মন বিনিময় পর্বঃ৪১

0
222

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ৪১
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

বৃষ্টির মধ্যে ফাঁকা রিকশা বা সিএনজি পাওয়া খুব মুশকিল। তাই তো মেইন রোডে এসে স্বপ্নিল-রাহিতাও পড়লো বিপাকে৷ তখন গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য মনে মনে স্বপ্নিলকে বারকয়েক বকে দিয়ে ক্ষ্যান্ত হলো রাহিতা। তার কিছুক্ষণ পরেই একটি ফাকা সিএনজির দেখা পেলো ওরা দুজন। বৃষ্টির সুযোগের সদব্যবহার করে সিএনজিওয়াল ভাড়া দ্বিগুণ ভাড়া চাইলেও রাহিতার মুখের দিক চেয়ে স্বপ্নিল আর দ্বিমত করলোনা। দুজনে উঠে পড়তেই ওদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো সিএনজি।

বৃষ্টির বেগ কমেছে, ভেজা শরীরে হিমেল বাতাস স্পর্শ করতেই শীত করতে থাকলো দুজনের। সিএনজিওয়ালা ডাবল ভাড়া পাওয়ার খুশিতে একমনে সামনের দিক তাকিয়ে চাপা স্বরে গুনগুন করতে করতে ড্রাইভ করছে, পেছনে কে আছে সেদিকে যেন কোনো হুশই নেই তার। এ সুযোগে স্বপ্নিল নিজের ও রাহিতার মাঝের দূরত্ব ঘুচিয়ে দিলো। গায়ের সাথে গা ঘেঁষে কোমড় জড়িয়ে ধরলো, রাহিতাকে মিশে ফেললো নিজের সাথে। সিএনজির মাঝে এমন করায় রাহিতা অবাক হয়, খানিকটা বিব্রতবোধ করে বলা চলে। স্বপ্নিলের শক্তহাতের বাধন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেস্টা করেও রাহিতা যখন পারলোনা তখন শেষমেশ নিচু স্বরে বললো,

—এই আপনার সমস্যা কি? রাস্তার মাঝখানে এমন করছেন কেন আজ?

রাহিতার বিরক্তবোধকে যেন পাত্তাই দিলোনা স্বপ্নিল। আরেকটু নিজের কাছে টেনে নিলো বরং।

—তুমি আমার সমস্যা! সবসময় আমার থেকে এত দূরে দূরে থাকো কেন, রাহি? আমাকে কি তোমার ভালো লাগেনা?

অস্থির গলায় বলে উঠলো স্বপ্নিল। ওর গমগমে কণ্ঠ শুনে রাহিতা ফিরে তাকায়। পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে স্বপ্নিলকে। ওর শুষ্ক মুখ ইষৎ ফ্যাকাশে, লালচে চোখজোড়াও আগাম জ্বরের প্রকোপে ছোট হয়ে এসেছে প্রায়। অথচ এসবের পরেও নির্বিকার সে ঘন ঘন চোখের পলক ফেলে গভীরভাবে তাকিয়ে আছে রাহিতার পানে! কৌতুহলবশত স্বপ্নিলের কপালে ছোয়ায় সে। ওর আন্দাজ সঠিক, গা গরম হতে শুরু করেছে স্বপ্নিলের। আর সে হয়তো জ্বরের ঘোরেই এসব পাগলামি করছে। দ্রুত বাসায় যাওয়া দরকার নয়তো জ্বর বেড়ে যেতে পারে। এটা ভেবেই জোরপূর্বক স্বপ্নিলের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে সিএনজিওয়ালাকে ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত টেনে নিয়ে যাওয়ার তাগিদ দিলো রাহিতা। মিনিট বিশেকের মধ্যে ওরা পৌঁছে যায় বাসায়। ভাড়া মিটিয়ে বাসার ভেতর ঢুকবে দুজনে এমন সময় রাহিতা লক্ষ্য করে স্বপ্নিল মুখটা বাংলার পাচের ন্যায় ভার করে রেখেছে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই স্বপ্নিল গম্ভীর মুখে অভিমানি গলায় বললো,

—তুমি আমায় একটুও ভালোবাসোনা, রাহি। এতদিন পর পেলাম তোমায় অথচ তুমি আমায় দূরে ঠেলে দিলে? তোমার সাথে আর কথা নেই যাও!

