায়েব হয়ে গেল ওর। যদিও মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী। তবুও কেন যেন কিছু একটা মিসিং লাগছে অরণ্যের কাছে। মনের মধ্যে কেমন যেন অদ্ভুত ফিলিংস হচ্ছে। ব্যাপার টা অরণ্যের নিজেরও বোধগম্য হচ্ছে না। মেয়েটা তো সুন্দরী, তাহলে ওর এমন লাগছে কেন? ও কল্পনাতে ওর সন্ধ্যামালতীর যে চেহারা এঁকেছিল, এই মেয়েটার সাথে তার কোন মিল নেই। তাই হয়তো এমন লাগছে। অরণ্য রিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর চোখ দুটোও অন্যরকম। ওর সন্ধ্যা মালতীর মতো না। নাকি আজ সরাসরি দেখছি বলে এমন লাগছে? এসব ভাবতে ভাবতে অরণ্য হঠাৎই বলে উঠলো।
–তুমি কি সত্যিই আমার বউ?

অরণ্যের কথায় রিয়া চমকে তাকালো ওর দিকে। উনি এভাবে বলছেন কেন? উনি কি সব বুঝে গেল নাকি? এখন কি হবে? ভয়ে গলা শুঁকিয়ে আসছে ওর। কোনরকমে কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো।
–এ এটা আবার কেমন কথা?

অরণ্য ফট করে কথাটা বলে নিজেই থতমত খেয়ে গেল। এমন একটা কথা বলা যে ঠিক হয়নি তা বুঝতে পারছে ও। তাই জোরপূর্বক মুচকি হেসে বললো।
–সরি। আসলে একটু নার্ভাস হয়ে গেছিলাম তো, তাই কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলেছি বুঝতে পারিনি। আচ্ছা যাক বাদ দাও এসব। তুমি নিশ্চয় টায়ার্ড হয়ে গেছ। যাও এসব শাড়ী গহনা চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে এসো।

রিয়া মাথা নেড়ে উঠে গিয়ে কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে।

অরণ্যের এদিকে হঠাৎ করেই কেমন যেন অস্থির লাগছে। এতক্ষণ ওর মনে থাকা খুশিটা কেমন যেন চুপসে গেল। এমনটা কেন হচ্ছে নিজেও বুঝতে পারছে না ও। ওতো কতো আশায় ছিল, আজ ওর সন্ধ্যামালতীকে দেখবে। তার প্রতি ওর অনুভূতি গুলোর কথা বলবে। তাহলে এমন কেন লাগছে? কেন মনে হচ্ছে এই মেয়েটা আমার সন্ধ্যামালতী না। নাহ আমি হয়তো একটু বেশিই ভাবছি। হয়তো সামনাসামনি দেখছি তাই এমন মনে হচ্ছে।মনকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করলেও সেটা খুব একটা কাজে আসছেনা অরণ্যের। অরণ্যের কেমন দমবন্ধকর লাগছে। তাই ও ফ্রেশ হাওয়া নেওয়ার জন্য বেলকনিতে আসলো। বেলকনিতে রাখা আরাম করার বড়ো হেলানো চেয়ারে বসে পড়লো। হেলান দিয়ে বসে একটা সিগারেট ধরালো অরণ্য। সবসময় সিগারেট খায়না অরণ্য। তবে মাঝে মধ্যে টেনশন হলে দুই একটা খায়। সিগারেট টানতে টানতে ভাবতে লাগলো কিভাবে সন্ধ্যামালতীর দেখা পেয়েছিল অরণ্য।

গত দুমাস পূর্বে নিউইয়র্ক থেকে নিজের সব স্টাডি কমপ্লিট করে দেশে ফিরেছে অরণ্য মেহরাব। দেশে ফিরে নিজের ফ্যামিলি বিজনেসে জয়েন করে অরণ্য। এদিকে অরণ্যের পরিবারের সবাই ওর বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগে। অরণ্যও ওর পরিবারের খুশির জন্য রাজি হয়ে যায়। অরণ্যের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা শুরু করে দেয়। এতো এতো মেয়ে দেখে তবে অরণ্যের কোন মেয়ে তেমন পছন্দই হয়না।

