মন বিনিময় পর্বঃ৩৬

0
191

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ৩৬
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

রাত ৯টা। রাহিতার পাশে বসে আছে স্বপ্নিল। পলকহীন, নিঃশব্দভাবে দেখে যাচ্ছে মেয়েটার নত করে রাখা মুখশ্রী। রাহিতার উজ্জ্বল মুখের সামান্য লালচে ভাব, ফোলা ফোলা চোখ ও ভেজা পাপড়ি স্বপ্নিলকে যা বুঝার, বুঝিয়ে দিয়েছে সব। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে ওর কোলে মাথা রেখে অফিসের সব কথা খুলে বলেছিলো সে, জুবায়ের নামক ছেলেটা কিভাবে তার কোম্পানির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, যার ফলে ওদের কতটা ভোগান্তি হয়েছে সবকিছুই জানিয়েছে স্বপ্নিল। গোপন রাখেনি কিছুই। বলা শেষে ক্লান্তি-অবসাদে ঘুমের সাগরে তলিয়ে গিয়েছিলো সে। উঠেছে একটু আগে কিন্তু ঘুম থেকে উঠে রাহিতার চেহারার এ হাল দেখে বেশ খানিকটা বিস্মিত হয় স্বপ্নিল। রাহিতা কেদেছে? কিন্তু কেন? সে চলে যাবে দেখে নাকি অন্য কোনো কারণে? স্বপ্নিলের মাথায় হাজার প্রশ্নের মেলা। এদিকে স্বপ্নিলকে জাগতে দেখেই চোখের পানি মুছে চুপচাপ বসে থাকার অভিনয় করে রাহিতা। স্বপ্নিলকে সে জানতেই দিবেনা ওর প্রতি নিজের দূর্বলতার কথা।
স্বপ্নিল মুখ খোলে। নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করে,

—মন খারাপ কেন তোমার? আমার সাথে সবাই বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করে শুনে খারাপ লাগছে?

স্বপ্নিলের প্রশ্নে চকিত দৃষ্টিতে তাকায় রাহিতা। ওর কণ্ঠে এক অদ্ভুত বিষাদ ছিলো, যা রাহিতার হৃদয়ে ক্ষ’ত সৃষ্টি করে। আসলেই তো! কেন স্বপ্নিলের সাথে বারবার এমন হয়? কি দোষ ওর? সবাই কেন ওর সাথেই এরকমটা করে? রাহিতার মনে রা’গ হয়। নাক ফুলিয়ে জবাব দেয়,

—ওরা এত খারাপ কেন? কোনো কারণ ছাড়াই একজন মানুষকে ধোকা দিতে ওদের বিবেকে বাধেনা কেন? আর আপনি উনাকে এখনো ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন কেন? তাকে চূড়ান্ত শাস্তি দিবেন। মামলা করবেন তার নামে!

রাহিতার কণ্ঠে তে’জ দেখে স্বপ্নিল খানিকটা অবাক হয়, মনে মনে নিজের প্রতি ওর এত চিন্তা দেখে খুশিও হয়। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বপ্নিল বলে,

—আমি শাস্তি দেবো তো ওকে। কিছু প্রুফ আছে আমাদের কাছে। সেগুলো প্রমাণ সমেত দেখালেই ওর বিরুদ্ধে অফিশিয়াল মামলা করা যাবে। আমার বিশ্বস্ত কর্মচারী হ্যান্ডেল করছে ব্যাপারটা। তুমি চিন্তা করোনা।

—এই বিশ্বস্ত কর্মচারী আবার কে? এটাও যদি ধোকা দেয় তখন কি করবেন আপনি?

