#মন_বিনিময়
#পর্বঃ৩৯
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
সেই রাতে স্বপ্নিলের সাথে কথা হওয়ার পর কেটে গেছে সাতটা দিন। এ ক’দিনে আর একবারও রাহিতার কথা হয়নি স্বপ্নিলের সাথে। বলাবাহুল্য, সে রাতে নিজের কথা বলার পর রাহিতার প্রতিক্রিয়া শুনার অপেক্ষা না করেই ফোন কেটে দিয়েছিলো স্বপ্নিল। ফলস্বরুপ, রাহিতা সে রাতের পর নিজ থেকেই ওকে ফোন দিয়েছিলো বেশ কয়েকবার কিন্তু স্বপ্নিল ফোন ধরেনি। এমনকি একটা মেসেজেরও জবাব দেয়নি। যার অর্থ দাঁড়ায় সে অভিমান করেছে, এতদিন রাহিতা মজার ছলে ওকে যেভাবে ইগ্নোর করেছে এবার স্বপ্নিল ইচ্ছে করেই সেটা করছে। হয়তো রাহিতার এহেন আচরণে বেচারা অনেক কস্ট পেয়েছে মনে। এসব ভেবে মনে মনে অপ’রাধবোধে দ’গ্ধ হয় মেয়েটা।
তবে আর যাই হোক, রাহিতার দিনকাল এতটাও খারাপ কাটছেনা। কেননা ভার্সিটি যেয়ে সে এক নতুন বিষয় উপলব্ধি করেছে এ ক’দিনে। ওর সাথে ঘোরার মতো বন্ধু বলতে রিমি ও নিবিড়-ই ছিলো শুরু থেকে। আর এদের মাঝে এখন আর আগের মতো দ্বন্দ নেই, দুজনের মধ্যে মা’রকাট সম্পর্ক কিছুটা হলেও কমে গেছে। ওরা আগের মতো ঝগড়া করলেও একে-অপরকে নিয়ে বেশ খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে ইদানিং। সম্পর্কের এ পালাবদল আর কারও চোখে পড়ুক না পড়ুক, নিবিড় ও রিমি মুখে না বললেও, সবসময় ওদের দুটোকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার দরুন রাহিতা ঠিকি বুঝে গেছে। তবে যেকোনো সম্পর্কেই সময় থাকতেই দুজনের মাঝে সব স্পষ্ট করা দরকার, নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করা দরকার। অন্যথা এ দ্বিধাদ্বন্দেই অর্ধেক জীবন কেটে যায়। তাইতো ভার্সিটি শেষে বের হতে হতে রাহিতা রিমিকে ডেকে বললো,
—তুই কি নিবিড়কে পছন্দ করিস?
রাহিতার প্রশ্নে রিমি চমকায়। ইতস্ততভাবে এদিক-সেদিক চায়। ওকে চমকাতে দেখে রাহিতা হেসে বলে,
—ভালোবাসিস, তাইতো?
—ন,না। এমন কিছুই তো না।
—দেখ রিমি, বেস্টফ্রেন্ড হিসেবে তোকে একটা পরামর্শ দিতে চাই। মন দিয়ে শুনবি, ঠিকাছে?
রাহিতার সিরিয়াস ভাবভঙ্গি দেখে রিমি মাথা নাড়ে। ওর মনোযোগ পেতেই রাহিতা বলে,
—যদি কাউকে ভালোবাসিস এবং তাকে পাওয়ার ইচ্ছে থাকে, তবে সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে ওকে মনের ভাব জানা। নয়তো পরে তাকে হারিয়ে ফেললে আজীবন আফসোস করবি যে আগে কেন বললাম না!
রাহিতার কথার মাঝে বিষাদের সুর খুজে পেলো রিমি। করুণ চোখে বললো,
—কিন্তু সে যদি মানা করে তাহলে? রিজেক্ট হতে ভয় পাই আমি!
—আগে বলেই তো দেখ! যদি রিজেক্ট করে তবে বিনাবাক্যে সরে যাবে। যদি ও তোকে ভালোবাসে তবে হয় সময়ের সাথে নিজের ভালোবাসা বুঝবে, তোর কমতি অনুভব করবে নিজের জীবনে। তখন ঠিকি কাছে আসবে। আর যদি ভালো না-ই বাসে তবে তো দূরে দূরেই থাকবে। কিন্তু অন্তত তোর আফসোস তো হবেনা কখনো মনের কথা মুখে না বলার!
এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে রাহিতা। ওর কথায় রিমি মাথা নাড়ায়, কিছুক্ষণ কি যেন ভাবে। তারপর হঠাৎ করে বলে,
—আচ্ছা, তোর আর স্বপ্নিল ভাইয়ার মাঝে সব ঠিক হয়ে, রাহি?
রাহিতা জানতো রিমি ঠিক এ প্রশ্নটাই করবে। তাই নিজেকে প্রস্তুতও রেখেছিলো এ কথার জবাব দেওয়ার জন্য। সেভাবেই বলে,
—আমার কথা শুনেও তুই বুঝলিনা আমি কেন তোকে এসব বলছি?
রিমি উৎসুক চোখে তাকাতেই রাহিতা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
—আমি তাকে ভালোবাসি এটা তো উনি ছাড়া আর সবাই জানে৷ আর এ জায়গাটাতেই আমার আফসোস হয় রে, রিমি। কেন আমি তাকে এতদিনেও মনের কথা বলতে পারলাম না? উনার ভয় কাটাতে গিয়ে, উনার খুশির কথা চিন্তা করতে যেয়ে তো আমি নিজের খুশিটাই ভুলে গিয়েছিলাম এতদিনে। সময় থাকতে তাকে ভালোবাসার কথাটা বলা উচিত ছিলো। তাহলে এখনো এতকিছুর পরেও আমাদের দুজনের মাঝে এত জড়তা, এত দূরত্ব এর কোনোটাই থাকতোনা!
রাহিতার কথায় কস্ট লাগে রিমির। মেয়েটা অনেক সরল, সবসময় অন্যের ভালোটাই দেখে গেছে, অন্যের জন্যই সব করে গেছে। দিনশেষে ও নিজে কি পেয়েছে? রিমির মন খারাপ হয়। তবে পরক্ষণেই স্বপ্নিলের কথা মনে হতেই ওর মনে মেঘের পরিবর্তে রোদের আলোর ঝিলিক খেলে উঠে৷ স্বপ্নিলের সম্পর্কে যতকিছু সে রাহিতার থেকে এ ক’দিনে জেনেছে ও শুনেছে, তাতে সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে স্বপ্নিল রাহিতাকে ভালোবেসে ফেলেছে। এইতো সেদিনই যখন ওদের শেষ ফোনকলের কথাটা রাহিতা একভরি দুশ্চিন্তা নিয়ে ওকে জানালো তখনো রিমি হাসছিলো। কেননা স্বপ্নিলের কথাবার্তা ওকে নিঃসন্দেহে রাহিতার পাগল প্রেমিক মনে হচ্ছিলো। প্রেমিকার বিরহে যে কাতর, প্রেমিকার থেকে এক রত্বি দূরত্বও যার সয়না, এমন প্রেমিক লাগে স্বপ্নিলকে রিমির কাছে। সুতরাং, এখন থেকে যে স্বপ্নিল নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করতে আর কোনো কার্পণ্য করবেনা, এটা এখন স্বচ্ছ পানির ন্যায় ঝকঝকে রিমির কাছে।
কিন্তু আফসোস! বোকা রাহিতা এটা বুঝলোনা, স্বপ্নিলের কথার মর্ম না বুঝে ওর অভিমানের চিন্তায় কাতর হয়ে আছে সে! লোকে ঠিকি বলে, অন্যের বেলায় মানুষ যতটা না সেয়ানা, নিজের বেলায় তার একটুও না! রাহিতার ক্ষেত্রেও যেন এর ব্যতিক্রম নয়। তাইতো মেয়েটার উদাস মুখের দিক চেয়ে রিমি বলে,
—স্বপ্নিল ভাইয়া কবে আসছে যেন?
—আগামীকাল দুপুরে ইনশা আল্লাহ।
—উম, কালকের জন্য বেস্ট অফ লাক, বেবি।
রাহিতা বিরক্ত হয়। চোখ পাকিয়ে বলে,
—কিসের বেস্ট অফ লাক?
—ভাইয়া এতদিন পর আসছে। তোকে দেখেনি কতগুলো দিন, তার মধ্যে আবার রে’গে আছে তোর উপর! উফ, কাল তো খেলা হবে মামা!
রিমির কথায় কপট রাগ দেখালেও মুহুর্তেই স্বপ্নিলের কথা ভেবে চুপসে যায় রাহিতা! সেদিন যেভাবে ধমক দিয়েছিলো ফোনে, আজেবাজে কিসব হু’মকি-টু’মকি দিচ্ছিলো দেশে ফিরে ওকে দেখে নেওয়ার, না জানি এসে সে কি করে?
এসব ভেবেই ভয়ে-লজ্জায় মনে মনে লাল আভায় রে’ঙে যায় রাহিতা।
______________
অবশেষে এলো সেই কাংক্ষিত দিন। স্বপ্নিল ফিরছে আজ দেশে। দুপুর ২.৩০ টায় ফ্লাইট ল্যান্ড করবে ওর। আপাতত এয়ারপোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাহিতা। সামিরা কলেজে থাকায় দিলারা বেগমকে সাথে আসতে জিদ করেছিলো সে। কিন্তু দিলারা বেগম নিজ দুশ্চিন্তায় বিভোর হয়ে আসতে রাজি হননি মোটেও! এবারও জোর করেই একা একা পাঠিয়ে দিয়েছেন রাহিতাকে। অগত্যা এয়ারপোর্টের বাহিরে একা একাই স্বপ্নিলের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে রাহিতা। আজ আকাশের অবস্থা ভালো নেই। বৃষ্টি হতে পারে যেকোনো সময়।
কিছুক্ষণ পেরোলো, স্বপ্নিল এলো। এতদিন পর প্রিয়তমের সাক্ষাৎ পেয়ে রাহিতার মন শান্তি ও আনন্দে পুলকিত হয়ে উঠলো! অবশ্য স্বপ্নিলের চেহারায় এর ছিটেফোঁটাও দেখা গেলোনা। তার মুখভঙ্গি স্বাভাবিক, ওর তী’ক্ষ্ণ ধারা’লো দৃষ্টি একনজরে রাহিতার শুষ্ক মুখ পরখ করছে। এহেন ছু’রির ন্যায় ধারালো গভীর দৃষ্টিতে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়না। রাহিতাও পারলোনা! আড়চোখে স্বপ্নিলকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো সে। স্বপ্নিল কাছে এসেই লাগেজ রেখে রাহিতার হাত থেকে ছো মেরে ওর ফোন নিয়ে নিলো। চমকে উঠে সেদিকে তাকাতেই স্বপ্নিল ওর দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে রাহিতার ফোন থেকে ড্রাইভারকে ফোন দিলো।
ড্রাইভার আসতেই তার উদ্দেশ্যে বললো,
—চাচা, আপনি লাগেজপত্র গাড়িতে নিয়ে বাসায় চলে যান।
স্বপ্নিলের কথায় ড্রাইভার ও রাহিতা উভয়েই বিস্মিত হলো। ড্রাইভার অবাক কণ্ঠে বললেন,
—কিন্তু সাহেব, আপনি ও ম্যাডাম বাসায় যাইবেন না? খালি লাগেজ নিয়া যাবো?
—জি। আপাতত শুধু লাগেজ নিয়েই যান। আমাদের একটু কাজ আছে। মা-কে বলবেন, টেনশন না করতে। আমি ঠিকভাবে পৌঁছে গেছি, রাহিতাও আমার সাথেই আছে। আমরা একসাথেই বাসায় যাবো।
স্বপ্নিলের শীতল কণ্ঠে বলা কথায় ড্রাইভারও আর কিছু বলার সাহস পেলোনা। শুধু মাথা নেড়ে লাগেজ নিয়ে চলে গেলো। এদিকে রাহিতা পড়লো চরম বিপাকে, মন ও মস্তিষ্ক উভয়ই দিশেহারা তার। একদিকে আকাশের বুকে জমে থাকা কালো কালো মেঘগুলো যেকোনো মুহুর্তে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে পারে ধরনীর বুকে। অপরদিকে, সদা হাস্যোজ্জ্বল স্বপ্নিলের এ আধারে ঢাকা মুখ যেন তার চেয়েও ভয়ংকর ঠেকলো রাহিতার নিকট!
#চলবে
রিচেক করা হয়নি। ভুলত্রুটি মার্জনীয়।