#মায়া_মহল (১৮) #রহস্য
কলমে #রেহানা_পুতুল
শাহের মায়ার গলা টিপে ধরে। রক্তচক্ষু নিয়ে বলে,
তুমি এর কাছে এলে কেন? সমস্যা কি তোমার? ভালোবাসি বলে মনে করনা তোমার সাতখুন মাফ। উল্টাপাল্টা চললে তোমাকে বরফ কুচি বানিয়ে নিবো একদম।
আপনিও মনে করবেন না ভালোলাগে বলে আপনার কোন অপরাধ আমি টলারেট করবো। কিমা বানিয়ে ফেলব এক্কেবারে কুচি কুচি করে।
শীতল কন্ঠে বলল মায়া।
মায়ার শাণিত কথার আঘাতে শাহের বিষ্ফোরিত চোখে তাকালো মায়ার দিকে। বলল,
তোমার এত দুঃসাহসী হয়ে উঠার রহস্য আমি ভেদ করবোই।
মায়া শাহেরের কথার প্রতিউত্তর করল না। তার পাশ কেটে নিরবে গুটিগুটি পায়ে মহলের ভিতরে চলে গেলো।
শাহের বের হয়ে পরশকে ডাকল। থমথমে মুখে বলল,
চাচা, রুস্তম মায়ার সাথে প্রচন্ড দুর্ব্যবহার করেছে। তাই গলা গলা কেটে দিয়েছি। গেটের সিকিউরিটি গার্ড দুজনকে ডেকে এর লা*শ যা করার করে ফেলেন। এই দায়িত্ব আপনার এখন। তবে আপনারা তিনজন ছাড়া কেউই যেন বিষয়টি না জানে। সে নিখোঁজ বা জ্বীন ভূতে তুলে নিয়ে মেরে ফেলেছে,এটাই যেন প্রচার হয়।
আইচ্ছা ছোটবাবু তাই হবে।
রুস্তম মারা পড়লো বলে পরশের তেমন দুঃখবোধ হল না। কেননা মায়া তার ভাতিজি। এতিম মায়ার প্রতি পরশের মমত্ববোধ অসীম। শাহের হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে গিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। বেড সাইড় টেবিলটার উপরে থাকা পানির গ্লাসটা হাতে নিলো। গলা তুলে ঢকঢক করে পুরো গ্লাস পানি খেয়ে ফেলল।
কিছুক্ষণ বাদেই মায়ার মোবাইলে টুং করে মেসেজ আসার শব্দ হলো।
মায়া দেখলো শাহেরের মেসেজ,
না ঘুমিয়ে থাকলো আমার রুমে আসো।
মায়া ভয় পেয়ে গেলো।
রিপ্লাই মেসেজ দিলো,
ভাইয়া খুব খারাপ লাগছে। ঘুমাবো। কাল দেখা করি কলেজ থেকে এসে?
ওকে, না আসতে পারলে মেসেজে বলো,
রাতে কেন তুমি মহলের বাইরে গেলে? কেন রুস্তমের রুমে গেলে? কি কাজ ছিলো তোমার তার কাছে? নয়ছয় করে আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করলে পরিণাম সুখকর হবে না তোমার। বুঝে নিও কিন্তু।
মায়া মেসেজটা বার তিনেক পড়লো। একটু সময় নিয়ে বুক ভরে স্বাস ছাড়লো।
ফিরতি রিপ্লাই দিলো মায়া।
আচ্ছা ভাইয়া। সত্যি বলব কারণ টা। একটু সময় দিন আমাকে। তবে যেই কারণেই যাই না কেন আমি রুস্তমের কাছে,তিনি আমাকে বিশ্রীভাবে টাচ করতে চেয়েছেন।
শাহের মায়ার রিপ্লাই দিলো,
আচ্ছা মানলাম। তবে তোমাকে কেউ স্পর্শ করা থেকে মুক্ত করার একটা গুরুত্বপূর্ণ ওয়ে আমি খুঁজে পেয়েছি।
মায়া অবাক হওয়ার ইমুজি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
কি ভাইয়া?