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে একা একাই বাড়ির ভেতর হাটা শুরু করলো স্বপ্নিল। এদিকে ওর কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেললো রাহিতা৷ জ্বরে-অভিমানে স্বপ্নিল যেন প্রেমিকাদের মতো ঢং শুরু করে দিয়েছে! এ লোকটাকে নিয়ে সে কি করবে!

______________

ভেজা শরীরে ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই মায়ের সাথে সাক্ষাৎ হলো স্বপ্নিলের। ওর পিছু পিছু আসা রাহিতাও দিলারা বেগমকে এভাবে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেলো। মা-কে দেখে স্বপ্নিল হাসি হাসি মুখ করে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতেই থামিয়ে দিলেন দিলারা বেগম। স্বপ্নিলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

—পুরো ভিজে গেছিস তো। এ শরীরে বেশিক্ষণ থাকলে জ্বর বাধবে নির্ঘাত। কপালটাও বেশ গরম লাগছে। আগে জামা পালটে ফ্রেশ হয়ে আয় দ্রুত, তারপর কথা বলছি!

কথাগুলো বলার সাথে সাথেই স্বপ্নিলকে একপ্রকার ঠেলে সিড়ির কাছে পাঠিয়ে দিয়ে রাহিতার নিকট এলেন তিনি। স্বপ্নিল সিড়ি বেয়ে উপরে উঠার মাঝে রাহিতার কপালে হাত দিয়ে বললেন,

—যাক, তোর জ্বর আসেনি! তাও ভালো। আমার ছেলেটা এদিক দিয়ে এমনই নাজুক ছোটবেলা থেকে। একটু বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর আসে। তাই ও নিজেও ভিজতে চায়না বৃষ্টিতে তেমন! তোরা গাড়ি না পাঠালেই বরং ভালো হতো! ভালোয় ভালোয় চলে আসতি বাসায়! কি হয়েছিলো রে স্বপ্নিলের? হঠাৎ ওভাবে রেগেছিলো কেন?

শাশুড়ির চিন্তা দেখে মিহি হাসে রাহিতা। মুখে বলে,

—আসলে উনার এয়ারপোর্টে একটু কাজ ছিলো, মা। তাই তখন ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যাতে সামিরাকে কলেজ থেকে আনতে দেরি না হয়। আমরা সিএনজি খুজতে খুজতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিলো তাই ভিজে গেছি দুজনে।

রাহিতার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও মাথা নেড়ে সায় দেন দিলারা বেগম। এরই মাঝে তার চোখে পড়ে রাহিতার গলায় চকচক করতে থাকা স্বর্ণের চেইনটার উপর৷ ফর্সা মেয়েটার ভেজা গলায় চেইনটা লেপ্টে থেকে যেন ওর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তা দেখে তিনি উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন করেন,

—বাহ! চেইনটা তো সুন্দর। এটা আবার কবে পড়লি? আগে খেয়াল করিনি তো!

চেইনের কথা শুনে স্বপ্নিলের চেইন পড়িয়ে দেওয়ার দৃশ্য মাথায় আসে রাহিতার। মুহুর্তেই লজ্জায় রেঙে যায় ওর মুখ। লাজুক মুখে বলে,

—এটা উনি মালেশিয়া থেকে এনেছেন, মা।

স্বপ্নিল এনেছে শুনে মনে মনে খানিকটা শান্তি পান দিলারা বেগম। যাক! তার ছেলেটা এতটাও কাণ্ডজ্ঞানহীন নয় তবে। ভেতরে যতই রাগ থাকুক না কেন নিজের দায়িত্ব পালন করতে কখনো পিছপা হয় না সে! দিলারা বেগমের ভাবনার মাঝেই রাহিতা বলে উঠে,

—মা, এখন আমি যাই? উনি হয়তো বেরিয়েছেন গোসল সেড়ে৷ ফ্রেশ হয়ে নিই।

রাহিতার কথায় দিলারা বেগমের টনক নড়ে। মেয়েটাও যে তার ছেলের সাথে বাইরে থেকে ভিজে এসেছে তা যেন মাথায়ই ছিলোনা তার। লজ্জিত তিনি দ্রুততার সাথে বললেন,

—আরে তাই তো, আমিও বা কেমন তোকে আটকে রেখেছি এখানে। তাড়াতাড়ি যা, কাপড় চেঞ্জ কর। ফ্রেশ হয়ে নে। স্বপ্নিল বের না হলে আমার বাথরুমে এসে গোসল সাড়িস!

শাশুড়ির অনুমতি পেয়ে মাথা নেড়ে রাহিতাও চলে গেলো সিড়ি বেয়ে উপরে। ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে দিলারা বেগম পড়লেন দোটানায়। তিনি যা ভেবেছেন তা কিভাবে বলবেন দুজনকে? ওদের দুজনের আচরণ একেকবার একেকরকম লাগছে! বিষয়টা সন্দেহজনক ঠেকছে তার কাছে। নাহ! তাড়াহুড়োয় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবেনা, আরেকটু ভালো করে দুজনকে পর্যবেক্ষণ করে তারপর ওদের সাথে কথা বলবেন। নিজের মনকে বুঝিয়ে অবশেষে এটাই ঠিক করলেন দিলারা বেগম।

______________

ডাইনিং টেবিলে কথার ফুলঝুরি ফুটেছে যেন। দিলারা বেগম নিজ হাতে যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছেন ছেলেকে। স্বপ্নিলের চোখজোড়া এখনো লালচে, একটু পর পর হাচ্চি দিচ্ছে বেচারা। যার দরুণ খাড়া নাকটাও একপ্রকার লাল হয়ে আছে। ভাইয়ের এ নাজুক অবস্থা দেখে বেশ হাসি পাচ্ছে সামিরার। সে-ও তো ভিজে এসেছে, একিসাথে রাহিতাও। অথচ তাদের কিছুই হলোনা কিন্তু স্বপ্নিলকে দেখে মনে হচ্ছে সব বৃষ্টির পানি ওর উপরেই পড়েছে! ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে হাস্যকর। কিন্তু মায়ের তীর্যক চাহনিতে ভয় পেয়ে হাসার দুঃসাহস সে করছেনা। এদিকে দিলারা বেগম ছেলেকে খাওয়ানোর ফাকে ফাকে একদৃষ্টিতে স্বপ্নিল রাহিতাকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। স্বপ্নিল তার সাথে, বোনের সাথে এমনকি রহিমা খালার সাথেও কথা বলছে। কিন্তু বাসায় আসার পর থেকে একবারও তিনি ওকে রাহিতার সাথে কথা বলতে দেখলেন না! বিষয়টা নিঃসন্দেহে দৃষ্টিনন্দন লাগলোনা উনার কাছে। তবে এ মুহুর্তে মুখে কিছু না বলাই শ্রেয় মনে করলেন তিনি। চুপচাপ খাওয়ানো শেষ করে হাত ধুতে উঠে গেলেন। এদিকে দিলারা বেগম উঠতেই সামিরা মুখ খুলে।
ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে,

—তারপর বলো কেমন কাটলো তোমার দিনগুলো, ভাইয়া?

—সারাদিন কাজ শেষে ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফিরতে না পারলে মানুষ যেমন অনুভব করে ঠিক তেমনি!

জবাব সামিরাকে দিলেও কথাগুলো রাহিতার উদ্দেশ্যেই ঠান্ডাভাবে বললো স্বপ্নিল। ওর কথায় একিসাথে দুঃখ ও ভালো লাগা ভর করলো রাহিতার মনে! স্বপ্নিল ওকে নিজের ঘরের সাথে তুলনা করলো? যে ঘর মানুষের মানসিক প্রশান্তির কারণ, সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে মুখ গুজার আশ্রয়, স্বপ্নিল কি তাকে সেই ঘরের সাথেই তুলনা করলো তবে! ছেলেটা কি ওকে সত্যিই এত ভালোবেসে ফেলেছে?
রাহিতা বিস্মিত মনে ভাবে।

সামিরা ভাইয়ের কথা পুরোপুরি বুঝলোনা। সে ধরে নিলো হয়তো অনেকদিন বাড়ি না ফিরে হোমসিক হয়ে গেছে স্বপ্নিল। তাই বাড়িকে মিস করছিলো। তাই প্রসঙ্গ ঘুরাতে সে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে,

—তা আমাদের জন্য কি কি আনলে দেখি!

—আরে দেখাবো বোন, আগে আমায় একটু শান্তিতে রেস্ট নিতে দে! এ ক’দিন বাসাতেই আছি আমি। কাল আরামসে দেখিস।

—কিন্তু আমার যে দেখার জন্য তর সইছেনা, ভাই।

লোভে বশীভূত হয়ে করুণ কণ্ঠে সামিরা কথাটা বল্লেও সে সময় দিলারা বেগম চলে আসেন। এক ধমক দিয়ে মেয়ের উদ্দেশ্যে বলেন,

—এখন আরেকবার যদি তোর মুখে এ কথা শুনি তবে তোর একদিন কি আমার একদিন। দেখছিস না স্বপ্নিল অসুস্থ, কোথায় ভাইকে একটু রেস্ট নিতে দিবি তা নয়। উলটো ভাই না আসতেই গিফট দেখার বায়না করছে।

মায়ের ধমকে মুখ ফুলিয়ে চুপসে যায় সামিরা। চেয়ার ঠেলে উঠে এক দৌড়ে ছুটে যায় নিজের রুমে। সেদিক চেয়ে স্বপ্নিল বলে,

—কেন ওকে ধমক দিলে, মা? ছোট মানুষ। এ বয়সে আগ্রহ থাকে এসব দেখার। ভালোভাবে বল্লেও তো পারতে!

—তুই চুপ থাক। নিজের শরীর ভালোনা এখন সেদিক নজর দে। ভাত তো খাইয়ে দিলাম এখন রুমে গিয়ে নাপা খেয়ে নিয়ে আমায় উদ্ধার কর।

—কিন্তু মা..

—যেতে বলছি, স্বপ্নিল।

অগত্যা চোখমুখ কুচকে স্বপ্নিল নিজেও প্রস্থান করে রুমের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার আগে মায়ের চোখ ফাকি দিয়ে রাহিতাকে চোখ রাঙিয়ে যেতে ভুলেনা। স্বপ্নিলের চোখ রাঙানো দেখে মনে মনে হাসে রাহিতা। শাশুড়ির দিক তাকিয়ে বলে,

—সামিরা হয়তো মন খারাপ করে বসে আছে। আমি যাই ওর কাছে!

কিন্তু ওর পথ আটকান দিলারা বেগম। রাহিতা তাকাতেই খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন ওর সরল মুখশ্রীর দিকে। এত ভালো, মিস্টি মেয়েটাকে কিভাবে স্বপ্নিল ভালোবাসতে পারলোনা দিলারা বেগম ভেবে পাননা! তার বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। রাহিতার কোমল হাতদুটো তার চামড়ায় ভাজপড়া হাতের ভাজে নিয়ে কোমল সুরে বলে,

—সামিরাকে আমি পরে দেখে নিবো। তুই বরং স্বপ্নিলের কাছে যা। ও তো এসব জ্বর-টরকে পরোয়া করেনা, আমি জানি বেশি জ্বর না আসা পর্যন্ত ওষুধ না খেয়েই বসে থাকবে। ওকে ওষুধ খাইয়ে দে।

মাথা নেড়ে রাহিতা সেদিকে অগ্রসর হতেই হঠাৎ পেছন থেকে দিলারা বেগম বলেন,

—কাজ শেষ করে আমার সাথে একটু দেখা করিস তো, রাহি। কিছু জরুরি কথা আছে।

শাশুড়ীর কথায় রাহিতার চলন্ত কদম থমকায়। পেছন ফিরবেনে ফিরবেনা করেও একবার পেছন ফিরে। দিলারা বেগম কেমন উদাস মুখে চেয়ে আছেন, তার কণ্ঠস্বর অন্যরকম। যা না চাইতেও রাহিতাকে ভাবায়! কি এমন জরুরি কথা বলার জন্য তিনি ডাকছেন ওকে? চিন্তার বিষয়!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here