#মায়া_মহল (১৯)#রহস্য ২০ এ শেষ পর্ব হবে।
কলমে #রেহানা_পুতুল
আঞ্জুমান আরার মুখের বাক্য কেড়ে নেয় মায়া। হিইইসস… বলে নিজের ঠোঁটের উপর আঙ্গুল চেপে ধরে থামিয়ে দেয় তাকে। বলে,
পরপারে ভালো থাকবেন বড় চাচী। আপনাদের অপরাধের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নিজেই অপরাধী হয়ে গেলাম। চাচাকেও আমিই শেষ করে দিয়েছি। আজ তবুও শান্তি।
আঞ্জুমান আরা মায়ার দিকে হা করে চেয়ে আছে নিস্তেজ চাহনিতে। কিছুই বলতে পারছে না। অবশ হয়ে আসছে তার সারাশরীর। প্রাণপণে চেষ্টা করছে কাউকে ডাকার। কিন্তু পারছে না।
অস্ফুট স্বরে অসহায় কন্ঠে মায়াকে বলল,
তুই খু*নী। তুই শান্তি পাবি না কোনদিন।
আমার শান্তিতো আপনারা স্বামী স্ত্রী মিলে বহু আগেই শেষ করে দিয়েছেন। যার মা,বাবাকে জীবন্ত হত্যা করা হয়, তার শান্তির প্রয়োজন নেই। তার বাঁচার ও প্রয়োজন নেই এই পৃথিবীতে। সে চায় প্রতিশোধ। খু*নের বদলে খু*ন। তারপর সে নিজেই মরে যাবে একদিন। দান করে দিবে এই পুরো বাড়ি।
দুঃখভরা আবেগ নিয়ে ব্যথিত চিত্তে বলল মায়া।
আঞ্জুমান আরার গোটা শরীর অসাড় হয়ে আসছে। তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে আসছে তার পঞ্চ ইন্দ্রিয়। তার প্রাণপ্রদীপ যখন নিবু নিবু, ঠিক তখন মায়া রুম থেকে বের হয়ে গেলো। গিয়ে শাহেরের রুমে ঢুকলো।
শাহের ঘুমাচ্ছিলো। দরজার ঠকঠক আওয়াজ শুনে চোখ মেলে চাইলো।
শুভ সকাল ছোটবাবু। আসতে পারি?
স্বাভাবিক কন্ঠে বলল মায়া।
শুভ স্নিগ্ধ সকাল মায়াবিনী। অনুমতি অনাবশ্যক। সুখী করার জন্য এলে? নাকি এখনো তোমার পার্সোনাল প্রবলেম চলছে?
সুখী করার জন্য আসিনি। প্রবলেম চলমান।
স্মিত হেসে বলল মায়া।
আর কতদিন চলবে তাহলে?
জানি না।
ছল চাতুরী করা হচ্ছে? নাহ? আচ্ছা কেন এলে বলো?
এলাম এমনিতেই গল্প করার জন্য।
ওহ। শুকরিয়া প্রিয়তমা। আমি পরশ চাচা ও আশেপাশের সবাইকে জানিয়ে দিয়েছি।
কি জানালেন?
ভ্রুদ্বয় নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো মায়া।
বললাম আমাদের বাড়িতে মায়া নামের যে মেয়েটা আছে। সে এখন আমার বউ।
ওহ খুব ভালো করেছেন।
শোন,কারণে কারণে বেশ কিছুদিন হলো বাড়িতে আছি। আমি কালই ঢাকা যেতাম। কিন্তু দুদিন পরেই যাবো। ফ্যাক্টরির জি এম কে বলে দিয়েছি। তোমার অথই সমুদ্রে অবগাহন না করে কিভাবে যাই বলো। ডুবুরি হয়ে সমুদ্রের অতলে যেতে চাই। কুড়াতে চাই হিরে,মনি,মুক্তা,দামী সব ঐশ্বর্য।
মায়ার সারামুখ লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠলো। মাথা নিচু করে বলল,
আপনি একটা আস্ত অসভ্য।
যথা আজ্ঞা মহারানী। আপনার কাছে জনমভর আমি একটা অসভ্য পুরুষ হয়েই থাকতে চাই। বছর বছর বাচ্চা পয়দা করবো। ক্রিকেট টিম গঠন করবো। নইলে এই বিশাল বাড়ি আর মায়ামহল বিরানভূমি হয়ে যাবে।
মায়া প্রতিউত্তর দিতে গিয়েও থামতে হলো। কারণ কুমকুম উদভ্রান্তের মতো রুমের ভিতরে শাহেরের সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
ভাইজান ভাইজান,
বেগম সাহেবা মইরা গ্যাছে।
মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শাহের উম্মাদের মতো মায়ের শিয়রে গিয়ে আছড়ে পড়লো।
তার পিছন দিয়ে প্রায় দৌড়ে মায়াও এলো। মিছে কান্নার ভান করলো।
আম্মা…এই আম্মা…চোখ খোল। কথা বলো আম্মা। তাকাও আমার দিকে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে কুমকুম,জরিনা,পরশ। তফুরার চোখ ও ভেজা অল্পস্বল্প। কারণ তার সঙ্গে আঞ্জুমান আরার তেমন ভালো করে কথাও হয়নি। তুচ্ছতাচ্ছিল্যর নজরেই সে সবসময় তফুরাকে দেখে আসছে।
বাকি সবাই কাঁদছে হাউমাউ করে।
শাহের তাদেরকে উদ্দেশ্য করে কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
হঠাৎ করে কি হলো আমার মায়ের?