সেটা এভাবে বলা যাবে না। মুখোমুখি বলতে হবে। সময় করে মিট করো। আর বিষয়টা অবশ্যই গোপন রাখবে, তোমার ভালোর জন্য। নয়তো এবার আমি শতচেষ্টা করেও আমাদের বাড়িতে তোমার থাকা রক্ষা করতে পারব না। আম্মা তোমাকে বের করে দিবেই। বাই।
আচ্ছা ভাইয়া। শুভরাত্রি, বলে মায়া তন্দ্রাঘোরে চলে গেলো। শাহের ও লম্বা হাই দিতে দিতে নিদ্রাঘোরে তলিয়ে গেলো।
পরেরদিন সকালে মর্জিনা রুস্তমকে ডাকতে গেলো। কোথাও না পেয়ে চারদিকে খোঁজাখুঁজি শুরু করলো। গেইটের গার্ডরা কিছুই জানেনা বলে মিথ্যা বলল তার কাছে। আঞ্জুমান শাহেরের রুমে গেলো।
উৎকন্ঠার সঙ্গে জানতে চাইলো ,
শুনছিস বাবা,রুস্তমকে পাওয়া যাচ্ছে না। মহলের কোথাও নেই।
শাহের চোখ বড় বড় করে ফেলল।
বিচলিত স্বরে বলল,
কি বলছ মা? দেখিতো বলে নিজেই উঠে গেলো হন্তদন্ত হয়ে। সবাইকে জিজ্ঞেস করলো আঞ্জুমানকে পাশে রেখেই। বাকিরাও খুঁজতে লাগলো। বাড়ির বাইরে বাজারে গিয়েও কোন হদিস বের করতে পারল না রুস্তমের। কিছুক্ষণ পর মহলে ফিরে এলো শাহের। মায়ের সামনে রুস্তমকে নিয়ে ভাবতে লাগল কই গেলো বলে।
আঞ্জুমান আরা নিজ থেকেই বলল,
নাকি সে নিশি রাতে গাঁজা,তাড়ি খেতে পুকুর পাড়ে গিয়েছিল। অমনি ভূত,প্রেত মেরে ফেলেছে?
ঠিক বলছ আম্মা। হয়তো। এটা হতেই পারে। ইমপসিবল কিছুই নয়।
পাশ থেকে কুমকুম বলল,
হতে পারে নয় ছোট বাবু। এটাই হইছে। এই লোক মাঝে মাঝে নেশা করে দক্ষিণ পুষ্করিণীর পাড়ে গিয়া। এদিকে পারে না নেশার গন্ধ বাড়ির ভিতরে ছড়ায়া যাইবো তাই।
রুস্তমের কবর যেখানে যেভাবে দেওয়া হয়েছে, সেখানে কেউই যায় না। যদিও সেটা কবরস্থানও নয়।
এদিকে পরশের সাথে অল্পস্বল্প কথা বলতে বলতে মায়ার পালিত মা তফুরার সখ্যতা গড়ে। তা ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতায় রূপ নিলো। যা কিনা মায়ার ও অনান্যদের নজরে পড়েছে। তবে শাহের ও আঞ্জুমান টের পায়নি এই বিষয়টা। কারণ এই দুজন ব্যক্তির সামনে তফুরার যাওয়া পড়ে খুব অল্প সময়ে। কুমকুম ও মর্জিনা তফুরা ও পরশকে নিয়ে গুঞ্জন তৈরি করে। নানা মুখরোচক কথা বানিয়ে ফেলল তারা।
শাহের মায়ার জন্য রোজ অপেক্ষা করে। কিন্তু নানা অজুহাতে মায়া শাহেরকে এড়িয়ে যায়। তার ভিতরে একটাই শংকা, রুস্তমের বিষয়ে সত্যি বলতে গেলে সে ধরা পড়ে যাবে। মুখ ফসকে কিছু কথা বের হয়েও যেতে পারে। কিন্তু সেই সময় এখনো হয়নি। তাকে পালিয়ে থাকতে হবে শাহের থেকে।
এভাবে মায়ার ফাইনাল পরিক্ষা সন্নিকটে চলে এলো। ভালোভাবে পরিক্ষা শেষও হয়ে গেলো। শাহেরও পরিক্ষা ও পড়াশোনার বিঘ্ন হবে বলে মায়াকে অহেতুক কাছে ডাকেনি। মায়ার জন্য তার হৃদয়টা কখনো পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠে। কখনো ফুলের ন্যায় কোমল হয়ে উঠে। এই মহলে মায়ার আগমন,এতগুলো মানুষের মৃত্যু, তার শরীরে থাকা তাবিজ, রাতে একাকী রুস্তমের রুমে যাওয়া,তার সাথে সাহসী কন্ঠে কথা বলা, সবকিছু মিলিয়ে রহস্যময়ী মনে হচ্ছে মায়াকে তার কাছে। একটা নিম্নবিত্ত সাধারণ ঘরের অসহায় একটি মেয়ে কিভাবে এমন হতে পারে?
