#মহাপ্রস্থান
#পর্ব_২২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________
একদম ঘরোয়াভাবে দোলা এবং হিমেলের বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। হিমেলের আপন বলতে কেউই নেই। তবে ছাদে বার দু’য়েক এক মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে। নাম পৃথুলা। মেয়েটার সহজ-সরল আচরণ তাকে খুব টেনেছিল। পরিচয়টা ছাদেই হয়েছিল। জ্বরে অসুস্থ হয়ে সেদিন সিঁড়িতে যেই শার্ট-প্যান্ট পরেছিল, ছাদে দেখা হওয়ার দিনও একই পোশাক পরা ছিল। তাই পৃথুলা যেচে এসেই জানতে চেয়েছিল,
“আপনিই কি সেদিন সিঁড়িতে বসে ছিলেন?”
হিমেল ভ্রু কুঞ্চন করে জানতে চায়,
“কোনদিন?”
“তা তো ঠিক মনে নেই। তবে অসুস্থ মনে হয়েছিল।”
হিমেল বুঝতে পেরে বলে,
“হ্যাঁ।”
“আপনাকে এত ডাকলাম সেদিন শোনেননি?”
“ঝাপসা শুনেছিলাম। জ্বর ছিল খুব।”
“ডাক্তারের কাছে না গিয়ে ওখানে কেন বসে ছিলেন?”
“ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্যই বের হয়ে ছিলাম। কিন্তু হাঁটতে এত কষ্ট হচ্ছিল যে সেখানেই বসে পড়ি।”
“আপনার বাড়ির কেউ নেই? ওরা কেন যায়নি ডাক্তার আনতে?”
হিমেল ম্লান হেসে বলেছিল,
“আমার দুনিয়াতে আপন বলতে কেউ নেই।”
পৃথুলা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। দুর্বোধ্য হেসে বলে,
“আমারও কেউ নেই।”
হিমেল চমকে তাকায়। কিছু বলার পূর্বেই ছাদে তখন সীমন্তির আগমন ঘটে। সে পৃথুলাকে হিমেলের সঙ্গে কথা বলতে দেখে রেগে যায়। গর্জে উঠে নিয়ে আসে রুমে। সেদিন থেকেই পৃথুলার প্রতি আলাদা একটা টান তৈরি হয়েছিল হিমেলের। নিজের বোন থাকলে হয়তো এমনটাই অনুভূতি অনুভব হতো। এভাবে মাঝে মাঝেই ওদের ছাদে কথা হতো। কিন্তু ওদের এই মেলামেশা চোখের বিষ ছিল সীমন্তির।
হিমেলকে চিন্তিতচিত্তে বসে থাকতে দেখে দোলা বলল,
“তুমি কি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত?”
হিমেল মলিন হেসে বলল,
“কই না তো!”
“কিন্তু তোমার চোখ-মুখ বলছে তুমি কিছু একটা নিয়ে খুব ভাবছ।”
এরপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলে,
“এখনো সময় আছে। চাইলে বিয়েটা না করতে পারো।”
হিমেল সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। দোলার হাত চেপে ধরে বলে,
“এমন কথা বোলো না দোলা! তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি অন্তিম পথ পাড়ি দিতেও প্রস্তুত ছিলাম। আর তুমি বলছ তোমাকে পেয়েও হারাতে?”
দোলা নিশ্চুপ। হিমেল বলল,
“আমি পৃথুলার কথা ভাবছি।”
দোলা বিস্মিত হয়ে বলে,
“পৃথুলা কে?”
“আমরা এক বাড়িতেই থাকি। মেয়েটাও আমার মতো অনাথ। আমি ওকে বোনের মতোই দেখি।”
“তাহলে ওকে নিয়ে এলে না কেন?”
“আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওর রুমমেট বলল দু’দিন ধরেই নাকি বাড়িতে নেই।”
“ফোন দিতে।”
“ফোন নাম্বার তো নেই!”
