“মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছা কি বলো?”
মেয়েটি ভীরু চাহনিতে নেত্রপল্লব মেলে ধরলো সামনে বসে থাকা লোকটির দিকে। তার দু’ হাত বাগানের ভিতরে সুপারি গাছের সাথে পিছমোড়া করে বাঁধা।
সে ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
” আমাকে মারবেন কেন? কি অপরাধ আমার?”
” এই বাড়িতে অপরিচিত কেউ প্রবেশ করলেই তার গর্দান নেয়া হয়। এটাই তার অপরাধ। বুঝলি ছেমরি।”
” ওহ বুঝলাম। আমার মরণ কেউই ঠেকাতে পারবে না।”
” মানে? খোলাসা কর। ”
” বলছি আমার মরণ হবেই আজ। এক মরণের দৌড়ানি খেয়ে বাঁচার জন্য এখানে লুকালাম। এখনতো দেখি আজরাইল আমার আগেই এখানে এসে হাজির।”
” কাহিনী বাদ দে। আজরাইলেরা এখানে এমনিতেই থাকে। সন্দেহভাজন মুখ দেখলেই জান কবজ করে ফেলো। তোর কোন খায়েশ আছে কিনা সেটা বল?”
” হুম আছে। এই বাড়িটি একবার ঘুরে ঘুরে দেখা। এত সুন্দর বাড়ি আমি এই প্রথম দেখলাম।”
নিরীহ সুরে বলল মেয়েটি।
লোকটি অনুসন্ধিৎসু নজরে চাইলো মেয়েটির দিকে।
“এত সুন্দর বাড়িটার কি নাম চাচা ?”
” মায়া মহল”
মেয়েটি কিছু বলার আগেই ডাক পড়ে লোকটির। হেঁড়ে গলায় কোন পুরুষালী গলার আওয়াজ ভেসে এলো রুস্তম বলে।
” এই ছেমরি আমি আসতাছি। চুপচাপ বইসা থাক কইলাম।”
” রুস্তম আপনার নাম? কে ডাকলো আপনাকে? অমন বাঘের মতো গলার আওয়াজ? ”
” তুই চিনবি? ডাকছে গেইটের পাহারাদার হারিস পালোয়ান। হুম জল্লাদ রুস্তম আমি। সবাইকে জ* বা *হ করি।”
মেয়েটি আলতো কেঁপে উঠলো। মনে মনে বলল,
মাগো! এ কোন মৃত্যুপুরীতে চলে এলাম বাঁচতে গিয়ে। আমাকে বাঁচানোর কি কেউই নেই এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে?
রুস্তম চলে গেলো সামনের দিকে। তার কাজ শেষ করে মায়া মহলের এক রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো।
” রুস্তম এত সময় কোথায় ছিলে? ”
বিশাল রুমের এক কোনে দোলনায় দুলতে দুলতে জানতে চাইলো আঞ্জুমান আরা।
নিচু মাথায় রুস্তম বলল,
” বেগম সাহেবা ওদিকে কাজ পড়ে গেলো বলে।”
” কি কাজ এই অবেলায়?”
” বেগম সাহেবা, একটা মেয়ে ঢুকে পড়েছে মহলের অন্দরে। তাই বিলম্ব হয়েছে এদিকে আসতে।”
আঞ্জুমান আরা গরম চোখে তাকায় রুস্তমের দিকে। কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” কি বলিস তুই? তাও কোন মেয়ে? বয়স কেমন হবে? ”
” অল্প বয়েস। বালিকা মেয়ে। মায়া মহলে এই প্রথম কোন অচেনা মেয়ে ঢুকে পড়লো।”
” তাই বলে এত কচি একটা মেয়ের প্রাণ চলে যাবে মহলের নিয়মের করাতলে পড়ে?”
দরদের সুরে বলল আঞ্জুমান আরা।
” এটাই যে এই মহলের চিরাচরিত নিয়ম বেগম সাহেবা। ”
” দ্বিতীয় কেউ দেখেছে মেয়েটিকে? বা কেউ জানে?”
