মায়া মহল পর্ব ১৩

0
144

#মায়া_মহল (১৩) #রহস্য
কলমে #রেহানা_পুতুল
পরশ মায়ার পিঠে মমতার ছোঁয়া দিয়ে বলল,
তোমার আম্মার বলা ও আমার ধারণাগুলো যদি সত্যি সত্যি মিলে যায়,
তাহলে এই মায়া মহলের একচ্ছত্র মালিক তুমি। দ্বিতীয় কেউই নয়। আর আমি কোন চাকর নই। তুমি যেমন ভাগ্যের শেকলে বন্ধী হয়ে নিজের বাড়িতে আশ্রিতা। ঠিক তেমনি আমিও তোমার মতো নিজের বাড়িতে আশ্রিতা রূপী চাকর।

নিজের বাড়িতে চাকর পরিচয়ে বাস? কি কষ্ট! কি আত্মগ্লানি! ভেবেই ক্রোধে মায়ার দু’কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো উত্তপ্ত সীসার মতো। তিরতির করে কাঁপা সরু অধরযুগল নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

কিহ? কিই..বলছেন চাচা? কি বলছেন এসব? আমি যে কিছুই বুঝতেছি না।সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।

তফুরার অক্ষিদ্বয় কোটর হতে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে বাজ পড়া পাখির মতো স্থির হয়ে আছে। গোটা দুনিয়া তারকাছে ওলট পালট লাগছে। পরশ মায়াকে বলল,

সব জানতে পারবে মা। আমি বহুত আগেই তোমারে চিনবার পারছি। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তোমারে সরাসরি কিছু জানাইতে পারিনাই। তবে চোখে চোখে রাখছি তোমারে। তারপর তফুরাকে বলল পরশ,

আপনি মায়ারে কোথায়,কিভাবে পাইছেন,সবকিছু সত্য সত্য আমারে কন। লুকাইলে আমার নয়,আপনাদের বিপদ হইবো।

তফুরা কন্ঠকে খাদে নামিয়ে মিনমিন স্বরে বলল,

ভাইজান,আপনি হইলেন এই মহলের খেটে খাওয়া সামান্য একজন মানুষ। আপনারে জানায়া কি লাভ? আমগো মুক্তি মিলব? আমগো মা মাইয়ারে সবাইর সামনে নিয়া যান,আমি সব কমু মায়ার ঘটনা।

মায়া তফুরার দু’গাল দু’হাত দিয়ে চেপে ধরলো। কাঁদোকাঁদো গলায় একাধিক প্রশ্ন ছুঁড়ে মারল তীরের ন্যায়,

আম্মা! তারমানে সত্যিই আমি তোমার পেটের মেয়ে নই? আমি কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে তোমার? কই কখনো তো শুনিনি এমন কিছু? টেরওতো পাইনি তোমার আচার আচরণে? স্কুলেওতো অভিভাবকের স্থানে তোমার নাম ছিলো, তোমার ঠিকানাই আমার ঠিকানা লিখা ছিলো। বলো সব মিথ্যা আম্মা! বলো সব মিথ্যা !

ক্যান টের পাইবি? ক্যান বুঝতে পারবি মা? আমি যে তোরে নিজের পেটের মাইয়ার চাইতেও বেশী আদর করি। যত্ন করি। মাথায় থুইনাই উকুনের ডরে। মাটিতে থুইনাই পিঁপড়ার ডরে। রাখছি তোরে মায় কোলে কোলে। বড় করছি আদব কায়দায়। যাগো কাছে এতটা বছর ছিলাম। হেরাও জানে তুই আমার পেটের মাইয়া।

তকদ্বীরের চাকায় ঘুইরা আইজ যে এই নিষ্ঠুর সত্য দিনের আলোর মতন হগলের সামনে আইবো, তাতো স্বপ্নেও কল্পনাই করতে পারিনাইরে মা।

তফুরা ও মায়া গলাগলি করে পাগলের মতো কাঁদছে। উম্মাদের মতো আহাজারি করছে। পরশ কেবল চেয়ে চেয়ে দেখলো তাদের মা মেয়েকে। পৃথিবীর এক অপূর্ব সুন্দর করুণ দৃশ্য তার সামনে ঘটে গেলো। সে না কাউকে বলতে পারছে, না এদের ক্রন্দন রোধ করানোর মিছে চেষ্টা করছে। এমন পবিত্র মধুর আলিঙ্গনের বেদনাবিধুর দৃশ্য সে এর আগে কবে কখন অবলোকন করেছে, তা মনেও করতে পারছে না।

তাদের ক্রন্দনের সুর স্তিমিত হয়ে এলো। পরশ থিতু গলায় তফুরাকে বলল,

ভুলেও এইকাজ করতে যাবেন না। আপনার মাথায় ঘিলু নাই? যেখানে এতবড় বড় কাহিনি ঘইটা গেলো, সেখানে তারা একজনও যদি মায়ার ও আপনার পরিচয় জানতে পারে,চাপাতি দিয়া দুইকোপে দুইজনের দম বন্ধ কইরা দিবো। বাঁচতে হইলে আমার পরামর্শ মতে চলতে হইবো। এবার কন মায়ারে পাওয়ার ঘটনা?

আম্মা, চাচা অনেক ভালো মনের মানুষ। উনার কথা শুনে বুঝতে পারনাই? সব রহস্য খুলতে হবে। তুমি বললে পরে চাচা কি বলে শুনি আমরা। দমে থাকলে হবে না আম্মা। বলো চাচারে সব। আল্লাহ ভরসা।

তফুরা পরনের সুতী কাপড়ের আঁচল দিয়ে আঁখিকোণ মুছে নিলো। বলতে শুরু করলো,

সময়টা ছিলো বারিষকাল। আবার তখন আমি ছিলাম বিধবা। কোন সন্তানাদি ছিল না আমার। দুইটা মাইয়া ছিলো। মইরা গ্যাছে। আমি ছিলাম খুব অভাবি। গরীব। কয়দিন থাকতে গেলাম আমার খালার বাড়ি। সেইটাও চরের মইধ্যেই। খালাগো বাড়ির শ্যাষ মাথায় একটা পুষ্করিণী ছিলো। তার পাড়ের দিকে কয়টা তালগাছ ছিলো। রাইতে সেই গাছ থেইকা তাল পড়ে ধপাস ধপাস কইরা। ভোর না হইতেই সেই বাড়ির অন্য গরিবরা আইসা সেই তাল নিয়া কাড়াকাড়ি করে। তাল গাছ যাদের, তারা থাহে শহরে। এসবের খবর রাহে না তারা। সেই বাড়ির আশপাশে তেমন কোন বাড়ি ছিল না। চাইরপাশ নিরব। ঘন জংলায় ভইরা থাইকতো। তো যেহেতু খালার বাড়ি ছোডকাল থেইকাই যাই। তাই তালের এই বিষয়টা আমি জানি। খালাও আমারে তাল চুরি কইরা আনতে কইতো। তাল আমার ম্যালা প্রিয়। তাই লোভও সামলাইতে পারি না। যাইতাম আর কয়টা তাল নিয়া লুকায়া নিয়া আসতাম।

সেদিন রাইতে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হইতেছিলো।শ্যাষ রাইতে মনে হইলো,সকাল হইলেই তাল ভাগে পামু না। ঘোর অমাবশ্যা তহন।সাদারেও তহন কালা দেহা যাইবো।
ভাবলাম আন্ধারকালেই যাই। তাল নিয়া আসি। তাল, গুড় দিয়া রাইন্ধা চাইল ভাজা দিয়া মিলায়া খামুনি। আমার লগে আমার এক খালাতো বইন ছিলো। সে ছোড একটা টচ লাইট হাতে নিয়া আমার লগে গেছিলো। এদিক সেদিক তাল খুঁজতাছি দুই বইন,

আচম্বিতে আমার বইন আমারে খামছি মাইরা ধইরলো। আমার পা থাইমা গেইলো। হে কইলো,

বুবু তাল লাইগব না। বাড়ি ল। ভূত আছে এইহানে।জংলার ভিতরে কে জানি গোঙ্গানি দিতাছে।

আমিও ডরাই গেছি। কান পাইতা রইছি। ওমা! হাঁচাইতো। মহিলা ভূতের গলা দেহি। রাইতের কাল। তাই নিরবে অল্প আওয়াজও আমরা স্পষ্ট হুনলাম। আমরা পা এগিয়ে চইলা আইতে লাগলাম। তহন সে আওয়াজ জোরে হইলো। কইলো,

আল্লার দোহাই লাগে বাঁচান। একটু এদিকে আসেন বোন। আপনাদের পায়ে পড়ি। আমি ভূত না। মানুষ। ভয়ের কিছুই নেই।

আমার নরম দিল সেই করুণ স্বর শুইনা গইলা গ্যালো। দুই বইন তার সামনে গেলাম পা টিপে টিপে। লাইট মাইরলাম। ওহ খোদা! এ দেহি আগাগোড়া আমার মতন এক বেডি। পরনে সুন্দর একখান কাপড়। গাছের সাথে পিছমোড়া করে তার দুইহাত বান্ধা। টিভির বেডিগো মতন কি মিঠা কইরা কথা কয়। বয়সও আমার মতন হইবো। কোলে কি সুন্দর চান্দের লাহান ফুটফুটে এক মাইয়া শিশু।