“আচ্ছা এত চিন্তা কোরো না। হয়তো কোনো আত্মীয় কিংবা বান্ধবীর বাড়িতে আছে।”
“বিয়ের কথাটাও তো বলতে পারলাম না।”
দোলা হেসে ফেলে হিমেলের সরলতা দেখে। গালে আলতো করে হাত রেখে বলে,
“বোকা ছেলে! দেখা তো আবার হবে নাকি? তখন আমায় দেখিয়ে সারপ্রাইজ দিও।”
দোলার হঠাৎ এমন আচরণে হিমেল যেমন অবাক হয়েছে তেমনই খুশিও হয়েছে। এই প্রথম দোলা এতটা স্নেহের সাথে ভালোবেসে কথা বলেছে।
হিমেলকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে দোলা বলে,
“একটা কথা বলি?”
“বলো।”
“তোমাকে একটাবার জড়িয়ে ধরি?”
একের পর এক ঝটকা আর নিতে পারছে না হিমেল। আজ কি সূর্য অন্যদিকে উঠেছে? নাকি ভাগ্য তার সহায় হয়েছে? নববধূ রূপে রূপবতী দোলা উত্তরের আশায় অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে। হিমেলের পূর্ণ সম্মতি আছে বুঝতে পেরেই সে হিমেলকে জড়িয়ে ধরে। মনে মনে স্বগতোক্তি করে বলে,
“আই এম সরি হিমেল। নিজের স্বার্থের জন্যই তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। অতীতের জীবন নিয়ে আমি অতিষ্ঠ। রাফসানকে চিরতরে ভুলে যেতে চাই। এরজন্য জীবনে নতুন কাউকে প্রয়োজন ছিল। কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। ভালোও বাসতে পারি না। এমনকি তোমাকেও আমি ভালোবেসে বিয়ে করছি না। এই কঠিন সত্যটা জানলে তুমি কষ্ট পাবে বলেই তোমাকে বলা হয়নি। কিন্তু আমি মন থেকেই দুঃখিত।”
.
.
পৃথুলা কাৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তার মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে দিবা। আরশানের কাছ থেকে ফিরে আসার পর আজ দু’দিন ধরেই সে দিবার কাছে থাকছে। নিজ বাড়িতে সীমন্তির জন্য টিকে থাকা দায় হয়ে পড়ছিল। ওর রুড ব্যবহার, অস্বাভাবিক আচরণ, ড্রা’গ নিতে বাধ্য করা এসব নিতে পারছিল না পৃথুলা। অভিমানে সে আরশানের কাছেও ফিরতে চাইছিল না। তার যাওয়ার মতো অন্য কোনো পথ নেই। তাই সে দিবার কাছে চলে এসেছে। দু’দিন যাবৎ ফোনও বন্ধ করে রেখেছে।
“এখনো মন বিষণ্ণ?” মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করল দিবা।
পৃথুলা দিবার হাত ধরে বলল,
“একটু, একটু। আমি এসে আপনাকে খুব জ্বালাচ্ছি তাই না?”
“মোটেও না। আমার ছোটো বোন এলে কি আমি বিরক্ত হতাম?”
“আচ্ছা আমাকে তো ব্যক্তিগতভাবে চেনেন না, জানেন না। তবুও কেন এত ভালোবাসেন?”
“কারণ তুমি মেয়েটাই ভালোবাসার মতো।”
“আমার জীবনকাহিনীর জন্য কি সবাই আমাকে করুণা করে? সহমর্মিতা দেখায়?”
“এসব কথা কেন বলছ সোনা?”
“কারণ আমার এমনটাই মনে হয়।”
“ভুল ভাবো তুমি। যারা তোমায় ভালোবাসে তারা সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসে। দু’দিন ধরেই বলব ভাবছি। কিন্তু বলা হচ্ছে না। আরশান ছেলেটার সাথে কি তোমার ঝগড়া হয়েছে?”
পৃথুলার হঠাৎ-ই কান্না পেয়ে যায়। সেই রাতের কথা মনে পড়লেই তার কান্না পায়। আরশান কী করে তার সাথে এতটা রুডভাবে কথা বলল? কীভাবে আঘাত করতে পারল? পৃথুলাকে কাঁদতে দেখে দিবা অস্থির হয়ে পড়ে। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
“আমি সরি বাচ্চা। কাঁদে না প্লিজ! আমার কিন্তু খারাপ লাগছে।”
“সে আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে আপু।” ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে পৃথুলা।
“কী হয়েছে আমাকে বলা যাবে?”