মায়াও এতদিন অপেক্ষার সীমানায় দাঁড়িয়ে প্রতিক্ষার প্রহর গুণেছে একজন মানুষের জন্য। এখন পরিক্ষা শেষ। এবার ফাইনাল খেলা খেলবে সে। হয় এসপার নয় ওসপার। কিভাবে তাকে মারবে সে ফন্দী আঁটছে মনে মনে। নারী হয়ে নারীর প্রতি বিধ্বংসী হওয়ার ফল পাবে এবার হাড়ে হাড়ে।
শাহের মায়াকে তার রুমে ডাকলো। বলল,
কাছে এসে বসো।
মায়া বসলো।
আমার চোখের দিকে চাও।
মায়া চাইলো।
কিছু দেখতে পাচ্ছ?
হুম।
কি?
আমার জন্য অনুরাগ,ভালোবাসা,প্রেম।
শাহের আপ্লুত হয়ে পড়লো। মায়ার হাত ধরে আকুল নয়নে বলল,
জানি তুমি বিষাক্ত, তবুও আমি তোমাতে আসক্ত। উদ্ধার করো আমায়।
মায়া বলল,
কিভাবে? আমি শুধু বিষাক্ত নই। জেহের। আস্ত একটা বিষের পেয়ালা। ছুঁতে আসলেই শেষ। ভাবেন এবার।
আমি যে শেষ হতে চাই মায়াবিনী, তোমার আকন্ঠ সুধা পান করতে চাই তৃষ্ণার্ত পথিকের ন্যায়। শাহের মায়ার কোমর পেঁচিয়ে ধরলো। হ্যাঁচকা টানে মায়াকে নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। মায়ার উষ্ণ বুকে চিবুক, ঠোঁট ঘষতে লাগলো বিক্ষিপ্তভাবে। মায়া ক্ষণে ক্ষণে দুলে উঠছে। কিন্তু শাহেরকে বাধা দিলনা। বরং এক নবসুখের আলিঙ্গনে নব নব শিহরণে মনপ্রাণ আন্দোলিত হয়ে উঠলো। শাহেরের গভীরে তলিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে নিবিড়ভাবে।
শাহের টের পেলো। মায়াকে বলল,
যেটা তোমাকে পরিক্ষার আগে বলতে চেয়েছি। সেটা এখন বলছি।
বলেন শুনি। মোলায়েম কন্ঠে বলল মায়া।
তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তাহলে তুমি আমাদের মহলের রানী হয়ে যাবে। আর কেউই তোমার সুবাস নেওয়ার দুঃসাহস দেখাবে না। ধরো, এই পর্যন্ত যারা তোমাকে স্পর্শ করতে চেয়েছে বাজেভাবে। তারা সবাই জানে তুমি আমাদের একজন আশ্রিতা মাত্র। তাই দ্বিতীয়বার ভাবে না তোমাকে ছুঁতে গিয়ে। কিন্তু শাহেরের বউ হয়ে গেলে কেউই আর এমন করবে না তোমার সঙ্গে। তুমি মর্যাদার সঙ্গেই চলতে পারবে। আর তোমার আম্মাও এখানে আছে। আশাকরি তিনিও আমার মতো সুপাত্র পেয়ে খুশী হবেন।
মায়া ভেবে দেখলো শাহেরের যুক্তিটা শতভাগ পারফেক্ট। তাই সে আপত্তি করল না। বরং লাজুক হেসে বলল,
আপনার যা ভালো মনে হয় তাই করেন।