সে আউলা ঝাউলা গলায় কাঁদতে কাঁদতে কইলো,

বোন আমাকে চিনবেন না। আমাকে আমার স্বশুর বাড়ির লোকজন মেরে ফেলার জন্য এই চরে এনে বেঁধে রেখে গিয়েছে দুই ঘন্টা আগে। আমি একটু পরে মরে যাব। শেয়াল কুকুরে খাবে আমার লা*শ। এটা আমার কলিজার টুকরার মেয়ে। ওর বয়স এখন ছয়মাস। আপনি ফেরেশতা হয়ে এলেন ওর জন্য। ওকে বাঁচান বোন। ওকে নিয়ে যান। আল্লাহ আপনাকে পরকালে শান্তিতে রাখবে।

আমার খালাতো বইন শিশুটারে কোলে তুইলা নিলো। তারকথা হুইনা আমার হাত পায়ের পশম খাড়ায়া গেলো। আল্লাগো কয় কি। কইলাম,

আমি ওরে নিমু। আপনারেও বাঁচামু। লন আমার লগে। আপনার স্বামী কই?

হে ঝরঝর কইরা কাইন্দা দিলো আবারো।কইলো,

আমার স্বামীকেও তারা জীবন্ত মেরে ফেলল গতকাল। আর আপনি আমাকে চাইলেই বাঁচাতে পারবেন না বোন। ওরা সবাই জোর করে ধরে আমার শরীরে মরণ বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে ইনজেকশনের মাধ্যমে। নিদিষ্ট সময় শেষ হলে আমি মারা পড়বো। তাদের বিশ্বাস ছিলো আমি মরে গেলে শেয়াল, কুকুর কামড়ে ছিঁড়ে আমার এই নিষ্পাপ কচি মেয়েটাকেও জংগলে খেয়ে ফেলবে।

আমি আবারও অবাক হইয়া জিগাইলাম,

বুঝলাম বইন। কিন্তুক কারণডা কি আপনাগো সক্কলরে স্বামীর বাড়ির লোকেরা মাইরা ফালানোর?

কইলো,
সম্পত্তির জন্য। ক্ষমতার জন্য। দূর্নীতি করার জন্য। অসৎ উপায়ে বিত্তশালী হওয়ার জন্য। তারা প্রচুর লোভী!

আমি ফের জিগাইলাম,

তাতে আপনাগোরে মাইরবো ক্যান বইন?

কইলো,
কারণ এসব কিছুর একমাত্র বাধা আমি,আমার স্বামী, আমার এই মেয়ে।

বাচ্চার নাম কি বইন?

মায়া ওর নাম। ওর আব্বু রাখছে। খুউব শখ কইরা। বোন ওর গলায় যে তাবিজটা আছে, বড় হইলে কোমরে দিয়া দিয়েন। ওরে সতর্ক করে দিবেন যেন ভুলেও এই তাবিজ না খুলে। সারাজীবন এই তাবিজ যেন সে সাথে রাখে। তাহলে কেউ চাইলেও অসৎভাবে আমার মেয়েটার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।

আমি কইলাম,
আইচ্ছা বইন। এই ভুল হইব না। মাথায় রাখলাম। আপনার স্বশুর বাড়ির ঠিকানা কন আমারে। দেহি কিছু করতে পারি কিনা? আর যারা আপনারে এই গহীন জংগলে রাইখা বাইন্ধা গ্যালো,হ্যারা কই এহন?

সে শরীরের যন্ত্রণায় কোঁকাতে কোঁকাতে কইলো দাঁত কিড়মিড় কইরা,

তারা তিনজন আসলো। তখনই চলে গেলো তারা। আর তাদের বাড়ি মানে মায়াদের বাড়ি হলো…

হে মানে এই মায়ার আম্মা আর কিছু কইতে পারেনাই ভাইজান। চটপটাইতে চটপটাইতে মইরা গ্যালো। আমরা হায় হুতাশ করতে করতে বাড়িত গিয়া সবাইরে জানাইলাম। সবাই তারে সেই চরেই আমার খালার বাড়িতে দাফন করে দিলো। এখন তো মনে হয় এটাই সেই বাড়ি মায়াদের।

তফুরার গলা ধরে এলো। মাটির জগ থেকে পানি নিয়ে খেলো গড়গড় আওয়াজে।

মায়ার সমস্ত অনুভূতি অবশ হয়ে আছে। প্রাণহীন মানুষের মতন অচল শরীরে কাত হয়ে আছে বিছানায়।

আর এই জঘন্যতম! ঘৃণিত! অভিশপ্ত কাজটি করলাম আমিই নিজহাতে। আমিও সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী!

দুইহাত জোড় করে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল পরশ।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here