#মায়া_মহল ( ৪) #রহস্য
কলমে #রেহানা_পুতুল
এর ঠিক এক সপ্তাহ পরেই,
মায়া মহলের বিশ্বস্ত কর্মচারী বাতেন মারা গেলো। মৃত্যুর কারণ খুব সাধারণ। জ্বর, শরীর ব্যথা এবং সারা শরীর জ্বালাপোড়া।
কিন্তু বাতেনের মৃত্যুটা সবার কাছে স্বাভাবিক মনে হলেও একজনের কাছে কিছুটা সন্দেহজনক লেগেছে। তবুও সেই ব্যক্তি নিরব রইলো। কেবলমাত্র ধারণা করে কাউকে ধরে ফেলা সমীচীন হবে না।
এদিকে কালক্ষেপন না করেই মহলে মায়ার বিষয়টা সবাইকে জানিয়ে দিলো আঞ্জুমান আরা। তাই এখন আর মায়ার লুকোচুরি করে থাকতে হয় না। মহলে তার পরিচয়, আঞ্জুমান আরার গল্প বলার সঙ্গী ও দূর সম্পর্কের আত্মীয়। অন্য সবার মতই নিত্য স্বাভাবিক জীবন যাপন করে মায়া।
একসময় আঞ্জুমান ছোট পুত্র শাহেরকে ডেকে বলল,
মেয়েটার বিষয়ে তার নানার বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর নেওয়া জরুরী নয় কি ?
না আম্মা। লাগবে না। আমাদের কাছে এই মেয়ে চুনোপুঁটি। সে যদি মহলে কোন মতলব নিয়েও আসে। কিংবা যদি তার বলা করুণ গল্পটা মিথ্যা হয়। টিকতে পারবে? পারবে না আম্মা। পিঁপড়ার মতো এক পিষাই তার প্রানবায়ু কেড়ে নিবো আমি নিজেই।
আচ্ছা বুঝলাম। তাহলে ওকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দে। মেয়েটাকে বোকা মনে হয় না। হয়তো আমাদের পরিবারের কোন না কোন উপকার হতে পারে তাকে দিয়ে।
আমি নয় আম্মা। তুমিই বড় ভাইজানকে বলে দিও ভর্তি করিয়ে দিতে।
আচ্ছা তাই হবে। তুই যেতে পারিস।
আঞ্জুমান বড় পুত্র জুবায়েরকে ডেকে পাঠালো। জুবায়ের তাদের পরিবারের বড় ছেলে। দেখতে সুন্দর। ব্যবহার অমায়িক ও মাধুর্যময়। গায়ের রঙ ফর্সা। মাঝারি গড়ন। জীবন যাপনে পরিমিতিবোধ যথেষ্ট। স্বাস্থ্যবান যুবক। স্বভাবে শান্ত কিন্তু কিছুটা দুষ্ট প্রকৃতির। সে গ্রামের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে। এবং সে গ্রামেই থাকে। পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত।
আঞ্জুমান জুবায়েরকে বলল মায়ার বিষয়ে। জুবায়ের মায়ার মুখমণ্ডলে কোমল চাহনি নিক্ষেপ করলো।
পরক্ষণেই বলল মায়াকে,
কাল সকালে তোমার সব পেপারস নিয়ে রেড়ি হয়ে থেকো। ঠিকাছে?
