#মন_বিনিময়
#পর্বঃ২৮
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
হলুদের সকালের ব্যস্ততায় ঘেরা পরিবেশ। বাড়ির ছাদে স্টেজ সাজানোর কাজ চলছে৷ বরাবরের ন্যায় নানিবাড়ির দিকের বড় ছেলে হিসেবে এসব তদারকির দায়িত্ব পালন করছে স্বপ্নিল। দীপ্তকে ফুলের ডালা নিয়ে আসতে বলেছিলো, ডেকোরেশনের লোকগুলো অপেক্ষা করছে কিন্তু ছেলেট নিচে গিয়ে যে কোথায় হাওয়া হয়ে গেছে স্বপ্নিল বুঝতে পারছেনা। মিনিট দশেক অপেক্ষার মাঝেই লোকগুলো ফুলের জন্য আবার তাগিদ দিলে। স্বপ্নিল নিজেই নিচে যায় দীপ্তকে খুজতে। বেশিক্ষণ খুজতে হয়না ওর, তার আগেই ফুলের ডালা হাতে সিড়ির দিকে হেটে আসা হাস্যোজ্জ্বল দীপ্তকে চোখে পড়ে ওর। দীপ্তকে দেখে গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে যায় স্বপ্নিল। চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করে,
—এতক্ষণ কোথায় ছিলি তুই? কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম উপরে তোর জন্য। ডেকোরেশনের লোকগুলোও যে এ ফুলের জন্য কাজ করতে পারছেনা সেদিকে হুশ আছে তোর?
—সরি ভাইয়া, আসলে আমার একটু কাজ..
স্বপ্নিলকে রাগতে দেখে খানিকটা ঘাবড়ে যায় দীপ্ত। আমতা আমতা করে নিজের পক্ষে কিছু বলবে এমন সময় স্বপ্নিল আবারো বলে,
—তোর কোনো কাজ থাকলে সেটা ফুলগুলো দিয়ে গিয়ে তারপর করতি। মানা তো করিনি তাইনা? আজ সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান, এখন কথা না বলে তাড়াতাড়ি ছাদে যা। অলরেডি সময় নস্ট হয়েছে, আর করিস না।
ভাইয়ের কথায় মাথা নাড়িয়ে তাড়াতাড়ি সিড়ি বেয়ে উপরে গেলো দীপ্ত। স্বপ্নিলের থেকে ছাড়া পেয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাচলো সে সেভাবে শ্বাস ফেললো।
“স্বপ্নিল ভাই এমনিতে খুব চিল, কিন্তু রেগে গেলে এমন ফা’য়া’র হয়ে যায় যে দেখলেই ভয় লাগে”
মনে মনে কথাগুলো বলে দ্রুতপায়ে ছাদে চললো দীপ্ত, পাছে যদি আবার দেরি হয়? তবে তো আবার স্বপ্নিলের বকা খেতে হবে! বলা তো যায়না। এদিকে স্বপ্নিল নিচে নেমে রাহিতাকে খুজে, দুপুরের পর তো ওকে আর পাওয়া যাবেনা। বাড়ির মেয়েদের সাথে সাজগোজ করতে ব্যস্ত হয়ে যাবে নির্ঘাত। পরমুহুর্তেই নিজের মনের চিন্তাভাবনায় নিজেই অবাক হয় স্বপ্নিল, থেমে যায় তার চলতে থাকা কদম! রাহিতার দেখা পাওয়া না পাওয়া ওকে ভাবাতে শুরু করেছে কবে থেকে? মনের প্রশ্ন মনেই থেকে যায়, উত্তর খুজে পায়না স্বপ্নিল। ওর ভাবনার মাঝেই পেছন থেকে চিরচেনা মিস্টি কণ্ঠস্বর ডেকে উঠে,
—শুনছেন?
রাহিতার কণ্ঠ কর্ণগোচর হওয়া মাত্র সূক্ষ্ম হাসি খেলে যায় স্বপ্নিলের ঠোঁটে। যেন এতক্ষণ এ ডাকেরই অপেক্ষায় ছিলো সেভাবেই পেছন ফিরে তাকায় অর্ধাঙ্গিনীর দিকে। হাসিমুখে বলে,
—তুমি বললেই শুনবো!
—সামিরাকে দেখেছেন? ওকে খুজছি তখন থেকে কিন্তু পাচ্ছিনা কোথাও। কই যে গেলো মেয়েটা!
—না, ওকে তো দেখিনি। কেন? কোনো দরকার ছিলো তোমার?
—হ্যাঁ
উত্তর দেয় রাহিতা। ওর কথায় কৌতুহলের সহিত স্বপ্নিল প্রশ্ন করে,
—কি কাজ বলো? ওকে পেলে বলবোনি।
—আসলে আমার শাড়ির সাথে চুড়ি আনতে ভুলে গিয়েছি। যেই স্বর্ণের চুড়ি আছে সেটা বিয়ের শাড়ির সাথে পড়বো। তাই মা বললো সামিরার কাছে যেতে, ওর কাছে থাকতে পারে। এজন্যই খুজছিলাম ওকে।
সব শুনে স্বপ্নিল কিছুক্ষণ ভেবে বুঝদারের ন্যায় মাথা নাড়ে। তারপর বলে,
—ঠিক আছে। আমি সামিরাকে দেখলে ওকে বলে দেবো। চিন্তা করোনা।
—আচ্ছা। আমি তাহলে যাই?