অরণ্য আজ পর্যন্ত কখনো কোন প্রেমের সম্পর্কে জড়াইনি। এমন না যে ও প্রেম ভালোবাসা পছন্দ করেনা বা এগুলুতে বিশ্বাস করে না। আসলে ও আজ পর্যন্ত ওর মনমতো কাওকে পাইনি। যাকে নিজের প্রেমিকা বা বউ বানানোর ইচ্ছা জাগবে। ওর আশেপাশে যত মেয়ে দেখেছে সবার ওপর শুধু কৃত্রিমতার ছাপ।আজ পর্যন্ত যতগুলো মেয়ে ওর জীবনে আসতে চেয়েছে, সবই শুধু অরণ্যের বাহ্যিক সৌন্দর্য আর ওর আর্থিক অবস্থানের জন্য চেয়েছে। তবে আজ পর্যন্ত কোন মেয়েই ওর মনকে ছুঁতে পারেনি।

অরণ্য এমন কাওকে চায় যার মন হবে নিস্পাপ, পবিত্র। যার মাঝে থাকবেনা কোন কৃত্রিমতার ছাপ। চেহারা ফুরফুরে সুন্দর না হলেও চলবে। তবে তার মনটা যেন সুন্দর হয়। এমনিতেও ধবধবে সাদা মেয়ে তেমন পছন্দ না অরণ্যের। যদিও সে নিজেও ফর্সা। তবে এতো বছর বিদেশে সাদা মানুষের ভীড়ে থেকে থেকে কেমন যেন একটা অনিহা সৃষ্টি হয়ে গেছে ওর। অরণ্য ওর কল্পনায় মনে মনে নিজের ভবিষ্যত প্রিয়তমার আবছা একটা চেহারা বানিয়েছে। যেখানে মেয়েটা হবে শ্যামল বর্নের। তার চোখ দুটো বড় আর টানাটানা হবে। তার চোখের ভাষায় হাজার তাঁরা খেলা করবে। তার চেহারায় থাকবে প্রচুর মায়া। আর তার মনটা হবে ফুলের মতোই স্নিগ্ধ।

তবে ওর ফ্যামিলি যেসব মেয়ে দেখায় তাদের কাওকেই ওর সেই কল্প কন্যার মতো দেখায় না। তাইতো ওর মনেও ধরে না। পরিবারের সবাইও একটা হতাশই ভেতর পরে যায়। ছেলের বিয়ে নিয়ে তারা টেনশনে পড়ে যান।

এমনই একদিন একটা মেয়ে দেখে ফিরছিল অরণ্য। একটা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল মেয়ের সাথে কথা বলতে। প্রতিবারের মতোই এই মেয়েও ওর পছন্দ হয়নি। অরণ্য গাড়ি চালাচ্ছে আর ভাবছে,এতো কৃত্রিমতার ভীড়ে কোথাও কি ওর মনের মতো কেউ নেই? যাকে এক নজর দেখেই মনে হবে, হ্যা এই সে। এসব ভাবতে ভাবতে একটা সিগনালের সামনে এসে দাঁড়াল অরণ্যের গাড়ি। চারিদিকে সন্ধ্যার আভাস নেমে এসেছে।

অরণ্য আনমনেই রাস্তার পাশে তাকাতেই একটা দৃশ্য দেখে ওর চোখ সেখানে আটকে গেল। অরণ্য দেখলো একটা বোরখা পড়া মেয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তখনই ওর সামনে রাস্তায় এক শিশুকে বসে কাঁদতে দেখলো। শিশুটা একজন ভিখারিনীর। ভিখারিনী শিশুটাকে রেখে রাস্তার গাড়িওয়ালাদের কাছে গিয়ে ভিক্ষা চাইছে। আর শিশুটা বসে বসে কাঁদছে। ওই বোরখা পড়া মেয়েটা শিশুটার কাছে গিয়ে শিশুটাকে কোলে তুলে নিয়ে শিশুটাকে আদর করতে লাগলো। বিষয় টা দেখে অরণ্য অনেক টা অবাক হলো। আজকাল কার দিনে যেখানে সবাই এসব রাস্তার নোংরা বাচ্চাদের দেখলে নাক কুঁচকে নেয়। সেখানে এই মেয়েটা কত সুন্দর অনায়াসে শিশুটাকে কোলে তুলে নিল। অরণ্য আগ্রহ নিয়ে সবকিছু দেখতে লাগলো।

মেয়েটা এবার বাচ্চাটাকে রাস্তার পাশে চায়ের দোকানের এক ব্রেঞ্চের ওপর বসিয়ে দিল। নিজের ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর থেকে একটা পানির বোতল বের করে শিশুটির মুখ ধুইয়ে দিল। শিশুটিকে কিছু একটা বললো মেয়েটা,তখন শিশুটিও মাথা ঝাকিয়ে কি যেন বললো। অরণ্য সেসব শুনতে পেল না। তবে ওদের ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে পারলো মেয়েটা হয়তো শিশুটিকে কিছু খাবে নাকি তাই জিজ্ঞেস করেছে, আর শিশুটিও খেতে চাচ্ছে। মেয়েটা ওর ব্যাগের ভেতর থেকে পার্স বের করে চেক করছে। তবে পার্সে হাত দিয়ে দেখলো তেমন টাকা নেই হয়তো। তবুও যা আছে তাই দিয়েই শিশুটিকে একটা পাওয়ারুটি আর কলা কিনে দিল। শিশুটি খাবার দেখে অনেক খুশিমনে সেগুলো নিয়ে খেতে লাগলো। মেয়েটা শিশুটির দিকে তাকিয়ে ওর খাওয়া দেখছে। মুখে হিজাব বাঁধার কারণে মেয়েটার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। তবে মেয়েটার চোখের ভাষায় বোঝা যাচ্ছে শিশুটিকে খেতে দেখে তার মনে যেন এক পরম আনন্দ হচ্ছে।

বিষয় টা দেখে অরণ্য সত্যিই মুগ্ধ হলো। একটা ক্ষুদার্থ শিশুকে খাইয়েও যে পরম আনন্দ পাওয়া যায়। তা এই মেয়েটাকে না দেখলে হয়তো জানতই না। অরণ্য হঠাৎ মোবাইল বের করে সেই মুহূর্তের একটা ছবি তুলে নিল। নিজের এহেন কাজে নিজেই অবাক হলো অরণ্য। সে আজপর্যন্ত এমন কাজ কখনোই করেনি। কারও বিনা অনুমতিতে ছবি তোলাটা একটা অনৈতিক কাজ। আর যদি কোনো মেয়ে হয় তাহলে তো আরও বেশি অনৈতিক কাজ। এটা জানা সত্বেও কিভাবে এমন কাজ করে ফেললো ও? কি হয়ে গেল হঠাৎ করে আমার?

অরণ্য দেখলো একটু পরে শিশুটির মা ওখানে এলো। তার বাচ্চার এভাবে যত্ন নেওয়া দেখে সে মেয়েটার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিলেন। মেয়েটি ওর পার্সের যা অবশিষ্ট সামান্য কিছু টাকা ছিল সেটাও শিশুটির মায়ের হাতে দিয়ে দিল। তারপর শিশুটির মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের গন্তব্যের উদ্দেশে হাঁটা ধরলো৷ তখনই পেছন থেকে আসা হর্নের শব্দে অরণ্যের ধ্যান ভাঙ্গলো। অরণ্য সামনে তাকিয়ে দেখলো সিগনাল গ্রীন হয়ে গেছে। অরণ্য তাড়াতাড়ি করে গাড়ি টা একপাশের দিকে চাপিয়ে নিল। তারপর রাস্তার পাশ ঘেঁষে ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে মেয়েটাকে ফলো করতে লাগলো।

