#মহাপ্রস্থান
#পর্ব_৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
আরশান পাথরের ন্যায় সিটের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার কাঁধে পৃথুলার মাথা। মেয়েটা এত ঘুম কাতুরে! এরকম প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও কীভাবে যে ঘুমাচ্ছে কে জানে! তারওপর জ্যামে পড়ে আছে প্রায় আধাঘণ্টা হতে চলল। আরশান হাত বাড়িয়ে জানালাটা একটু খুলে দিল। সে এতক্ষণ ধরে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছে। একা হলে তার বাসে যাওয়ার প্রয়োজন হতো না। আর যদি প্রয়োজন হতোও তাহলে সমস্যা ছিল না। অন্তত এই জ্যামে বসে বিরক্ত না হয়ে বাস থেকেই নেমে যেত। যত সমস্যার মূলে রয়েছে এই মেয়ে। শান্তি শব্দটা জীবন থেকে একদম ধুয়ে, মুছে দিচ্ছে। একটা ভুলের জন্য রীতিমতো এখন তাকে পস্তাতে হচ্ছে।
আরও মিনিট পাঁচেক অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে অবশেষে ব্যস্ত শহরের জ্যাম ছাড়ল। বাস তবুও কিছুটা শ্লথগতিতেই চলছে। জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে মৃদু বাতাস। আরশানের ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। শিমুল কল করেছে।
“হ্যালো স্যার, কেমন আছেন?”
আরশান মুখটা গোবেচারার মতো করে বলল,
“যেমন রেখে গেছ!”
শিমুল একটু থমকাল। কিছুটা ইতস্ততবোধও করছে। এরকমভাবে তো সাধারণত ব্রেকাপের পর গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ডরা কথা বলে। কিন্তু সে কী করেছে? সে তো কোনো চিট করেনি। তারচেয়েও বড়ো কথা আরশানের সঙ্গে তার সম্পর্ক তো আর ওরকম নয়।
“হলো কী আবার তোমার?”
আরশানের ধমকে শিমুলের চিন্তা ভঙ্গ হয়। চিন্তা না বলে একে দুশ্চিন্তা বলা যায়। এতক্ষণ কীসব ভাবছিল ভেবেই নিজেকে তিরস্কার করছে শিমুল। আর ভাববেই না কেন? পৃথুলা মেয়েটার জন্য তো আর দু’দণ্ড স্বস্তি নেই। নিজে একটা পা-গ-ল। বাকিদেরও পা-গ-ল বানানোর পণ করে বসে আছে।
নিজেকে সামলে নিয়ে শিমুল বলল,
“এ কথা বললেন কেন স্যার? আমি তো কিছু করিনি।”
“তুমি করোনি তো কে করেছে? আনতে বলেছিলাম সূর্যমুখী, নিয়ে এসেছ গোলাপ।”
শিমুল অসহায়বোধ করছে। কীসের সূর্যমুখী, কীসের গোলাপ? তার স্যার কি ফুল নিয়ে গবেষণা করছে নাকি? সে ভয়ে ভয়ে বলল,
“আপনি তো আমাকে কোনোদিন ফুলই আনতে বলেননি স্যার।”
আরশানের রাগে শরীর জ্বলছে। শিমুল ছেলেটা তো যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছিল। এখন এমন হাভাতের মতো আচরণ করছে কেন? ছোট্ট একটা হেঁয়ালি বুঝতে পারছে না। আশ্চর্য! সে কি এখন পাবলিক প্লেসে বলবে যে, সে শিলাকে কি-ড-ন্যা-প করতে বলেছিল। কিন্তু শিলার বদলে কি-ড-ন্যা-প করেছে পৃথুলাকে।
“স্যার, আমি কি গোলাপ নিয়ে আসব?”