চোখ সরু করে সুধায় রাহিতা। ওর কথায় এবার প্রশস্ত হাসে স্বপ্নিল। বাতাসের দরুণ রাহিতার কপালে উড়ে আসা কিছু এলোমেলো চুলগুচ্ছ কানের পিছে গুজে দিতে দিতে বলে,

—আরে বাবা, এটা আমার ম্যানেজার তুষার। সকালে যে ফোন করেছিলো না? ওই ছেলে। এ আমার সাথে ব্যবসার শুরু থেকে আছে। আমার রাইট হ্যান্ড বলতে পারো। ও অন্তত আমায় ধোকা দিবেনা এটা আমি জানি। যদি দেওয়া লাগতো তবে আগেই দিতো, এমন অনেক সুযোগ ছিল ওর কাছে। আমার পরে কোম্পানির সব খুটিনাটি তথ্য সে-ই জানে। তাই ওর ব্যাপারে আমার সন্দেহ নাই। তাছাড়াও, জুবায়ের এর বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারটা তুষারই ধরেছে আগে এবং কনফার্ম করেছে আমায়। এটা নিয়ে জলদি একটা সমাধান হবে।

স্বপ্নিলের দৃঢ় কণ্ঠ ও আত্মবিশ্বাস দেখে চুপ হয়ে যায় রাহিতা। মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। মুখে বলে,

—আচ্ছা ঠিক আছে। তবুও সাবধানে থাকবেন।

—হুম। এখন বলো তুমি কাদছিলে কেন তখন?

—ক,কখন? আমি কাদিনি তো!

—আমার সাথে একদম মিথ্যে বলবেনা, রাহি। তোমার রন্ধ্র রন্ধ্র চিনে গেছি আমি এখন। আমার থেকে লুকিয়েও লাভ নেই। মুখ স্বীকার না করলেও তোমার এই ফোলা ফোলা চোখ ও হালকা লাল হওয়া নাক কিন্তু ঠিকই বলছে আমায়।

কথার মাঝেই রাহিতার চোখের পাতায় ও নাকে তর্জমা ছুয়ে দেয় স্বপ্নিল। ওর হঠাৎ ছোয়ায় ইষত কেপে উঠে রাহিতা। খানিকটা বিরক্তও হয় বটে! এই স্বপ্নিলটা এত নাছোড়বান্দা কেন? সবকিছু ওর বুঝতে ও জানতেই বা হবে কেন? রাহিতা এখন কিভাবে বলবে যে যতটা না মন খারাপ ওর অফিসের কথা শুনে হয়েছে তার চেয়েও অধিক মন খারাপ হয়েছে স্বপ্নিলকে প্রায় দু’সপ্তাহের জন্য মালেশিয়া যেতে হবে শুনে। এতদিন ওকে চোখের সামনে দেখবেনা, ওর দুস্টু ফাজিল কথাগুলো শুনবেনা এসব ভাবতেই রাহিতার চোখ ভরে উঠেছিলো জলে। মাত্রই তো স্বপ্নিল ওর প্রতি দূর্বলতা অনুভব করতে শুরু করেছে, ওকে মন দিতে শুরু করেছে। তবে কেন এ সময়ই এই দূরত্ব সৃষ্টি হতে হবে? কেন?

মনের প্রশ্ন মনেই থেকে যায়। উত্তর পায়না রাহিতা। এসব ভাবনার মাঝেই পুনরায় ওর গালে টোকা দেয় স্বপ্নিল। রাহিতা তাকাতেই ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে ইশারায়। দম ফেলে এ নাছোড়বান্দার উদ্দেশ্যে রাহিতা বলে,

—আসলে, বাবা-মার কথা মনে পড়ছিলো খুব। তাই কেদেছি একটু। তেমন কিছুই না।

রাহিতা সরল মুখে মিথ্যা কথা বল্লেও স্বপ্নিল পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারলোনা। মনের মধ্যে কিছু প্রশ্ন থেকেই গেলো তবু। কিন্তু এ মুহুর্তে সেগুলোকে পাত্তা না দিয়ে সহাস্যে বললো,

—তাই? এ সামান্য ব্যাপারে কাদছো? তুমি চাইলে কালকেই দেখা করিয়ে নিয়ে আসবো আব্বু-আম্মুর সাথে। কিন্তু আমি অবাক হলাম শুনে। এত ছোটখাটো বিষয়ে কান্নাকাটি করা তোমাকে মানায়না। ছি, রাহি। তোমায় আমি স্ট্রং মেয়ে জানতাম।

স্বপ্নিলের কথায় মনের দুঃখে হাসে রাহিতা। ভালোবাসার প্রদীপের তাপ যে মরিচাধরা হৃদয়কেও গলাতে সক্ষম, সেখানে সে তো কোমল মনের এক সাধারণ মানুষ! সে কিভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে? নির্বোধ স্বপ্নিল তো এসব বুঝবেনা। যদি বুঝতো তবে কত আগেই না রাহিতার চোখে ওর প্রতি ভালোবাসা টের পেতো! প্রতিদিন কতশত বার মেয়েটা ওকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে এসব লক্ষ্য করতো! কিন্তু আফসোস যতদিন না স্বপ্নিল নিজে প্রেমে পড়বে ততদিন হয়ত এসব ওর চোখের আড়ালেই থেকে যাবে! মনের আক্ষেপ গোপন করে স্বপ্নিলের উদ্দেশ্যে রাহিতা বলে,

—ঠিকাছে, আর কাদবোনা। এখন চলুন ডিনার করি। সন্ধ্যায় তো কিছু খেলেন না। ক্ষুধা লাগেনি?

—হুম, লেগেছে তো। আচ্ছা চলো নিচে যাই।

অতঃপর দুজনেই খাওয়াদাওয়ার জন্য নিচে চলে যায়। রোজকার ন্যায় আজকেও খাবার টেবিলে একে-অপরের সাথে সুখ-দুঃখের আলাপ চলে!

____________________

মধ্য রাত। আকাশে নির্জন চাঁদ। চুল আচড়ে ড্রেসিং টেবিল থেকে উঠতেই রাহিতার চোখে পড়লো পেছনে দাঁড়ানো স্বপ্নিলকে। রাতের আধারের ন্যায় গাঢ় তার দৃষ্টি! ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাহিতার পেটে মোচড় দেয়। হঠাৎ কি হলো ছেলেটার? সচারাচর তো এভাবে তাকায়না ওর দিকে? রাহিতার ভাবনার মাঝেই স্বপ্নিল কখন এগিয়ে এসেছে সে টের পায়না। যতক্ষণে উপলব্ধি করে ততক্ষণে স্বপ্নিল নিঃশব্দে অনেকখানি এগিয়ে এসেছে। তা দেখে রাহিতা দু কদম পিছিয়ে গেলো।

—কি হলো? পিছিয়ে যাও কেন!

—আপনি কাছে আসছেন কেন?

—আমি কাছে আসবোনা তো কে আসবে?

স্বপ্নিলের দৃষ্টি ছু’ড়ির ন্যায় ধা’রালো গভীর, যে নজর ভেতরটা নাড়িয়ে দেয়, তীক্ষ্ণভাবে ছুয়ে যায়। রাহিতা চমকায়। হঠাৎ করে স্বপ্নিলের এ বদলে যাওয়া আচরণ সর্বাঙ্গে শিহরণ জাগায়। ক্রমশ পিছিয়ে পিঠ যখন দেয়াল ছুই ছুই, সে মুহুর্তে স্বপ্নিল কোমড় জড়িয়ে টেনে নেয়। নিমিষেই ওর বলিষ্ঠ শরীরের দৃঢ় বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয় রাহিতা৷
স্বপ্নিল ঝুকে। রাহিতার তর তর করে কম্পমান ওষ্ঠদ্বয়ের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। লজ্জায়, শং’কায় অক্ষিদ্বয় বড় হয় রাহিতার।

—ক,কি করছেন?

—যা আরও আগেই করা উচিত ছিলো!

—আপনি..

—হুশ, এমন মুহুর্তে কথা বলে ডিস্টার্ব দেওয়ার কোনো মানে হয়না, রাহি। চুপ থাকো, এত নড়াচড়া করবেনা। যা হতে চলেছে, হতে দাও৷

কথাটা বলে থেমে যায় স্বপ্নিল। কিছুক্ষণ পর কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

—যদি পারো তবে সাড়া দাও।

কথাটার মর্মার্থ উপলব্ধি হতেই লজ্জায় চোখজোড়া খিচে বন্ধ করে রাহিতা। বেশ কিছুক্ষণ পেরোয়, স্বপ্নিলের এগোয় না। যা ভেবেছিলো তা হতে না দেখে ইতস্ততভাবে চোখ মেলে তাকায় রাহিতা, খেয়াল করে স্বপ্নিল দুস্টু হেসে ঠাই চেয়ে আছে ওর চোখের দিকে। ওকে বোকা চাহনিতে চেয়ে থাকতে দেখে স্বপ্নিলের ঠোঁটের কোণ বেকে যায়, মুখখানা নিজ হতে এগিয়ে যায়। এক হাতে ওর গাল চেপে ধরে কোমল ওষ্ঠজোড়া সদর্পে দখল করে নেয়। আবেশে, বিস্ময়ে রাহিতা কিছু বুঝে উঠার আগেই স্বপ্নিলের চুম্বনের তীব্রতা প্রলম্বিত হয়! তারপর…

তড়াক করে ঘুম থেকে জেগে উঠে স্বপ্নিল। কপালে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম। বুকের গতি অসম, শ্বাস-প্রশ্বাস এলোমেলো। শুষ্ক গলায় ঢোক গিলে আশেপাশে তাকায় সে। বিছানার অপরপ্রান্তে গভীর ঘুমে মগ্ন রাহিতাকে দেখে উপলব্ধি করে যে, এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিলো! ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই বেশ খানিকটা অবাক হয় স্বপ্নিল। প্রায় সাথে সাথেই আবারো চোখ বন্ধ করে। ঘোরগ্রস্ত স্বপ্নিলের মনে হলো একটু আগেই যেন রাহিতা ওর খুব কাছেই ছিলো, অথচ এখন সে বিছানার অন্য প্রান্তে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। এত কাছে তবু কত দূরে! কেন স্বপ্নটা সত্যি হলোনা? আফসোস হয় মনে! পরক্ষণেই নিজের ভাবনায় নিজে বেকুব সাজে স্বপ্নিল। নিজের মনকে প্রশ্ন করে – সে কি রাহিতাকে ভালোবাসে? সে কি প্রস্তুত পুরোদস্তুর সংসার শুরু করতে? মনের অনিশ্চয়তা যায়না। হতাশ স্বপ্নিল পুনরায় শুয়ে পড়ে। নিষ্পলক চেয়ে থাকে পাশে শোয়া রাহিতার দিকে। কি হতো যদি এদিক ফিরে ঘুমাতো মেয়েটা? কেন সে কাছে আসেনা! স্বপ্নিল তো একবার প্রেমে ধোকা খেয়ে ভয় পাচ্ছে আবারও সেই নৌকায় পা দিতে। কিন্তু রাহিতা কেন এগিয়ে আসছেনা ওর দিকে? সে কি ওর কাছে আসতে চায়না?
স্বপ্নিল মনে মনে অভিমান করে। আজ আর ঘুম আসবেনা বোধহয়। যে স্বপ্ন দেখেছে তা বাস্তবতার সম্পুর্ন বিপরীত। এ দুঃখে তার তৃষ্ণার্ত বুকে খরা নামে!

একবার হাত বাড়িয়ে রাহিতাকে নিজের দিক টেনে নিতে যেয়েও নেয়না। হাত গুটিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে টানটান শুয়ে পড়ে। রাহিতার ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখার লোভ শক্তভাবে দমন করে চোখ বুজে ফেলে! কয়েক মুহুর্ত পার হতেই রাহিতা ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরে। যেন স্বপ্নিলের লুকায়িত আকাংক্ষা টের পেয়েছে সেভাবেই হঠাৎ এগিয়ে এসে মাথা রাখে ওর বুকে৷ আচমকা নিজের উপর ভার অনুভব করায় তড়িৎ গতিতে চোখ মেলে স্বপ্নিল। রাহিতাকে ওর বুকে মিশে থাকতে দেখে অজানা খুশিতে চোখ দুটো ঝিলমিলিয়ে উঠে। বহু আকাংক্ষিত কিছু পেলে যেমন মানুষ আগলে রাখে নিজের কাছে, ঠিক সেভাবেই রাহিতার মুখের দিক নির্নিমেষ চেয়ে দু’হাতে আবদ্ধ করে নিজের সাথে মিশে রাখে ওকে। অথচ রাহিতার সেদিকে হুশ নেই। ঘুমন্ত সে বুঝলোই না নিজের অজান্তে কিভাবে সে তার বৈধ প্রেমিকের বুকের মরুভূমিতে এক পশলা প্রেমের বৃষ্টি নামিয়েছে!

#চলবে

কেমন লেগেছে জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here