জ্বি ভাইয়া। ঠিকাছে।
জুবায়ের পরদিন মায়াকে নিয়ে গিয়ে তাদের নিকটবর্তী কলেজে ভর্তি করিয়ে দিলো। স্বল্পভাষী জুবায়ের মায়ার সাথে অতিরিক্ত কোন কথাই বলল না। মায়া ভীষণ উৎফুল্ল কলেজে ভর্তি হতে পেরে। নিয়ম করে কলেজে যাচ্ছে। পড়াশোনা করছে। আঞ্জুমান আরার মোবাইল দিয়ে তার মায়ের সাথে যোগাযোগ রাখছে। মাকে বিস্তারিত সে আগেই জানিয়ে দিয়েছে। তার মা দারুণ খুশী মেয়ে একটা ভরসার জায়গায় আশ্রয় পেয়েছে বলে।
মায়া মহলে আকস্মিক আরেজন বিশ্বস্ত কর্মচারী মারা গেলো। নাম হানিফ। এতে সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। হানিফ ও বাতেন নামের দু’জন ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ একই এবং খুব সাধারণ। জ্বর, শরীর ব্যথা এবং সারা শরীর জ্বালাপোড়া।
ডাক্তার, কবিরাজ ডাকা হলো। তারা বলল, স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে দু’জনের অতিরিক্ত অসুস্থতার জন্য। দু’বারই থানায় ইনফর্ম করা হলো। পুলিশ এলো। লাশের পোস্টমর্টেম করা হলো। যথাসময়ে রিপোর্ট এলো। জানা গেলো তাদের কেউই হ*ত্যা করেনি। তারা আত্মহ*ত্যাও করেনি। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তাদের।
কিন্তু মহলের কেউ কেউ এই স্বাভাবিক মৃত্যুটাকে অস্বাভাবিক মনে করছে। এবং একেকজনের আড়ালে একে অপরের দিকে সন্দেহের তীর ছুঁড়ে দিচ্ছে। সেই সন্দেহের বিশেষ তালিকায় পড়ে গেলো বাতেনের স্ত্রী জরিনাও। জরিনা মায়া মহলের হেঁসেল সামলানোর দায়িত্বে নিয়োজিত। বাতেনের সাথে প্রায়ই তার খিটমিট লেগেই থাকতো। এই বিষয়টা মহলে গুঞ্জন সৃষ্টি করেছে।
বিকেলের অবসরে জরিনাকে সবার সামনে ঢাকা হলো। শাহের জিজ্ঞেস করলো,
জরিনা তুমি কি বাতেনের কোন খাবারে কিছু মিশিয়েছিলে?
জরিনা ঘাবড়ে গেলো। বিরক্তও হলো বেশ। চঞ্চল ভয়ার্ত সুরে বলল,
যেইখানে ডাক্তার, বৈদ্য,পুলিশ কইল উনার স্বাভাবিক মরণ হইছে। সেইখানে আপনার আমারে সন্দেহ হয় ক্যান ছোটবাবু? আমি আর আপনেগো কাম করুম না। আমি আল্লার কিরা কইরা কইতাছি, ক্যামনে হের আর হানিফ ভাইর মরণ হইলো তা আমি জানি না। জানে কেবল ওই উপরওয়ালা। ঔষধ পথ্য কি কম করছি কন? নিজেই স্বামীর লাইগা পুড়তেছি।
আচ্ছা তুমি এখন যাও। মন দিয়ে কাজ করো।
জরিনা চলে গেলে শাহের মা আঞ্জুমান আরার রুমে যায়। আঞ্জুমান দুদিন ধরেই আবার শয্যাশায়ী।
রুগ্ন মায়ের শিয়রে বসে কপালে যত্নের হাত রাখে। আঞ্জুমান আরা আধবোঁজা চোখে পুত্রের দিকে চায়।
আম্মা কেমন লাগছে এখন? খারাপ লাগছে বেশি?
এইতো বাবা এখন কিছুটা আরামবোধ করছি। তবে শরীরটা বেশ কাহিল লাগে। মায়া নামের এই মেয়েটির সেবা শুশ্রূষা না পেলে হয়তো সেরে উঠতাম না। বাতেন আর হানিফের আচমকা মৃত্যুটা আমি মেনে নিতে পারছিনা। আমার মাথায় কাজ করে না,জ্বর হলে মানুষ মরে যায় এভাবে? কি যে হলো আল্লাহ জানে। সুস্থ জোয়ান দুটো মানুষ। কতই বা বয়েস হবে এদের? স্বভাব চরিত্রও ভালো ছিলো।
আম্মা আপনার মতো আমারও ডাউট হয়। কিন্তু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না। বিষয়টা এমনও হতে পারে। আসলেই স্বাভাবিক মৃত্যু হলো তাদের দুজনের। এমন কোয়েনসিডেন্স বিষয় ঘটে যায় আম্মা।
হয়তো বাবা। চিন্তা করছি পুরা বাড়িটাকে বড় মসজিদের বড় হুজুরকে দিয়ে বন্ধ করিয়ে নিবো আবার। কোন বালা মুছিবত এসে থাকলেও চলে যাবে।
আচ্ছা আম্মা তাই হবে। আমি উনাকে বলে রাখবো।
মায়া তোমার পড়াশোনার কি খবর? ভার্সিটিতে যাচ্ছতো?