পৃথুলা কাঁদছে। কিছু বলছে না। কোনো মেয়েঘটিত ব্যাপার নিয়ে আরশান তাকে কষ্ট দিয়েছে এই বিষয়টা সে দিবাকে বলতে চাইছে না। আর যাই হোক সে চায় না, আরশান কারও কাছে খারাপ হোক।
“আচ্ছা বেশ, কিছু বলতে হবে না। এখন ওঠো তো। ফ্রেশ হয়ে নাও। আমরা বের হব।”
“কোথায় যাব?”
“বাইরে ডিনার করতে যাব।”
“আপনি আর ভাইয়া যান। আমি যাব না।”
“তোমার ভাইয়া আজ ভোরেই চট্টগ্রাম গেছে একটা কাজে। বলেছিলাম তো তোমাকে।”
“ওহ। ভুলে গেছিলাম।”
“এখন চটজলদি উঠে ফ্রেশ হয়ে আসো।”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও পৃথুলা ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে চলে যায়।
_____
আরশান অস্থির হয়ে দাঁত দিয়ে নখ খুঁটছে। তাকে ভীষণ চিন্তিতও দেখাচ্ছিল। দু’দিন ধরে হন্যে হয়ে সে পৃথুলাকে খুঁজেছে। পায়নি। কিন্তু আজ সকালেই সে পৃথুলার সন্ধ্যান পেয়েছে। দিবার সঙ্গে হাসপাতালে আরশানের দেখা হয়। আরশান তাকে না চিনলেও দিবার চিনতে সমস্যা হয় না। তার স্মৃতিশক্তি ভীষণ ভালো। দিবার কাছেই আরশান জানতে পারে যে, পৃথুলা এখন তার কাছেই আছে। সে দিবাকে অনুরোধ করে পৃথুলার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য। সেই অনুরোধ রাখতেই দিবা পৃথুলাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে আসবে।
আরশানকে বারবার ঘড়ি দেখতে দেখে শিমুল বলে,
“স্যার, একটু শান্ত হয়ে বসুন। এত অস্থির হচ্ছেন কেন?”
“তুমি বুঝবে না আমার ভেতর দিয়ে কী বয়ে যাচ্ছে।”
“আমাদের আরেকটু সেইফ থাকা দরকার ছিল। তাহলে পৃথুলার সাথে এই ঘটনাটি ঘটত না। মেয়েটা ভীষণ হার্ট হয়েছে।”
আরশান ভীষণ অনুতপ্ত। সে মুখে কিছু বলল না। থাই গ্লাস ভেদ করে নিচে তাকিয়ে দিবা এবং পৃথুলাকে দেখতে পায়। সঙ্গে সঙ্গে শিমুলকে নিয়ে সেখান থেকে সটকে পড়ে সে।
আরশান এবং শিমুল যেই টেবিলে বসেছিল দিবাও পৃথুলাকে নিয়ে সেখানেই বসল। এখান থেকে বাইরের ভিউটা খুব ভালোভাবে দেখা যায়। রেস্টুরেন্টে লোকজনও খুব কম। চারদিকে তাই নিস্তব্ধতা ও নির্জনতা বিরাজ করছে।
“তুমি বসো। খাবার অর্ডার করো। আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।” বলে দিবা ওয়াশরুমে যায়।
পৃথুলা কাচের বাইরের শহরটা দেখছে। যান্ত্রিক শহরে গাড়ির অবাধ চলাচল। মানুষের সমাগত। ব্যস্ত নগরী। রাতের শহর। আকাশের বুকে অর্ধখণ্ড চাঁদ এবং ছোটো ছোটো তারা নিবিষ্ট মনে দেখছিল পৃথুলা। এতকিছুর মাঝে থেকেও তার শুধু আরশানের কথাই মনে পড়ছে। কতটা সময় পার হয়ে গেল মানুষটাকে দেখা হয় না, ছোঁয়া হয় না, কথা হয় না!
“তেরা ধিয়ান কিধার হে,
এ তেরা হিরো ইধার হে।”
হঠাৎ পরিচিত কণ্ঠে গানের লাইন শুনে পৃথুলা বিচলিত হয়ে পড়ে। তারচেয়েও বেশি অবাক হয় যখন পাশে তাকিয়ে আরশানকে দেখতে পায়।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]