#মায়া_মহল (১৫) #রহস্য
কলমে #রেহানা_পুতুল
আমি তাদের আড়ালে থেকে সব শুনছি দেখতে না পেলেও। সেই রাতেই তোমার বাবার হাত পা বেঁধে কায়রুস নিজ হাতে জ*বা করে ফেলে চাপাতি দিয়ে। জল্লাদ রুস্তম তাকে সহযোগিতা করছে। আরো দুজন সহযোগী ছিলো। তারা নেই এখন মারা গিয়েছে। এবং মহলের কবরস্থানেই সেই গভীর রাতের নির্জনতায় আমিনুলের লাশ কবর দিয়ে ফেলেছে জানাযা ছাড়াই।
মায়া নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে।শপথ করে বলে,
খু*নী কায়রুস, তোর প্রাণ আমার হাতেই। কসম খোদার।
মায়ার সৎ চাচা পরশ আরো বলতে লাগল,
এসবে আমিও ছিলাম । নিরুপায় ছিলাম মা। চাকরের মতো সব মাইনা নিই আর খাইটা চলি বলেই আজও দম ফালাইতে পারতেছি এই দুনিয়ায়। সেদিন যদি তার বিপক্ষে যাইতাম, তাইলে সেই রাইতে আমারেও জিন্দা কবর দিতো। আমার বাবা,মা,বইন কেউই নেই। কে করবে আমার হয়ে প্রতিবাদ। কায়রুসের হিংস্রতার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতাম না। আর এই দুনিয়া টাকার গোলাম। তাই কেউ তার বিরুদ্ধে থানা,পুলিশ করার কথা চিন্তাও করে না।আবার সরাসরি কারো চউক্ষে তার সব অপরাধ ধরাও পড়ে নি।
তো তারপরের রাইতেই কায়রুস আমারে ডাইকা শীতল গলায় কইলো,
ধানের গোলায় আমিনুলের বউ বন্দী আছে। ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে রেখেছি। তার মেয়েকেও ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। মরার নয় সেটা। ঘুমিয়ে থাকার। তার মায়ের চার ঘন্টার আগে জ্ঞান ফিরবে না। ফিরতে ফিরতে সে আর বেঁচে রইবে না। কোলের মেয়ে এমনিতেই মরে যাবে। চরের জঙ্গলে নিয়ে যা গাড়িতে করে। বেঁধে রেখে তোরা চলে আসবি। তোর সঙ্গে কদম ও কাল্লু যাবে। কাল্লু গাড়ি চালিয়ে নিবে।
ব্যাস যেই হকুম সেই কাজ। নিয়ে গেলাম তোমারে সহ তোমার মায়েরে। চরের গহীন জংগলে সুপারি গাছের লগে বাইন্ধা রাখি। তারপর আমরা চইলা আসি। এই হইলো তোমার পরিবারের নিষ্ঠুরতম কালো বেদনাদায়ক ইতিহাস।
যেই অপরাধ, অনুশোচনা সাপের ছোবলের মতো প্রতিমুহূর্তে আমার বিবেকরে দংশন করে।
তুমি মহলে আওনের পরেই যখন লাগাতার তিনজন মানুষ মইরা গেলো, তখনই আমার ডাউট হইতেছিলো তোমার উপরে। তুমি কি এই বাড়ির একমাত্র কন্যা নাকি। সবার মরণের বিষয়ে তুমি জাননা এটা সত্যি। তোমার তাবিজের বিষয়টাও আমি বলি শোন,
তুমি জন্মাবার পর তোমার মাকে নিয়া তোমার নানার বাড়িতে যাই আমি। তোমারে দেইখা সবাই অবাক চোখে চাইয়া থাকতো। কইতো এত্ত সুন্দর কাজলের মাইয়া। আবার তোমার মাও ডরাইতাছিল খুউব। যদি তুমি মইরা যাও তাই। কারণ এই বংশের সব কন্যারা মইরা যায়। তোমার নানী করলো কি, তোমার মা,ও আমারে নিয়া অনেক দূরে এক বিখ্যাত দরবেশের কাছে গেলো। সব কইলো। সেই দরবেশ তোমার কোমরে থাকা এই তাবিজটা দিলো। এবং তোমার মাকে কইলো,
তোর মেয়ের শরীরে সবসময় এই তাবিজ বাইন্ধা রাখবি। দেখবি সহজে তার কোন অসুখবিসুখ হইবো না। ইনশাআল্লাহ। সব নিয়মগুলা মেনে চলবি তিনমাস পর্যন্ত। তবে তার বিয়ার পরে এই তাবিজ সঙ্গে না রাখলেও চলবে। রাখতে পারলেই ভালো তবে।
কেউ কখনো তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কেউ যদি তার শরীরে বদ নজরে হাত দেয়,কুদৃষ্টি নিক্ষেপ করে, তারপরেই সে মারা যাবে।
এই বিষয়টা আমি ছাড়া এই মহলের দ্বিতীয় কেউই জানে না। কাজল আমারে অনুরোধ করে বলছিলো বিষয়টা যেন গোপন রাখি। তুমিও জানতানা এইটা।
মায়া আশ্চর্য হলো শুনে। তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। দুলে উঠলো তার সমস্ত পৃথিবী। তারজন্য এতগুলো মানুষ মরে গেলো! কেন যে তারা তার শরীরে হাত দিলো। হায় খোদা! সে কোমরে থাকা তাবিজটার উপরে হাত বুলিয়ে নিলো। কৃতজ্ঞতা জানালো নানীকে। শুকরিয়া আদায় করলো স্রষ্টার প্রতি।
পরশকে বলল,
চাচা আঞ্জুমান আরার হাত নেই আমাদের বিষয়ে?
আছে মানে? পুরাই আছে। আমিতো কইতে ভুইলা গ্যাছি। সেইতো আসল ভিলেন। কাইন্দা কাইটা কায়রুসরে নরম কইরা ফালাইছে। তবে সে মারতে কয়নাই। বাইর কইরা দিতে কইছে তোমারে ও তোমার মায়েরে।
শুনে তার প্রতি মায়ার সমস্ত মায়া,শ্রদ্ধা এক লহমায় উবে গেলো কর্পূরের ন্যায়। ঘৃণায় রিরি করছে তার অনুভব অনুভূতি।
সে পরিতাপের স্বাস ছাড়লো। তার দৃষ্টিতে আগুন খেলা করছে। আকস্মিক তার মনে ও শরীরে যেনো অসুরের শক্তি ভর করলো। তার দূর্বল চাহনি প্রখর হয়ে উঠলো সূর্যের আলোর ন্যায়। সে তেজোদীপ্ত কন্ঠে বলল,
চাচা আপনি কাউকে কিছুই বলবেন না আশাকরি। আর যেহেতু আমি এই বাড়ির মেয়ে। সুতরাং আমি কোথাও যাব না। কিন্তু আমার পরিচয়ও প্রকাশ করা যাবে না আপাতত। নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আমি প্রতিশোধ নিতে চাই সকল অন্যায়ের। নিজের বাড়িতে অবহেলা আর দাসত্বের জীবন থেকে আমি আপনাকে মুক্ত করবো। আপনি জীবন যাপন করবেন মর্যাদার সাথে।
বোকা মেয়ে। আমিই সব কইলাম তোমারে। আর তুমি আমারে সতর্ক করতাছো। ম্যালা সময় হইলো। আমি যাই অহন। তুমিও অভিনয় কইরা চইলো সবার সাথে। আগের মতোই কথাবার্তা বইলো মাথা নিচু কইরা।
কৃতজ্ঞতার ভাষায় বলে পরশ রুম হতে প্রস্থান নিলো। কায়রুসের রুমে গেলো পরশ।
ভাইজান কিছু লাগবে?
নাহ। তবে শোন।
কিহ?
আচ্ছা সেদিন কাজল ও তার মেয়ে মায়া মারা যায়নি?
গেছেতো অবশ্যই। তা না হলে এতদিনে এটার খবর পাইতেন না? ওই চরে ঝড়ের মইধ্যে শিশু মায়া ক্যামনে বাঁচবো? আশেপাশে কোন বাড়িঘরতো নজরে পড়ল না,যে কেউ আইসা বাঁচাইবো। আর আমিতো দেখছি এই মহিলারে। এ তফুরা। কাজল নয়। মায়া তফুরার মাইয়া। তার গরিবি বেশ। কথা কয় গেরামের ভাষায়। এই মায়া সেই মায়া নয় ভাইজান। আপনে নিশ্চিন্তে থাকেন। ঘুমান। আমি গেলাম।
তার একটু পর মর্জিনা এলো। মায়া ও তফুরার জন্য রাতের খাবার দিয়ে গেলো। এবং তফুরার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁথা বালিশ দিয়ে গেলো। তারা মা মেয়ে খেয়ে নিলো। মেঝেতে পরিপাটি করে বিছানা করে দুজন শুয়ে গেলো। তফুরা নানান জল্পনা কল্পনা করছে মায়াকে নিয়ে। মায়ার চিন্তাভাবনার বিপুল পরিবর্তন এলো। মানসিকভাবে দুর্দান্ত সাহসী হয়ে উঠলো। একদিকে লোকাল বাসের জার্নি দীর্ঘ পথের। আরেকদিকে আসার পর শুনতে হলো এক ভয়াবহ ইতিহাস। সব মিলিয়ে অবসাদ নেমে এলও তফুরার মুখাবয়বে। ঝিমিয়ে আসছে তার দুচোখ। মায়ার হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এলো।
মায়া দরজা খোল। আমি আসতেছি। জরুরী দরকার আছে।
মায়া খুলছে না দরজা। দ্বিধায় পড়ে গেলো। দরজায় আস্তে করে ঠকঠক আওয়াজ হলো। মায়া মনে মনে বলল,
আমারে ধরতে আসলেই অক্কা যাবেন ছোটবাবু। আসেন। নয়তো রাতে কি দরকার আমাকে। আমি বুঝি না কিছু?
উঠে গিয়ে নিঃশব্দে দরজা খুলে দিলো মায়া। শাহের ভিতরে এলো।
তফুরা মোচড় দিয়ে উঠে বসলো।
আপনার কোন অসুবিধা হচ্ছে ঘুমাতে?
না বাপজান। সব ঠিকাছে। কোন সমস্যা নাই। আমরা মা মাইয়া আরামেই আছি।
আচ্ছা বুঝলাম। আপনার মেয়েকে একটু আমার রুমে নিয়ে যাবো। খুব দরকার। নিরিবিলি বলতে হবে কথাগুলো। আপনি ভুল বুঝবেন না।
তফুরা দোনোমোনো শুরু করলো। মায়া চোখের ইশারায় তফুরকে আস্বস্ত করলো। পরক্ষণেই শব্দ করে বলল,
আম্মা সমস্যা নাই। তুমি ক্লান্ত অনেক।
ঘুমায়া যাও। ছোটবাবু খুব ভালো মানুষ। হাতের পাঁচ আঙ্গুল সমান নয়। আমার সঙ্গে উনি কখনো দুর্ব্যবহারটুকুও করেনি। থাকতো আবার গায়ে হাত দিয়ে মারবে।
আইচ্ছা মা। তাড়া কইরা চইলা আসিস।
মায়া চলে গেলো শাহেরের পিছু পিছু। তফুরার দুচোখ বুঁজে এলো হাই দিতে দিতে।
শাহের ভিতর থেকে দরজা ভিড়িয়ে দিলো। কিন্তু বন্ধ করলো না। মায়াকে বসতে বলল। মায়া জড়োসড়ো হতে শাহেরের মুখোমুখি একটি চেয়ারে বসলো।
যা জিজ্ঞেস করবো সত্যি আনসার দিবে বাঁচতে চাইলে।
রুষ্ট কন্ঠে বলল শাহের।
জ্বি ছোটবাবু। সত্যিই বলব।
ওকেহ। যেই মানুষগুলো তোমার কারণে মারা গেলো, এদের মাঝে কেউ কি তোমাকে রে*প করেছে? এবং তুমি কেন এসব আমাকে বা আম্মাকে জানাওনি? এই দুটো প্রশ্নের জবাব চাই আগে।
মায়া বিমূঢ় হয়ে শাহেরের চোখের দিকে চাইলো। মনে মনে বলল,
তুমি কি জানো আমি তোমার আপন চাচাতো বোন?
চলবে…