প্রশ্ন করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে রাহিতা। স্বপ্নিল উত্তর না দেওয়ায় সে নিজেই প্রস্থান করে। এক কদম এগোতেই কবজিতে টান পড়ায় থেমে যায় রাহিতা। পেছন ফিরে আড়চোখে তাকায় স্বপ্নিলের দিকে। জিজ্ঞেস করে,
—কিছু বলবেন?
স্বপ্নিল এবারো উত্তর দেয়না। চুপচাপ শক্তভাবে রাহিতার হাতের কবজি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এবার রাহিতা বিরক্ত হয়, প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকায় স্বপ্নিলের দিকে। খানিকবাদে স্বপ্নিল হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,
—কি? দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমার না কাজ আছে? যাও!
এ কথা বলে রাহিতার আগে সে নিজেই গটগট পায়ে চলে যায় সেখান থেকে। স্বপ্নিলের যাওয়ার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাহিতা, ওর আচরণ খুবই সন্দেহজনক লাগে ওর কাছে। মুখ ফুটে বেরোয় “অদ্ভুত লোক!”
__________________
বউ পার্লারে গেছে সাজতে। তাকে পার্লার থেকে আনতে গেছে সামিরা ও হিয়া। ওদের সাজা শেষ, ওরা একটু আগেই বের হলো বাসায় থেকে। মেয়েদের সাথে তাল মিলিয়ে সাজছিলো রাহিতা নিজেও। যদিও তার খানিকটা মন খারাপ কারণ সামিরার কাছে ওর শাড়ির সাথে ম্যাচিং কোনো চুড়ি নেই। তবুও শাড়ি পড়া শেষ করে, হালকা মেকাপ করে চোখে কাজল লাগিয়ে লিপস্টিক দিচ্ছিলো সে। এমন সময় রুমের বাহিরে দরজায় নক পড়ে। সেদিকে তাকিয়ে রিয়ার উদ্দেশ্যে রাহিতা বলে,
—রিয়া, একটু দেখবে কে এসেছে? আমি লিপস্টিক দিচ্ছি তো!
—দেখছি ভাবী, দাঁড়াও!
রিয়া দরজা খুলে উকি দিয়ে দেখে স্বপ্নিল দাঁড়িয়ে রুমের বাহিরে। ওকে দেখে দুস্টু হেসে রিয়া বলে,
—কি ব্যাপার, ভাইয়া? তুমি এ সময় মেয়েদের রুমের সামনে কি করছো হুম?
—বেশি কথা না বলে সর তো সামনে থেকে। রাহিতা আছে না ভেতরে? ওকে ডাক। এই রাহি?
মাত্র চুল আচড়ানো শুরু করেছে রাহিতা, এমন সময় হঠাৎ স্বপ্নিলের ডাকে চমকে উঠে সে। রিয়া সরলে দরজার কাছে দাড়াতেই স্বপ্নিল বলে,
—আমার পাঞ্জাবি কোথায় রেখেছো? খুজে পাচ্ছিনা তো। তাড়াতাড়ি আসো।
—আচ্ছা আপনি যান, আমি আসছি। এক মিনিট দিন আমায়!
কথাটা বলেই দরজা পুনরায় লাগিয়ে দেয় রাহিতা। দ্রুতবেগে আয়নার কাছে গিয়ে স্ট্রেট করা চুল আচড়ানো শুরু করে, এটা করলেই ওর সাজগোজ কমপ্লিট। স্বপ্নিল বিরক্ত হয়ে রুমের দিকে হাটা দেয়। মনে মনে বিড়বিড় করে,
“যত সময়ই দাও না কেন, মেয়ে মানুষের সাজগোজ তাও শেষ হবেনা!”
__________________
রাহিতা রুমে ঢুকতেই বিছানায় বসে থাকা স্বপ্নিলকে দেখতে পায়, একমনে ফোন টিপছে সে। রাহিতা যে এসেছে সেদিকে কোনো খবরই নাই! ওর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গলা ঝাড়ে মেয়েটা, এতে কাজ হয়। মুহুর্তে চোখ তুলে তাকায় স্বপ্নিল। এক মিনিট বলে ওকে দশ মিনিট অপেক্ষা করানোর জন্য কিছু শুনাতে যাবে এমন সময় চোখের সামনে পরিপাটি সুশ্রী স্ত্রীকে দেখে কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় সে! অনুভব করে বুকের ভেতর জোরেশোরে বাড়তে থাকা হৃদস্পন্দন। মেরুন রঙের শাড়ি রাহিতার উজ্জ্বল ত্বকে অত্যন্ত মানিয়েছে, একিসাথে কোমড় ছাড়ানো সোজা চুল ও গাঢ় লিপস্টিক মাথা নস্ট করার জন্য যথেষ্ট! স্বপ্নিল দ্রুত চোখ ঘুরায়। ক’দিন ধরে একি হচ্ছে তার সাথে? এমন লাগছে কেন? আগে তো কখনো হয়নি এমন!
এদিকে স্বপ্নিলের এমন দৃষ্টি দেখে মাথা নোয়াই রাহিতা, এমন গভীর দৃষ্টি নিতে পারেনা সে। নিমিষেই রক্তিম আভায় লালিত হয় গাল। দ্রুত কদম চালিয়ে চলে যায় ব্যাগের কাছে, খুজে খুজে বের করে কাংক্ষিত পাঞ্জাবি। এগিয়ে এসে তা স্বপ্নিলের হাতে দিয়ে বলে,
—এই যে আপনার পাঞ্জাবি। আমি তো আমার পছন্দমতো নিয়েছি। আপনার কি ভালো লাগছে? দেখুন তো!
স্বপ্নিল কিছু বলেনা, পাঞ্জাবি পাজামা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। খানিকবাদে বেরিয়ে আসে। ততক্ষণে আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের সাজগোজ আরেকবার পরখ করছিলো রাহিতা। ওর আচরণে স্বপ্নিল হাসে। আয়নার কাছে যেতে যেতে বলে,
—হয়েছে হয়েছে, এতবার আয়না দেখলে নিজের দৃষ্টিতে নিজেই ঝল’সে যাবে তো! এবার থামো!
স্বপ্নিলের কথায় মনক্ষুণ্ণ হয় রাহিতার, চোখ পাকিয়ে তাকায় ওর দিকে। সেদিকে পাত্তা দেয়না স্বপ্নিল। চুপচাপ এগিয়ে যায় সাইড টেবিলের দিকে, ড্রয়ার থেকে বের করে একটি প্যাকেট। সেটা নিয়ে এগিয়ে দেয় রাহিতার দিকে। আগ্রহী চোখে একবার স্বপ্নিলের দিকে একবার প্যাকেটের দিকে তাকায় রাহিতা। জিজ্ঞেস করে,
—কি আছে এর ভেতর?
—খুলে দেখো তাহলেই বুঝবে।
স্বপ্নিলের বলতে দেরি, রাহিতার প্যাকেট খুলতে দেরি হলোনা। মুহুর্তেই হাতের মুঠোয় ডজনখানেক মেরুন রঙের চুড়ি চোখে পড়লো তার। খুশিতে নয়নজোড়া চকচক করে রাহিতার! উল্লাসিত কণ্ঠে বলে উঠে,
—এ চুড়িগুলো কোথায় পেলেন আপনি? কখন এনেছেন? একদম ম্যাচিং হয়েছে আমার শাড়ির সাথে! ওয়াও!
—ম্যাচিং তো হবেই, কে এনেছে দেখতে হবেনা! স্বপ্নিল সব কাজ পারফেক্টলি করে বুঝেছো, মিসেস রাহি?
—হুহ!
মুখ ভেংচি দেয় রাহিতা। পরমুহূর্তেই ওর ঠোঁটের কোণে দেখা যায় বিশাল হাসির রেখা, যে হাসি প্রশান্তি এনে দেয় স্বপ্নিলের অন্তরে। সে নিজেও হেসে বলে,
—এখন হাতটা দাও তো। দেখি তোমার মাপে হয়েছে কিনা?
ঝটপট হাত এগিয়ে দেয় রাহিতা। আলতোভাবে ওর হাত ধরে এক এক করে চুড়ি পড়িয়ে দেয় স্বপ্নিল, যদিও সে জানে এটা রাহিতার হবে কেননা সকালে কব্জি ধরে সে রাহিতার হাতের মাপ নিয়েছিলো। সে অনুযায়ীই চুড়ি কিনেছে। তবু রাহিতাকে নিজ হাতে চুড়ি পড়ানোর জন্য এটা বাহানা মাত্র আরকি!
—বাহ! এটা তো একদম আমার হাতের মাপে ঠিক হয়েছে। আন্দাজে হলেও একদম সঠিক জিনিস এনেছেন আপনি!
“চুড়িগুলো আমি আন্দাজে আনিনি, রাহি। জেনেবুঝেই নিজ হাতে বেছে এনেছি তোমার জন্য”
মনে মনে কথাটা বলে বোকা মেয়েটার এমন খুশি হওয়া দেখে হাসে স্বপ্নিল নিজেও। এদিকে নিজের রেশমি চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজ তুলে দুহাত নাড়িয়ে স্বপ্নিলের দিক চেয়ে কথা বলছে রাহিতা, কিন্তু স্বপ্নিলের সেদিকে কান নেই। আপাতত ওর সম্পূর্ণ মনোযোগ রাহিতার চুড়িভরা হাতের দিকে।
রাহিতার দুলতে থাকা এলোমেলো চুড়িগুলোর সাথে যেন ওর এলোমেলো হৃদয়-ও যেন কাপছে!
#চলছে
সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন।