#মায়া_মহল (৩)#থ্রিলার
কলমে #রেহানা_পুতুল
কে এই গুপ্তচর? কি তার পরিচয়? এত লোভনীয় চমৎকার রান্নার হাত তার? কিন্তু তাকে মেরে ফেললে আমার প্রিয় চিকেন স্যুপ খাব কিভাবে? না না এটা হতে পারে না। সামান্য রসনা তৃপ্তির জন্য মহলের নিয়ম ভঙ্গ করাও অন্যায় হবে।
রুমের বাইরে মহলের পালিত কুকুরের ঘেউঘেউ আওয়াজে মায়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ মেলেই দেখতে পেলো মহলের ছোটবাবু নামে পরিচিত সাদমান শাহেরকে। যার নির্দেশে সে এখানে বন্দী। শাহের দেখতে সুদর্শন যুবক। সুপুরুষ। লম্বা চওড়া। স্বভাবে চঞ্চল। গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ। মুখের গড়ন লম্বাটে। মেজাজ খিটমিটে। অল্পতেই রেগে যায়। শহরে পড়াশোনা শেষ করেছে তিন বছর আগে। সেখানে পিতার ব্যবসা দেখাশোনা করে। মাঝে মাঝে গ্রামে আসে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল ঘাড় অবধি। চোখের রঙ বাদামি। হাতে সবসময় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ঘড়ি পরে থাকে। ইউজ করে নামি-দামি সব পারফিউম।
মায়া ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। সরু চোখে চায় শাহেরের দিকে।
শাহের পায়ের উপর পা তুলে নিলো নবাবি স্টাইলে। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
তোমার নাম কি?
জ্বি মায়া।
দূর্বল কন্ঠে জবাব দেয় মায়া।
তুমি কি আমাদের এখানে এসে কোন স্যুপ রান্না করেছ?
হুম।
কে বলেছে তৈরি করতে?
স্যুপ তৈরির কথা আপনার আম্মাকে বলছিলো আপনাদের কাজের মেয়ে। শুনে বললাম আমি ভালো স্যুপ বানাতে পারি। তখন আপনার আম্মা বলল, তাহলে তুমি বানাওতো। দেখি আমার ছেলেটার রুচিটা ফিরে আসে কিনা ভোজনে।
স্যুপ তৈরি কিভাবে শিখেছ?
আমি শহরে এক আত্মীয়ের বাসায় থাকতাম। তখন ইউটিউব দেখে শিখে নিয়েছি।
হুম। তোমাকে মেরে ফেলা হবে। জানতো?
হুম।
বাঁচতে চাও?
নাহ।
কেন?
যা চেয়েও পাওয়া যাবে না। তা চাওয়াটাই বোকামি ও অনর্থক।
মায়ার বুদ্ধিদীপ্ত চতুর জবাব, শুদ্ধ বাংলায় কথাবলা, শব্দচয়ন, উচ্চারণ শুনে শাহের অবাক হয়। ভাবে এই মেয়ে কিভাবে কাজের লোক হয়। অদ্ভুত তো!
তবুও নিজ সিদ্বান্তে সে অটল থাকে। কারণ তার বিশ্বাস, মায়াকে কেউ কৌশলে পাঠিয়েছে এই বাড়িতে। সে সত্য মিথ্যা যাচাই করার প্রয়োজন মনে করে না।
নির্জন রুমে মায়াকে একা রেখে শাহের বেরিয়ে যায়। রুস্তমকে আদেশ দেয় রাতের আঁধারেই যেন মায়াকে মেরে পুঁতে ফেলা হয়৷
রাতে বাইরে থেকে মহলে ফিরে আসে আঞ্জুমান। মায়াকে রুমে না দেখেই তার বুক কেঁপে উঠলো। সে জিজ্ঞেস করার আগেই সব শুনে যায় মায়া সম্পর্কে। ব্যস্ত পায়ে পুত্রের রুমে যায়।
শাহের ধারণা করেছিলো তার মা উদ্বেগ প্রকাশ করতে এসেছে তাদের মহল নিয়ে। সে মাকে দেখে গলা বাড়িয়ে বললো,
আম্মা বসেন। উৎকন্ঠায় থাকতে হবে না আর। জানি এতক্ষণে সব শুনে গিয়েছেন। দেখলেন তো, আপনার অনুপুস্থিতে মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে আপনার রুম থেকেই উদ্ধার হলো চোর।
আজ রাতেই মেয়েটির জীবনাসান ঘটবে। মূল গেইটের কর্তব্যরত গার্ডকে এ মাসেই বিদায় করে দিবো। জলজ্যান্ত একটা মেয়ে গার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাড়ির ভিতরে কিভাবে এসে পড়লো?
মেয়েটির প্রাণ নেওয়ার পূর্বে তার মুখ থেকে আমি কিছু শুনতে চাই। ওকে আমার শয়ন কক্ষে পাঠিয়ে দে।
শাহের আশ্চর্য হলো। অবাক কন্ঠে বলল,
আম্মা, কই এর আগেতো কারো সম্পর্কে শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করেন নি? আজ হঠাৎ?
এর আগে কি এই বাড়িতে এমন করে কোন মেয়ে প্রবেশ করেছে? কোন মেয়ের মাথা কাটা পড়েছে?
নাহ আম্মা। সব ছিলো ছেলে মানুষ।
এজন্যই আমি জানতে চাই মেয়েটিকে। রুস্তমকে খবর দে দ্রুত।
গমগমে স্বরে আদেশ দিয়ে পুত্রের রুম থেকে প্রস্থান নেয় আঞ্জুমান আরা।
শাহের উঠে যায় মায়ের আদেশ মান্য করে। চোয়াল শক্ত করে মায়াকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে মায়ের রুমে। চেয়ারে আরাম করে বসে পড়ে হেলান দিয়ে।
আঞ্জুমান আরার নির্দেশে মায়া রাতের খাবার খেয়ে নেয়। সে পুত্রকে বলে,
তুই বসে আছিস কেন?
আপনি যা শুনবেন,আমিও তা শুনতে চাই।
আচ্ছা বোস তাহলে।
মায়া তোমার কোন আপত্তি আছে আমার পুত্রের সামনে কথা বলতে?
না। বেগম সাহেবা। নেই।
তাহলে সত্যি সত্যি করে সব বলো। কে তুমি ? কি পরিচয়? কেন, কিভাবে আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়লে? তোমার বলায় কোন ফাঁক ফোকর প্রমাণ হলে মরবে তো নিশ্চিত। কিন্তু যন্ত্রণা পেতে পেতে মরবে। মনে রেখ।
শুনে মায়ার মাঝে বিশেষ হেলদেল দেখা গেল না। সে ভাবলেশহীনভাবে রুমের দেয়ালের দিকে চেয়ে রইলো।
পরক্ষণেই মলিন মুখে মায়া বলতে লাগলো,
আমি চরের মেয়ে। আমার আব্বা নেই। আম্মার মুখে শুনেছি আব্বা আমার শিশুকালেই মারা গিয়েছে। আমরা তিনবোন। কোন ভাই নেই। আমার বাকি দুইবোন মারা গিয়েছে। একজন বিলের ধারে শাক তুলতে গিয়ে সাপের কামড় খেয়ে মারা গিয়েছে। আরেকজন ডায়রিয়া হয়ে চিকিৎসার অভাবে মারা গিয়েছে। আমার দাদা দাদি,ফুফু, কেউই নেই। নানার পক্ষের কেউ কেউ আছেন। আম্মা আমাকে নিয়ে একা হয়ে পড়েন। পরে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় আম্মাকে আমিসহ ঢাকায় নিয়ে যায়। তারা ধনী লোক। সবাই বড় বড় চাকরি করে। আম্মা তাদের বাসার দেখাশোনা ও সব কাজ করতো। এবং বিনিময়ে আম্মার শর্ত অনুযায়ী আমাকে তারা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়। আমি এবার এসএসসি পাস করেছি। মোটামুটি সব ঠিকঠাক চলছিলো। কিন্তু আমি কলেজে ভর্তি হতে চাই। তারা আর পড়াতে চাচ্ছে না।
তারচেয়েও বড় বিপদ হলো তাদের এক রিলেটিভ ছেলে কয়েকমাস ধরে আমার পিছনে লেগে পড়েছে। সে নাকি আমাকে পছন্দ করে। তাই বিয়ে করতে চায়। এতে তারাও রাজী হয়ে যায় তাদের পারিবারিক স্বার্থে। তাই আমি আম্মাকে বলে গ্রামে চলে আসি।
