মহাপ্রস্থান পর্ব ৭

0
315

#মহাপ্রস্থান
#পর্ব_৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
দোলার ফোন বাজছে। ফোনের স্ক্রিনে লেখা ‘আননোন’। আননোন লেখা উঠলেও নাম্বারটি দোলা খুব ভালো করেই চেনে। সেই ছেলেটা! দোলার সামনে গালে হাত দিয়ে বসে ছিল পৃথুলা। তার মুখ এখনো নিকাবে ঢাকা। এজন্যই বোধ হয় তার বিরক্তিমাখা মুখটা আবিষ্কার করতে পারেনি দোলা। পৃথুলা বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলল,

“ফোন রিসিভ করছেন না কেন?”

দোলা চেয়ারে বসে ছিল হেলান দিয়ে। সে পৃথুলার দিকে একবার তাকাল। নড়েচড়ে বসে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,

“ইচ্ছে করছে না তাই।”

“রিসিভ করতে ইচ্ছে না করলে সাইলেন্ট করে রাখুন। ফোনের ঘ্যানঘ্যানানি ভালো লাগছে না।”

দোলা ফোনটি সাইলেন্ট করল। পৃথুলা উশখুশ করছে। শুভ্র রঙের রুমটিতে সে ত্রিশ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে বসে আছে। আর সামনে বসে রয়েছে পুলিশ! প্রথম অবস্থাতে তো পৃথুলার জান প্রায় বের হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সে তো ধরেই নিয়েছিল, আরশান তাকে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। যদিও আদতে সে কোনো অন্যায় করেনি। উপরন্তু আরশান এবং তার লোকজন তাকে কি-ড-ন্যা-প করে ঘোর অন্যায় করে বসে আছে। তবে চাইলে আরশান তাকে শিলা বানিয়ে জেলে পাঠাতেই পারত নিজ স্বার্থ হাসিলে। কিন্তু আরশান এমনটা করেনি। সে তার কাজ শেষ করার জন্যই দোলার কাছে জিম্মি রেখে গেছে।

পৃথুলা কিছুক্ষণ পায়চারি করে বলল,

“উনি কখন আসবেন?”

“মিটিং শেষ হলে।” দোলার উত্তর।

“কখন শেষ হবে?”

“বলতে পারছি না শিওর।”

পৃথুলা চুপ হয়ে যায়। তার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে অবশেষে আরশানের মিটিং শেষ হলো। এজন্য অবশ্য তাকে আরও দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। সে এবং দোলা করিডোরের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। ওদের থেকে কিছুটা দূরে আরশান এবং আরও কয়েকজন লোকজন। এদের কথা কি এখনো শেষ হয়নি? বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে ফেলল পৃথুলা। এরমাঝে আবার সেখানে দোলাও এগিয়ে গেল। লোকগুলো চলে গেছে। আরশান এবং দোলা কথা বলছে। কথা বলতে বলতেই দুজন এগিয়ে এলো। আরশানের শেষ কথা ছিল,

“ঠিক আছে। থ্যাঙ্কিউ।”

দোলা সৌজন্যমূলক হাসল। আরশান পৃথুলার উদ্দেশ্যে বলল,

“আর দু’মিনিট। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি।”

পৃথুলা কোনো প্রত্যুত্তর করল না। আরশান চলে যাওয়ার পর পৃথুলা দোলার নেইম প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলল,

“দোলা রহমান! এই মিস দোল দোল দুলুনি, আমার হাজবেন্ডের সঙ্গে ডলাডলি কম করবেন।”

দোলা হকচকিয়ে গিয়ে বলল,

“সরি?”

“সরি বলতে হবে না। মাফ করে দিয়েছি এবারের মতো।”

“আমি মাফ চাইনি। বুঝতে পারিনি আপনার কথা ঠিক। কীসের ডলাডলি? এবং আপনি কী বললেন? আরশান স্যার আপনার হাজবেন্ড?” বিস্ময়ে হতবাক দোলা।

পৃথুলা দাম্ভিক ভঙ্গিতে বলল,

“হু। ডলাডলি বুঝেন না? বেশি ঘেঁষাঘেঁষি করবেন না।”

“একটু সংযত হয়ে কথা বলুন। আর সত্যিই আপনি আরশান স্যারের ওয়াইফ?”

“হ্যাঁ। আর কতবার বলব? বিশ্বাস না হলে তাকেই জিজ্ঞেস করুন।”

দুজনের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই আরশান ফিরে আসে। দোলা এই প্রসঙ্গে কোনো প্রশ্ন করার আগেই আরশান বলল,

“আসছি।”

হতবাক দোলা কোনো উত্তর দিতে পারল না। আরশান পৃথুলাকে নিয়ে নিচে নেমে এলো।

“এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি?” জানতে চাইল পৃথুলা।

আরশান বলল,

“আরেকটা কাজ আছে।”

“আরও কাজ! সেখানে আবার কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে?”

“জানিনা।”

পৃথুলার রাগ হলো আরশানকে এতটা ভাবলেশহীন দেখে। আরশান দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে একটা সিএনজি ভাড়া করল। পৃথুলা ভীষণ ক্লান্তবোধ করছিল। অথচ পাশের মানুষটাকে দেখলে মনে হবে একদম তরতাজা। ক্লান্তের ‘ক’-ও নেই এই লোকের মাঝে। খাবার দেখেই পৃথুলার পেটে ক্ষুধার রাজা হৈ-চৈ শুরু করে দেয়। সে আরশানকে না সেধেই নিজের মতো খেয়ে যাচ্ছে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার আধোআধো অন্ধকারের আভা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সিএনজি চলেছে পিচঢালা পথ ধরে। দু’ধারে ঘন বন-জঙ্গল। হঠাৎ আরশান সিএনজি ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“মামা, গাড়ি থামান।”

পৃথুলা কিছুটা অবাক হয়ে বলল,

“আরে কী হলো? এই মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামাবে কেন?”

আরশান কোনো উত্তর দিল না। পৃথুলার হাত ধরে সিএনজি থেকে নামাল। যত দ্রুত সম্ভব ভাড়াটা দিয়ে সে বাম পাশের জঙ্গলে ঢুকে গেল। পৃথুলা কিছুই বুঝতে পারছে না। তার হাত থেকে খাবার পড়ে গেছে। আরশান এত জোরে হাত ধরে হাঁটছে যে সে নিজেকেই সামলাতে পারছে না। আর না পারছে আরশানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে। এমন ঘন জঙ্গল! রাস্তায় চলা গাড়ির শব্দগুলো ক্রমশই কমে আসছিল। এখন শুধু শুকনো পাতার মর্মর শব্দ শোনা যাচ্ছে। এতটুকুতেই আরও বেশি ক্লান্ত হয়ে গেছে পৃথুলা। সে বিরক্ত হয়ে বারংবার জিজ্ঞেস করছে,

“আরে হলো কী? কোথায় যাচ্ছেন? আমার কিন্তু ভয় করছে। প্লিজ! বলেন।”

আরশান না থেমেই উত্তর দিল,

“এখন এতকিছু বলার সময় নেই। দৌঁড়ান।”

হাঁটার মাঝেই এবার দুজনে দৌঁড়ানো শুরু করে। কান খাড়া করে পৃথুলা শুনতে পায় আরও অনেকগুলো পায়ের শব্দ। পাতার মর্মর শব্দ অনেক বেশি শোনা যাচ্ছে। সে একবার পিছু ফিরে তাকাল। চক্ষু তার চড়কগাছ। আট থেকে নয় জন ব-ন্দু-ক-ধা-রী লোক তাদের পিছু নিয়েছে। এবার পৃথুলার মনে হচ্ছিল সে আর নিজের মাঝে নেই। চোখের পলক ফেলার পূর্বেই গু-লি-র শব্দ শুনতে পায়। দৌঁড়ানোর গতি শ্লথ হয়ে যায় তার। আরশান স্পষ্ট তা বুঝতে পারে। সে সাহস যোগাতে বলে,

“এখানে থেমে গেলে চলবে না পৃথুলা। প্লিজ, একটু শক্ত হোন। সাহস আনুন। মনোবল হারাবেন না।”

পৃথুলা সবকিছু ঝাপসা দেখছিল। তার কানে বাজছে ‘এখানে থামলে চলবে না।’ সে এই কথাটুকুকেই পুঁজি করে প্রাণপণে দৌঁড়াচ্ছে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হাঁপিয়ে গেছে সে। অনেকদূর যাওয়ার পর একটা পুকুর দেখতে পায় দুজনে। যার কিনারের পানি শুকিয়ে গেছে। ওপরে ঝোপ এবং নিচে গর্তমতো স্থান বলে কেউ লুকিয়ে থাকলেও খুব সহজে খুঁজে বের করা যাবে না। চারদিকে আবছায়া অন্ধকার। একটু পরেই রাত হয়ে যাবে। আরশান চটজলদি ওকে নিয়ে সেখানে লুকিয়ে পরে। পৃথুলা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে সে। এখনো ভয়ে তার হৃদস্পন্দন দ্রুত চলছে। আরশান স্পষ্ট টের পাচ্ছে তার ভীতি। আশ্বাস দিতে এবং ভয় লাঘব করতে পৃথুলাকে সে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। আশকারা পেয়ে হুহু করে কেঁদে ফেলে পৃথুলা। আরশান ওর মুখ চেপে ধরে ফিসফিস করে বলে,

“প্লিজ! এখানে কাঁদবেন না। ওরা শুনতে পাবে।”

পৃথুলা ক্রন্দনরতস্বরে ফুঁপিয়ে মৃদুস্বরে বলে,

“আমার ভয় করছে!”

আরশান পৃথুলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“ভয় নেই পৃথু। আমি আছি তো!”

পায়ের শব্দ একদম কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে এখন। মনে হচ্ছে, একদম পুকুরটার কিনারেই লোকগুলো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কথোপকথনও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল দুজনে। ভয়ে শব্দ করেই ফুঁপিয়ে ওঠে পৃথুলা। লোকগুলো হঠাৎ-ই সতর্ক হয়ে চুপ হয়ে যায়। তাদের কথার আলাপ আর শোনা যাচ্ছে না। কয়েক সেকেন্ড বাদেই পুকুরের পানিতে টর্চের আলো দেখতে পায় পৃথুলা। ধরা পড়ার ভয়ে চোখ বড়ো বড়ো হয়ো যায় তার। ত্রস্ত দৃষ্টিতে আরশানের দিকে তাকাতেই আরশান তার মুখের ওপর হাত রেখে দু’দিকে মাথা নেড়ে ইশারা করে কিছু না বলতে। পৃথুলা কোনোভাবেই আর নিজেকে সংবরণ করে রাখতে পারছিল না। এতটা ভয় সে ইতোপূর্বে কখনো পেয়েছে বলে মনে হয় না। সে জ্ঞান হারিয়ে আরশানের বুকে ঢলে পড়ে। আরশানের এতক্ষণ ভয় না লাগলেও এখন কিছুটা ভয় হচ্ছে। নিজের চেয়েও বেশি পৃথুলাকে নিয়ে ভয় তার। উপরে শ-ত্রু পক্ষ আর এখানে পৃথুলা সেন্সলেস। পালানোর কি কোনো পথ আদৌ রয়েছে?

চলবে…

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here