জানিনা ছোটবাবু। আমি রুমে আইসা দেখি বেগম সাহেবা চিৎ হইয়া পইড়া আছে। নাড়াচাড়া কইরা কোন সাড়া না পাই জরিনারে ডাকলাম। পরে আপনেরে ডাকলাম।
আম্মারে ইনসুলিন দেয়া হয়নি কুমকুম?
ছোটবাবু দেয়া হইছে। আমি দিইনাই আইজ। ভাবিসাব দিছে।
কান্নারত সুরে বলল কুমকুম।
মায়া পাশ থেকে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলল,
হ্যাঁ, আমিই মাকে ইনসুলিন দিলাম। দিয়েই বের হয়ে গেলাম। উনিতো সুস্থই ছিলেন। আমার সঙ্গে কথা বললেন।
শাহের আর কোন কথাই বলতে পারল না। তোড়জোড় করে মাকে গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। ডাক্তার পরিক্ষা করে তার মাকে মৃত ঘোষণা করলো। কারণ হিসেবে জানতে পারলো ডায়াবেটিস থাকার জন্য সুগার ফল্ট করেছে তার মায়ের। সে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো,
সুগার ফল্ট করার কারণ?
ডাক্তার বলল,
রক্তে শর্করা (Blood Sugar) বা সুগারের মাত্রা হঠাৎ করে এনি টাইম কমে যেতে পারে। নিদিষ্ট কোন কারণ লাগে না সুগার ফল্ট করতে। তবে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শরীরে ইনসুলিনের মাত্রা ভুলক্রমে বেশি পড়ে গেলেও মৃত্যু হতে পারে। এবং সে অনুযায়ী টাইমলি যদি খাবার না খায় তাহলেও মৃত্যু হতে পারে।
শাহের চুপ হয়ে গেলো। মায়ের নিথর দেহ নিয়ে বাড়িতে চলে এলো। তার মায়ের মৃত্যু সংবাদ দূর দুরান্ত পর্যন্ত পৌঁছে গেলো। শতশত উৎসুক মানুষের জটলা লেগে গেলো বাড়ির ভিতরে। মায়া মহল নিয়ে নানারকম মুখরোচক আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠলো।
#মায়া_মহল নামের বাড়িটায় ভূত প্রেত আছে নাকি?এই বাড়িতে একে একে সব মানুষের মৃত্যু হয় কেন? থানা পুলিশ জানানো দরকার। কি ভুতুড়ে কর্ম কাণ্ড হচ্ছে সব।
সেদিন বিকেলেই আঞ্জুমানের লা*শ দাফন হয়ে গেলো। সারাদিনের অভুক্ত শাহের। জীর্ণশীর্ণ বেদনার্ত মলিন মুখ। থেকে থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। নিকটাত্মীয়রাও একটু পরপর আঞ্জুমান আরার নানা স্মৃতিচারণ করছে।
মহলে তফুরা ও পরশের কতৃত্ব বেড়ে গেলো। পরশের চাকর মনোভাব দূর হয়ে গেলো। তার আচরণ হয়ে গেলো মহল পরিবারের কর্তাবাবুর ন্যায়। তার শিরদাঁড়া উঁচু হয়ে গেলো। পানি দিতে দিতে নুয়ে পড়া বৃক্ষ সোজা হয়ে যাওয়ার মতো সে বুক টানটান করে চলতে লাগলো। ছোটবাবু না বলে শাহেরকে নাম ধরে ডাকতে শুরু করলো। শাহের বিষয়টা মাথায় গেঁথে রাখলো আপাতত পরশকে কিছু না বললেও।
মায়া শাহেরের নিকটে এসে দাঁড়ালো। আদ্রকন্ঠে বলল,
সারাদিন কিছু মুখে দেননি। খাবার নিয়ে আসি?
শাহের ক্রন্দনরত চোখে মায়ার মুখপানে চাইলো। ভাবলো,
পুরুষরা মারা গেলো মায়ার জন্য। কিন্তু আম্মা? আম্মাতো নারী! মায়া আম্মাকে কেন মারবে ইনসুলিনের ডোজ বাড়িয়ে দিয়ে? পাছে মায়া ভুল বুঝবে এই ভেবে মায়াকে সরাসরি কিছু বলতেও পারছে না।
কিছু ভাবছেন আপনি?
না মায়া। ভালোলাগছে না। খাবনা। তুমি চলে যাও। আমি একাকী থাকতে চাই।
রাতে কি আমি আপনার সঙ্গে ঘুমাবো?
আপাতত না। মন চাইলে আমিই ডাকবো।
মায়া চলে গেলো চিন্তিত মনে।
মাকে হারিয়ে শাহের এলোমেলো হয়ে গেলো। জীবন যাপনে ছন্নছাড়া ভাব চলে এলো। চুলগুলো থাকে উসকোখুসকো। নির্ঘুম রাত কাটে। দুই চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে। উদাস হয়ে থাকে দিবানিশি। আনমনে চেয়ে থাকে শূন্যের পানে।প্রতিমূহুর্তে মনের মাঝে অস্থিরতা বিরাজ করছে মায়াকে নিয়ে। বুঝে নিলো মায়া হয়তো কোন স্বাভাবিক কেউ নয়। তাকে বিয়ে করা জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে। ভীষণ দুর্ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে গেলো শাহের। মহলে গেটের নতুন দুই গার্ড, দুই চাকরানী ও পরশ ছাড়া কেউই বেঁচে রইল না। তাহলে তার মৃত্যুর উপলক্ষ তৈরি হতে কতক্ষণ। সে গ্রাম ছেড়ে চলে গেলো। মায়ার একান্ত সান্নিধ্য পাওয়ার ইচ্ছাটুকু প্রায় মৃত তার মাঝে। বরং প্রণয়,আবেগ,অনুরাগ,অনুযোগ, ভালোবাসার স্থান দখল করে নিলো শংকা,সন্দেহ, কৌতুহল,ভীরুতা।
নিজের অজান্তেই মায়াও ভালোবেসেছিলো শাহেরকে। নিজের পরিচয় জানার পর সেই ভালোবাসা প্রগাঢ় হয়ে গিয়েছিলো। তাই শাহেরের জন্য তার হৃদয়টা পুড়ে খাঁক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেও পারেনি মা বাবার প্রতিশোধ না নিয়ে থাকতে।
মায়া পরশকে সঙ্গে নিয়ে এক রাতে গুপ্তধন নামক সোনার গহনাগুলো উদ্ধার করলো। একবার চিন্তা করলো থানায় জমা দিবে। পরে চিন্তা করলো,তারাও এগুলো নিয়ে নিবে। কোন কল্যাণ মূলক কাজে লাগাবে না। তারচেয়ে যা করার তাকেই করতে হবে। সে খোঁজ নিয়েও সেইসব পরিবারের উত্তরসূরীদের কোন সন্ধান করতে পারেনি।
তারপর অল্পকিছু গয়না রেখে বাকিসব
কয়েক ভাগে ভাগ করে নিলো। একেকদিন একেক স্থানের স্বর্ণকারদের কাছে বাজারদরে বিক্রি করে দিলো। বিক্রির সব টাকা আলমারিতে নিরাপদে রাখলো।
কারণ সব গহনা এক দোকান বা দুই তিন দোকানে বিক্রি করলে ধরা পড়ে যেতো। অমনি সব গহনা বাজেয়াপ্ত হয়ে যেতো। বড় চাচা পরশকে নিয়েই মায়া এসব করলো আস্তে আস্তে।
তার পরেরদিন মায়া তফুরা ও পরশকে একসঙ্গে নিয়ে বসলো। গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
চাচা, আম্মা, আমি একটা সিদ্বান্ত নিয়েছি। আম্মার ও স্বামী নেই। চাচাও কখনো বিয়ে করেন নি। এভাবে ত লাইফ চলতে পারে না। আপনারা বিয়ে করে ফেলেন। আম্মা, মায়া মহলের বউ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেলো। আপনিও একজন সঙ্গী পেলেন।
মায়ার গুরুদায়িত্ব পালনে পরশ ও তফুরা আনন্দিত হলো। পরদিনই তাদের বিয়ে হলো বাড়িতে কাজী ডেকে এনে। শাহেরকে শুনানো তারা জরুরী মনে করল না। সে হয়তো বাধা দিবে। আর এই মহলের, এই বাড়ির,জায়গা জমির একমাত্র মালিক মায়া। তার ইচ্ছেমতোই সব হবে।
মায়া সঞ্চিত অর্থ থেকে বেশকিছু অর্থ খরচ করলো পরশ ও তফুরার বিয়েকে কেন্দ্র করে। পাঁচটা গরু খাওয়ালো কয়েক গ্রামের ধনী গরিব সবাইকে। মূলত তার উদ্দেশ্যই ছিলো গরীবদের পেটপুরে খাওয়ানো। সেই সময় মায়া চারদিকে মায়া মহল বাড়ির একমাত্র কন্যা ও পুত্রবধু হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেলো।
পরশ তফুরার মাঝবয়স। তফুরার আচরণ চলাফেরায় বিপুল পরিবর্তন এলো। সে নত হয়ে,নরম সুরে এখন আর আগের মতো কথা বলে না। হাসিখুশি মুখে থাকে কর্ত্রী কর্ত্রী ভাব নিয়ে। সেই প্রশ্রয়, সুযোগ, ভালোবাসা মায়াই দিয়েছে। মায়ার পূর্ণজন্ম দেওয়া তফুরা তার কাছে মায়ের চেয়েও অমূল্য কিছু। নইলে আজ সে কোথায় থাকতো।
সংকোচ,দ্বিধা, জড়তা কাটিয়ে পরশ,তফুরার বাসর হয়ে গেলো। স্বামী স্ত্রী হিসেবে তাদের সময়গুলো মধুমাখা হয়ে উঠলো।
মায়া শাহেরের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। মায়া বহু অনুরোধ করলেও শাহের বহু অযুহাতে বাড়ি আসে না। মায়া কারণ বুঝতে পারলো, তবুও কিছুই বলল না। পরশ তফুরার বিয়ের বিষয় জানালে, শাহের ভয়ংকর ভাবে ক্ষেপে গেলো মায়ার উপর।
ফোনের ওপাশ থেকে র*গর*গে স্বরে বলতে লাগল,
আমি শীঘ্রই বাড়ি আসছি। তোমার মতো একটা কানাকড়ি মূল্যের মেয়েকে বিয়ে করেছি বলে তুমি আমাকে ডিঙিয়ে কতৃত্ব ফলাতে পার না। পেয়েছ কি তুমি? সবাই মরে যায় তোমার জন্য। এতটা বছর কুমকুম আম্মাকে ইনসুলিন দেয়। আম্মার কিছুই হয়নি। আর তুমি দেওয়ার পরেই আম্মা মরে গেলো? আমার ত মনে হয়,তুমি আমার মাকে ইনসুলিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছো ইচ্ছে করেই। যেন আম্মার কতৃত্বগিরি তুমি দেখাতে পারো সর্বক্ষেত্রে।
মায়া কিছুই বলল না। মোবাইল থেকে কানটাকে আলগা করে নিলো। সুইচড অফ করে দিলো।
মায়া পরশকে এগুলো বলল না কষ্ট পাবে মনে তাই। তার সঙ্গে পরামর্শ করলো গহনার অর্থগুলো নিয়ে। পরে সেই টাকাগুলো দিয়ে বাড়ির বাইরে বাজার সংলগ্ন লাগোয়া কয়েকটি ধানি জমি কিনলো। চরের থেকে বালু মাটি এনে কয়েক মাসেই তা ভরাট করে নিলো। এগুলো পরশ নিজ দায়িত্বে করছে মায়ার অনুরোধক্রমে।
স্থানীয় ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের বাড়িতে গেলো মায়া। যেতে বিশাল উপহার নিয়ে গেলো চেয়ারম্যানের জন্য। দেখা করে মায়া তার জীবনের অতীত ইতিহাস ব্যাখ্যা করলো বর্তমান পর্যন্ত। এবং কেনা জায়গায় সে একটা নারী আশ্রম ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করতে চায় জানালো। কারণ এই গ্রামের ছেলেমেয়েদের জন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয় বেশ দূর হয়ে যায়। বর্ষাকালে হাঁটু ডুবিয়ে স্কুলে যেতে মেয়েদের খুব বিপাকে পড়তে হয়। আর নারী আশ্রমে আশ্রয় হবে সেসব অসহায় পরিত্যক্ত যেকোন বয়েসী নারীদের। যারা বিধবা,ডিভোর্সি, স্বামী, সন্তান,ও পুত্রবধু দ্বারা লাঞ্চিত, যাদের অবলম্বন হিসেবে তিনকূলে কেউই নেই,এমন সব নারীরা। তবে এদের মধ্যে কর্মক্ষম নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য হাতের কাজের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
চেয়ারম্যান ও তার পরিবার মায়ার উপর ভারি প্রসন্ন হলো। তিনি বললেন,
ঠিক আছে মা। তোমার আব্বা আমার জুনিয়র ছোট ভাই। আমি তাকে খুব ভালো করেই চিনতাম। তোমার ইচ্ছেগুলো কল্যাণমূলক। যা কিনা আমারই করার কথা। এতে আমাদের গ্রাম একটি সমৃদ্ধশালী গ্রাম হিসেবে সর্বত্র পরিচিত লাভ করবে।
তুমি কাজ শুরু করে দাও। আমি মেম্বারকে বলে দিচ্ছি, সে সবসময় তদারকি করবে।যেকোন প্রয়োজনে তুমি আমার সহযোগীতা পাবে। তবে তুমি পড়াশোনা স্টপ করোনা। কন্টিনিউ করে।
মায়া চেয়ারম্যান থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো। জমিন ভরাট হয়ে গেলো। তার একমাস পর নির্মাণ কাজের প্রাথমিক ধাপ শুরু হয়ে গেলো।
সেদিনের পর হতে শাহের মায়ার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। মায়ার ফোন রিসিভ করে না। মেসেজ সিন করে না। রিপ্লাই দেয়না। বাড়ি আসবে বললেও আসেনি।
মায়াও অভিমান করে সম্পূর্ণ যোগাযোগ করে দিয়েছে। মায়ার রেজাল্ট প্রকাশ হলো। মেসেজে শাহেরকে জানালো। শাহের দায়সারাভাবে কংগ্রাচুলেশনস জানালো। তাতেই মায়া বিশ্বজয়ের মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। সে সত্যিই ভালোবাসে চাচাতো ভাই শাহেরকে। মায়া স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল সায়েন্সে ভর্তি হলো। ক্লাস সপ্তাহে তিনদিন। প্রেম,ভালো বাসা,সঙ্গীহীন জীবনটা তার নিরানন্দভাবেই পার হচ্ছে অবসন্ন বিকেলের মতন।
ম্যাপ অনুযায়ী জমির একপ্রান্তে দালান তৈরির কাজ চলছে নারীদের জন্য। আরেকপাশে বিদ্যালয় তৈরির কাজ চলছে।
এ নিউজ শাহের শুনে গেলো ঢাকায় থেকে। তারপর উত্তেজিত মনে গ্রামে চলে এলো। এসেই মায়ার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করলো। তফুরাকে ও পরশকে কটাক্ষ করে কথা বলল। শাহের ঠিক করলো এবার ঢাকায় গেলে আর গ্রামেই আসবে না। তাই রাতে একাকী গয়নাগুলো নিতে গেলো গোলাঘরে। এগুলো সব নিয়ে যাবে সে। কিন্তু দেখল কোন গহনাই নেই। সব ফাঁকা। সঙ্গে সঙ্গে পরশের দরজায় গিয়ে লাথি মারলো শাহের। তার ঘাড়ের সমস্ত র*গ ফুলে গেলো। মাথার মগজ টগবগ করে ফুটছে যেন। পরশ এখন ঘুমায় মহলের ভিতরেই। সে তড়িঘড়ি করে উঠে এলো। শাহের হুংকার দিয়ে পরশের কলার চেয়ে ধরলো। মায়া তার রুমে ঘুমিয়েছিলো। শাহের তর্জন গর্জনে তার নিদ্রা ভঙ্গ হলো।
মায়া ভয়,জেদ নিয়ে নিরবে শাহেরের পিছনে দাঁড়ালো। দেখলো শাহের পরশকে মারতে উদ্যত হলো। ক্রোধান্বিত কন্ঠে বলছে,
সব গহনা চুরি করে সরিয়ে নিয়েছেন নাহ? একটা ফকিরনির মাকে বিয়ে করেছেন। বাইরে ঘুমানো বাদ দিয়ে মহলে ঢুকে পড়ছেন। মাঝবয়সে দুজনকে ভিমরতি ধরেছে?
রাজত্বগিরি করবেন তাকে নিয়ে নাহ? আমার মা বিদায় নেওয়ার পর হতেই দেখছি সবার পাখনা গজিয়েছে।
কিন্তু জানেনতো ‘পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।’
পরশ বলিষ্ঠ কন্ঠে বলল,
হাত ছাড়ো বলছি শাহের। ভুলে যেওনা সৎ হলেও আমি তোমার আপন চাচা। পড়াশোনা কম করেছি বলে,কোন চাকরি করিনি বলে নিজেই সবসময় ছোট হয়ে চলছি তোমাগো সাথে। হীনমন্যতায় ভুগছি সবসময়। কিন্তু আর নয়।
ওহ হো। আচ্ছা আচ্ছা। তাহলে আমার মা থাকতে গলার স্বর বিড়ালের মতন মিনমিন হয়ে থাকতো। এখন এত চড়া হয়ে গেলো? আর তাই দখলদারিত্ব শুরু হয়ে গেলো। গহনা সব নিয়ে নিলেন?
তীর্যক স্বরে বলল শাহের।
আমি কিছুই নেয়নি শাহের।
আপনি ছাড়াতো কেউই এগুলোর কথা জানেনা? বললেই আমি মেনে নিবো?
চাচার গলা থেকে হাত সরান বলছি।
আচমকা চেনা মিষ্টি কন্ঠটা রুক্ষ শোনাতেই শাহের হাত সরিয়ে নিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ার দিকে চাইলো। অবলোকন করলো মায়ার অগ্নিরূপ।
মায়া পা বাড়িয়ে শাহেরের সামনে এলো। বলল,
চাচা নয় আমি নিয়েছি ওসব।
শাহের মায়ার গায়ের দিকে তেড়ে গেলো। প্রচন্ড তেজী স্বরে বলল,
তোর এত বড় হিম্মত? তুই আমার মা বাবাকে মেরেছিস। আমি এখন বুঝতে পেরেছি। তুই গুপ্তধনের জন্যই চক্রান্ত করে এই মহলে ঢুকেছিস। সবাইকে তুইই মেরেছিস। রুস্তমের রুমে সেদিন তাকে মারতেই গিয়েছিলি। শুরুতেই আমি তোকে নিয়ে এমন কিছু ধারণা করেছিলাম।
তোকে আমি মেরেই ফেলব আজ। তোর এত বড় দুঃসাহস বলে শাহের প্যান্টের বেল্ট খুলে মায়াকে প্রচন্ডভাবে প্রহার করতে লাগলো। এবং বলল, দাঁড়া তোকে পুলিশেই দিয়ে দিবো। শাহের থানায় ফোন দেওয়ার চেষ্টা করছে।
তফুরা রুমের ভিতর হতে ভীরু
চোখে সব দেখতে ও শুনতে লাগলো এতক্ষণ। এবার আর পারল না। বেরিয়ে এলো। শাহেরকে অনুনয় বিনয় করে বলল,
বাবা থামো দয়া কইরা। ও তোমার চাচাতো বোন। আমার মেয়ে নয়।
শাহের থেমে গেলো। প্রহার করা বন্ধ করলো।
পরশও চিৎকার করে উঠলো রাশভারি কন্ঠে,
হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ। মায়া তোমার সেই ছোট্টবেলার বাবু। তোমার ছোট চাচা আমিনুলের একমাত্র মেয়ে। তাকে মাইরো না বাবা।
শাহের কিহ! বলে আর্তনাদ করে উঠলো। হাত থেকে বেল্ট ফেলে দিলো। দপ করে হাঁটু ভেঙ্গে মায়ার কাছে বসে পড়লো।
পর্ব ১৯