দুইদিনের মধ্যেই শাহের মায়াকে নিয়ে কাজী অফিসে চলে গেলো। বিয়ে করে নিয়ে এলো। মাথায় ওড়না দিয়ে মায়া আঞ্জুমান কে পা ছুঁয়ে সালাম দিতে গেলো। তিনি পা সরিয়ে নিলেন। শাহেরের সালামও নিলেন না। শাহের চলে গেলো মায়ের সম্মুখপান হতে। এরপর মায়াকে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে লাগলেন আঞ্জুমান আরা। ছোটলোক,নষ্টা ,লোভী, চরিত্রহীন, বলে মায়াকে নানানভাবে কটাক্ষ করলো।
তার দুইদিন পরের এক ভোরের ঘটনা। কুমকুম অসুস্থ। তাই আঞ্জুমান মর্জিনাকে দিয়ে মায়াকে নিজের কক্ষে ডেকে নিলেন।
শ্বাশুড়ি মা ডেকেছেন আমায়? নমনীয় স্বরে বলল মায়া।
এই ছোটলোকের বাচ্চা ছোটলোক? কে তোর শাশুড়ী ? কিসের শাশুড়ী আম্মা? তুই আমার পুত্রবধূ হওয়ার যোগ্যতা রাখিস না। তোর পরিচয় আমার কাছে একজন আশ্রিতাই। আমাকে ডায়াবেটিসের ইনসুলিন দিয়ে ভাগ বলছি।
মায়া কিছুই বলল না আঞ্জুমান আরাকে। ফ্রিজ থেকে ইনসুলিন বের করে নিলো। তার প্রেসক্রিপশন হাতে নিলো মায়া। সকালে কতটুকু দিতে হবে সেই পরিমাপটা দেখে নিলো। মেডিসিন বক্স থেকে সিরিজটি হাতে নিলো। ইনসুলিন ভরে নিলো। আঞ্জুমান আরা তাকে হাতের বাহু দেখিয়ে দিলো। মায়া তার দেখানো স্থানেই সিরিজটি পুশ করে দিলো।
মায়া তার সামনেই বসে রইলো। আঞ্জুমানের দিকে সুক্ষ্ম চাহনি নিক্ষেপ করলো।দেখলো আঞ্জুমান আরার শরীর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছে।
আঞ্জুমান আরা তাকে বলল,
মনে হয় আমার ডায়াবেটিস নীল হতে যাচ্ছে। ইনসুলিনের ডোজ বেশি পড়ে গেলো নাকি?
মায়া আস্তে করে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মরা কন্ঠে বলল,
বেশি পড়ে যায়নি বড় চাচী। আপনার দেবর আমিনুলের মেয়ে মায়া ইচ্ছে করেই আপনাকে ডোজ বেশি দিয়েছে।যেমন করে আপনিও আপনার স্বামীর মনে তার বাবা মাকে মেরে ফেলার জন্য ইন্ধনের ডোজটা বেশী দিয়েছেন।
আঞ্জুমান আরা আৎঁকে উঠলো।
কে..কে..তুমি?সেই মায়া কিভাবে তুমি হও? তুমিতো…
আঞ্জুমান আরার মুখের বাক্য কেড়ে নেয় মায়া। হিইইসস… বলে নিজের ঠোঁটের উপর আঙ্গুল চেপে ধরে থামিয়ে দেয় তাকে। বলে,
পরপারে ভালো থাকবেন বড় চাচী। আপনাদের অপরাধের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নিজেই অপরাধী হয়ে গেলাম। চাচাকেও আমিই শেষ করে দিয়েছি। আজ তবুও শান্তি।
চলবে… ১৮