#মন_বিনিময়
#পর্বঃ৩১
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
বরপক্ষের আপ্যায়নে কোনো কমতি রাখা হয়নি। সবকিছু সুন্দরভাবে পরিচালনা হয়েছে। বিয়ে পড়ানো ও খাওয়া-দাওয়ার কার্যক্রম শেষে এখন বিদাইয়ের প্রস্তুতি চলছে। স্বপ্নিল ভীষণ ব্যস্ত, এদিক সেদিক ফোন নিয়ে ছুটছে মামাদের সাথে। কাজের ব্যস্ততায় রাহিতা নিজেও স্বপ্নিলের জন্য মনে চেপে রাখা সূক্ষ্ম রাগ ভুলে গিয়ে ছুটতে লাগলো! তেমনিভাবে বাপের বাড়ি থেকে ফোন আসায় সে চলে গেলো বাড়ির পেছনের দিকটাই। যেখানে কোলাহল নেই একদমই, সবাই বাসার ভেতরেই ব্যস্ত। কথা শেষ করে কয়েক কদম এগোতেই হঠাৎ সীমা বেগমের কণ্ঠ কানে এলো তার।
—এই মেয়ে শুনো।
—আমায় বলছিলেন, খালামনি?
—তুমি ছাড়া এখানে আর কেউ আছে যাকে বলবো? আজব মেয়ে তো!
চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করে সীমা বেগম। তার কথার বিপরীতে রাহিতা মুচকি হেসে বলে,
—আমার নাম রাহিতা৷ নাম ধরে না ডাকলে কিভাবে বুঝবো কাকে ডাকছিলেন? তাই বললাম!
রাহিতার কথায় চোখ সরু হয়ে আসে সীমা বেগমের। তার মতে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ মেয়েটার এত স্পর্ধা দেখে নিমিষেই রাগে কেপে উঠে তনুমন! হিসহিসিয়ে বলেন,
—এই মেয়ে, তোমার কি লজ্জা করেনা এতকিছুর পরেও এভাবে আমার সাথে কথা বলতে? অবশ্য আমিও বা কাকে বলছি! লজ্জা থাকলে তুমি এভাবে চলাফেরা করতেই না। সবকিছু জেনেশুনেও আমার সামনে এমন দাম্ভিকতা দেখাতেনা!
মহিলার এহেন কথায় মনে মনে বেশ কস্ট পায় রাহিতা। একটা মানুষ কি করে নিজ শোকে এতটাই পাগল হয় যে বারবার সামনের জনকে অপমান করার জন্য মুখিয়ে থাকে? রাহিতা ভেবে পায়না। কস্টে দুচোখে পানি আসতে চায়, কিন্তু সে আসতে দেয়না। ভাবে এবার তাকে একটা উচিত জবাব দিতেই হবে। নয়তো আর যে ক’টা দিন আছে এখানে, শান্তিতে থাকতে পারবেনা সে। দ্বিধা ছেড়ে রাহিতা এবার বলে,
—খালামনি আপনি আমার শাশুড়ি মায়ের বোন বলেই আপনার সম্মানার্থে কিছু বলিনি এ কয়দিন। তবুও যদি আপনার কাছে মনে হয় আমি আপনাকে দাম্ভিকতা দেখাচ্ছি তবে আমার কিছুই বলার নেই। এখানে আসার পর থেকে একই বিষয় নিয়ে পড়ে আছেন আপনি। আমি জানি আপনার কস্ট হয় আমায় দেখলে, হয়তো আমায় যতবার দেখেন ততবারই নিজের মেয়ের কথা মনে হয়ে খারাপ লাগে আপনার। কিন্তু তাই বলে বারবার এভাবে আমায় কথা শুনানোর কি মানে হয়? আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করিনি তাইনা? আনিকা আপুর সাথে যেটা হয়েছে সেটা একটা এক্সি’ডেন্ট ছিল, এটাতে আমার কোনো হাত ছিলো কি? আমি তো তার যাওয়ার পরেই স্বপ্নিলের জীবনে এসেছি।
এটুকু বলে থেমে গেলো রাহিতা। এক পলক চেয়ে দেখলো সীমা বেগমের মুখভঙ্গি। অথচ তার মুখ নির্বিকার। একটু নিশ্বাস নিয়ে সে আবারো বলে,
—আর একটা কথা হচ্ছে, উনাকে বিয়ের আগে আমি জানতামও না তার জীবনে কোনো অতীত ছিলো, আনিকা আপুর মৃত্যুর ব্যাপারটাও আমাদের বিয়ের পরেই জানতে পারি। সব শুনে আমার নিজেরও ভীষণ খারাপ লাগে কিন্তু জীবন তো কারও জন্য থেমে থাকেনা তাইনা, খালামনি? আমার জায়গায় যদি আজ আনিকা আপু হতো তবে কি আপনি তার সাথেও এভাবে বিহেভ করতেন যেটা আমার সাথে করছেন? আমার জায়গায় একবার নিজের মেয়েকে ভেবেই দেখুন…
—শাট আপ। চুপ করো তুমি মেয়ে। একদম নিজের সাথে আমার মেয়ের তুলনা দেবেনা তুমি!
