#মন_বিনিময়
#পর্বঃ৪৩
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
নিজরুমে একা একা পায়চারি করছে স্বপ্নিল। মায়ের বলা একটা কথাই সারা মাথাজুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। “রাহিতা চলে গেছে” এই একটা বাক্যই যেন স্বপ্নিলের ধ্যান-জ্ঞান, শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে যথেষ্ট! ব্যস্ত পায়ে ঘরে এসে রাহিতার নাম্বারে ডায়াল করে স্বপ্নিল। বেশ কয়েকবার ফোন দেওয়ার পরেও যখন রাহিতা ফোন ধরলোনা তখন স্বপ্নিল চিন্তায় পড়ে যায়। মেয়েটা ওর ফোন ধরছেনা কেন? আগে কখনো তো এমন হয়নি! দুশ্চিন্তার রেখা কপালে নিয়ে অস্থির স্বপ্নিল দ্রুতপায়ে হেটে যায় দিলারা বেগমের রুমে। তখন খাবার টেবিল থেকে নিঃশব্দে উঠে গেছেন তিনি, স্বপ্নিলকে জবাব দেননি। কিন্তু এবার স্বপ্নিল নাছোড়বান্দা। প্রসঙ্গ যখন রাহিতার, তখন জবাব তো ওকে নিতেই হবে!
দিলারা বেগম বিছানায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। রুমের দরজা ঠেলে শব্দ করে স্বপ্নিল ভেতরে এলে এক পলক চোখ তুলে ওর দিক তাকিয়ে পুনরায় পেপার পড়ায় মনোযোগ দিলেন তিনি। মায়ের সামনে এসে স্বপ্নিল বেশ ক’বার ডাকলেও দিলারা বেগম বিশেষ সাড়া দিলেন না। এমন ভান করলেন যেন স্বপ্নিলকে দেখেও তিনি দেখেননি। মায়ের এহেন ঠান্ডা আচরণে স্বপ্নিল মেজা’জ হা’রালো। কণ্ঠ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—রাহিতা কোথায় গেছে, মা?
—আমি কি করে জানবো?
নির্বিকারভাবে উত্তর দিলেন দিলারা বেগম। তার এত গা-ছাড়া কথা স্বপ্নিলের মোটেও পছন্দ হলোনা। কোমড়ে হাত রেখে সে বললো,
—তুমি কি মজা করছো আমার সাথে? দেখো মা, আমি এখন মোটেও মজা করার মুডে নেই। প্লিজ বলো না রাহি কই গেছে। আমার টেনশন হচ্ছে!
—কিসের টেনশন?
—এই যে, এভাবে হঠাৎ না বলে চলে গেলো! আগে তো কখনো এমন করেনি। তবে আজ ওর কি হলো? সব ঠিক আছে তো? আমি জানি ও নিশ্চয়ই তোমায় না বলে কোথাও যায়নি। গেলে তুমি এতটা স্বাভাবিক থাকতে না!
—ওহ!
দিলারা বেগম এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে স্বপ্নিলের কথা শুনে পুনরায় পেপার পড়া শুরু করতেই স্বপ্নিল এগিয়ে গিয়ে পেপার কে’ড়ে নিলো তার হাত থেকে! ছেলের আচরণে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকালেন দিলারা বেগম। স্বপ্নিল সেদিকে পাত্তা না দিয়ে মায়ের সামনে হাটুগেড়ে বসে বললো,
—এমন করছো কেন, মা? কেন বলছোনা রাহিতার ব্যাপারে? আমার অবস্থা কি তুমি বুঝতে পারছোনা?
এবার দিলারা বেগম মুখ খুললেন। এতক্ষণ চেপে রাখা কথা বের করে বেশ শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
—তোর অবস্থা কেন বুঝবো? তুই কখনো রাহিতার অবস্থা বুঝার চেস্টা করেছিস?
স্বপ্নিল অবুঝের ন্যায় তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। থেমে থেমে শুধায়,
—মানে?
—মানেটা খুব সহজ, স্বপ্নিল। মেয়েটা এতদিন অপেক্ষায় ছিলো তোর ভালোবাসার, তোর থেকে স্ত্রীর যোগ্য মর্যাদার কিন্তু তুই তো ওকে সেভাবে মূল্যই দিতি না! এখন রাহিতা গেলেও তোর কি, আর থাকলেই বা কি!
মায়ের কথায় স্বপ্নিল কয়েক মিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। জবাব দেওয়ার ভা’ষা হারিয়ে ফেলে যেন! নিজেকে সামলে তে’জী কণ্ঠে উত্তর দেয়,
—মা, তুমি কি আদৌ জানো তুমি কি বলছো? তুমি যা বলছো তা অনেক আগের কাহিনি। আমাদের বিয়ের শুরুটা কিভাবে হয়েছিলো, কোন পরিস্থিতিতে হয়েছিলো, আমার মানসিক অবস্থা তখন কেমন ছিলো সবটাই তুমি জানো। আমাদের সম্পর্কের পারিপার্শ্বিকতাও তোমার থেকে লুকায়িত নয়। এখন দিন বদলেছে, আমি পাল্টেছি। রাহিতার প্রতি, আমাদের দুজনের সম্পর্কের প্রতি আমার দৃষ্টিভংগিও বদলে গেছে। তবুও তুমি এখন এসব কথা কেন বলছো আমি তো সেটাই বুঝতে পারছিনা!
