#মরীচিকাময়_ভালোবাসা
#পর্বঃ২
#লেখিকাঃদিশা_মনি
বিধ্বস্ত মন নিয়ে নিজের রুমে চুপচাপ বসে আছে মৌরী। রাগে-ক্ষোভে তার নিজেকেই শে’ষ করে দিতে ইচ্ছা করছে। মাথার উপর শো শো শব্দ করে ঘোরা ফ্যানটাকেও আজ ভীষণ বিরক্ত লাগছে তার। সব বিরক্তির একটাই কারণ, প্লাবণ নামক পাষাণ মানুষটা।
মৌরীর আজকাল কেন জানি নিজের উপরেই রাগ হয়। কেন সে ভালোবাসতে গেল ঐ মানুষটাকে? বয়ঃসন্ধিকালের আবেগই তো ঠিক ছিল, আবেগটা ভালোবাসায় পরিণত না হলে হয়তো আজ মৌরীর মন এতটা বিক্ষিপ্ত হতো না।
দরজায় কারো কড়া দেওয়ার শব্দে মৌরী নিজের ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো। দরজার পানে তাকিয়ে প্লাবণকে দেখে ভীষণ অবাক হলো সে। সাথে খুশিও হলো বেশ। প্লাবণ মৌরীর দিকে তাকিয়ে ছিল। মৌরীর সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নেয়৷ তেজালো সুরে বলে,
‘একটু বাইরে আয়, তোর সাথে কথা আছে।’
‘আমাকে বাইরে আসতে বলছ কেন? তুমি ভেতরে এসো না।’
‘তোর সেন্স না থাকতে পারে কিন্তু আমার আছে। এত রাতে একটা কুমারী মেয়ের রুমে প্রবেশ করব এমন কথা আমি চিন্তাও করতে পারি না।’
প্লাবণের কথা শুনে বেশ বিরক্ত হলো মৌরী। প্লাবণের সামনে বিরক্তির প্রকাশ ঘটাতে না পেরে মনে মনে বলল,
‘ব্যা’টা খবিশ। এত আদর্শবান হতে তোমায় কে বলেছে? তোমার আদর্শ ধুয়ে তুমি পানি খাও।’
প্লাবণ মৌরীর মনোভাব ঠাহর করতে পারল। বুক হাত গুজে দাঁড়িয়ে চোখে মুখে বেজায় রাগ ফুটিয়ে ক্রুদ্ধস্বরে বললো,
‘মনে মনে আমাকে গা’লি দেওয়া শেষ হলে দ্রুত বেরিয়ে আয়। আমার কাছে তোর মতো রাজ্যের সময় নেই।’
মৌরী বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রুমেই বাইরে বেরিয়ে এলো। প্লাবণের একেবারে মুখোমুখি দাঁড়ালো। তাদের মাঝে দূরত্ব বেশ কম থাকায় প্লাবণ দুপা পিছিয়ে গেল৷ মৌরী গমগম গলায় বললো,
‘কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো। আমারও তোমার কথা শোনার মতো ওতো বা’জে সময় নেই। আজ রাতে অনেকগুলো ড্রামা দেখতে হবে।’
‘রাত জেগে ড্রামা না দেখে পড়াশোনা করলেও তো পারিস, সেটা তোর জন্য কাজে দেবে।’
‘হুশ, নো মোর জ্ঞান, কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো।’
প্লাবণ মৌরীর দিকে একটি পেপার বাড়িয়ে দেয়। মৌরীর পেপারটি হাতে নিয়ে একপলক চোখ বুলিয়ে নেয়। অতঃপর প্লাবণকে শুধায়,
‘এটা কিসের পেপার?’