এতক্ষণ চুপচাপ রাহিতার সব কথা শুনে গেলেও হঠাৎ আনিকার নাম নেওয়ায় পুরনো রাগ ফিরে আসায় আবার গর্জে উঠেন সীমা বেগম। এবার রাহিতা মনে মনে ভীষণই হতাশ হয়। সে বুঝে ইনাকে ইহকালেও আর বুঝানো যাবে কোনোকিছু। যে মুহুর্তে রাহিতা হাল ছেড়ে দিলো ঠিক তখনি হঠাৎ কোথা থেকে যেন তার পাশে এসে দাড়ালো আমিরা। মায়ের দিক তাকিয়ে বেশ শান্তভাবে প্রশ্ন করলো,
—তুমি রাহিতা ভাবীর সাথে এভাবে কথা বলছো কেন, আম্মু? কি সমস্যা তোমার?
মেয়ের কথায় যারপরনাই অবাক হয়ে তিনি বললেন,
—আমার সমস্যা কি মানে? এখানে এসে তোরও মাথা গেছে নাকি?
—আমার মাথা কেন যাবে? আমি যা-সব শুনলাম সেটার উপর ভিত্তি করেই বলছি। তুমি ভাবীর সাথে এইরকম বিহেভ করছো কেন? কি করেছে সে?
—বাহ! এখন দেখি আমার মেয়েও আমায় প্রশ্ন করছে, বিয়েবাড়িতে আসতে না আসতেই তোকেও নিজের দিকে করে নিলো না মেয়েটা? আমি তো আর এমনি বলিনি যে এই মেয়েই সব সমস্যার মূল!
মায়ের কথায় বিরক্ত হলেও মোটেও বিচলিত হলোনা আমিরা। কেননা স্বপ্নিল ইতোমধ্যে তাকে বলেছে সীমা বেগমের রাহিতার সাথে করা ব্যবহারের কথা। তা শুনেই মূলত সে মা-কে খুজছিলো কথা বলার জন্য এবং পথিমধ্যে এ নির্জন দিকটাই এসে দুজনকে একসাথে দেখতে পায়। উপরন্তু তাদের কথা শুনার জন্য এতক্ষণ আড়াল থেকেই দুজনকে লক্ষ্য করছিলো সে। কিন্তু এতকিছুর পরেও নিজ জননীর একগুঁয়ে কথায় মেজাজ হারিয়ে সে নিজেই চলে আসে দুজনের কথার মাঝে। আমিরাকে ওর জন্য নিজ মায়ের সাথে এভাবে কথা বলতে দেখে রাহিতার সরল মন কস্ট পায়। সে আমিরার হাত টেনে ধরে বলে,
—বাদ দাও, আপু। আমরা এমনিতেও আর বেশিদিন নেই এখানে, অযথা বিয়েবাড়িতে কোনো সিনক্রিয়েট করার দরকার নেই। আমি চলে যাচ্ছি, দেখি বাকিরা কি করে।
—বাহ। এভাবেই কথার জালে স্বপ্নিল, দিলারা আপার পাশাপশি আমিরাকেও একদিনে পটিয়ে ফেলেছো তাইনা? খুব চালু মেয়ে তো তুমি!
উনার কথায় বিরক্তবোধ করলেও আর তর্ক করার রুচি নেই রাহিতার। যে বুঝতে চাইবেনা তাকে হাজারবার চেস্টা করলেও বুঝানো যাবেনা এ কথাটা যেন সীমা বেগমকে দেখেই উপলব্ধি করেছে সে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে রাহিতা চলে যেতে ধরতেই ওকে থামিয়ে দেয় আমিরা। মায়ের কথায় অতীষ্ঠ হয়ে শেষমেশ বলে,
—আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ করো, আম্মু। আর কত শুনাবে এই মেয়েটাকে? নেহাত ভালো মেয়ে বলে তোমায় ভদ্রভাবে হ্যান্ডেল করছিলো রাহিতা। নয়তো অন্যকেউ হলে বিনা অপরাধে এতকিছু শুনে কোনোদিনও এত ভালোভাবে কথা বলতোনা, ত্যাড়াভাবেই উত্তর দিতো তোমায়। আর আমি বুঝিনা…
—তুই আমাকে চুপ করতে বলছিস, আমিরা? আমাকে? এই মেয়ে যে এভাবে নিজের মাসুম ইমেজ তৈরি করে তোদের ব্রেইনওয়াশ করছে সেটা কেন বুঝছিস না তোরা? স্বপ্নিলের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম! পুরুষমানুষ এমনই হয়, দুদিনও লাগেনা তাদের মন এদিক সেদিক হতে। কিন্তু তুই কি করে এত সহজে সব মেনে নিতে পারিস? আমি ভেবে পাইনা!
—কারও জীবন তো আর আমার বা তোমার অনুমানের উপর ভিত্তি করে থেমে থাকবেনা, আম্মু। আজ হোক, কাল হোক আপু যাওয়ার পর স্বপ্নিল ভাইয়া তো বিয়ে করতোই। সেটা এখন করা নিয়ে তোমার কিসের এত মাথাব্যথা আমায় বুঝাও একটু!
—এত সিম্পল বিষয় বুঝতে পারছিস না? আরে স্বপ্নিল কখনো আনিকাকে ভালোবাসেনি বুঝেছিস? আরে, ও এতদিন আনিকাকে ভালোবাসার নাটক করছিলো নয়তো এত বছরের সম্পর্ক শেষ হতে না হতেই কেউ এত তাড়াতাড়ি বউকে নিয়ে সুখে থাকতে পারে? এক মাস না যেতেই সংসার করতে পারে? এগুলো তো বুঝবিনা তোরা। সবাইকে নিজের মতোই ভাবিস দেখেই এ ভুল করিস। তোর বোনও এ কাজ করেছিলো, স্বপ্নিলকে বিশ্বাস করে ভালোবেসেছিল। কিন্তু সে যদি জানতো স্বপ্নিল ওকে এভাবে ধোকা দিবে তবে হয়তো কখনোই ভালোবাসতে পারতোনা! মরার আগেই ওর প্রতি সব অনুভূতি শেষ করে মরতো!
মেয়ের সাথে তর্কের মাঝে মনের সকল কস্ট-অভিযোগ নিংড়ে ফেলেন সীমা বেগম, একিসাথে আক্রোশের অশ্রু ঝড়ে তার চোখ থেকে। মা-কে এভাবে দেখে অশ্রু জমে আমিরার চোখের কোটরেও! তবু নিজেকে সামলে নেয় সে। আজকে সবকিছুর খোলাসা করতেই হবে, মা-কে সবকিছু জানাতেই হবে। নয়তো তিনি এই ভুল ধারণা নিয়ে সারাজীবন এভাবেই ঘৃণা করে যাবেন স্বপ্নিল ও রাহিতাকে। তাই মায়ের দিকে শান্ত চোখে চেয়ে আমিরা অত্যন্ত ধীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছু’ড়লো,
—যদি তুমি কখনো জানো যে স্বপ্নিল ভাই আপুকে কোনো ধোকা দেয়নি, উলটো সে নিজেই ধোকার শি’কার হয়েছে তবে তোমার অনুভূতি কিরকম হবে, আম্মু? তখন কি তুমি নিজের মতামত পাল্টাবে?
মেয়ের হঠাৎ এমন প্রশ্নে অতিকায় থমকে যান সীমা বেগম। বিস্ময়ে হহতবিহ্বল তিনি পালটা প্রশ্ন করারও সাহস পান না যেন। ভাঙা কণ্ঠে কোনোমতে শুধান,
—ম, মানে? কিসব যা-তা বলছিস? মাথা ঠিক আছে তোর?
মায়ের ভাবভঙ্গি দেখে শীতল হাসি দেখা গেলো আমিরার ঠোঁটে। খানিকটা সময় নিয়ে বেশ ধীরস্থির ভাবেই সে বলে,
—তুমি এইমাত্র যা শুনেছো সেটাই সঠিক, আম্মু। স্বপ্নিল ভাই আপুকে ভালোবাসার নাটক করেনি। বরং আপুই ইউকে যেয়ে অন্য একজনের সাথে রিলেশনে গিয়েছিলো। তোমাদের চাপে দেশে ফিরে বিয়ের কথা চললেও প্রকৃত অর্থে ওর মন সুদূর লন্ডনেই পড়ে ছিলো। কিন্তু তোমার ও আব্বুর ভয়ে আপু এ কথাটা কাউকে বলতে পারেনি। এমনকি স্বপ্নিল ভাইকেও না! কারণ আপু জানতো স্বপ্নিল ভাই ভালো মানুষ, সে যদি বিয়ের আগে সত্যিটা জেনে যায় তখন নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও আপুর খুশির জন্য নিজের বিয়ে ভাঙতো। কিন্তু এমনটা হলে তোমরা সত্যিটা জেনে যেতে ও সবার সামনে অপমানিত হতে। এই ভয়েই আপু কখনো কাউকে এ কথাটা বলে। মনের কথা মনে চেপে রেখেই অসুস্থ শরীরে নিজের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করেছে আমার বোন। এভাবেই ধুকে ধুকে মরে একদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেলো হুট করেই!
কথার মাঝে বহুবার গলা ধরে আসছিলো আমিরার তবুও আজ সে থামেনি আজ। আজকে যদি মাকে সবকিছু না জানায় তবে স্বপ্নিল ও রাহিতার সাথে চরম অন্যায় করা হবে! এদিকে সামনে দাঁড়ানো সীমা বেগম সব শুনে মিনিট কয়েকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন যেন! অবাক শব্দটাও যেন নেহাৎ ক্ষুদ্র ঠেকবে তার বি’স্ফো’রিত মুখভঙ্গির সামনে! বারকয়েক কথা বলার চেস্টা করেও যেন পারলেন না! যেন বুঝার চেস্টা করছেন কি থেকে কি হলো! তাকে সামলে নেওয়ার সময় দেয় আমিরা। একিসাথে এক এক করে সবকিছু খুলে বলে মৃত্যুর আগে ওর কাছে দেওয়া আনিকার ডায়েরির কথা, এরপর স্বপ্নিলের অবস্থা দেখে ওর সেটা স্বপ্নিলকে দেখানোর কথা। অবশেষে স্বপ্নিলের সব ভুলে মুভ অন করার কথা! কোনোকিছুই আজ বাদ রাখেনা সে। স্বপ্নিল ও রাহিতা যা এতদিন বলেনি, তা আজ হুট করে নিজের আপন মেয়ের কাছে শুনে বাকশক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছেন সীমা বেগম। একদিনে এত ধাক্কা নেওয়ার সক্ষমতা হচ্ছেনা উনার যেন! তার এ অবস্থা দেখে পাশে দাঁড়ানো রাহিতা দ্রুত এগিয়ে গিয়ে একটি চেয়ার নিয়ে আসে এবং সযত্নে তাতে বসিয়ে দেয় সীমা বেগমকে। স্তম্ভিত উনি চেয়ারে বসে একদৃষ্টে রাহিতার দিকে চেয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। অতঃপর বহুক্ষণ প্রচেস্টার পর আমিরাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
—এতকিছু যদি হয়েই থাকে তবে আমায় কেউ জানায়নি কেন? এ কথাটা তোরা সবাই জানতি? শুধু আমি জানতাম না?
মায়ের প্রশ্নে আমিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
—এতদিন আমি, স্বপ্নিল ভাই ও রাহিতা ছাড়া কেউ জানতোনা। এমনকি দিলারা খালামনিও জানেনা। আজকে তুমি জানলে শুধু। মূলত স্বপ্নিল ভাইয়াই আমায় নিষেধ করেছিলেন আর কাউকে জানাতে! তাই তোমায় বলিনি এতদিন!
মেয়ের কথায় মা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন ওর দিকে কিছুক্ষণ। আমিরা ফের বলে,
—তুমি যার বিরুদ্ধে আপুকে ভালোবাসার নাটক করার অভিযোগ করছিলে, আপুকে ধো’কা দেওয়ার অভিযোগ করছিলে আসলে ভি’ক্টি’ম সে নিজেই। কিন্তু আমার মরা বোনের প্রতি সম্মান রেখে সে চায়নি কেউ তাকে ঘৃণাভরা স্মৃতিতে স্মরণ করুক, কেউ তাকে নিয়ে কটুক্তি করুক এজন্যই স্বপ্নিল ভাই কাউকে কিছু বলেননি কখনো। নীরবে নিজেই সয়ে গেছেন সব এবং অনেকটা সময় ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে রাহিতা ভাবীর সাথে জীবনকে নতুনভাবে উপভোগ করার সুযোগ খুজছেন। এবার তুমি বলো স্বপ্নিল ভাই কি ভুল করছেন? তিনি কি সঠিক সিদ্ধান্ত নেন নি?
মেয়ের কথায় চোখ দিয়ে আরেকদফা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে সীমা বেগমের। এসব কথা যে তার অজান্তে ছিলো তিনি কস্মিনকালেও ভাবেননি কখনো! আজ একসাথে সত্যিটা উপলব্ধি করে যেন কাউকে কোনোকিছু বলার মতো অবস্থায় নেই তিনি আর। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে উঠে দাড়ালেন চেয়ার হতে। বাহিরে থেকে হইচই আওয়াজ আসছে ভীষণ, এমন সময় রাহিতার হাতে থাকা মুঠোফোন বেজে উঠলো। স্বপ্নিল ফোন দিয়েছে। সে রিসিভ করতেই স্বপ্নিল বললো,
—রাহি, কোথায় তুমি? নীতিকে বিদাই দিবো আমরা এখন। তাড়াতাড়ি গেটের কাছে আসো, খুজে পাচ্ছিনা তোমায়।
—এইতো আসছি, পাচ মিনিট দিন!
বলে ফোন কেটে দেয় রাহিতা। তাকে বলার প্রয়োজন হয়না কে ফোন দিয়েছে, সামনে থাকা দুজন মানুষ নিজ হতেই বুঝে নেয়। আমিরা বলে,
—ভাইয়া ফোন দিয়েছে তাইনা? বিদাইয়ের সময় হয়ে যাচ্ছে হয়তো। সবাই খুজছে আমাদের না? চলো যাই!
এরপর মায়ের দিক তাকিয়ে নির্দ্বিধায় শুধালো,
—এখনো কি স্বপ্নিল ভাই বা রাহিতা ভাবীর প্রতি তোমার কোনো অভিযোগ আছে, আম্মু?
মেয়ের প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না সীমা বেগম। হতাশ ভংগিতে রাহিতার দিক চেয়ে মাথা নুইয়ে ফেললো আমিরা। রাহিতাও মন খারাপ করে বিনাবাক্য ব্যয়ে চলে যাচ্ছিলো সেখান থেকে। ঠিক এমন সময় হঠাৎ রাহিতার হাত চেপে ধরেন সীমা বেগম। চমকে উঠে তার দিক তাকায় রাহিতা। কোনো কিছু না বলে শুধু আলতোভাবে রাহিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন সীমা বেগম। ব্যস! তাতেই যার যা বুঝার ছিলো, বুঝা হয়ে গেছে! আমিরার মুখে বিশ্বজয়ের হাসি, রাহিতার ঠোঁটের কোণেও মুচকি হাসির রেখা! অতঃপর সব ঝামেলার অবসান ঘটিয়ে তিনজন মিলে চলে যায় বিদাই মেহফিলে প্রধান ফটকের কাছে!
______________
মাত্র কিছুক্ষণ হলো বউয়ের বিদাই পর্ব শেষ হয়েছে। কেদেকেটে সকলের অবস্থা খারাপ। সবাইকে এভাবে কাদতে দেখে নিজের বিদাইয়ের কথা স্মরণ হয়ে কান্না জমলো রাহিতার চোখের কোণেও! হাতে থাকা টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতেই সেটা নস্ট হয়ে গেলো কিছুক্ষণের মাঝে। বিরক্ত হয়ে সেটা ফেলে দিতেই চোখের সামনে রুমাল ধরলো কেউ। পাশে তাকাতেই ওর দিক তাকিয়ে থাকা স্বপ্নিলের দেখা পায় রাহিতা। নিজ হাতে রাহিতার মুখ ধরে থুতনি উচু করে নিজের দিক তুললো স্বপ্নিল, অতঃপর বেশ ধীরে খুব যত্নসহকারে মুছে দিলো অর্ধাঙ্গিনীর চোখের পানি। মোছা শেষে রাহিতার মাথায় বাকা হয়ে যাওয়া টিকলিটা সোজা করে দিয়ে নিজ বুকের কাছে হাত বেধে স্বপ্নিল বললো,
—তুমি এত কাদছো কেন, হুম? তোমায় তো আর বিদাই দিচ্ছিনা ওর সাথে!
—আপনি বললেই যাবো নাকি?
আড়চোখে চেয়ে বলে রাহিতা। সে ভেবেছিলো স্বপ্নিল হয়তো বলবে “তোমায় কোনোদিন যেতেই দিবোনা আমি” অথবা কোন সুন্দর কিছু বলবে এর বিপরীতে! কিন্তু স্বপ্নিল তো স্বপ্নিল-ই! তাই রাহিতাকে ভুল প্রমাণ করে সে বললো,
—তা অবশ্য ঠিক! তুমি তো সারাজীবনের জন্য আমার ঘাড়ে চড়ে বসে আছো! ওখান থেকে আর নামবেনা বোধ হয়!
ওর কথায় চোখ পাকিয়ে তাকায় রাহিতা। রে’গে কিছু না বলেই খানিকটা জোরে মা’রে ফা’জিল স্বপ্নিলের বাহুতে। ওকে মা’রতে দেখে শব্দ করে হেসে ফেলে স্বপ্নিল। হাসতে হাসতেই বলে,
—এই রাহি, এটা কিন্তু একদমই ঠিক না! এভাবে ভরা বিয়েবাড়িতে বরকে মা’রতে লজ্জা করেনা? কেউ দেখলে কি ভাববে বলো তো? এভাবে মে’রে সবার সামনে আমায় নি’র্যা’তিত পুরুষ প্রমাণ করতে চাইছো নাকি তুমি?
—উফ! আপনার শুধু ফাজলামো! অসহ্য!
বিরক্তিকর কণ্ঠে বলে রাহিতা। অতঃপর স্বপ্নিলের দিক চেয়ে সে নিজেও হেসে ফেলে কিছুক্ষণের মাঝে! দুজনের অগোচরেই দূর থেকে তাদের খুনসুটি দেখছিলো একজোড়া চোখ। যে চোখে এতদিন দুজনের প্রতি শুধু তাচ্ছিল্য ও রা’গ ছিলো আজ সে চোখে বিস্ময়। কিছুক্ষণ দুজনকে পর্যবেক্ষণ করার মাঝেই যেন সীমা বেগম উপলব্ধি করলেন জীবনে যা কিছুই হয় না কেন সবকিছুতেই ভাগ্যের অনেক বড় হাত থাকে! আমরা যেভাবেই জীবনটাকে সাজাইনা কেন শেষ মুহুর্তে সেটাই হয় যেটা বিধাতা তার কলমে লিখে রাখেন। স্বপ্নিল ও রাহিতার মন দুটিও যেন একে-অপরের কাছে বিনিময় হওয়ার জন্যই তৈরি করেছিলেন তিনি। ঠিক এ কারণেই এতকিছুর পরেও তারা ঠিকই এক হয়েছে। কেউ তাদের থামাতে পারেনি। দুজন যে নিজেদের অজান্তেই নিজেদের মায়ায় জড়িয়ে গেছে এটা তারা না বুঝলেও সীমা বেগমের অভিজ্ঞ চোখের বুঝতে ভুল হলোনা। দূর থেকে ওদের জন্য দোয়া করলেন তিনি। খানিকটা অস্ফুট স্বরেই তার মুখ থেকে দুজনের উদ্দেশ্যে নিঃসৃত হলো দুটি সুন্দর শব্দ!
“সুখে থেকো”
#চলবে
অনেক বড় পর্ব! রিচেক করিনি। তিনদিন পর দিলাম তাই বড় পর্ব দিয়েছি। কেমন লেগেছে জানাবেন।