#মায়া_মহল (১৪)
কলমে #রেহানা_পুতুল
মায়ার সমস্ত অনুভূতি অবশ হয়ে আছে। প্রাণহীন মানুষের মতন অচল শরীরে কাত হয়ে আছে বিছানায়।
আর এই জঘন্যতম! ঘৃণিত! অভিশপ্ত কাজটি করলাম আমিই নিজহাতে। আমিও সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী!
দুইহাত জোড় করে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল পরশ।
মায়া কোনমতে উঠে বসলো। মৃগী রোগীর ন্যায় থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো তার সমস্ত শরীর। কি নৃশংসভাবে জীবন দিতে হলো তার মা, বাবাকে। ভেবেই তার মনটা দমকা হাওয়ার মতো হুহু করে উঠলো এক অসীম শূন্যতায়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল,
যাদের জন্য অন্যায়ভাবে সে এতিম হয়েছে। পিতা মাতার আদর,স্নেহ,মমতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, লাঞ্চিতার জীবন পেয়েছে,তাদের কাউকেই সে ছাড়বে না। কাউকেনা। সে বজ্র হয়ে তাদের একে একে শেষ করে দিবে। এই পৃথিবী থেকে তাদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দিবে।
তার মনে হলো সে কোন ভিনগ্রহের মেয়ে। এই মাটির ভুবনে এত অতি আশ্চর্যজনক,অদ্ভুত, অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটা অকল্পনীয়! সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। এত জায়গা জমি,ধন সম্পদের মালিক সে? কিভাবে সম্ভব! কিভাবে! ভ্রুকুঁচকে প্রচন্ড ঘৃণা, ক্রোধ, দুঃখভরা হৃদয়ে জিজ্ঞেস করলো পরশকে,
চাচা আমার মনে হয়, আমার সব প্রশ্নের জবাব আপনি দিতে পারবেন। এবং আপনি যা জানেন তা হয়তো অন্যরাও জানে না। তাই এই মহল ও এই পরিবার সম্পর্কে আপনি যা জানেন বলেন? আপনিই আমার একমাত্র ভরসার কেন্দ্রবিন্দু চাচা।
পরশ তফুরার দিকে চাইলো। নমনীয় স্বরে বলল,
দেখছেন আপা, কইলাম না। মায়া ভীষণ বুদ্ধিমতী। পরশ কাঁধের বড় গামছাটা দিয়ে কপালের ও ঘাড়ের চিকন ঘামগুলো ঢলে মুছে নিলো। দৃষ্টি স্থির করলো দেয়াল ঘড়িটার দিকে।
বলল,
তোমাকে সব জানানোর সময় হয়ে গিয়েছে। নয়তো তুমি অত্যাচারিত ও রক্তাক্ত হতেই থাকবে এদের হাতে।
মায়ার ও তফুরার পূর্ণ মনোযোগ পরশের মুখের দিকে। পরশ বলতে লাগলো,
আমাদের পরিবারে কয়েক প্রজন্ম ধরেই কোন কন্যা সন্তান বাঁচে না। জন্মের পর কোন না কোন ছুতোয় তার মৃত্যু হয়। এর কারণটা অজ্ঞাত। কেউই জানে না। অনেক ফকির, দরবেশ,ডাক্তার,কবিরাজ ধরেও এর কোন সদুত্তর বা সুরাহা মেলেনি। এইটা আমার বাবা জমির উল্লা মানে তোমার দাদার মুখেই শুনা। এবং আমিও দেখেছি। আমার, আমার বাবার, আমার দাদার, দাদার বাবার, কোন বোন ছিলো না।
আমার বাবার প্রথম স্ত্রী অর্থাৎ তোমার দাদী মারা যায় দুজন পুত্র সন্তান রেখে। সেই ঘরের বড় পুত্র হলো কায়রুস ভাই। ছোট পুত্র হলো তোমার বাবা আমিনুল। তখন আমার মাকে দ্বিতীয় বিয়ে করে তোমার দাদা। সেই ঘরে আমি জন্ম নিই। আমার আর কোন ভাইবোন নেই। আমার জন্মের সময় তোমার বাবার বয়স ছিলো দুই বছর। বলতে গেলে আমরা দুই সৎ ভাই ছিলাম পিঠাপিঠি। আমাদের খাতির ছিলো তুই তাকারি করে দোস্তর মতো। সবাই কইতো জমির উল্ল্যার ছোট দুই পোলারে দেখলে মনে হয় এক মায়ের প্যাটে হইছে। কয়েক বছর আগে আমার মাও মারা যায় বেমারে পড়ে।
আমি পড়াশোনায় কাঁচা ছিলাম। তাই ফাইভ পাশের পর আমার আর পড়াশোনা হয়নি। বড় ভাইজান কিছুদূর পড়াশোনা করছে। তবে আমিনুল আরো বেশি লেখাপড়া করছে। তার মাথা ভালো ছিলো। আর পারিবারিকভাবে আমরা আগে থেকেই অনেক সচ্ছল ছিলাম। তাই আমি তেমন কোন কাজ কর্ম করতাম না। নিজেদের নারকেল, সুপারির বাগিচা, ধানি জমি, মাছের পুকুর,গরুর ফার্ম,বাজারের মিল, এগুলো দেখাশুনা করতাম। আর ঘুরেফিরে খাইতাম।
বাবার খুব শখ ছিলো নিজের কোন কন্যা সন্তান নেই যেহেতু ,তাই তেমন করেই বড় পুত্রের বিয়ে ধুমধাম করে দিবেন। এবং তিনি একটা পাত্রীও ঠিক করেছেন নিজে দেখে। পাকা কথাও দিয়ে ফেলেছেন তাদেরকে।
কিন্তু ভাইজান হলো খুব অবাধ্য,স্বার্থবাদী। নিজের ইচ্ছারেই গুরুত্ব দেয় বেশি। সে হুট করেই এক মেয়েরে বিয়ে করে নিয়ে এলো। বাহানা দিলো সেই নাকি পরিস্থিতির শিকার।
এদিকে বিয়ে ঠিক করা পাত্রীর পিতা তোমার দাদাকে অপমান করলো অনেক। আমার বাবার ভয়ানক রাগ হলো সেদিন। তিনি চুপেচুপে আমারে সঙ্গে নিয়ে সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি তোমার বাবার নামে লিখে দিলো,এবং আমার নামেও দিলো কিছু। আমি নিজ থাইকাই বাবারে কইছি,
আমিনুলরে সব দেন। আমারে অল্প দিলেই হবে। কারণ আমিনুলরে আমি অনেক ভালোবাসতাম। এটা কেউই জানতো না। আমিনুলও জানতো না। তার কিছুদিন পর বাবা মারা গেলো। বড় ভাবির ঘরে দুটো পুত্র সন্তান হলো। জুবায়ের ও শাহের বাবাজি। তাদেরও কোন বোন হল না।
আমার সাদীর দায়িত্ব কেউ নেয়নি।
আমিও সেইভাবে পারিনি কাউকে পছন্দ করতে। তাই আমার আর সাদি করা হয়নি।।
তবে উপর দিয়ে পরিবারের সবার সঙ্গেই সবার সুসম্পর্ক ছিলো। আমিনুলের সঙ্গে প্রায় বড় ভাইর মনোমালিন্য হতো। আমি অশিক্ষিত। তাই সব জেনেও চুপ থাকতাম। কিন্তু আমিনুল ছিলো সৎ,নির্ভীক, প্রতিবাদী,দৃঢ়চেতার মানুষ! সেটা পরে বলছি। আগে তোমার ইতিহাস কই।
তোমার বাবা পড়াশোনা শেষ করলো। শহরে অনেক বড় সরকারি চাকরি পেলো। বাবা,মা,বোন নেই। তাই বাধ্য হয়ে একসময় আমিনুলও নিজের পছন্দে তোমার মা কাজলকে বিয়ে করলো। তোমার মাও শিক্ষিত ছিলো। বিয়ের বছর চারেক পরে তোমার মা সন্তান সম্ভবা হলো। তখন তোমার বাবার মনের ফূর্তি আসমান ছোঁয়া।
এক বিকেলে চা খাইতে খাইতে তোমার বাবা আমগো সকলরে শুনায়া কইলো,
সবাই দোয়া করেন,
আমাদের বংশে যেন একটা কন্যা সন্তানের আবির্ভাব ঘটে।
তখন তোমার বড় চাচা হেসে আমিনুলরে কইলো,
আল্লাহ যেন তোর মনের আশা পূরণ করে। তোর কন্যা হলে আমি আম্মাজানরে অনেক বড় উপহার দিমু।
আপনি দিবেন আর আমি পিতা হয়ে দিব না?
কি দিবি তুই?
আপনি কি দিবেন বলেন তো?
আমি আমার ভাগের সম্পত্তি থেকে আম্মাজানরে একখান জমি তার নামে লিখে দিবো উপহার হিসেবে।
আমিনুল খুশিখুশি দিলে কইলো,
আমার মেয়ের নাম রাখবো মায়া। সবার মায়ায় মায়ায় সে বেড়ে উঠবে। আমি বিশাল একটা ঘর বানাবো ভাইজান। রাজা বাদশাগো মহলের আদলে। নাম দিবো #মায়ামহল। মহলের সামনে জ্বলজ্বল করে জ্বলবে নামটি। সেই মায়া মহল ও আমার ভাগের সব আমার কন্যার নামে উইল করে দিয়ে দিবো। আর এই মহলে সে রঙিন প্রজাপতির মতো স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবে। হাসিখুশি থাকবে। মায়া মহল মাতিয়ে রাখবে তার নুপুরের ছন্দে।
তখন তোমার আম্মা পাশ থেকে কইলো,
আমার মায়াকে সোনার নুপুর বানিয়ে দিবো আমি।
বাহবা! তোমরাতো দেখি মেয়ে পৃথিবীতে না আসতেই তার লাইফ সেটেল করে দিয়েছো। আগে ভালোর ভালো তাকে দুনিয়াতে আসতে দাও। মেয়ে না ছেলে হয় সেটা আরো পরে বলা যাবে।
তাচ্ছিল্যের সুরে বলল বড় ভাইজান। কারণ তার অগাধ বিশ্বাস ছিলো,কখনোই এই বংশে কন্যা সন্তান পয়দা হবে না। হলে পাঁচ সিঁড়ি ধরে হয়না ক্যান।
সেইদিন আমি আমিনুলরে জানায়া দিলাম যে, সকল সম্পত্তি বাবা ওর নামে দিয়েছে এবং কারণও জানাইলাম। অবশ্য আমিনুল এতে ততটা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। বরং বলল,
আব্বার এটা কিছুতেই উচিত হয়নি। এরপর আমিনুল আমারে সঙ্গে নিয়া সব তোমার নামে দলিল কইরা দিয়া দিছে।
দুনিয়াতে তোমার আসার সময় হইলো। মালিকের হুকুম মতে এক চান্দের রাইতে ঘর আলো কইরা তুমি জন্মাইলা। তোমার বাবা,মার আনন্দ বুক সমান। সারা গেরামে মিঠাই বিতরণ হইলো। দলে দলে লোকজন তোমারে দেখতে আইলো। উপহার দিতো। কোলে নিতো তোমারে। দোয়া করতো। কিন্তু তোমার বড় চাচা চাচীর পৃথিবী আন্ধার হইয়া গ্যালো। তাদের মুখে নাইমা আইলো অমাবইশ্যা। সারাদিন মুখ কালো কইরা রাখতো। কারণ পরিবারের একমাত্র কন্যা তুমি। তোমার হিসাব নিকাশই আলাদা সবার কাছে। আমিনুল তোমার জন্মের পর তিনমাসে এই মহল বানালো রাজ প্রাসাদের মত কইরা। নাম দিলো মায়া মহল। মুখ ফসকে কইলেও কায়রুস ভাই কিন্তু তোমারে আর জমি দেয়নাই। আমিনুল মাঝে মাঝে মজা করে বলতো,
ভাইজান কথার বরখেলাপ করলেন তো।
তিনি নয়ছয় করে পাশ কাটায়া যাইতেন।
তোমার বয়স যখন ছয়মাস। তখন বর্ষাকাল ছিলো। খুব ঝড় তুফান হইতাছিলো সেই মুহূর্তে। তো সেই গুপ্তধন নিয়া এক দুই কথায় তারা দুই ভাইয়ে তর্ক শুরু করে দিলো। এক পর্যায়ে আমিনুল বলল,
আমি আর সহ্য করবো না। পুলিশে জানিয়ে দিবো সব। অন্যের সোনাদানা কেন আপনি ভোগ করবেন?
তুই কি করতে চাস আমিও দেখতে চাই।
রক্তচক্ষু নিয়ে বলল বড় ভাইজান।
তখন আমিনুল ক্রোধান্বিত হয়ে বলল,
আমি কি করতে চাই দেখবেন আপনি? আমি যদি না পারিও, আমার মেয়ে মায়া বড় হলে আপনার এই আত্মসাৎ করা সোনাদানা রাখতে দিবে না। সে এসব মহৎ কাজেই লাগাবে। দেখবেন আপনি। আমি আর কাজল মায়াকে সেই আদর্শেই গড়ে তুলবো। আর এই সবকিছুই মায়ার নামে। বাবা আমার নামে দিয়েছে। আমি আমার মায়ার নামে রেজিষ্ট্রেশন করে দিয়েছি।
আমি তাদের আড়ালে থেকে সব শুনছি দেখতে না পেলেও। সেই রাতেই তোমার বাবার হাত পা বেঁধে কায়রুস নিজ হাতে জবা করে ফেলে চাপাতি দিয়ে। জল্লাদ রুস্তম তাকে সহযোগিতা করছে। আরো দুজন সহযোগী ছিলো। তারা নেই এখন। মারা গিয়েছে। এবং মহলের কবরস্থানেই সেই গভীর রাতের নির্জনতায় আমিনুলের লা*শ কবর দিয়ে ফেলেছে জানাযা ছাড়াই।
মায়া নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে।শপথ করে বলে,
খু*নী কায়রুস, তোর প্রাণ আমার হাতেই। কসম খোদার।
চলবে…