উদ্দেশ্য নানাদের বাড়িতে থেকে গ্রামের কলেজে ভর্তি হবো। আর টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ মেটাবো। বাস থেকে নেমেই রিকসার জন্য হাঁটতে থাকি। দেখি আমাকে অচেনা দুটো ছেলে ধাওয়া করছে। তাই দৌড়ে আপনাদের বাড়িতে ঢুকে যাই। মনে হলো, এই বাড়ির চারিধারে প্রাচীর ঘেরা রয়েছে। এখানে চাইলেও তারা হুট করে আসতে পারবে না। তবে মনে হয় তারা পরে আর আমাকে দেখতে পায়নি। তখন রুস্তম নামের লোকটি আমাকে দেখে যায়। ধরে নিয়ে বাগানে বেঁধে রাখে।
মায়া কথাগুলো একনাগাড়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বলে থেমে যায়।
তার পরের সময়ের ঘটনার বিবরণ আঞ্জুমান আরা ছেলেকে শোনায়।
শাহের মায়াকে বলল,
অচেনা ছেলেরা তোমাকে ধাওয়া করার কারণ?
মনে হয় সেই ছেলে এদের লাগিয়েছে আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ও এমন বেপরোয়া টাইপের ছেলে। এমনি কি আর পালিয়ে আসছি ছোটবাবু?
মায়ার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো নিরবে। শাহের ও তার মা দৃষ্টি বিনিময় করলো ইশারায়।
তোমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে তো? জিজ্ঞেস করলো শাহের।
হুম আনছি ছোট বাবু।
আঞ্জুমান আরা বলল,
আনছে। ছোট একটা ব্যাগ ছিলো তো।
তোমার কথা বিশ্বাস করলাম। তাই তোমার মৃত্যুদণ্ড সাময়িকভাবে স্থগিত মায়া। তোমাকে আমি কলেজে ভর্তি করিয়ে দিবো। বিনিময়ে তুমি আমার আম্মার দেখাশুনা করবে। রাতেও আম্মার রুমেই ঘুমাবে। আম্মা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে যায়। আর আমি যখন চাইবো তোমার হাতের স্যুপ বানিয়ে খাওয়াবে আমাকে। এবং তোমার মায়ের সাথে যোগাযোগ করবে সবসময়।
শাহের! তুই! কি বলছিস বাবা! তুই স্বাভাবিক আছিস তো?
বিষ্ফোরিত চোখে চেয়ে বলল আঞ্জুমান আরা।
শাহের বসা থেকে উঠা দাঁড়ায় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে। দুর্বোধ্য হাসি দিয়ে বলল,
আম্মা বিস্মিত হচ্ছেন? মায়া মহলে নতুন আলোড়ন সৃষ্টিকারী নতুন কিছুর সূচনা হলো। তাইতো? ফাঁসীর আসামিওকে কিন্তু মুক্ত করে দেওয়া হয় আম্মা। যদি সিচুয়েশন তেমন হয়। আপনিতো এটাই চেয়েছেন আম্মা। চমকাচ্ছেন কেন তাহলে?
আঞ্জুমান আরা ছেলের কথার প্রতিউত্তর না দিয়ে চুপ থাকে।
এরপর মায়ার দিকে দৃষ্টি তাক করে শাহের বলল,
তবে এটা জেনে রাখ,কখনো যদি তোমার মিথ্যা কিছু ধরা পড়ে,আমার হাতে তোমার নির্মম মৃত্যু হবে। নির্মম!
শাহের ভারি ভারি পা ফেলে মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
এর ঠিক এক সপ্তাহ পরেই,
মায়া মহলের বিশ্বস্ত কর্মচারী বাতেন মারা গেলো। মৃত্যুর কারণ খুব সাধারণ। জ্বর, শরীর ব্যথা এবং সারা শরীর জ্বালাপোড়া।
কিন্তু বাতেনের মৃত্যুটা সবার কাছে স্বাভাবিক মনে হলেও একজনের কাছে কিছুটা সন্দেহজনক লেগেছে ।
চলবে…৩