#মায়া_মহল (৭)#রহস্য
কলমে #রেহানা_পুতুল
মায়াকে সবসময় মহলের যেই ব্যক্তিটি অনুসন্ধিৎসু চোখে দেখে আসছে। সেই ব্যক্তি এদের কথাগুলো পাশে দাঁড়িয়ে শুনে নিলো। সে মহলের অন্দরে গিয়ে আড়াল হতে মায়ার দিকে জ্বলজ্বল চোখে চেয়ে রইলো। অপেক্ষা করবে সে আরো কিছুদিন।
সংবাদটি গৃহ পরিচারিকার মাধ্যমে আঞ্জুমান আরাসহ মহলের সবাইর কর্ণহকুহুরে প্রবেশ করতে কালক্ষেপণ হলো না। আঞ্জুমান আরার নির্দেশে মৃতের পক্ষের অভিযোগকারীদের মহলের বৈঠকখানায় ডাকা হলো। তারা কয়েকজন ভিতরে এলো। যেহেতু বিষয়টা ব্যক্তিগত নয়। পারিবারিক ইস্যু। সুতরাং সবাই সত্যিটা জানার অধিকার রাখে।
আঞ্জুমান নিজেই মায়াকে সঙ্গে নিয়ে বৈঠকখানায় গেলো। শাহের,জুবায়ের থেকে শুরু করে মহলের সকল শ্রেণীর সবাই উপস্থিত। বাকি রইলো না সেই ব্যক্তিটিও। সে নিরীহ ভঙ্গিতে বসে আছে স্বেতপাথরের মেঝেতে। গলায় বরাবরের মতো গামছা ঝুলানো।
সবার দৃষ্টিতে উপচে পড়া উৎসুক খেলা করছে। এমনিতেই মহলে মায়াকে নিয়ে কানাঘুঁষা প্রতিনিয়ত চলে অন্যদের মাঝে। কি করে মায়া মহল নামের বাড়িটায় উড়ে এসে জুড়ে বসে গেল সম্পুর্ন অচেনা, অজানা একটি সাধারণ মেয়ে। সে কি মায়াবীনি নাকি ছলনাময়ী?
শাহের গরম কন্ঠে তাদের জিজ্ঞেস করলো,
মাহবুব ভাইর মৃত্যুর সাথে মায়ার কি সম্পর্ক?
দুজন বলে উঠলো,
মাহবুব ভাই আমাদের কাছে বলছিলো টুকটাক ওর কথা?
কি বলছিলো?
বলছে, মায়া মহল বাড়ির মায়া মেয়েটিকে ভালোবাসি আমি। তাকে বিয়ে করবো আমি। ওই বাড়ির কার আত্মীয় শুনলাম মেয়েটি।
আমরা বলছি, সে আপনাকে পছন্দ করে?
মাহবুব ভাই বলছিলো,
করে না। করতে কতক্ষণ। ম্যানেজ করে ফেলবো।
বুঝলাম না? মাহবুবের মারা যাওয়ার সাথে মায়া কিভাবে জড়িত?
রুক্ষ স্বরে জানতে চাইলো জুবায়ের।
তাদের সাথের একটি ছেলে বলল,
জড়িত না। আমরা কেবল জানতে চাচ্ছি মাহবুব ভাইয়ের ব্যক্তিগত কিছু জানেটানে কিনা সে। সামান্য কারণেই উনার মৃত্যু হইলো।
শাহের মায়ার দিকে তাকালো। কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
মায়া এদের বলা সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
কতটুকু কি সব বলো এদের সামনে?
মায়া আত্মবিশ্বাসী সুরে বলল,
কিছুদিন ধরেই আমি কলেজ থেকে আসার সময় মাহবুব নামের উনি আমাকে বিরক্ত করতো। আমি উনাকে পছন্দ করতাম না। এটা বারবার বলেছি। তবুও জোর করে আমাকে দাঁড় করিয়ে নিতো গলির ভিতরে৷ ভালোবাসি বলতো। হাত ধরার চেষ্টা করতো। শেষের দিন উনি জোর করে আমাকে ছুঁয়েছিলো।
তারপর? বলল আঞ্জুমান আরা।
আমি উনার হাত কামড়ে দিয়ে নিজেকে রক্ষা করেছি।
শুনলে তো মায়ার কথা। এবার যেতে পারো তোমরা।
রাগত কন্ঠে বলল শাহের। তারা সবাই চলে গেলো।
আঞ্জুমান আরা অন্যদের আদেশ দিলো চলে যেতে। এরপর মায়াকে রুষ্ট কন্ঠে বলল,
তাহলে আমাদের জানাওনি কেন তুমি এসব? হিম্মত কি তোমার? একা একাই নিজেকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা?
মায়া মিনমিনিয়ে বলল,
আন্টি ভয়ে বলিনি। আমি একটা উটকো ঝামেলা আপনাদের লাইফে,এই ভেবে যদি আমাকে তাড়িয়ে দেন তাই।
আঞ্জুমান আরা মায়াকে বকাঝকা করে নিজ কক্ষে চলে গেলো। জুবায়ের জেদ করলো মা ও ভাইয়ের উপরে। কেন মায়াকে তারা আশ্রয় দিয়ে মহান সাজতে গেলো। একটা যুবতী মেয়ে বাড়িতে থাকলে বহুমুখী ঝামেলা হতেই পারে। আজ একরকম। কাল আরেকরকম। কিছু না কিছু ঘটবেই।
শাহের ক্ষোভে ফুঁসে উঠলো। র*ক্তচক্ষু নিয়ে মনে মনে বলল,
ভাগ্যিস মাহবুব ভাই মরে গেলো। নয়তো মায়াকে টাচ করার অপরাধে আমিই মেরে ফেলতাম তাকে।
মায়ার দিকে চেয়ে গমগমিয়ে বলল শাহের,
তুমি আমার রুমে আসো।
শাহেদের পিছু পিছু মায়া গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চলে গেলো।
শাহের রুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ না করে চাপিয়ে দিলো। নরম আরাম কেদারায় পা তুলে আরাম করে বসলো।
মায়া নারভাস হয়ে গেলো। সংকীর্ণ মনে বলল,
ছোট বাবু দরজা খোলা থাকুক। যদি কারোর প্রয়োজন হয় আসার।
তুমি কেন এটা বলছ তা বুঝতে পেরেছি।ঠিক যেই যেই কারণে তুমি এই কথাটা বলছ।যদি সেই কারণগুলো ঘটে,তার সমাধান আমিই দিবো।
অধরজুড়ে চওড়া হাসি দিয়ে বলল শাহের।
মায়া বোকা বোকা চাহনিতে ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে রইলো শাহের চোখের দিকে। শাহেরের কথাগুলো তার কাছে বড় দুর্বোধ্য ঠেকলো।
শাহের তার সামনের চেয়ারটিতে মায়াকে বসতে আদেশ দিলো।
মায়া আড়ষ্ট হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।
কানে শুনতে পাওনি তুমি?
মায়া শাহেরের মুখোমুখি চেয়ারটায় গিয়ে দুই হাঁটু ঝুলিয়ে বসলো।যথাসম্ভব মাথা ঝুঁকিয়ে রাখলো মেঝের দিকে।
এইতো সূর্বণ সূযোগ নয়ন ভরে তোমাকে দেখার। ভেবেই শাহের তৃতীয় নয়ন দিয়ে মায়ার আপাদমস্তক আবিষ্ট চিত্তে নিবিষ্ট হয়ে দেখতে লাগলো। কামুক দৃষ্টি দিয়ে মায়ার রূপলাবন্য নিংড়ে নিচ্ছে বহুদিনের ক্ষুধার্ত বাঘের ন্যায়।
এই কয়মাসে মহলের তাজা শাকসবজি,পুকুরের মাছ,পালা গরুর দুধ,পালা হাঁসের ডিম, পালা কবুতর, বাগানের ফলমূল এমন সব নির্ভেজাল সব তাজা খাবারগুলো খেয়ে মায়া কিছুটা স্বাস্থ্যবতী হয়েছে। দেখতে যেমন লোভনীয় তেমনি অতি আকর্ষণীয়। তার যৌবন যেন উপচে পড়ছে ফুলে ফেঁপে উঠা উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের ন্যায়। এই ঢেউয়ের প্রবল তোড়ে ভেসে যেতে চায় শাহের নামের যুবকটি। হতে চায় মায়ার গোপন প্রেমিক। পান করতে চায় মায়ার নিটোল অঙ্গের আকন্ঠ সুধা।
শাহের গলা খাঁকারি দিয়ে মায়ার মনোযোগ আনলো নিজের দিকে। মায়া মাথা তুলে চাইলো অন্যদিকে।
কি বলি শোন,যা হওয়ার তাতো হয়ে গিয়েছেই। এখন থেকে কেউ কিছু বললে বা তুমি সমস্যা মনে করলে নিঃসংকোচে আমাকে বলবে। লুকিয়ে বাঁচতে পারবে না। তাতো দেখলেই আজ।
আচ্ছা ঠিকাছে। আমি এখন যাই? পড়া আছে?
কালতো অফ ডে। তুমি সকালে নাস্তা খেয়ে রেডি হয়ে নিও। তোমাকে একটা মোবাইল ও কিছু ড্রেস কিনে দিব৷ আম্মা বলল তাই। আর সেই মোবাইল দিয়ে প্রথম তোমার মাকে ফোন দিবে। এবং তোমার মাকে সেখান থেকে একবারে বিদায় নিয়ে চলে আসতে বলবে। আমি চাই উনি তার মেয়ের কাছেই থাকুক।
মায়া বিষম খেল। বিস্মিত চোখে পলক তুলে চাইলো শাহেরের দিকে।
দৃষ্টি নামাও মায়া। প্রবলেম আছে।
মায়া ফিক করে হেসে ফেলল।
এই মেয়ে হাসলে কেন?
মায়া দৃষ্টি সরিয়ে বলল,
আম্মার আম্মাকে আসতে বলছেন যে সেই আনন্দে।
কলেজে উঠে চালাক হয়ে যাচ্ছ নাহ?
আচ্ছা আমার আম্মা যে একবারে চলে আসবে , আন্টির অনুমতি লাগবে না ছোটবাবু?
একদম নাহ। আমার ইচ্ছাই আম্মার ইচ্ছা। গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠে বলল শাহের।এবার যেতে পারো তুমি।
মায়া চলে গেলো মাকে কাছে পাবে বলে সুখ সুখ মনে । নিজে নিজে বলল,
আমাকে তিন তিনটে চিরকুট কে দিলো তা আপনাকে জানাবো এবার ছোটবাবু।
এদিকে সেই লোকটি থরথর করে কাঁপতে লাগলো। দেয়াল ধরে আস্তে আস্তে কোনভাবে উঠে দাঁড়ালো।ঘাবড়ে গেলো প্রচন্ডভাবে। তোতলানো স্বরে গোপনে বলল,
হে পরওয়ারদিগার! হে মাবুদ! তোমার লীলাখেলা সত্যিই রহস্যময়! নইলে এ কিভাবে সম্ভব! কিভাবে? যেই মেয়েটির অস্তিত্বই নেই দুনিয়াতে। সে কিভাবে বেঁচে ফিরে? কিভাবে এই মহলে ঢুকলো সে? নাকি আমার ভ্রম সবই? আমি দেখতে ভুল করছি। শুনতে ভুল করছি। আজকের এই দিন দেখার আগে আমার মরণ হল না কেন? গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে মাথা ডানে বামে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সে চলে গেলো বাগানের ভিতরের দিকে।
আরো চিন্তা করতে লাগলো, মেয়েটির সাথে কথা না বলে আর উপায় নেই। তবে খুব সংগোপনে বলতে হবে।
কায়রুস কি জানে হানিফ ও বাতেনের মৃত্যু সংবাদ? জানে কি মায়া মহলে মায়া নামের একটি কন্যার আগমনী বার্তা?
চলবে…