ও এসব কেন করছে তা নিজেও জানে না। তবে কেন যেন মেয়েটাকে নিয়ে কৌতুহল বাড়ছে ওর মনে। মেয়েটাকে নিয়ে আরও জানতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে ওর। কিছুটা পথ যেতেই অরণ্য দেখলো মেয়েটা রাস্তায় এক বৃদ্ধ লোকের হাত ধরে তাকে রাস্তা পার হতে সাহায্য করছে। বৃদ্ধ লোকটা খুশী হয়ে মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিল। তারপর আবার হাঁটতে লাগলো মেয়েটা। কিছুদূর গিয়ে একজন গর্ভবতী মহিলাকে অনেক গুলো বাজারের ব্যাগ নিয়ে যেতে দেখে মেয়েটি তার ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে তাকে সাহায্য করলো। এভাবে যেতে যেতে মেয়েটি সব অসহায় ব্যাক্তিদের সাহায্য করার চেষ্টা করছে । অরণ্য যত দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে মেয়েটাকে দেখে। এখনকার দিনেও এমন পবিত্র মনের মানুষ কেউ আছে সেটা দেখে অরণ্যের মনে এক অজানা অনুভূতিরা হানা দিল। তাহলে কি এই সেই মেয়ে যাকে আমি খুঁজে চলেছি? কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতর হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে গেল অরণ্যের। ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক প্রাপ্তির হাসির রেখা। ইয়েস ইয়েস ফাইনালি আমি পেয়ে গেছি। পেয়ে গেছি আমি আমার কল্পকন্যাকে। সি ইজ দা ওয়ান। আমার সন্ধ্যামালতী।

অরণ্য যখনই ভাবলো ও গাড়ি থেকে নেমে মেয়েটার কাছে কথা বলতে যাবে। তখনই হঠাৎ দেখলো মেয়েটা সামনের দোতলা একটা বাসার গেটের ভেতর ঢুকে গেল। অরণ্য একটু আপসোস করে মনে মনে বললো, ধ্যাৎ মেয়েটার সাথে তো কথাই বলতে পারলাম না। এখন মেয়েটার সম্পর্কে জানবো কি করে? অরণ্য দেখলো গেটের কাছে একটা দাড়োয়ান দাঁড়িয়ে আছে। অরণ্য গাড়ি থেকে নেমে ধীরে ধীরে দারোয়ানর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।মেয়েটার সম্পর্কে একেবারে সরাসরি জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে না। এতে সমস্যা হতে পারে। এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আগে কখনোই পরেনি ও। কিন্তু কথা না বললেও তো মেয়েটার সম্পর্কে জানতে পারবোনা। তাই কোনরকমে গলা খাঁকারি দিয়ে দারোয়ানের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–আচ্ছা এই বাড়িটা কার?

দারোয়ান বলে উঠলো।
— আপনাকে কেন বলবো? আপনি কে?

অরণ্য দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–আমার পরিচয় টা বেশি জরুরি নাকি তোমার লাভ টা?
কথাটা বলে অরণ্য একটা এক হাজার টাকার নোট দারোয়ানের হাতে গুঁজে দিল। দারোয়ানকে আর পায় কে। দারোয়ান দাঁত কেলিয়ে বললো।
–জ্বি এইটা তারেক রহমানের বাড়ি স্যার?

–আচ্ছা একটু আগে যে মেয়েটা ঢুকলো, ওই মেয়েটা কে?

–স্যার আমিতো আইজকা নতুন জয়েন করছি। তাই ওতো ভালো করে জানিনা। তবে শুনছি তারেক স্যারের নাকি একটা মেয়ে আছে। ওই আপাই হবে।

অরণ্য আর কিছু না বলে ওখান থেকে চলে এলো। সেদিন বাড়িতে এসে সারারাত শুধু সেই সন্ধ্যামালতীর কথাই ভেবেছে। সারারাত একফোঁটাও ঘুমাতে পারেনি ও। মেয়েটার চেহারা কল্পনা করতেই ওর সেই কল্প কন্যার সাথে কেমন মিলে যাচ্ছে। অরণ্য বুঝতে পারছে ও ওর সন্ধ্যামালতীর প্রেমে পড়ে গেছে। না দেখেও কারোর প্রেমে পড়া যায় তা ওই মেয়েটাকে না দেখলে হয়তো জানতেই পারতো না। তখনই অরণ্য সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, বিয়ে করলে সে এই মেয়েকেই করবে। এই সন্ধ্যামালতীই হবে ওর জীবন সঙ্গী। ওর প্রিয়তমা মনের রাণী।