” নাহ কেউই দেখেনি। কেউই জানেনা।আমিই দেখেছি। আমিই ধরেছি।”
” মহলের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করেছে মেয়েটি? না পাশের ফটক দিয়ে? প্রহরীরা কোথায় ছিলো? ”
” পাশের ফটক দিয়েই প্রবেশ করেছে বেগম সাহেবা। প্রহরী ছিলো। কিন্তু সে ঝিমুচ্ছিলো তখন। সেইক্ষণেই বালিকাটি ফুরুৎ করে চড়ুই পাখির মতো ঢুকে পড়লো।”
“ওকে মারার আগে চুপে চুপে একবার আমাকে দেখিয়ে নে। কেন জানি মেয়েটাকে দেখতে খুউব ইচ্ছে করতেছে।”
” ছোট বাবু কি অবস্থায় আছে খবর নিই আগে। নয়তো সেই মেয়ের আগে আমার গলা কা* টা পড়বে।”
” ওতো একটু অসুস্থ। উঠবে না। তাও দেখে নে।”
রুস্তম গিয়ে ছোট বাবুকে দেখে নেয়। তারপর চুপিচুপি মেয়েটির কাছে যায়। মেয়েটির হাতের বাঁধন খুলে দেয়। মেয়েটি ঘাবড়ে উঠে। আৎঁকে উঠে ভাবে, এই বুঝি তার প্রাণ পাখি উড়ে যাবে দেহ নামক খাঁচা থেকে। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। দুই হাত সামনের দিকে লম্বা করে ধরে ঝাঁকুনি দেয়। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছে।
মেয়েটির হাত ধরে রুস্তম বলে,
” এদিকে আসো। ”
” কই নিচ্ছেন ? পুরা মহল দেখাতে?”
” নাহ।পুরো মহল দেখা চাট্রিখানি কথা নয় ছেমরি। কেউ তোমাকে হাঁটাচলায় দেখতে পেলেই ধরে জায়গামতে ফেলে দিবে।”
মেয়েটি মনে মনে উচ্চারণ করে,
কি আজব! বাড়ির নামের শুরুতেই মায়া শব্দটি। অথচ এদের কান্ডকীর্তি সব নির্দয়,নিষ্ঠুরের মতো। কাহিনীটা কি? তারপর মুখ তুলে রুস্তমকে বলল,
” আচ্ছা থাক। তাহলে দেখতে হবে না। ”
” কেন হাউস মিটে গেল ছেমরি?”
মেয়েটি উপর নিচে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
মহলের কর্ত্রী আঞ্জুমান আরার নিকট মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া হলো। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে আপাদমস্তক চাইল। পিঠের উপর মমতার স্পর্শ দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
” তোমার নাম কি ?
” আমার নাম মায়া ”
“মায়া?”কে রাখলো এই নাম?”
” আমার আম্মায় রাখছে।”
ফ্যাকাসে হয়ে আসা তিরতির করে কাঁপা ঠোঁটে বলল মেয়েটি।
আঞ্জুমান আরা করুণ হাসি হেসে বলল,
এই মহলের নাম মায়া মহল। এই মহলে এসে পড়ল ফুলের মতো ফুটফুটে এক মায়া। কি মিষ্টি দেখতে মেয়েটি। কিন্তু এখানে দয়ামায়ার কোন বালাই নেই। ঘটে তার উল্টোটা।
“বেগম সাহেবা ওর সাথে আলাপ শেষ করেন।”
আঞ্জুমান অতীতে ডুবে যাচ্ছে বুঝতে পেরে রুস্তম থামিয়ে দিতেই উক্ত বাক্যটি আওড়ালো।
“রুস্তম এই মেয়েটি আজ রাত বেঁচে থাকুক অন্তত। আমি ওর সাথে কিছু কথা বলব। ”
” কি বলছেন বেগম সাহেবা? যদি…? ”
রুস্তমের মুখের কথা কেড়ে নিলো আঞ্জুমান আরা। চাপা স্বরে বলল,
” কোন জন মানব থাক দূরের কথা,কাক পক্ষীও টের পাবেনা। ওকে আমার রুমে লুকিয়ে রাখবো।”
” রিস্ক নেয়াটা কি উচিত হবে বেগম সাহেবা?”
উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল রুস্তম।
” উচিত অনুচিত সবসময় মাথায় খেলেনা রুস্তম। আমি ওর বিষয়ে জানতে চাই। তুই তোর মতো করে থাক। যা এবার।”
রুস্তম চলে যায়। আঞ্জুমান মায়া নামের মেয়েটির দিকে কৌতুহলী চাহনি ফেলে।
“ক্ষুধা লেগেছে নাহ?”
” হুম লাগছে। ”
আঞ্জুমান আরা রুমের দরজা বন্ধ করে দিল অতি সাবধানী হয়ে। একটা ফলের ঝুড়ি ঠেলে দিলো মায়ার দিকে। মধুর হেসে বলল,
“যত ইচ্ছে মন ভরে খাও।”
দেশি বিদেশি বাহারি ফলের ঝুড়ির দিকে মায়া অবাক চোখে চেয়ে রইলো। তার পছন্দমতো কিছু ফল খেয়ে নিলো টপাটপ করে। ক্ষুধার্ত পেটে নাশপাতি, ড্রাগন ফলের পানসে স্বাদও অমৃত ঠেকলো তার কাছে।
সন্ধ্যার বেশ কিছু সময় পরে তার সেবাদাসী কুমকুম এলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে,
“বেগম সাহেবা আসতে পারি? একটু দরকার ছিলো।”
আঞ্জুমান মায়াকে ভারি মখমলের পর্দার আড়ালে লুকিয়ে নেয় তড়িঘড়ি করে। গলা বাড়িয়ে বলে ,
“হ্যাঁ আসো।”
” এলাচিকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে নিখোঁজ। খুকুমণি কেন্দে কেটে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। ”
” নাতো এলাচি এখানে আসেনি। তুই যা এখন।”
মায়া শিউরে উঠে। ভাবে কে এই এলাচি? মনে হয় কোন কাজের মেয়ে হবে এদের। তবে এত পাহারাদার থাকতে কিভাবে নিখোঁজ হলো? নাকি কোন ভুলের জন্য তাকে মেরে ফেলল রুস্তম জল্লাদ।
রাত বেড়ে গেলো। জরিনা নামে একজন দাসী রুমের ভিতরে টেবিলের উপরে নৈশভোজ দিয়ে গেলো আঞ্জুমানকে। আঞ্জুমান তার খাবার থেকে অন্য একটি প্লেটে অধের্ক খাবার তুলে নিলো। মায়াকে আদেশ করে খেয়ে নিতে বলল। মায়া কাঁচুমাচু করতে করতে খেয়ে নিলো।
রাতে ঘুমানোর আগে রুমের দরজার উপর নিচের সব ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো আঞ্জুমান ভিতর হতে। মায়াকে তার পাশে শুয়ে যেতে আদেশ দিলো। এটাচ বাথরুম থাকায় রুমের বাইরে পা রাখতে হয়নি মায়াকে।
নিশুতি রাত। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রকৃতিজুড়ে অখন্ড নিরবতা বিরাজ করছে। আকাশে নেই কোন তারকাজি। শীতের কনকনে হিমেল হাওয়া বইছে। কানাকুয়োর ডাক ভেসে আসছে বাড়ির পিছনের ঝোপঝাড় হতে। গা ছমছমে ভুতুড়ে পরিবেশ। মায়া নামের মেয়েটি হাঁটু ভাঁজ করে শুয়ে আছে পালংকের কিনারায়। তার চোখের পাতা বুঁজে আসছে নিবু নিবু প্রদীপের ন্যায়।
নিমিষেই মায়ার মুদে আসা নয়নকোন ভিজে উঠলো বেদনার অশ্রুতে। কাল কি সত্যিই তার ছোট্ট জীবনের বিদায়ী সুর বাজবে?
চলবে…১ জনরা #থ্রিলার + রোমান্টিক