হ্যাঁ ছোট বাবু, পড়াশোনা চলছে ঠিকভাবে। আর সমস্যা হলে জুবায়ের ভাইয়াতো আছেন।
দেখো অবস্থা। তুমিও সবার মতো ছোটবাবু বলা শুরু করলে?
মায়া সংকুচিত দৃষ্টিকে নামিয়ে ফেলে নিচের দিকে।
থাক না বাবা। সমস্যা কি। ছোটবাবুতো সুন্দর ডাক।
আচ্ছা মায়া, তুমি স্বস্তিবোধ করলে এভাবেই বলো। যাইহোক, এটাতো তোমাকে শুরুতেই বলে রাখছি। কোন চ্যাপ্টার বুঝতে প্রবলেম হলে জুবায়ের বা আমি থাকলে আমার থেকে সলভড করে নিবে।
শাহের উঠে চলে যায় মায়ের পাশ থেকে। যাওয়ার আগে মায়ার দিকে আড়চোখে চায়। শাহেরের সেই লুকানো চাহনি মায়ার অগোচরে রয়ে যায়। সেদিন রাতে মায়া তার বিছানার বালিশের নিচে একটি ভাঁজ করা চিরকুট পায়। ভাঁজ খুলে লিখাটা বার দুয়েক পড়লো মায়া।
“নেশার মায়া কাটানো যায়, কিন্তু মায়ার নেশা কাটানো যায় না।”
ঠিক কয়দিন আগে একই স্থানে একই ভাবে এমন আরেকটি চিরকুট পেয়েছে মায়া। সেটাই ছিলো মায়াকে লিখা প্রথম চিরকুট।
তাতে লিখা ছিলো,
” মায়া! বড্ড ভয়ংকর একটা শব্দ! ভোলা যায় না।”
যদিও কথাগুলো রোমাঞ্চিত হওয়ার মতো। আবেগের সায়রে ভেসে যাওয়ার মতো। তবুও মায়া চমকে উঠে। বিষম খায়। দপ করে বসে পড়ে বিছানায়।
মনে করতে থাকে দুটো চিরকুট পাওয়ার সময়ের ব্যবধান। হুম মনে পড়েছে। ঠিক দশদিন আগে পেয়েছে এই চিরকুটটি। কে হতে পারে ভেবেই মায়া দিশেহারা। জুবায়ের ভাই নাকি। তিনি মাঝে মাঝে কেমন করে যেনো দুষ্টমিষ্ট চোখে তাকায়। তবে যেই দিয়েছে সে একজন মানুষ এবং পুরুষ মানুষ। এটা নিশ্চিত।
সে নিজেকে জিজ্ঞেস করে,
আঞ্জুমান আণ্টিকে বিষয়টা জানাব? নাকি জুবায়ের ভাই,শাহের ভাইকে জিজ্ঞেস করবো? সরাসরি? না না জিজ্ঞেস করা যাবে না। কেমন দেখায়। ভারি বিব্রতকর সিচুয়েশন ক্রিয়েট হবে পরে।
মায়া বুদ্ধি বের করে। জুবায়ের ও শাহের দুজনের রুমেই স্টাডি নিয়ে যাবে কোন একটা টপিক ধরে। তাদের এটিচ্যুড দেখে অনুধাবন করার চেষ্টা করবে, কে তাকে চিরকুট লিখেছে। এখন কেবল সেই উপযুক্ত পরিবেশের দরকার।
বাতেন ও হানিফের মৃত্যু নিয়ে সেই একই ব্যক্তির সন্দেহ গাঢ় হলো। সে পুকুর ঘাটে একাকী বসে চিন্তা করতে থাকে,
ডাক্তার ও পোস্টমর্টেম রিপোর্ট মিথ্যা হইতে পারে না কিছুতেই। সেইটা ঠিক। তবে দুজনের মৃত্যুর লক্ষনগুলো যেহেতু একই ছিলো। সুতরাং এই মৃত্যুর পিছনে ভিন্ন রহস্য আছে। কিন্তু কি সেই রহস্য?
চলবে…৪