পরেরদিন অরণ্য ওর বড়ো বোন ইরিনকে সবকিছু খুলে বলে। ইরিন সব শুনে অনেক খুশী হয়ে যায়। আর বাড়ির সবাইকে বলে কথাটা। সবাই আনন্দে আত্মহারা। শেষমেশ তাদের ছেলের কাওকে পছন্দ হয়েছে। তাই ওরা আর দেরি করতে চায়না। পরেরদিনই অরণ্যের মা বাবা আর চাচা চাচী অরণ্যের বলা ঠিকানা অনুযায়ী সেই বাড়ি পৌঁছে যায়। মেয়ে দেখে তাদেরও পছন্দ হয়। মেয়ের মা বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তারাও সানন্দে রাজি হয়ে যান। পরে আনুষ্ঠানিক ভাবে ছেলে মেয়ে দেখানোর পর্ব সারতে একটা ডেট দেওয়া হয়। সেদিন অরণ্য সহ বাকি সবাইও যাবে মেয়ে দেখে বিয়ের কথা পাকাপোক্ত করতে।

তবে সেই দিনে হঠাৎ অরণ্যের বিজনেসের একটা জরুরি কাজ চলে আসে।যার জন্য ওকে তিনদিনের জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে। তাই অরণ্য মেয়ে দেখতে যেতে পারবেনা। এটা শুনে বাকি সবাই ডেট পিছিয়ে দিতে চায়। তবে অরণ্য ভাবে নিয়তি হয়তো এটাই চায়। তাহলে তাই হোক। আমি আমার সন্ধ্যামালতীকে একেবারে আমার বধূ রুপেই দেখবো। বিয়ের রাতে যখন প্রথম বার ওর সন্ধ্যামালতীর মুখদর্শন করবে সেই মুহূর্ত টা হবে সবচেয়ে অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। তাই এর আগে আর তাকে দেখবো না আমি। এসব ভেবে অরণ্য ওর ফ্যামিলিকে বলে তারা গিয়ে যেন বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেলে। ও দেশে ফিরেই বিয়ে করবে। অরণ্যের কথামতো ওর পরিবার তাই করে। ওরা গিয়ে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে আসে। ওরা অরণ্যের ফোনে মেয়ের ছবি পাঠাতে চায়। তবে অরণ্য তাতেও মানা করে দেয়। সে মনে মনে ভেবে নিয়েছে সে কোনভাবেই বিয়ের আগে তার সন্ধ্যামালতীকে দেখবে না। এমনকি ফোনেও কথা বলবে না। একেবারে বিয়ে করেই দেখবে।

ব্যাপার টা হয়তো অনেকের কাছে ছেলেমানুষী বা ফিল্মি মনে হবে। তবে অরণ্য এই ব্যাপার টা এনজয় করতে চায়। সবাই তো দেখে বিয়ে করে। তবে ও না দেখেই বিয়ে করতে চায়। এটাতেও এক অন্য রকম অনুভূতি আছে। প্রিয়তমাকে দেখার আকাঙ্ক্ষা মনে পুষে রাখা। সেই মুহূর্ত টার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা। আর ফাইনালি সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত টা আসা। এটার মজাই অন্যরকম। যেটা সব মানুষ বুঝতে পারবে না।

আর সেই ভাবনা অনুযায়ী অরণ্য তিনদিন পরে দেশে ফিরে আজ বিয়ের পীড়িতে বসে পড়ে।

তবে আজ যখন সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত টা এসেছে তাহলে এমন লাগছে কেন আমার? কেন কিছু একটা মিসিং লাগছে আমার? না দেখে বিয়ে করে কোন ভুল করলাম নাতো? কিন্তু আমি তো কনফার্ম হওয়ার জন্য আপুর কাছে সন্ধ্যামালতীর সেই ছবিটা দিয়েছিলাম। যাতে কনফার্ম হয় যে রিয়াই সেই সন্ধ্যামালতী। আর আপু বলেছিল রিয়ার মা নাকি ছবি দেখে বলেছিল ছবির মেয়েটাই নাকি রিয়া। তাইতো আমিও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম। তাহলে আজ কেন মনে হচ্ছে এই মেয়েটা আমার সেই সন্ধ্যামালতী নয়? বিয়ের সময় যখন ওকে আমার পাশে বসানো হলো, তখনও তো মনে হলো যেন সন্ধ্যামালতী আমার পাশেই আছে। তাকে ফিল করতে পারছিলাম আমি। তার হাতটা ধরতেই যেন অনুভূতি গুলো নাড়া দিয়ে উঠেছিল। তাহলে এখন এমন লাগছে কেন? যাকে না দেখে ফিল করতে পারি, তাকে সরাসরি দেখে ফিল করতে পারছিনা কেন? নাহ আমি হয়তো একটু বেশিই ভাবছি। হতে পারে এই প্রথম সরাসরি দেখছি তাই এমন লাগছে। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।

হঠাৎ পেছন থেকে রিয়ার ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো অরণ্যের। রিয়া বলে উঠলো।
–আপনি এখানে কি করছেন? ভেতরে আসবেন না?

অরণ্য পেছনে তাকিয়ে দেখলো রিয়া একটা টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার লেগিস পড়েছে। রিয়ার এমন পোশাক দেখে অরণ্যের ভ্রু কুঁচকে এলো। ওতো ভেবেছিল ওর সন্ধ্যামালতী প্রচুর লাজুক স্বভাবের হবে। কিন্তু এর ভেতর তো লজ্জার ল ও দেখছিনা। যে মেয়ে বাইরে বোরখা পরে বের হয়। সে মেয়ে এতো মডার্ন হয় কিভাবে? অরণ্যের কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে ও ওর বউ না অন্য কোন মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অরণ্য কোনরকমে বলে উঠলো।
–তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি আসছি একটু পরে।

অরণ্যের কথায় রিয়া মনে মনে একটু অবাক হলো। চোখের সামনে ওর মতো এতো সুন্দর মেয়েকে দেখেও এমন চুপচাপ আছে কেন উনি? ওতো ভেবেছিল নিজের রুপের জালে ফাঁসিয়ে অরণ্যকে কোন বাহানায় বিয়ের কথা বলবে। কিন্তু এতো কোন ইন্টারেস্টই দেখাচ্ছে না। অগত্যা রিয়া রুমে এসে বেডে শুয়ে পড়লো।

অরণ্য একটু পরে আসার কথা বললেও সে ওখানেই বসে রইল।ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না। ওর সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না ও। এমনই এলোমেলো ভাবনার মাঝেই একসময় ব্যালকনিতেই ঘুমিয়ে পড়লো অরণ্য।
____

মায়া দুর্বলচিত্তে উঠে দাঁড়িয়ে কোনরকমে কাপড় চেঞ্জ করে বেডে এসে ক্লান্ত শরীরে শুয়ে পড়লো। অশান্ত চোখের পাতায় ঘুমের লেশমাত্র নেই। বারবার শুধু চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো ভাসছে। নিয়তির এই নির্মম খেলায় নিজেকে কোন রঙ্গমঞ্চের পুতুল মনে হচ্ছে। না চাইতেও শুধু মনের মাঝে একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। তার স্বামী নামক পুরুষ টা কি এখন রিয়াতে মেতে আছে? স্বামী? হ্যাঁ হাস্যকর হলেও এটাই সত্যি। আর কেউ না জানুক সেতো ঠিকই যে ওই লোকটা তার নামমাত্র হলেও তার স্বামী।

মায়া ভাবছে তখনকার কথা। বিয়ের আসর থেকে ওকে যখন বাসার ভেতর আনা হয়। রিয়া তখনও ফিরে আসেনি। মায়ার মামী মায়াকে ওর রুমে গিয়ে যা লাগবে গুছিয়ে নিতে বলে। মায়াও সেই কথা মতো নিজের রুমে চলে আসে। কিন্তু রুমে এসে মায়া কিছুতেই শান্তি পায় না। অস্থিরতা আর ভয়ে হাত পা কাঁপতে থাকে। বারবার শুধু মাথায় একটা কথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। যেভাবে বিয়েটা হলো সেটা কি আদৌ জায়েজ হয়েছে? আর যদি জায়েজ না হয়ে থাকে তাহলে একটা পরপুরুষের সাথে একসাথে একই রুমে? না না এটা আমি কিছুতেই করতে পারবো না। কখনোই না। এখন আমি কি করবো? এসব চিন্তা ভাবনা করতে করতে মায়া অস্থির হয়ে পায়চারী করতে থাকে।