‘আমাদের কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের।’
‘তুমি ইতিমধ্যেই সব ব্যবস্থা করে নিয়েছ।’
‘হুম, এখন শুধু পরিবারকে রাজি করানো বাকি। কারণ তোর মত তো অলরেডি নিয়ে নিয়েছি।’
প্লাবণের কথা শোনামাত্র বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ না করে মৌরী বলে ওঠে,
‘কে বলেছে আমার মত আছে? আমার এই বিয়েতে কোন মত নেই।’
মৌরীর হঠাৎ এভাবে পাল্টি খাওয়া দেখে প্লাবণ ভারী অবাক হয়। বিস্ময়ে থ বনে যায় তার চেহারা। মৌরীর এমতাবস্থায় প্লাবণের চেহারা দেখে খুব হাসি পেলেও সে অনেক কষ্টে নিজের মনের এই অদম্য ইচ্ছাকে সামলে নেয়৷ ততক্ষণে প্লাবণ বিস্ময় কা’টিয়ে উঠে বলে,
‘এসব কি বলছিস টা কি তুই? আজ সকালেই তো তুই বিয়ের জন্য মত দিলি।’
‘আজ সকাল এখন অতীত কাল হয়ে গেছে। এখন যেটা চলছে সেটা বর্তমান আর কাল যেটা হবে সেটা ভবিষ্যত।’
মৌরীর কথার কোন মানে বুঝতে না পেরে প্লাবণ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। রাগ তার মাথায় উঠে যাচ্ছে। বেশ জোরেশোরে সে বলে ওঠে,
‘যা বলার স্পষ্ট করে বল। তোর এসব হেয়ালী আমার ভালো লাগছে না।’
‘ওয়েট, আমি এক্সপ্লেইন করছি। আজ সকাল অব্দি আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইছিলাম। বাট নাও, আমি সেটা চাই না।’
‘তাহলে কি চাস তুই?’
‘আমার কলেজের এক ব্যাচমেট আছে রাজু, ও না আমাকে প্রচুর ভালোবাসে। আমার জন্য নিজের হাত পর্যন্ত কে’টেছে। ও আমাকে এই কথাও বলেছে যে আমার জন্য আকাশের চাঁদ এনে দেবে। ওর এই প্রকৃত ভালোবাসা দেখে…’
মৌরীর কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠল প্লাবণ। মুখ ফসকে বলে ফেললো,
‘এসব বা’জে কথা। আকাশের চাঁদ কখনো মাটিতে আনা যায়না। তাছাড়া একজন ছাত্র মানুষ কি তোকে সেই সুখে রাখতে পারবে যেভাবে একজন প্রফেসর পারবে…’
পুরো কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই নিজেকে সংযত করে নিলো প্লাবণ। কিন্তু মৌরীর যা শোনার ছিল সেটা সে ততক্ষণে শুনে নিয়েছে। প্লাবণের কথা শুনে মৌরীর ওষ্ঠদ্বয় হাসিতে প্লাবিত হয়ে যায়। বাধভাঙ্গা খুশির জোয়ারে ভেসে ওঠে তার মন। মৌরী খুশি হয়ে বলে,
‘তাহলে আমার প্রফেসরকেই বিয়ে করতে হয়না। তাই না মিস্টার প্রফেসর?’
প্লাবণ আর এক মুহুর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। মৌরী প্লাবণের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলে,
‘তুমি মুখে যতো যাই বলো, তোমার মনে যে আমার জন্য অনুভূতি রয়েছে সেটা আমি জানি। তোমার এই অনুভূতি আমি ঠিকই বের করে আনব। আর এটাই আমার প্রমিজ।’
★★★
পূর্ব দিগন্তে সূর্য উদিত হয়েছে। সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ ফসলের ভূমি থেকে শুরু করে কংক্রিটের তৈরি শহরে।
ঘড়ির কা’টায় ছ’টা বাজতেই ঘুম ভেঙে যায় প্লাবণ। নিয়মানুবর্তিতা তার স্বভাবের সাথেই মিশে আসে। তাই আজও প্রতিদিনকার মতো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে জগিং এর জন্য বেরিয়ে পড়লো। একটি কালো রঙের স্যান্ডো গেঞ্জি এবং সাথে টাউজারের প্যান্ট পড়ে জগিং করতে বেরিয়েছে প্লাবণ। এই অবস্থায় তাকে অনেক আবেদনময় লাগছিল। যার ফলে রাস্তা দিয়ে গমনকারী অনেক রমণীই চোখ দিয়ে গিলে খেয়েছে তাকে।
জগিং শেষে ঘামে ভেজা শরীরে বাড়িতে ফিরলো প্লাবণ৷ তার শরীর থেকে তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম বয়ে যাচ্ছে। মৌরীও ততক্ষণে জেগে পড়েছে। প্লাবণকে এমন অবস্থায় দেখে সে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। হাতের কাছে একটি গামছা পেয়ে সেটা নিয়ে এগিয়ে আসে প্লাবণের কাছে। প্লাবণের ঘামার্ত দেহ মুছে দিতে দিতে বলে,
‘তোমার ঘামের গন্ধেও বোধহয় অ্যালকোহল আছে, যা আমাকে তোমার নেশায় আরো বেশি করে আসক্ত করে দেয়।’
প্লাবণ যথেষ্ট দূরে সরে এসে কপাট রাগ দেখিয়ে বলে,
‘এটা ঠিক নয় মৌরী। আমি তোর ভাই হই, আমাকে অন্য নজরে দেখবি না।’
মৌরী স্মিত হাসে। প্লাবণ আড়চোখে সেই হাসিটা খেয়াল করে। মৌরীর হাসিমুখ দেখতে যে তারও ভীষণ ভালো লাগে। মৌরী মুখে হাসি বজায় রেখেই বলে,
‘ভাই নও তুমি আমার বর হবে। আমার একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষ হবে। তাই তোমার দিকে তাকানোর অধিকার শুধু এবং শুধুমাত্র আমার। তুমি এই অবস্থায় জগিং করতে গেলে নিশ্চয়ই অনেক মেয়ে তোমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে? আমি সেটা মেনে নিতে পারবো না। কাল থেকে তোমার জগিং এ যাওয়া বন্ধ।’
প্লাবণের সব ভালো লাগা এবার দূর হয়ে যায়। মৌরীর এই অধিকারবোধ তার কাছে ভালো ঠেকে না। তাই প্লাবণ থমথমে গলায় বলে,
‘এখন কি আমায় তোর অনুমতি নিয়ে চলতে হবে?’
মৌরীও জোর দিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, এখন থেকে তোমায় তাই করতে হবে। আমার মনে প্রেমের বীজ বপন করেছ তুমি, সেই বীজ এখন অঙ্কুরিত হয়েছে। তুমি শুধু আমার, তোমার দিকে কেউ মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকাবে সেটা আমি মেনে নিতে পারবো না।’
মৌরী ধীরগতিতে প্লাবণের কাছে যায়৷ আলতো করে তাকে জড়িয়ে ধরে। প্লাবণের কপালে নিজের অধর ছুইয়ে দিয়ে বলে,
‘ইউ আর জাস্ট মাইন।’
মৌরী যে এমন কিছু করবে সেটা কস্মিনকালেও ভেবে উঠতে পারে নি প্লাবণ। আচমকা এমন হওয়ায় সে সম্পূর্ণ তব্দা খেয়ে যায়। মৌরীকে ধা’ক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। তাকে মা’রার জন্য হাত তুলেও থেমে যায়। কিন্তু ধমকের সুরে বলে ওঠে,
‘আজকে তোকে ক্ষমা করে দিলাম। কিন্তু এরপর থেকে এমন করলে তোকে আমি ছা’ড়ব না। কঠিন শাস্তি দেব।’
মৌরী ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
‘আমি আরো হাজারবার এমন করব। পুরুষ মানুষের ভালোবাসার অনেক গল্প শুনেছে সবাই এবার এক ভিন্ন আঙ্গিকের গল্প শোনার পালা। একটি মেয়ে তার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কতদূর যেতে পারে তার সাক্ষী হবে এবার সবাই।’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