★বিয়ে হয়েও আজ কুমারী থেকে গেল মায়া।
বিষন্নতায় ঘেরা কালো রাতে ছাদের এক কোণায় দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে, এলোমেলো ভাবে অনুভূতি শূন্য হয়ে বসে আছে মায়া। চেহারায় নববধূর সাজ থাকলেও, তার শরীরে বধূর শাড়ীটা নেই। সেটা যে এখন অন্য কারোর অঙ্গে শোভা পাচ্ছে। এইতো ঘন্টা খানিক হলো তার সদ্য বিয়ে করা বর আর বরযাত্রীরা চলে গেছে এই বাড়ি থেকে। তবে মায়ার সৌভাগ্য হয়নি তাদের সাথে যাওয়ার। তাই বলে এই না যে তারা খালি হাতে যাচ্ছে। তাদের সাথে তাদের বাড়ির বউ ঠিকই যাচ্ছে। আর সেই বউটা হলো মায়ার মামাত বোন রিয়া।
মায়ার জীবনে এমন একটা দিনও আসবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি মায়া। শূন্য চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনের ছক কষছে সে। আর বারবারই শেষে এসে শূন্য ছাড়া আর কিছুক্ষণ পাচ্ছে না মায়া। উনিশ বছরের এই কষ্টে জর্জরিত গ্লানি ভরা জীবনে খুব একটা সুখের আশা সে করেওনি। শুধু সামান্য একটা চাওয়াই ছিল তার। তা হলো, নিজের ওপর থেকে এই আশ্রিতা নামটা ঘোচানোর আশা।
হ্যাঁ আশ্রিতা। মায়ার বয়স যখন দুবছর তখনই একটা এক্সিডেন্টে ওর মা বাবা মারা যায়। আর মায়াকে এই পৃথিবীতে একা রেখে চলে যায় তারা। ছোট্ট মায়াকে আপন করে নেওয়ার মতো কেউই ছিলনা। মায়ার বাবা ছিল এতিম।তার কোন আত্মীয় স্বজন ছিলনা। তাই বাবার পক্ষ থেকে কেউই ছিল না মায়ার। শেষমেশ মায়ার মামা দয়া করে মায়ার দায়িত্ব নেন। আর মায়াকে তার বাড়িতে নিয়ে আসে। মায়ার মামা ওকে আপন করে নিলেও ওর মামি কখনোই ওকে আপন ভাবতে পারেনি। মামি তার কথা আর কাজে সবসময় মায়াকে মনে করিয়ে দিতো যে, মায়া শুধুই একটা আশ্রিতা । সে এবাড়ির আশ্রিতা ছাড়া আর কিছুই না। ধীরে ধীরে মায়াও এটা মন মস্তিষ্কে ভালো করে গেঁথে নিয়েছে যে সে শুধুই এবাড়ির একজন আশ্রিতা। তাইতো সে মুখ বুজে সবই মেনে নিতো। আশ্রিতা দের যে কিছু বলতে নেই। এরা আমাকে খাইয়ে পড়িয়ে মানুষ করেছে এটাই তো অনেক।
তবুও মায়ার মনে একটা ছোট্ট আশা ছিল। একদিন এমন একটা ঘর পাবে যেখানে সে আশ্রিতা থাকবে না।সেটা হবে তার নিজের ঘর। তারও একটা পরিবার হবে। যে পরিবারে সে আশ্রিতা না, বরং নিজের পরিবারের সদস্য হয়ে থাকবে। মায়া ভাবতো বিয়ের পরে ওর স্বামীর বাড়িই হবে সেই ঠিকানা। যেখানে ও আশ্রিতা হয়ে থাকবেনা। যেখানে কেউ ওকে আশ্রিতা বলবেনা। ও তখন সত্যিকারের একটা পরিবার পাবে।
মায়ার সেই সীমিত আশাটুকুও আজ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। এমনটা কেন হলো ওর সাথে? ও কি খুব বেশি কিছু চেয়েছিল জীবন থেকে? একটা আপন ঘরই তো চেয়েছিল। ওর নিজের একটা পরিবার চেয়েছিল। সেই আশাটাকে এভাবে ভেঙে না দিলে কি অনেক ক্ষতি হয়ে যেত? এমনতা না যে ও এই বিয়ে করতে চেয়েছিল। তাহলে বিয়ের নামে আমাকে এভাবে খেলার পুতুল না বানালেই হতো না?
মায়া ভাবতে লাগলো কিভাবে ওর সাথে বিয়ে নামক এক নিষ্ঠুর মজা হলো।
আজ মায়ার মামাত বোন রিয়ার বিয়ে ছিল। তিনদিন আগেই বরপক্ষ রিয়াকে দেখে বিয়ের দিনতারিখ সব ঠিক করে যায়। মায়া তখন ভার্সিটিতে ছিল। পরে ও বাসায় আসলে সব জানতে পারে। আর আজ সারা বাড়ি বিয়ের ধুমধাম চলছিল। সন্ধ্যা অবদি সবকিছু ঠিকই ছিল। মায়া ওর মামির কথামতো ঘরের ভেতরই বসে ছিল। ওর মামি বলেছিল ও যেন বিয়ে বাড়ির লোকজনের সামনে না আসে। তাই মায়াও বাইরে আসেনি। রাত দশটার দিকে হঠাৎ মামা আর মামি ওর রুমে আসে। মায়া ওদের দেখে একটু অবাক হয়ে বললো।
–মামা মামি,আপনারা এখানে?
মায়ার মামি শিউলি বেগম মায়ার মামা তারেক রহমানের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে কিছু বলার ইশারা করতেই তারেক রহমান মায়ার সামনে এসে করুন সুরে বললো।
–মায়া মা, অনেক বড়ো একটা বিপদ হয়ে গেছে মা। এখন একমাত্র তুই আমাদের রক্ষা করতে পারিস। নাহলে আজ আমার মানইজ্জত সব ধুলোয় মিশে যাবে।
মায়া চিন্তিত সুরে বললো।
–কি হয়েছে মামা? এমন করে বলছেন কেন?
–মারে রিয়াকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। পার্লার থেকে কোথায় যেন চলে গেছে। ফোনও বন্ধ করে রেখেছে। ওদিকে বরপক্ষ চলে এসেছে। বারবার রিয়াকে বিয়ে পড়ানোর জন্য নিয়ে যেতে বলছে। এখন আমি কি করবো? উনাদের কে যদি বলি মেয়ে পালিয়েছে, তাহলে ভরা মজলিশে আমার আর আমার বংশের মুখে চুলকানি মারবে সবাই। এখন এই মুহূর্তে শুধু তুইই আমাদের বাঁচাতে পারবি।
মায়া ভ্রু কুঁচকে বললো।
–আ আমি? আমি কিভাবে বাঁচাব?
এবার শিউলি বেগম বলে উঠলো।
–তুই রিয়ার জায়গায় বউ সেজে ঘোমটা টেনে বসে থাক। আর কাজী সাহেব বিয়ে পড়াতে আসলে রিয়ার জায়গায় তুই কবুল বলে দিবি ব্যাস।
মায়া হতভম্ব হয়ে বললো।
–কি কি বলছেন এসব? আ আমি কবুল বলবো মানে? না না এটা সম্ভব না। এটাতো সোজাসুজি ধোকা দেওয়া হবে উনাদের। এতবড় অন্যায় আমি করতে পারবোনা।
শিউলি বেগম চোয়াল শক্ত করে বললো।
–ওও খুব নীতিগিরি দেখানো হচ্ছে তাইনা? আমরা তোকে সারাজীবন খাইয়ে পড়িয়ে মানুষ করলাম। আর আজ আমাদের বিপদে তোকে সাহায্য করতে বলছি আর তুই নীতিগিরি দেখাচ্ছিস? এই তোর উপকারের প্রতিদান?
তারেক রহমান শিউলি বেগম কে হালকা ধমকের সুরে বললো।
–আহ তুমি চুপ করোতো। আমিতো বলছি তাইনা।
তারেক রহমান এবার মায়ার হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বললো।
–দেখ মা আমি জানি তোর সাথে অনেক বড়ো অন্যায় করছি।কিম্তু আর কোন উপায় নেই। এই মুহূর্তে একমাত্র তুইই আমাদের বাঁচাতে পারিস। তোর এই বুড়ো মামাটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমাদের কথাটা মেনে নে। আমার এতবছরের মান সম্মান এভাবে সবার সামনে ধুলোয় মিশে গেলে, আমার মরা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবেনা।
মায়া ওর মামার এমন করুন দশা দেখতে পারলো না। এই বাড়িতে একটু হলেও শুধু এই লোকটাই ওকে স্নেহ করে। অতিরিক্ত না করলেও যতটুকু পারে মায়ার ভালো মন্দের খেয়াল রাখার চেষ্টা করে। আর মায়াও তারেক রহমান কে নিজের বাবার মতোই দেখে। তাই সেই মানুষ টার আকুতির সামনে হেরে গেল মায়া। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের মন মেরে মামার খাতিরে ওদের কথায় রাজি হয়ে গেল।
শিউলি বেগম তাড়াতাড়ি করে কোনরকমে মায়াকে বউ সাজিয়ে দিয়ে লম্বা ঘোমটা টেনে ওকে বাইরে এনে বরের পাশে বসিয়ে দিল। যদিও এসবে শিউলি বেগম ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছে। রিয়াকে সামনে পেলে থাপড়িয়ে গাল লাল করে দিতো। আজ এখানে ওর বসার কথা ছিল। অথচ এই আশ্রিতাকে ওর জায়গায় বসাতে হচ্ছে। ভাবতেই রাগে শরীর ফেটে যাচ্ছে শিউলি বেগমের।
বরের পাশে বসাতেই মায়ার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। শরীরের শক্তি হ্রাস পাচ্ছে ওর। ভেতরে চলছে তুমুল কম্পন। একটু পরেই কাজী সাহেব এসে বিয়ে পড়ানো শুরু করলো। প্রথমে বরের বিয়ে পড়ানো শুরু হলো। এরপর মায়াকে কবুল বলতে বলা হলো। মায়ার সামনে যেন পুরো পৃথিবী ঘুরতে লাগলো। ও কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। অনেকক্ষণ হলো মায়াকে কবুল বলতে বলা হয়েছে, কিন্তু কিছুই বলছে না। সবাই কেমন একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। তখন তারেক রহমান মায়ার কাছে এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রেখে কবুল বলতে বললো। শেষমেশ মায়া কবুল বলেই দিল। ঘোমটার আড়ালে চোখ দিয়ে অশ্রু ধারা গড়িয়ে পড়লো মায়ার। এর পরিণতি কি হবে তা চিন্তা করতেই মায়ার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠছে।
তখনই হঠাৎ নিজের হাতের ওপর কারোর স্পর্শ অনুভব করলো মায়া। মাথা নিচু অবস্থায় হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো কোন পুরুষের হাত ওর হাতের ওপর। তারমানে এটা উনি? কথাটা ভাবতেই মায়ার আগে থেকেই কম্পনরত শরীর টা আরও কেঁপে উঠল। ঘোমটার ভেতর থেকেই আরচোখে একবার পাশের বর নামের লোকটির দিকে তাকালো মায়া। ঘোমটার আড়ালে আবছা আবছা বুঝতে পারলো লোকটার মুখে প্রাপ্তির হাসি। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নিল মায়া। উনি নিশ্চয় আমাকে রিয়া ভেবে এতো খুশি হচ্ছেন। যখন সত্যি টা জানতে পারবেন তখন কি হবে? ভাবতেই ভয়ে গলা শুঁকিয়ে আসছে মায়ার। মায়া আস্তে করে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। নিজেকে আজ অনেক বড়ো অপরাধী মনে হচ্ছে ওর।
বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসলে মায়ার মামা মামী কিছু কাজের কথা বলে মায়াকে ধরে আবার বাসার ভেতর নিয়ে গেল । বাসার ভেতর এসে রুমে ঢুকতেই ওরা তিনজনই অবাক হয়ে গেল। কারণ রুমে রিয়া বসে আছে। মাথায় ওর ব্যান্ডেজ করা। রিয়ার মা এগিয়ে গিয়ে রিয়ার হাত ধরে এক ঝটকায় উঠে দাড় করিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো।
–কোথায় গিয়েছিলি তুই হ্যাঁ? নিজের বিয়ে থেকে পালিয়ে কোথায় গিয়েছিলি তুই হ্যাঁ? এখানে আমাদের কি অবস্থা হয়েছে তুই জানিস?
রিয়া বলে উঠলো।
–আরে কে বলেছে আমি পালিয়েছি? আমি কেন পালাতে যাবো? আরে পার্লার থেকে ফেরার পথে আমার এক্সিডেন্ট হয়ে যায়। তাইতো আমি আসতে পারিনি। দেখছনা মাথায় ব্যান্ডেজ। আরে আমার বান্ধবী সুমাও তো আমার সাথেই ছিল। ওই তো আমাকে হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে এলো। বাসায় লোকজন আছে দেখে আমি পেছনের দরজা দিয়ে এসেছি।
রিয়ার কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল। যেহেতু রিয়ার কথামতো ওর কোন দোষ নেই তাই ওকে কিছু বলতেও পারছে না। রিয়া এবার মায়াকে বধূবেশে দেখে কপাল কুঁচকে বললো।
–মা ও বধূবেশে কি করছে? তোমরা ওকে বউ সাজিয়েছ কেন? এক মিনিট, তোমরা আবার আমার জায়গায় ওকে বসিয়ে দাওনি তো?
রিয়ার মা রিয়াকে সব খুলে বললো। সব শুনে রিয়া উত্তেজিত হয়ে বললো।
–হোয়াট? তারমানে সত্যি সত্যিই তোমরা আমার জায়গায় ওকে বসিয়ে দিয়েছ? তোমরা কি করে পারলে এমনটা করতে? আমার জায়গা ওই আশ্রিতাকে দিয়ে দিলে? এখন আমার কি হবে?
–রিয়া মা শান্ত হ। ওইসময় আমাদের আর কোন উপায় ছিলনা। বরপক্ষ কনের জন্য অপেক্ষা করছিল। আর তোকেও পাচ্ছিলাম না। সত্যি টা বলে দিলে সবার সামনে অপমানিত হতে হতো। তাই আর উপায় না পেয়ে এইকাজ করতে হলো।
রিয়া তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–বাহ্ নিজের মেয়েকে খুঁজে না বের করে ওই আশ্রিতাকে আমার জায়গায় বসিয়ে দিলে। এই তোমাদের সমাধান। তোমরা কি ভেবেছ এতে সব ঠিক হয়ে যাবে? আরে ঠিক না বরং আরও খারাপ হয়ে যাবে। যখন সবাই সত্যি টা জানতে পারবে তখন কি হবে একবারও ভেবে দেখেছ? আরে আমার কি হবে? আমার তো বদনাম হয়ে যাবে। এরপর কে আমাকে বিয়ে করতে চাইবে? আচ্ছা আমার কথা নাহয় বাদই দিলাম। একবারও ভেবেছ যখন ওই বাড়ির লোকজন সত্যি টা জেনে যাবে তখন কি হবে? তারাতো আমাকে ভেবে ওকে নিয়ে যাবে। কিন্তু যখন ওর চেহারা দেখতে পাবে তখন কি হবে? তাও যদি বউটা সুন্দর হতো তাও একটা কথা ছিল। কিন্তু আমার মতো সুন্দরী মেয়ের জায়গায় যখন ওই কালি কুৎসিত মায়াকে দেখবে তখন কি হবে ভেবে দেখেছ? আরে ওদের মতো উচ্চ পরিবার কখনো এই কালি মায়াকে নিজেদের বউ হিসেবে মেনে নিবে না।
রিয়ার কথাগুলো মায়ার বুকে তীরের মতো বিঁধছে। ঠিকিতো বলেছে রিয়া। আমার মতো কালো মেয়েকে কে তাদের ঘরের বউ হিসেবে মেনে নিতে চাইবে। আর এই ভয়েই আমি বিয়েতে রাজি হতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু এখন কি হবে? মায়ার ভাবনার মাঝেই রিয়া আবারও বলে উঠলো।
–আরে ওরা অনেক উচ্চ পরিবার। সত্যি টা জানলে ওরা তোমাদের ওপর কেইস করে দিতে একসেকেন্ডও ভাববে না। তোমাদের ফ্রড কেসে ফাঁসিয়ে দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিবে।
রিয়ার কথায় ওর মা বাবা সত্যিই ভাবনায় পড়ে গেল। আসলেই তো এতকিছু তো ওরা ভেবেই দেখেনি।রিয়ার কথায় যুক্তি আছে। ওরা রেগে গিয়ে এমনটা করতেই পারে। এখন কি হবে? রিয়ার মা তারেক রহমানের দিকে তাকিয়ে বললো।
–এই শুনছ রিয়া তো ঠিকই বলছে। ওর জায়গায় মায়ার মতো কালো মেয়েকে দেখে তারা নিশ্চয় অসম্ভব রেগে যাবে। তখন ওরা আমাদের সাথে কি করবে তা আল্লাহই জানে। আর আমরা তো ওনাদের ক্ষমতার সামনে কিছুই না।
তারেক রহমান চিন্তিত সুরে বললো।
–কিন্তু এখন আর কিবা করতে পারি আমরা?
রিয়া বলে উঠলো।
–একটা উপায় আছে। যে উপায়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কেও কিছু জানবেও না।
তারেক রহমান বললো।
–কি উপায়?
–মায়াকে তো আর ওরা কেও দেখেনি তাইনা? ওরাতো জানে ঘোমটার নিচে আমিই আছি। তাই বলছি যা হওয়ার হয়ে গেছে। এবার আমাকে মায়ার জায়গায় বসিয়ে দাও। তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কেউ কিছুই বুঝতে পারবে না।
রিয়ার কথায় মায়া চমকে গেল। ওর এখন কি রিয়্যাকশন দেওয়া উচিত তা ভেবে পাচ্ছে না ও।
তারেক রহমানও চমকে উঠে বললো।
–কি বলছিস এসব? পাগল হয়ে গেছিস? আরে মায়ার বিয়ে হয়েছে ওই ছেলের সাথে। তাহলে মায়ার জায়গায় তোকে কিভাবে পাঠাবো?
শিউলি বেগম এবার বলে উঠলো।
–আরে রাগছ কেন? রিয়া ঠিকিতো বলেছে। এটাই একমাত্র বাঁচার উপায়। দেখ ওরাতো রিয়াকেই ওবাড়ির বউ করতে চেয়েছিল তাইনা? তাহলে রিয়াকে পেলে আর ওদের কোন সমস্যা হবে না। আর আমার মেয়েটারও বদনাম হবে না।
–আর মায়ার কি হবে হ্যাঁ? ওর জীবন টা বুঝি নষ্ট হবে না?
–না নষ্ট হবে না। আরে আমরা ছাড়া তো আর কেউ কিছু জানেও না। তাহলে কিভাবে ওর জীবন নষ্ট হবে। আমরা বরং ওকে দেখেশুনে অন্য কোন ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেব।তাহলে তো আর কোন সমস্যা নেই তাইনা?
রিয়া বলে উঠলো ।
–হ্যাঁ বাবা। এতেই আরও ওর ভালো হবে।কারণ ওই বাড়িতে ওকে কেও মেনে নিবে না। তখন ওরজন্য আরও বেশি খারাপ হবে। পরবর্তীতে ওকে আর অন্য কোথাও বিয়েও দেওয়া যাবে না। তারচেয়ে ভালো আমার কথা মেনে নাও। এইকথা শুধু আমাদের মাঝেই থাকবে। এতে আমাদেরও ভালো। আর ওদেরও।
রিয়ার কথায় তারেক রহমান ভাবনায় পড়ে গেল। রিয়ার কথায় যুক্তিতো আছে। কিন্তু এটা কি ঠিক হবে। শিউলি বেগম তারেক রহমানের হাত ধরে একপাশে নিয়ে গিয়ে বললো।
–দেখ এতো ভাবনা চিন্তার দরকার নেই। রিয়া একদম ঠিক বলছে। এতেই সবার ভালো হবে। নাহলে কিন্তু আমার মেয়েরও ক্ষতি হবে আর তোমার ভাগ্নিরও।
তারেক রহমান বলে উঠলো।
–কিন্তু একটা কুমারী মেয়েকে কিভাবে পরপুরুষের বউ হিসেবে পাঠিয়ে দেব? তুমি একবারও এ বিষয়ে ভেবে দেখেছ?
–আরে এটা কোন ব্যাপার না। আমি রিয়াকে বুঝিয়ে দেব যে ও যেন কোন বাহানা দিয়ে ওই ছেলের সাথে আবার বিয়ে করে নেয়। তার আগে যেন দুরত্ব বজায় রাখে।
–কিন্তু….
–আর কিন্তু কিন্তু করোনা। এটাই সবার জন্য ভালো হবে। তুমি যেয়ে মায়ার সাথে কথা বলো।
মায়া এতক্ষণ ধরে নীরব দর্শকের মতো এদের কথাবার্তা শুনে যাচ্ছে। এরা ওর জীবনের ফয়সালা করছে, অথচ ওর কাছে কোন কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করছে না। নিজেকে যেন অনুভূতিহীন জড়বস্তু মনে হচ্ছে ওর।
একটু পরে তারেক রহমান মায়ার সামনে এসে দাঁড়াল। কেমন অসহায় চোখে মায়ার দিকে তাকালো। এই চাহনির অর্থ বুঝতে মায়ার খুব একটা বেগ পেতে হলো না। সে ভালোই বুঝতে পারছে তার মামা কি বলতে চাইছে। তাই মায়া নিজেই বলে উঠলো।
–আপনাদের যেটা ভালো মনে হয় সেটাই করেন। আমাকে নিয়ে ভাববেন না।
তারেক রহমান মায়ার দুই হাত ধরে অপরাধী সুরে বললো।
— আমাকে মাফ করে দিস মা। আমি জানি তোর সাথে অনেক অন্যায় করছি। কিন্তু এছাড়া যে আর উপায় নেই। আর তোরও এতে ভালো হবে। তুই তো বুঝতেই পারছিস তোকে ও বাড়ির কেউ মেনে নিবে না। তাই এই কথা আমাদের মাঝে থাকাই ভালো হবে।
মায়া বলে উঠলো।
–কি করছেন মামা। আপনি গুরুজন, এভাবে মাফ চেয়ে আমাকে ছোট করবেন না। আপনি যা করতে চাচ্ছেন করুন। আমার কোন সমস্যা নেই।
ব্যাস এটাই শোনার অপেক্ষায় ছিল রিয়া আর ওর মা। মায়া রাজি হতেই তাড়াতাড়ি করে তারেক রহমান কে বাইরে যেতে বললো।তারপর মায়ার শাড়ী খুলে রিয়াকে পড়িয়ে দিল। রিয়াকে রেডি করতে করতে ওর মা ওকে বলতে লাগলো।
–শোন তুই কোন একটা বাহানায় জামাইর সাথে আবার বিয়ে করে নিস। তার আগে যেন কোনভাবেই কাছে আসতে দিসনা।
রিয়া একটা বাঁকা হাসি দিল। ওর মাতো জানেই না যে, সে কবেই তার সতিত্ব হারিয়ে বসে আছে। এসব ওর জন্য কোন ব্যাপারই না। তবুও ওর মাকে আস্বস্ত করার জন্য বললো।
–তুমি টেনশন নিও না মা। তোমার মেয়ে অনেক চালাক। দেখবে এক তুড়ি বাজিয়ে ওকে বিয়ে করতে রাজি করিয়ে ফেলবো।
মায়া আর এসব শুনতে পারছেনা। দরজা খুলে দ্রুত ওখান থেকে বেড়িয়ে ছাঁদে চলে এলো। তখন থেকে ওভাবেই বসে আছে। নিজের শেষ আশাটুকুও হারিয়ে নিজেকে নিস্ব মনে হচ্ছে ওর। মাঝে মাঝে চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছে করে। আমি কেন বেঁচে আছি? বাবা মা আমাকেও কেন নিয়ে গেলে না তোমার সাথে? এই অভিশপ্ত জীবনের চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো। আত্মহত্যা মহাপাপ না হলে আজ সত্যি সত্যিই এই জীবন থেকে মুক্তি নিয়ে নিতাম।
মায়া আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, এতক্ষণে নিশ্চয় আমার নামমাত্র স্বামী আর রিয়াকে বাসর ঘরে দেওয়া হয়েছে। আচ্ছা ওই লোকটা কি বুঝতে পারবে তার সামনে যে আছে সে তার বউ না? নিজের ভাবনার ওপর তিরস্কার করে মনে মনে বললো, কেন বুঝতে পারবে? তুই কি তার প্রেমিকা নাকি যে সে বুঝতে পারবে? সেতো কখনো তোকে চোখেই দেখেনি। আরে রিয়ার মতো সুন্দরী মেয়ে সামনে পেয়ে অন্য কিছুর কথা কেন ভাববে কেউ? আর তোর মতো কালির কথা তো কখনোই ভাববে না। মানুষ সুন্দরের পূজারী। সব ছেলের মতোই সেও সুন্দর বউ পেয়ে নিশ্চয় তাতে মেতে উঠেছে। হয়তো সে এখন রিয়ার মোহে ডুব দিচ্ছে।
কথাগুলো ভাবতেই কেমন গা গুলিয়ে আসছে মায়ার। পেটের নাড়ী উল্টে আসছে। আর বসে থাকতে পারলোনা মায়া। মুখ হাত চেপে ধরে দৌড়ে নিজের রুমে এসে, ওয়াশরুমে ঢুকে বেসিনে গড়গড় করে বমি করে দিল। বমি করে ক্লান্ত শরীরে শাওয়ার ছেড়ে ধপ করে শাওয়ারের নিচে বসে পড়লো। শাওয়ারের পানিতে মুখের সব সাজ ধুয়ে যাচ্ছে। তবে ওর দুঃখগুলো কি ধুয়ে যাবে এই পানিতে? আসবে কি ওর জীবনে নতুন ভোরের আলো?
চলবে…..
#মায়ারণ্যে
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
#প্রথম পর্ব
(