#মায়াবতী
#পর্ব:৫৪
#তানিশা সুলতানা
তন্নিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হবে। বিদেশ থেকে আগত ডাক্তার দুটো আশ্বাস দিয়েছে অর্ণবকে। তার স্ত্রীর মাথার পচন অংশ পুরো মাথায় ছড়িয়ে পড়ে নি। আল্লাহ চাইলে তাকে ভালো করা যাবে। তবে সে আগের মতো স্বাভাবিক কখনোই হতে পারবে না। তার মাথায় কখনোই চুল হবে না। বা মুখের এক পাশ বেঁকে যেতে পারে। অর্ণব এক সেকেন্ডও সময় নেয় নি। সাথে সাথে বলে দিয়েছে “তন্নির শরীরে শুধু মাত্র জানটা থাকলেই হবে। তাকে অর্ণব বলে ডাকলেই চলবে। আর কিচ্ছু লাগবে না।”
ডাক্তার মুচকি হেসে অর্ণবের কাঁধ চাপকে দেয়। রিজুয়ানও এক পলক দেখে অর্ণবকে। কপাল করে বর পেয়েছে তন্নি। এতো ভালোবাসা সহজে চোখে পড়ে না।
তন্নির মাথাটা বুকে চেপে ধরে বসে আছে অথৈ। তন্নিকে শান্তনা দিচ্ছে ভরসা দিচ্ছে।
“জান ভয় পাবি না তুই। কিচ্ছু হবে না। জাস্ট একটু ব্যাথা পাবি। আমরা সবাই অপেক্ষা করবো তোর জন্য। সবাই আছি তোর সাথে। আল্লাহ ভরসা। আল্লাহ তোর মতো অভাগাকে আর কষ্ট দিবে না। ভরসা রাখবি।
তন্নি মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। অথৈ তন্নির মাথায় চুমু খায়।
ওটিতে নেওয়ার আগে তন্নি সবার সাথে দেখা করে। কিন্তু ইতি বেগম আসে নি তন্নিকে দেখতে। নিধিও এসেছে। তন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। আশ্বাস দিয়েছে।
তামিম তন্নির মাথার কাছে বসেছে। তারেক তন্নির পাশে যেতেই তন্নি বলে ওঠে
“মা আজকেও আমার ওপর রেগে আছে?
তারেক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। মেয়েকে সে বলতে চায় না। সে ইতি বেগমকে ডিভোর্স দিয়েছে এবং তার নামে মামলা করেছে। এখন সে জেলে আছে।
তাই সে ইনিয়েবিনিয়ে বলে
“সব চিন্তা বাদ দাও।
সাগর অথৈয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে৷ দৃষ্টি তার তন্নির দিকে৷
কয়েকমাস একটা মানুষকে কি থেকে কি বানিয়ে দিয়েছে।
রূপ আর টাকার অহংকার বেশিদিন থাকে এটার জলজ্যান্ত প্রমাণ হচ্ছে তন্নি। কয়েক মাসেই রূপ শেষ।
আশা বেগম আনোয়ার সবাই দেখছে তন্নিকে।
রিজুয়ান কেবিনে ঢুকে সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলে। অর্ণব তাকায় না তন্নির দিকে। চুপচাপ বেরিয়ে যায়।
অনেকটা সময় নিয়ে তন্নির সার্জারী করানো হয়। মাথার চুল গুলো কেটে ফেলা হয়েছে। আল্লাহ অশেষ রহমত অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে। অপারেশন থিয়েটারের লাল বাতি নিভে যাওয়ার সাথে সাথে অর্ণব দাঁড়িয়ে যায়। সে থ মেরে বসে ছিলো।
ডাক্তার মাক্স খুলতে খুলতে বেরিয়ে আসে। অর্ণব এগিয়ে যায় না ডাক্তারের কাছে। তারেক আর আনোয়ার এগিয়ে যায়।
ডাক্তার বলতে শুরু করে
” এই ধরনের পেশেন্ট সাধারণত বেশিদিন বাঁচে না। একবার রিকোভার করলেও দ্বিতীয় বার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থেকেই যায়। তার স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।
ডাক্তার চলে যায়। সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে ওঠে। অর্ণব খুশিতে কেঁদে ফেলে। নিধি অর্ণবের দিকে তাকায়। মানুষটা মনে হয় আজকে প্রাণ খুলে শ্বাস নিচ্ছে। এতোদিন যেনো তার শ্বাস আটকে ছিলো।
অথৈ ভাইকে জড়িয়ে ধরে। যেনো তারা যুদ্ধ জয় করে উঠেছে।
তন্নির হাত ধরে বসে আছে অর্ণব। আরেক হাত ধরে অথৈ। ডাক্তার কথা বলতে বারণ করেছে। কেউ কথা বলছে না। দুজনই তন্নিকে দেখছে। মাথা পুরোটা ব্যান্ডেজ করা। হাতে ক্যানেলো লাগানো। নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে। চোখ দুটো বন্ধ। শুষ্ক ঠোঁট দুটো আরও শুকিয়ে গেছে। ফর্সা মুখটা কালচে হয়ে গেছে।
অর্ণব তন্নির হাতে চুমু খায়
“অনেক কষ্টে ফিরে পেয়েছি মায়াবতী। আর কখনোই হারাতে দিবো না তোমায়। ভালোবাসার চাদরে মুরিয়ে রাখবো তোমায়। মাথায় করে রাখবো। দ্বিতীয়বার তোমার কিছু হতেই দিবো না আমি।
বিরবির করে বলে অর্ণব।
তিনদিন পরে তন্নির সেন্স ফেরে। পিটপিট করে চোখ খুলে সবার প্রথমে অর্ণবের মুখটা দেখতে পায়। তার হাত ধরে ঘুমিয়ে আছে। তন্নির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। আরেকবার সুযোগ পেলো এই মানুষটার সাথে বাঁচার। একটা সেকেন্ডও নষ্ট করবে না আর। এই মানুষটার ভালোবাসা সে খুব যত্ন নিয়ে গ্রহন করবে। খুব ভালোবাসবে তাকে।
কিন্তু তার ভালোবাসার আরেকজন কোথায়? কোথায় অথৈ? তন্নি এদিক সেদিন মাথা ঘুরিয়ে খোঁজে অথৈকে। কিন্তু কোথাও নেই। দেখতে আসলো না তন্নিকে?
হাসি মুখটা চুপসে যায় তন্নির৷
হাতটা নারানোর চেষ্টা করে। তখনই জেগে যায় অর্ণব। সে সারা রাত বসেছিলো তন্নির হাত ধরে। একটু আগেই চোখ দুটো লেগে এসেছে।
তন্নিকে তাকাতে দেখে অর্ণবের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এক গাল হেসে বলে
” বউ ভালো আছো?
তন্নির মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। সে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু খুব কষ্ট হচ্ছে। মাথায় টান লাগে।
অর্ণব বুঝতে পারে
“আরে আরে রিলাক্স
মুখে বলতে হবে না। আমার হাতটা আলতো করে ছুঁয়ে দাও।
তন্নি তাই করে। অর্ণব খুব সাবধানে তন্নির মাথায় চুমু খায়।
” আল্লাহ আমার প্রার্থনা শুনেছে।
তারপর মনে মনে বলে “আমি তো মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে আল্লাহকে বলেছিলাম আমার সন্তান চাই না। আমার কিচ্ছু চাই না। শুধু তন্নিকে ফিরিয়ে দিন। আমরা সারাজীবন সন্তানের সুখ ত্যাগ করবো।”
অথচ অর্ণবের বাচ্চা খুব পছন্দের। তন্নি বেঁচে গেছে। অর্ণব আর কখনোই অনি তাতান ওদের নামটাও মুখে নেবে না।
অথৈ আসে বিকেলে। সে এতোদিন পর ঘুমিয়েছিলো। শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছিলো। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে সাগর।
অর্ণব পুরো রুম জুড়ে হাঁটছে আর তন্নিকে গল্প শোনাচ্ছে। মজার মজার গল্প বলছে।
আশা বেগম খাবার নিয়ে এসেছিলো। দরজার সামনে এসে থেমে যায়। এতোদিন পরে ছেলের মুখে হাসি দেখছে সে। তার ছেলে হাসছে। প্রাণ খুলে হাসছে। মন প্রাণ জুড়িয়ে যায় ওনার। আল্লাহ এভাবেই খুশি রাখুক তার সন্তানদের।
তারেক আনোয়ার তামিম নিধি রিজুয়ান আর্থি সাগর সবাই নিয়ম করে তন্নিকে দেখে যায়। তন্নির পাশে বসে সময় কাটায়। তন্নিকে গল্প শোনায়।
তন্নিও একটু একটু হাসে।
মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতে চায় কিন্তু কথা বলতে পারে না।
এভাবেই কেটে যায় একটা মাস। এখন তন্নি খানিকটা সুস্থ। আজকে তন্নিকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অর্ণবের বাড়িতে। ছোটখাটো করে তাদের বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। ইসলামিক শরিয়ত মতো বিয়ে করবে তারা।
শুরু করবে নতুন জীবন।
তন্নি হাঁটতে পারে না। কথা বলতে পারে না। রিজুয়ান হুইল চেয়ার এনেছে তন্নিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
অর্ণব কোলে তুলে নেয় তন্নিকে।
“আমার অনি
বলতে গিয়ে থেমে যায় অর্ণব। তন্নির দিকে এক পলক তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বলে
” আমার তন্নিকে আমি কোলে করে নিবো৷
তন্নির মনে খটকা লেগে থাকে।
___সমাপ্ত ___