শিমুলের এমন বোকা বোকা কথা শুনে আরও রাগ বেড়ে যায় আরশানের। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“কোনো দরকার নেই। গোলাপ আমার সঙ্গেই আছে।”
“আপনি গোলাপ নিয়ে কেন ঘুরছেন স্যার?”
“আমার শখ হয়েছে তাই। তোমার সমস্যা কী?”
“আপনি রাগ করছেন!”
“হ্যাঁ, করছি। কী একটা আপদ যে আমার গলায় ঝুলিয়ে তুমি ওদিকে আরামে শুয়ে আছো তা তো তুমি জানো না।”
শিমুল এতক্ষণে আরশানের রাগের কারণটা বুঝতে পারে। নিশ্চয়ই পৃথুলা কোনো অঘটন ঘটিয়েছে। সে সন্দিহান কণ্ঠে সুধাল,
“মেয়েটা কি কিছু করেছে নাকি আবার?”
“পুরো বাঁদর নাচ নাচাচ্ছে। ফর গড সেইক, তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসো। এই মেয়েকে একা সামলানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
শিমুল হেসে বলে,
“স্যার, এতসব মানুষকে একহাতে সামলে নেন। অথচ এখন একটা মেয়েকে সামলাতে পারছেন না? আপনি বউ সামলাবেন কীভাবে?”
“একদম দাঁত ক্যালাবে না।”
শিমুলের হাসি বন্ধ হয়ে যায়। আরশান বলে,
“এই মেয়ে যে কী চিজ তা তুমি জানো না? আমার বউ হলে তো এক চ-ড়ে সোজা করে ফেলতাম।”
“আমি কি বাঁকা নাকি?” ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে উঠল পৃথুলা। আরশানের রাগারাগি আর ধমকানোরসুরে বলা কথা শুনে তার ঘুম ভেঙে গেছে।
আরশান কল কেটে দিয়ে বলল,
“একদম কোনো কথা বলবেন না। চুপ করে বসে থাকেন।”
“আশ্চর্য! এখন আবার আমি কী করলাম?”
“কিছু যেন করতে না পারেন এজন্য শুরুতেই চুপ থাকতে বলেছি।”
পৃথুলা চুপ হয়েই থাকল। বাস থেকে নেমে একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ল দুজন। পায়ে চালানো রিকশা। জায়গা কম। চাপাচাপি করে বসতে হয়েছে। জায়গায় জায়গায় উঁচু-নিচু গর্ত। সামলে বসে থাকা কঠিন। পৃথুলার ভয় হচ্ছিল কখন না জানি আবার পড়ে যায়। সে আরশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মাস্কটা খুলুন তো।”
আরশান ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
“কেন?”
“আপনার মুখ দেখে আপনাকে কয়েকটা গা-লি দেবো। এত মোটা হতে বলেছে কে? রিকশায় জায়গা হচ্ছে না। ঠিকমতো বসতেও পারছি না আমি।”
“আপনি আমার ওজন নিয়ে কথা বলছেন কেন? আমি মোটেও মোটা নই। হাইট অনুযায়ী ওয়েট একদম পার্ফেক্ট। আপনি এসবের বুঝবেন কী? স্বাস্থ্য মেইনটেইন সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা আছে?”
“আমার অত ধারণার দরকার নাই তো। আমার দরকার জায়গা। আমি বসতে পারছি না।”
“বসতে পারছেন না মানে কী? বাতাসীর মতো শরীর আবার বলেন জায়গা হয় না।”
“আপনি আমাকে বাতাসী বললেন?”
“হ্যাঁ, বললাম। আপনি জাস্ট চুপ থাকেন তো! আপনার সঙ্গে থেকে থেকে আমাকেও বেশি কথা বলতে হচ্ছে।”
পৃথুলা আরশানের বাহু জড়িয়ে ধরে বসে রইল। আরশান হতবিহ্বল হয়ে বলল,
“এসব কী হচ্ছে?”
“জান বাঁচানো ফরজ। তাই জান বাঁচাচ্ছি।”
“মানে?”
“এত মানে মানে করেন কেন? পড়ে যেন না যাই তাই আপনাকে ধরেছি।”
আরশান অন্যদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিল।
.
রিকশা এসে দাঁড়িয়েছে ‘আতোয়ার চৌধুরী ফ্যাশন লিমিটেড’ এর সামনে। আরশান ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বলল,
“আসুন। আর শুনুন, দয়া করে এখানে কোনো রকম সিনক্রিয়েট করবেন না প্লিজ!”
পৃথুলাকে আরশানের সঙ্গে দেখে সিকিউরিটি গার্ড কিছু বলেনি। ভেতরে ঢুকে আরশান আগে আগে হাঁটছিল। পৃথুলা চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে। তার হাঁটার গতি শ্লথ। কেমন যেন একটু ভয় ভয়ও করছিল। অফিসের সামনে এসে দেখল আরশান নেই। সে ফের চতুর্দিকে তাকাল। কোথাও নেই তো! এবার তার সত্যিই ভয় হতে লাগল। এখানেই তো ছিল। গেল কোথায় তবে? অফিসের ভেতর? সে ভেতরে গেল দৌঁড়ে। লিফ্টের সামনে গিয়ে দেখল আরশান দাঁড়িয়ে আছে। সে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পৃথুলার দিকে। পৃথুলা যেন জানে পানি ফিরে পেল। সে এক দৌঁড়ে আরশানের কাছে গিয়ে হাত ধরল।
আরশান সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে বলল,
“এখানে হাত ধরছেন কেন? হাত ছাড়ুন।”
“না। আমার ভয় করছে!”
আরশানের ভ্রুঁ কুঁচকে যায়। ভয় আর পৃথুলা? এটাও কি সম্ভব? কারও আসার শব্দ শুনে পৃথুলাকে টেনে নিয়ে লিফ্টের ভেতর ঢুকে গেল সে। চটজলদি ৪ নং বাটন প্রেস করে স্থির হয়ে দাঁড়াল।
“হঠাৎ এত ভয় পাওয়ার কারণ কী?” ভরাট কণ্ঠে জানতে চাইল আরশান।
পৃথুলা এখনো তার হাত ধরে রেখেছে। সে একবার তাকাল আরশানের মুখপানে। বলল,
“জানিনা! কেমন যেন ভয় ভয় করছে।”
“কেমন ভয়?”
পৃথুলা তার এক হাত আরশানের মুখের সামনে নিয়ে ভয় দেখানোর ভান ধরে সুর দিয়ে বলে,
“গা ছমছম
কী হয়, কী হয়,
কখনো মজার,
কখনো বা ভয়!
পশু-পাখি, রাজা-রানি
ভূত-পেত্নী চোখের সামনে সব হাঁটবে-চলবে
কথা বলবে।
ঠাকুরমার ঝুলি খুলবে,
মজার গল্প বলবে।”
আরশান এক ঝটকায় পৃথুলার হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,
“খুব চিল মুডে আছেন মনে হচ্ছে।”
পৃথুলা আড়চোখে তাকাল এবার। মাস্ক পরার কারণে আরশানের হাসি দেখা না গেলেও, চোখ দুটো স্পষ্ট বলে দিচ্ছে মানুষটা হাসছে। রহস্যজনক হাসি!
চার তলায় যাওয়ার পর আরশানের প্রথম দেখা হলো পুলিশ অফিসার দোলা রহমানের সঙ্গে। দুজনের কোনো কথাবার্তা হয়নি। জাস্ট সৌজন্যমূলক হাসি আদান-প্রদান হয়েছে।
“ওকে নিয়ে যান।” দোলার উদ্দেশ্যে বলল আরশান।
পৃথুলা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। আরশানকে কিছু বলার পূর্বেই আরশান সেখান থেকে চলে গেছে। একবারও পিছু ফিরে তাকায়নি সে। এদিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পৃথুলা।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]