এক নাগাড়ে সবগুলো কথা বলে স্বপ্নিল থামে। মায়ের উত্তরের অপেক্ষায় তার মুখের দিক চেয়ে রয় অনিমেষ। স্বপ্নিলের কথায় দিলারা বেগম তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেন। ব্যঙ্গাত্বক কণ্ঠে শুধান,
—তাই নাকি? রাহিতাকে কখনো বলেছিস এসব? নাকি নিজের মনেই সব ঠিক করে কল্পনার জগতে বাস করছিস?
মায়ের কথায় স্বপ্নিলের চোয়াল শক্ত হয়। শীতল চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
—রাহিতা এসব বলেছে তোমায়?
স্বপ্নিলের প্রশ্নে দিলারা বেগমের রা’গ হয়। গর্দ’ভটা এখনো রাহিতাকেই ভুল ভাবছে?
দাতে দাত চেপে তিনি বললেন,
—রাহিতা কখনো কিছু বলে? এটা আমার চেয়েও ভালো তুই জানিস যে, রাহি কখনোই নিজের কস্ট অন্যকে বলার মতো মেয়ে নয়। তোদের দুজনের মধ্যে কি হয়েছে তা আমাকে বলেনি, অন্য কাউকে তো মোটেও না! বরং আমিই তোদের দুজনের মাঝের শিথিল হওয়া সম্পর্কের একটা সমাধান করতে ওর সাথে আলাপ করেছিলাম।
—কিসের আলাপ?
ভ্রু তুলে প্রশ্ন করে স্বপ্নিল। মায়ের কথাবার্তা খুব একটা সুবিধার ঠেকছেনা ওর কাছে৷ স্বপ্নিলের প্রশ্নে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিলারা বেগম সব খুলে বলেন। স্বপ্নিল বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর সেদিন রাহিতাকে ডেকে এনে কি বলেছিলেন তা বিস্তারিত বলতেই স্বপ্নিলের চোখেমুখে আত’ঙ্কের রশ্মি উকি দেয়। আলাদা হওয়ার কথা কানে আসতেই এতক্ষণ ঢিপঢিপ করা হৃদপিণ্ড বক্ষপিঞ্জরের বাইরে আসতে ধরে!
নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ স্বপ্নিল চে’চিয়ে উঠে বলে,
—এসব কি বলছো, মা? কিসের ডি’ভোর্স? আমাদের দুজনের মধ্যে এমন কিছুই হয়নি যাতে বিষয়টা ডি’ভোর্স পর্যন্ত গড়ায়! আমরা দুজন কখনো আলাদা হবোনা! আমি রাহি-কে আমার থেকে আলাদা হতেই দিবোনা।
স্বপ্নিলের কথায় সরু চোখে ওর দিক তাকিয়ে থাকলেন দিলারা বেগম। স্বপ্নিলের ক্রো’ধা’ন্বিত অন’লে ঘি ঢেলে বলেন,
—এখন যে বড্ড দেরি হয়ে গেছে রে, বাপ। তুই যখন রাহিতাকে মেনে নিতে চাসনি, আমি তখনি রাহিতাকে কথা দিয়েছিলাম ও যদি কোনোদিন এ সম্পর্ক ছি’ন্ন করতে চায়, আমি ওকে সাপোর্ট করবো। কোনো বাধা দিবোনা। স্বেচ্ছায় ওকে যেতে দিবো। এখন তুই চাইলেও…
—আমি চাইলেও মানে? সবকিছু কি তোমাদের ইচ্ছেমতোই চলবে নাকি? আমার ইচ্ছের কোনো দাম নেই তোমার কাছে?
মায়ের কথা শেষ না হতেই ফু’সে উঠে বলে স্বপ্নিল। ওর চোখমুখ টগবগ করছে রা’গে৷ কি মনে করেছে এরা শাশুড়ী-বউমা? সব সময় নিজেদের মর্জি ওর উপর চাপিয়ে দিবে আর সে চুপচাপ মেনে নিবে?
অবশ্যই না! স্বপ্নিল আহমেদ নিজের বউকে কিছুতেই হাতছাড়া করতে পারবেনা! অসম্ভব!