হঠাৎ তখনই ওর এক চাচা ( মায়ার বাবার চাচাত ভাই) মায়ার রুমে আসে। রিয়ার বিয়ে উপলক্ষে এসেছিল সে। যাওয়ার আগে মায়ার সাথে দেখা করার জন্য আসে। ছোট বেলা থেকেই মায়াকে তিনি অনেক স্নেহ করেন। মাঝে মধ্যে এসে মায়াকে দেখে যান। এতিম মেয়েটির জন্য তার বড্ড মায়া হয়।
কিন্তু রুমে ঢুকে মায়াকে এভাবে বঁধু বেশে দেখে তিনি অবাক হয়ে যান। মায়ার কাছে এসে এসবের কারণ জিজ্ঞেস করেন।

মায়ার চাচাকে দেখে হঠাৎ মায়া একটা পথ খুঁজে পায়। মায়ার চাচা একজন ইমাম। মায়া ওর চাচাকে সবকিছু খুলে বলেন। তখন মায়ার চাচা রেগে গিয়ে মায়ার মামার সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু মায়া অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে মানান,যে এই কথা জানাজানি হয়ে গেলে ওর আর মামার দুজনেরই ক্ষতি হবে। মায়ার মামা সবকিছু শুনে বলেন।
–কিন্তু এই বিয়ে তো জায়েজ হয়নি। কারণ বরের সামনে তো তোমার নাম নেওয়া হয়নি।

মায়া অনুনয়ের সুরে বললো।
–তাহলে চাচা আপনিই কিছু করেন যাতে বিয়েটা জায়েজ হয়ে যায়। প্লিজ চাচা আপনার পায়ে পরছি। আমাকে পাপের হাত থেকে রক্ষা করুন।

মায়ার জন্য অনেক মায়া হয় ওর চাচার। সে ভাবে হয়তো একদিক দিয়ে ভালোই হবে। মা বাবা মরা মেয়েটা একটা ভালো সংসার পাবে। তাই অনেক চিন্তা ভাবনার পর ওর চাচা বললেন।
–ঠিক আছে মা আমি কিছু করছি তুই চিন্তা করিস না। হয়তো আমাকে কিছু মিথ্যে বলে পাপের ভাগিদার হতে হবে। তবুও তোর জন্য আমি এটা করবো।

কথাটা বলে ওর চাচা বাইরে বের হয়ে যায়। কিছু একটা ভেবে অরণ্যের বাবাকে একপাশে ডেকে বললেন।
— বিয়াই মশাই একটা কথা ছিল। আসলে আমাদের গ্রামের একটা রিত আছে। একবার বিয়ে পড়ানোর পর ওই রীত অনুযায়ী আবার বিয়ে পড়ালে স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন অনেক সুখী হয়। এটা আমাদের মান্যতা। তাই আপনারা কিছু মনে না করলে আমরা ওই রীত অনুযায়ী আবার বিয়ে পড়াতাম।

অরণ্যের বাবা হাসিমুখে বললেন।
–হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই কেন নয়। এতে যদি ওদের দাম্পত্য জীবন সুখী হয় তাহলে তো করা উচিত।
–ধন্যবাদ বিয়াই সাহেব। তাহলে আপনি একটু অরণ্যকে বাসার ভেতর নিয়ে আসবেন? আসলে রীতটা একটু একাকী ভাবেই করতে হয়। শুধু দুজন সাক্ষী হলেই হবে।

–আচ্ছা ঠিক আছে। আমি অরণ্যকে ওর ভাই সাহিল আর বন্ধু ইহানের সাথে পাঠাচ্ছি।

সেই কথা অনুযায়ী একটু পরেই সাহিল আর ইহান মিলে অরণ্যকে বাসার ভেতর একটা রুমে নিয়ে আসে। অরণ্যকে বসিয়ে দিয়ে সাহিল আর ইহান একটু খানি দূরে দাঁড়িয়ে ওরা ওদের মতো ফোনে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। মায়ার চাচা নিজের ফোনে কিছু দোয়াদরুদ চালু করে দিয়ে অরণ্যের হাতে দিয়ে শুনতে বলে।ইচ্ছে করেই বলিউম টা বেশি বাড়িয়ে দেয়। অরণ্য এসব দেখে একটু অবাক হলেও আপাতত কিছু বলে না। ভাবে হয়তো এটাই তাদের প্রথা হবে। মায়ার চাচা বিয়ে পড়ানো শুরু করে। মায়ার বাবার বাড়ি আর নানার বাড়ি একই গ্রামে। আর নিয়তিরই হয়তো কোনো লিলা, তাইতো ভাগ্যক্রমে মায়ার বাবার নামও তারেক। যদিও উনার ডাকনাম আলাদা ছিল।কিন্তু খাতা কলমে উনার নামও তারেক। তাইতো মায়া ওর মামাকে বাবার মতোই ভালোবাসে।

মায়ার চাচা বিয়ে পড়ানো শুরু করে। গ্রাম আর বাবার নাম এক হওয়ায় সেগুলো স্বাভাবিক ভাবেই চলে। শুধু মায়ার নামের সময় একটু বুদ্ধি করে বলে।যেহেতু রিয়া আর মায়া একই রকম শোনায় তাই মায়ার ম টা একটু আস্তে করে বলে। আর য়া টা স্বাভাবিক সুরে বলে। ফোনের আওয়াজের জন্য অরণ্য বা বাকিরা ব্যাপার টা বুঝতে পারে না। শেষে কবুল বলতে বললে অরণ্য কবুল বলে দেয়। মায়ার মামা তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

তারপর সাহিল আর ইহানকে সাথে নিয়ে মায়ার রুমে আসে। মায়া আবারও ঘোমটা টেনে বসে আছে। ওদের সামনে আবারও বিয়ে পড়ানো হয়। অতঃপর মায়াও কবুল বলে দেয়। আর এভাবেই সত্যি সত্যিই ওদের বিয়েটা হয়ে যায়। তার কিছুক্ষণ পরেই রিয়া চলে আসে আর মায়ার জীবন টা এভাবেই এলোমেলো হয়ে যায়। মায়ার চাচা বিয়ে পড়ানোর পরেই চলে যায়।তাই সে আর এসব জানতে পারে না।

মায়ার এখন নিজের ওই কাজের জন্য আপসোস হচ্ছে। আগে জানলে সে কখনোই ওভাবে বিয়ে টা পাকাপোক্ত করতো না। তাহলে আজ ওকে এভাবে অসহায়ত্বের শিকার হতে হতো না। না না ওসব আর ভাবা যাবে না। মন থেকে সব মুছে ফেলতে হবে। সে আমার কিছুই না। ওটা শুধু আমার জীবনের একটা মিথ্যে স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না। আমি ভুলে যেতে চাই এই ভয়ংকর স্বপ্নকে। হ্যাঁ ভুলে যাবো সবকিছু।

চলবে……….
(আশা করি বিয়ের ব্যাপার টা এখন ক্লিয়ার হয়ে গেছে আপনাদের কাছে। এই বিষয় টা সাসপেন্স ছিল কিছু পর্ব পরে কোন এক ঘটনা চক্রে এটা সামনে আসতো। তবে অনেকে প্রথম পর্ব পড়েই নানান মন্তব্য শুরু করলেন। তাই এই পর্বেই সবটা ক্লিয়ার করতে বাধ্য হলাম।
পাঠকদের ভালো মন্দ বলার অধিকার আছে। তবে কোনো রাইটারই কিন্তু প্রথম পর্বেই সবকিছু বলে দেয়না।গল্পের কাহিনির সাথে ধীরে ধীরে সবটা জানা যায়। তবে আপনারা প্রথম পর্ব পরেই নানান রকম মন্তব্য শুরু করলেন। ব্যাপার টা একটু আশাহত। যাইহোক আশা করি এখন আর কোন কনফিউশান নেই। হ্যাপি রিডিং??।
ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।)

গল্প নিয়ে যেকোনো আলোচনা আড্ডা দিতে আজই গ্রুপে জয়েন হোন। নিচে গ্রুপ লিংক দেওয়া হলো। জয়েন হওয়ার সময় অবশ্যই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিবেন।
গ্রুপ
https://facebook.com/groups/170529085281953/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here