মনে মনে এসব ভেবে মায়ের উদ্দেশ্যে দৃঢ়কণ্ঠে স্বপ্নিল বলে উঠে,
—দেখো, মা। অনেক হয়েছে এসব। আমি আর তোমাদের কথা মানতে পারবোনা। মগের মুল্লুক পেয়েছো নাকি? যখন মন চাইলো আমার বিয়ে করিয়ে দিলে আবার যখন মন চাইলো বউকে সরিয়ে দিলে? আমার দিকটা দেখি কেউ ভাবেইনা! আশ্চর্য!
একটু থেমে বলে,
—তবে অনেক হয়েছে, আর নয়। তোমার কথা তো বাদই দিলাম। রাহিতার বেশি সাহস বেড়েছে দেখছি! আমায় না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে? স্বপ্নিলের জীবন থেকে চলে যাওয়া কি এতই সহজ?
—ও হয়তো আসবেনা, স্বপ্নিল। জোর করবিনা ওকে। মেয়েটা এমনিতেই অনেক কস্টে আছে!
—আসবেনা মানে? ও আসবেনা, ওর ঘাড় আসবে! কোথায় গেছে বলো? নিশ্চয়ই বাপের বাড়ি, তাইনা? আর যাবেই না কোথায়! তাই তো! আমিও কেন যে বোকার মতো এতক্ষণ টাইম ওয়েস্ট করছিলাম! এক্ষণি যাচ্ছি ওর মাথা থেকে সব ভূত বের করতে! আর তোমার সাথে তো এসে কথা বলছি! খবরদার আটকানোর চেষ্টা করবেনা আমায়। আগে তোমার বউমাকে নিয়ে আসি। না আসতে চাইলে তুলে আনবো ওকে! বেশি আহ্লাদী হয়ে গেছে!
রা’গে গজগজ করতে করতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো স্বপ্নিল। দিলারা বেগম ওকে বেশ কয়েকবার ডাকার পরেও সাড়া দিলোনা কোনো! ঝড়ের বেগে রুমে যেয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে শশুড়বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো সে।
এদিকে স্বপ্নিলকে রে’গেমে’গে বাড়ি থেকে বের হতে দেখে তার অগোচরেই হেসে উঠলেন দিলারা বেগম। ছেলে তার ভালোই ক্ষে’পেছে। রাহিতার যাবার কথা শুনে কি পাগলামিটাই না করলো! হওয়ার পর থেকে আজ অব্দি কখনো তার সাথে উচু স্বরে কথা বলেনি স্বপ্নিল। আর আজ সে রাহিতার জন্য এরকম করলো! যাক, অবশেষে ছেলে তার ভালোবাসার জা’লে পা দিয়েছে ঠিকি। যে ভবিষ্যতের আশায় দুজনের জুটি বেধেছিলেন সেদিন আজ এলো ঠিকই! মনে মনে এসব ভেবে সন্তুষ্ট হলেন দিলারা বেগম! রাহিতা যে তার পিছে ঘটে যাওয়া এসবের কিছুই জানেনা। স্বপ্নিলকে হঠাৎ দেখে নিশ্চয়ই চমকে যাবে সে! স্বপ্নিল কি কি পাগলামি করতে পারে ভেবে নিজে নিজে হেসে আরেকদফা কুটি কুটি হলেন দিলারা বেগম। ঠিক সে সময় রুমে এলো সামিরা। মা-কে এভাবে একা একা হাসতে দেখে বেশ অবাক-ই হলো বটে! বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করলো,
—কি ব্যাপার, মা? তুমি একা একা এভাবে হাসছো কেন?
আচমকক মেয়েকে আসতে দেখে নিজেকে সামলে নিলেন দিলারা বেগম। মেয়েকে উত্তর না দিয়ে চোখের চশমা ঠিক করে স্বপ্নিলের মাটিতে ফেলে রেখে যাওয়া নিউজপেপার তুলে নিয়ে গম্ভীর মুখে পড়তে লাগলেন। সামিরা সেদিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। অতঃপর প্রসঙ্গ পালটিয়ে কৌতুহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—আচ্ছা মা, ভাইয়ের কি হয়েছে? উপর থেকে জিনিস ভা’ঙার আওয়াজ আসছিলো। খুব রে’গে আছে মনে হয়! আবার ঝড়ের বেগে কই যেন বের হয়ে গেলো! ওর কি হয়েছে তুমি কিছু জানো?
মেয়ের প্রশ্নে কিছুক্ষণ ওর দিক চেয়ে রইলেন দিলারা বেগম। মুখ ঠেলে বেরিয়ে আসা হাসিকে সাবধানে ঠেলে দিয়ে অবাক হওয়ার ভান করে বললেন,
—তাই নাকি! এই ছেলেটার যে মাঝেমধ্যে কি হয়? কে জানে!
#চলবে
দীর্ঘদিন পর গল্প দেওয়ার জন্য ভীষণ দুঃখিত। এর কারণ আমি বেশ কিছুদিন ধরে সর্দি-জ্বরে ভুগছিলাম। আজ ডেং’গু টেস্ট করাতে গিয়েছিলাম। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন।