#মন_পিঞ্জর
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_৪৫(শেষ)
আয়েশা এগিয়ে গিয়ে সেখানে বসে থাকা লোকগুলোকে দেখে যেনো আকাশ থেকে পরলো,পুরো চৌধুরী পরিবার সামনে বসে আছে,আয়েশাকে দেখতেই আঁখি ফাজলামো করে ওর পাশে আসলো।
মাশাআল্লাহ, একেবারে চাঁদ মুখ,আমার দেবরের চোখ আছে বটে,তা আমি আমার পরিচয়টা দিয়ে দিয়,আমি আপনার ওয়ান এন্ড অনলি জা তাও বড়, হয়তো এখনও হই নি তবে খুব জলদিই হবো,তাই আমাকে যথেষ্ট সম্মান দিতে হবে আপনাকে বুঝেছেন।
আঁখির কথা শুনে সবাই হাসিতে ফেঁটে পরলেন,তবে আয়েশা এখনও কোনো কিছু বুঝে উঠতে পারছে না,সব যেনো ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে,এবার ইশা মা উঠে এলেন,আয়েশার হাতের চায়ের ট্রে টা রেখে আয়েশার মাথায় হা বুলিয়ে বললেন।
সত্যিই আমার ছেলের চোখ আছে,বেয়াইন সাহেবা আপনার এই মেয়েকে আমি আমার ছোট ছেলে নোমানের জন্য জুরে নিতে চাই,আপনি যদি একে না দেন তবে আমরা একে চুরি করে নিয়ে যাবো,কারন আমার এমনই একটা সোনার টুকরো মেয়ে চাই।
মিরা রাহমান উৎসুক হয়ে বললেন।
আলহামদুলিল্লাহ।
আয়েশার আর কিছু বুঝতে বাকি রইলো না,এদিকে ফাঁক দিয়ে নোমানের দিকে তাকালে নোমান দুষ্টুমি করে ওকে চোখ মেরে বসলো,আয়েশা তো যেনো লজ্জায় নেই একদম।
ভালোয় ভালোয় বিয়েটা ঠিক হয়ে গেলো,আয়েশা পরে আঁখিকে অনেক মেরেছে দুষ্টুমি করে, কারন আঁখি সবকিছু জানতো,আর এমনটা করার যুক্তিও ওরই ছিলো,আঁখিও অনেক পঁচিয়েছে আয়েশাকে এ নিয়ে,সেদিন আঁখি বাড়ি এসেছিলো আয়ানকে না চাইতেও বাড়িতে থাকতো হলো যেহেতু বোনের বিয়ে ঠিক হবার কথা,কিন্তু আঁখিকে আদৃতের সাথে দেখে হৃদয়ের দহন যে সহ্য করার মতো ছিলো না ওর,অনেক কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করে রেখেছিলো তখন,আয়ান আদৃতদের হাসপাতালের কাজটাও ছেঁড়ে দিয়েছে,তারপর সবার বিয়ে ঠিক হলো,সায়েদা আর আঁখির অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা পরীক্ষা থাকায় বর্তমানে ওরা আর বিয়ের চাপটা মাথায় নিতে চায় না,পরীক্ষার জন্য বিয়েটা ছয় মাস পিছানো হলো,এই ছয় মাস আঁখি ওর বাবা মায়ের কাছে চলে গেলো,আদৃত ওকে রাখতে চাইলেও ও আদৃতকে অনেক বুঝিয়ে চলে যায়,ও এই ছয় মাস নিজের বাবা মায়ের কাছেই থাকতে চাইলো,তাই আঁখির খুশির উপর আদৃত আর মানা করলো না,ছয় মাস ভার্সিটির পড়ালেখা আর আদৃতের সাথে ঘোরাঘুরিতে ভালোই কাটলো আঁখির,সায়েদা তাজবীর আর নোমান আয়েশারও দিন ভালোই কেটেছে,আয়েশা চলে আসার পর নোমান ওর শুণ্যতা অনুভব করতে পারে,বুঝে উঠতে সক্ষম হয় নিজের মনের অজানা অনুভুতি,তারপর আদৃতকে আর আমির চৌধুরীকে জানায় সে কথাটা,আমির চৌধুরী পুষ্পর বাবাকে বুঝিয়ে বললে উনি আর অমত করেন নি এতে,পুষ্প অনেক অশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে,নোমান ওকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেও ও কোনোরমকে মানতে রাজি হলো না,পরবর্তীতে ওর বাবা মা ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে একপ্রকার জোর করেই লন্ডন নিয়ে চলে যান,এদিকে আরোহী আয়ানের দিন কাল ভালো কাটছে না,আরোহী ভিতর ভিতর পুড়ে মরছে কাউকে বুঝতে না দিলেও আঁখি যেনো ওর কষ্ট ঠিকই আন্দাজ করতে পারে,সারাদিন ওর সাথে গল্প গুজব করে ওকে খুশি রাখার চেষ্টা করে,হয়তো ওর জন্য এর থেকে বেশি কিছু করার ক্ষমতা আঁখিরও নেই,এটা যে আরোহীর কর্মের ফল।
আয়ান আরোহী পরে সবারই ছয় টা মাস ভালোই কাটলো।আজ ধুমধামে বিয়ে হলো আঁখি আদৃত আর নোমান আয়েশার,দুইটা জীবনের ভালোবাসা পূর্নতা পেলো আজ।আগামী পরশু তাজবীর সায়েদার বিয়ে।
আয়েশা নোমান বসে আছে নিজেদের রুমের বারান্দার দোলনাতে,আয়েশা বিয়ের সাজ খুলে বেগুনী রঙের একটা শাড়ি পরেছে, নোমানও পরেছে বেগুনী রঙের একটা শার্ট ,দুজনই দোলনাতে বসে প্রেমালাপে ব্যস্ত,অবশেষে ওদের ভালোবাসাও সুন্দর একটা সম্পর্কে পুর্ণতা পেলো,আয়েশা নোমানের বুকে মাথা রেখে বসে আছে, মনের প্রশান্তিতে ওর চোখ বেয়ে বেড়িয়ে এলো কিছু জল,যা আন্দাজ করতে পারলো নোমান,অস্থির হয়ে আয়েশার চোখের জল মুছে বললো।
কি হয়েছে আয়েশা কাঁদছো কেনো তুমি?
আয়েশা ঠোঁটের কোনে অল্প হাসি ফুঁটিয়ে নিয়ে বললো।
অবশেষে আপনাকে পেয়ে যাবো ভাবি নি।
নোমান আবারও ওকে বুকে টেনে নিয়ে বলতে লাগলো।
তুমি চলে যাওয়ার পর বুঝতে সক্ষম হলাম তুমি আমার জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, হয়তো এমন অনেকেই আছে যারা নিজের কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার মানুষটা কাছে থাকতে তার মর্ম বুঝতে সক্ষম হয় না,তবে সে দূরে গেলে তার গুরুত্বটা মন পিঞ্জরায় ধরা দেয়,তুমিও চলে যাওয়ার পর তোমার শুণ্যতা তোমার মর্ম বুঝতে সক্ষম করেছে আমায়,পারবো না আমি থাকতে তোমাকে ছাড়া,যেও না কভু আমায় ছেঁড়ে,ভালোবেসে ফেলেছি যে বড্ড তোমাকে।
আমিও আপনাকে ভালোবাসি অনেক।
অবশেষে আঁখির সপ্ন পুরন হলো,সব মেয়েরই স্বপ্ন থাকে নিজের বাবার বাড়ি থেকে বাবা মায়ের দোয়া নিয়েই স্বামীর ঘরে পদার্পণ করার,আঁখিরও একই স্বপ্ন ছিলো যা একসময় আক্ষেপের কারন হয়ে উঠলেও আজ প্রশান্তিতে মন ভরে আছে ওর,শেরওয়ানিতে আদৃতকে দেখে নতুন করে যেনো আবারও প্রেমে পরলো ওর,আজ যে বাকি আট দশটা মেয়ের মতোই বিয়ের সাজে মা বাবার মতামতেই প্রকৃত মানুষের হাত ধরে নতুন জীবনে পদার্পণ করলো আঁখি,খুশির যে আর ঠিকানা নেই ওর।
আঁখি রুমে বসে অপেক্ষা করছে কিন্তু আদৃতের কোনো খোঁজ নেই,এতে বড্ড বিরক্তি বোধ হলো ওর,ভেবে নিয়েছে আজ এলে আর কাকতাড়ুয়ার সাথে কথা নেই,তখনি দরজা খোলে কেউ প্রবেশ করে,তবে সে আদৃত নয় বুঝতেই পারে আঁখি,কাজের লোক আহাদ এসে ওকে একটা বক্স দিয়ে গেলো,গিফ্টপেপারে মুড়ানো।আঁখি আলতো হেসে বাক্সটা খুলে নিলো,সেখানে মেরুন কালারের একটা শাড়ি আর কিছু মেচিং জুয়েলারি,নিচে একটা চিরকুট,চিরকুটে লিখা।
এগুলো পরে চলে আসেন, বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছে আপনার এই কাকতাড়ুয়া।
আঁখি লজ্জাময় হাসি দিয়ে বিয়ের সাজ খুলে শাড়ীটা পরে নেয়,চোখে গাঢ় করে কাজল আঁকে,ঠোঁটে দেয় হালকা লিপস্টিক, কানে হালকা দুল পরেছে,চুলগুলো পুরো না ফিরলেও বেশ ফিরেছে একদম পিঠ ছুঁইছুঁই যাতে বেশ ভালোই খোঁপা হলো,খোঁপায় গাথলো রজনীগন্ধা ফুল যা আদৃতই ওর জন্য পাঠিয়েছিলো,হাতে মেরুন রঙের চুড়ি পরেছে,বেশ…. সাজ শেষে আয়নার দেখলো নিজেকে খুঁটিয়ে,একটা মৃদ্যু হাসি হাসলো,ওকে মন্দ লাগছে না যে খুব একটা,বেড়িয়ে গেলো বাইরের দিকে,গাড়িতে হেলান দিয়ে হাত ভাজ করে অপেক্ষা করছিলো আদৃত,মেরুন কালারের একটা শার্ট নিজেও পরেছে, আঁখিকে দেখেই বিমোহিত হলো সে,অপলকে তাকিয়ে রইলো খানিকক্ষণ,আঁখি পাশে আসতেই বললো মাশাআল্লাহ, আঁখি লজ্জায় মুচকি হাসলো,অতঃপর আদৃত দরজা খুলে দিলে ভিতরে ঢুকলো,গাড়ি এসে থামলো এক নদীতীরে,আঁদৃত নেমে এসে হাত ধরে আঁখিকে নামালো,এখানে আগেও এসেছে দুজন অনেকবার,তবে আজকের রুপটা যে এর ভিন্ন,নদীতীরবর্তী বড় শিমুল গাছে ঝুলছে একটা দোলনা,ফুল দিয়ে অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো সেটা,শিমুল গাছটির আশেপাশে জ্বলছে অসংখ্য মোমবাতি,পুরো নদীতীরেই ফুলের পাপড়ির ছড়াছড়ি সাথে অনেক হার্ট সেইপের বেলুনও শোভা পেয়েছে,এক সাইডে বড় করে ফুল দিয়ে হার্ট বানানো আর তার মধ্যে ফুলের পাপড়ি দিয়েই বড় করে লিখা,আদৃত +আঁখি=দৃতখি
নামটা দেঁখে আঁখি মিষ্টি হাসলো,পিছন থেকে তখন আদৃতের স্পর্শ অনুভব করতে পারলো,আদৃত ওকে জড়িয়ে ধরে ওর কাধে থুতনি রেখে বললো।
পছন্দ হয় নি নামটা?
অনেক পছন্দ হয়েছে,একটু অদ্ভুত পুরো আপনার মতো।
আদৃত মৃদ্যু হেসে আঁখিকে কোলে নিয়ে গিয়ে সেই দোলনাতে বসিয়ে ওকে দোলাতে শুরু করলো।
আঁখি স্বাচ্ছন্দ্য মনে বললো।
এসব কিছু আপনি করেছেন?
আমি ছাড়া আপনার আর কজন পাগল প্রেমিক দেখতে পাচ্ছেন আপনি এখানে মেডাম?
হুম এমন পাগলামি তো শুধু আপনিই করতে জানেন,তবে এই গম্ভীর ডাক্তার ভিতরে ভিতরে এতো রোমান্টিক জানতাম না আমি।
এবার আদৃত এসে আঁখির পাশে বসলো,ওর কপালের সামনে লেপ্টে থাকা চুলগুলো আলতো হাতে গুজে দিলো কানের পিছন,অতঃপর আঁখির চোখের পানে নেশাক্ত চাহনি স্থির রেখে বললো।
প্রেমপিয়াসু হয়তো কখনো এতোটা ছিলাম না,আপনার ভালোবাসা যে তাও শিখিয়ে দিলো।
আঁখি এইবার প্রচুর লজ্জায় আদৃতের বুকে মুখ গুজলো,আদৃত ঠোঁটের কোনে প্রাপ্তির হাসি ঝুলিয়ে আঁখির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।
রিতীমতো আজ আমাদের বাসর রাত,তবে এই রাতটা আমি বাকি সবার মতো কাটাতে চাই নি, জীবন আমাদের দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছে আর সে দ্বিতীয় সুযোগের প্রথম শুরুটা আমি আলাদা ভাবে করতে চাইছিলাম ,তবে জীবনে আপনার আসা যে অনেক বড় পাওয়া যার ভালোলাগার পরিমাণ আমি হয়তো কোনো পন্থাই অবলম্বন করে আপনাকে বুঝাতে সক্ষম হবো না,এসব তো ছোট্ট একটা চেষ্টা মাত্র।
আঁখি খনিক নিরবতা পালন করে বলতে শুরু করলো।
আমি কখনোই ভাবি নি জীবন দ্বিতীয় সুযোগ হিসেবে আপনার মতো কাউকে আমায় উপহারে দিবে,ভালোবাসি আপনাকে খুব ড.আদৃত।
ভালোবাসি আমিও মিস আঁখি।
আঁখি এবার খনিক নাক চটকিয়ে আদৃতকে ছেঁড়ে ঠিক হয়ে বসে বললো।
মিস আঁখি কি?আমি কি আপনার নানু হই যে আমাকে আপনি বলে ডাকতে হবে।
আমিও তো আপনার নানু না,তবে আমাকে কেনো আপনি বলে ডাকতে হবে?
কারন আপনি আমার বয়সে বড়,আর কর্মেও।তাছাড়া আমার আপনাকে আপনি বলে ডেকে অভ্যেস হয়ে গেছে।
হুম,অভ্যেস টা তো আমারও হয়েছে,তবে আসল কথা হলো যে হতে পারি আমি আপনার বয়সে বড় কিন্তু স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে বড় ছোট, উচু নিচু বলে কিছু থাকতে নেই,স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হলো একটা ঠেলাগাড়ির দুটি চাকার মতো,একটা চাকা চলতে অচল বা অক্ষম হলে ওপরটিকেও অচল ধরে নেওয়া হয়,সেটারও কোনো মর্ম থাকে না,কারন সেই গাড়িটাকে চালিয়ে নিতে দুটি চাকাকেই সমান হারে উপযুক্ত হতে হয়,তেমনি বিবাহিত জীবন সফল করতে হলে স্বামী স্ত্রীকে সমান অবস্থানে থাকতে হয়।যতোটা সম্মান আপনি আমাকে করেন ঠিক ততোটাই সম্মান আমি আপনাকেও করি আর আজীবন করবো।
আদৃতের কথায় সুখে আঁখির চোখে জ্বল চলে আসলো,আঁখি তা অল্প হেসে মুছে আবারও আদৃতের বুকে মাথা রাখলো,সেখানে যে আছে ওর জন্য অসীম সুখের এক রাজ্য,আদৃত আঁখির চুলে হাত নাড়াতে নাড়াতে এবার বললো।
আজকে একটা জিনিস চাইবো আপনার কাছে দেবেন মিস আঁখি।
কি চাই আপনার?
আপনার জীবনভরের সঙ্গ তো আমি অনেক আগেই নিজের করে নিয়েছি,এবার জীবনভর আপনার ভরন পোষণের দায়িত্বও আমি নিতে চাই,আমি জানি আপনি একাই সব করতে পারেন,কারো উপর নির্ভরশীল হতে হবে না কভু আপনাকে, কিন্তু আমার উতলা মন পিঞ্জরখানা আপনার জীবন সংগ্রামের সঙ্গী হতে যে বড্ড ইচ্ছুক।
দেবেন সে অধিকারটুকুও আমায়।
দিলাম।
আলহামদুলিল্লাহ।
আরেকটা কথা আপনাকে নিজের নামের সাথে আমার নাম জুড়তে হবে না মিস আঁখি,আমি আরোহীকেও কখনো জোর করি নি এতে,বাসর রাতে ওকেও বলেছিলাম কথাটা,তবে ও নিজের ইচ্ছেতেই নিজের নামের সাথে আমার নাম ব্যবহার করতো।আসলে একটা মেয়ের নামের সাথে যে ওর বাবা বা স্বামীর নাম থাকতে হবে তা কিন্তু বাধ্যতামুলক নয়,একটা মেয়ের পুরো অধিকার আছে নিজের নামে বেঁচে থাকার।
আঁখি এবার মাথা উঠিয়ে আদৃতের পানে দৃষ্টি অটল রেখে বললো।
আপনার মতো জীবন সাথীর নাম নিজের নামের পিছনে থাকলে যে নিজেকে আমি ধন্য মনে করবো।কারন এই জীবন সংগ্রামে আপনিই আমার প্রেরণা।
আজ দুটি মন পিঞ্জর পুড়ছে বড্ড,কাঁদতে কাঁদতে চোখগুলো যে অনেকাংশে ফুলেছে,চোখের জল যেনো ফুরিয়েই গেছে,কতো আর ঝড়বে তা,তারও তো একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে,তবে সেই দুটি মন পিঞ্জরের ব্যাথার সীমা নেই যার পরিমাণ বুঝিয়ে দিতে এখন যেনো চোখের জ্বলেরও কমতি পরছে,সে দুটি হৃদয়ের অধিকারী হলো সয়ং আয়ান আরোহী, দুদিকে দুটি প্রাণ ব্যাথার্থ ভঙ্গিতে পরে আছে,সবাই অনেক বললেও ওরা আদৃত আঁখির বিয়েতে যায় নি,তবে কেউ তেমন ওদের বাদ্যও করে নি যেতে,আঁখি আদৃতই সবাইকে মানা করেছে নিজের চোখের সামনে ভালোবাসার লোকগুলোকে অন্যের হতে দেখার অনুভুতির তিক্ত স্বাদ সম্পর্কে যে ওদের ভালোই জানা আছে।তাও পারছে না দুজন মেনে নিতে,নিজেদের কর্মের সাজা এতোটা নিষ্ঠুর হবে জানলে হয়তো কখনো সে পথে পা বাড়াতো না,তবে এই পাপের সাজা হয়তো দুজনের জন্য জীবনভরের সাথী। নিজেদের কর্মফল মনে করে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে মেনে নিতে চাইছে ওরা সব।
______
আজ তাজবীর সায়েদার বিয়ে হলো,সায়েদা কাঁদতে কাঁদতে নেই,বাসর ঘরে ঢুকে তাজবীর শুরু করেছে ওর সাথে যা তা ব্যবহার।
কি মনে করেছো সায়েদা আমি তোমায় ক্ষমা করে দিয়েছি, একদম না,আমি তো তোমাকে প্রতিশোধ নিবো বলে বিয়ে করেছি,আমাকে অপমান করা,বার করছি তোমার দাঁড়াও।তুমি আজ থেকে ফ্লোরে ঘুমাবো কোনো চাদর বালিশ ছাড়াই।
সায়েদা কাঁদতে কাঁদতে বললো।
ঠিক আছে,তোমার ক্ষমা আর ভালোবাসা পেতে আমি ফ্লোরে ঘুমানোতো কি যেখানেই বলবে সেখানেই শুবো,যাই বলবে তাই করবো,কথাটা বলে সায়েদা বিছানা থেকে নেমে ফ্লোরে নেমে পরতে গেলে তাজবীর হাসতে হাসতে গিয়ে ওকে থামায়।
এমনি কি আর টিউবলাইট বলি,এতো সাধনার পর পেয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে কি আর কষ্ট দেওয়া যায়,তবে তুমি যে গাধি গাধিই থাকবে,সবসময়ের মতো আজকেও আমার কথায় ফাঁসার ছিলো তোমার?হা হা
সায়েদা এবার কান্না মুঁছে জোরছে একটা চিমটি কাটলো তাজবীরের পেটে।
আহ কি করছো?
পেট ফুঁটো করে দেবো একদম আমার সাথে আর লাগতে এলে।
শবে তো বাসর রাত শুরু, লাগালাগির দেখলে কি তুমি?
কথাটা বলে তাজবীর নেশাক্ত ভঙ্গিতে সায়েদার অধরের পানে এগিয়ে গেলে সায়েদা চট করে ওর মুখ চেঁপে ধরে বললো।
আগে ফ্রেস হয়ে দুজন ওযু করে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করার উদ্দেশ্যে একসাথে দু’রাকাআত নফল নামাজ পড়বো,আর তারপর অন্য কিছুর কথা ভাবা যাবে।
হুম,ঠিক আছে,তবে পরে কিন্তু ছারবো না তোমায়।
দুষ্টুমি করে কথাটা বলে ফ্রেস হতে চলে গেলো তাজবীর।
কেটে গেলো আরও কয়েকটা দিন,আয়ান আর পারছে না এই বিরহ মেনে নিতে,দূরে কোথাও চলে যেতে চাইছে সব ছেঁড়ে,এদিকে আয়েশা চলে গেলে মায়ের জন্য চারটে মেয়ে রেখেছে আয়ান,ওরা মায়ের সব রকম দেখাশোনা করলেও মা প্রায়ই অসুস্থ থাকেন,আয়ান ভালোই বুঝতে পারে একাকিত্বে মায়ের অসুখ ছাড়ছে না,মন অসুস্থ থাকলে শরীর কেমনে সুস্থ থাকবে,আঁখি আয়েশার কাছে থাকলে মা অনেক ভালোই থাকেন,চৌধুরী বাড়িতে থাকাকালীন যে মা একদম ভালোই ছিলেন,আয়েশা আঁখিও আয়ানকে অনেক জোরাজোরি করছে মাকে ওদের ওখানে পাঠিয়ে দিতে,আয়ানও কাজের চাপে সারাদিন বাড়ি থাকে না,একাকিত্বের সাজা যে নিজেও কাটছে তাই মাকে সে কষ্ট আর অনুভব করতে দিতে চায় না সে,মাকে নিজে গিয়ে দিয়ে আসে আঁখি আয়েশার কাছে,চৌধুরী বাড়ির সবাই অনেক খুশি উনাকে পেয়ে,অতঃপর কাউকে না বলেই আয়ান দেশ ছেঁড়ে চলে যায়,কোথায় গেছে কাউকে বলেও যায় না।
আঁখি বারান্দার দোলনাতে বসে কিছু চিন্তা করছে,তখন আদৃত এসে পাশে বসলো ওর,আঁখি চট করে এসে পরে আদৃতের বুকে,আদৃত যেনো প্রিয়সীর মনোভাব বুঝতে সক্ষম হয়।
আয়ানের জন্য খারাপ লাগছে বুঝি।
হুম,চলে গেলো অথচ কোথায় গেলো বলেও গেলো না,দূরে গিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে হয়তো। তবে তাতে ভালোই হয়েছে,দোয়া করি যেনো আল্লাহ ওকে নিজেকে সামলে নেওয়ার তৌফিক দেন।
হুম,আমিও এটাই চাই।
কিন্তু আমার অন্য কিছুও চাই আপনার কাছে।
তবে কি চাই মেডামের?
বাচ্চা,আদৃতের পানে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বললো আঁখি।আদৃত মৃদ্যু হেসে আঁখিকে বুকে টানলো আবার তারপর বললো।
হুম বাচ্চা তো আমারও চাই তবে আরও দুবছর পর, একবার ডাক্তারি শেষ করে নিন তারপর যতো ইচ্ছে বাচ্চা নিবেন সমস্যা কই।
আরে আমি কি বলেছি বাচ্চা হলে পড়া ছেঁড়ে দিবো,ও তো আমি প্রাণ গেলেও ছাড়বো না,ডাক্তার তো আমি হবোই,তাই বলে কি বাচ্চা নিবো না।
হুম,নিবেন কিন্তু দুবছর পর,আমি চাই না আপনার আর আপনার পড়ালেখার মধ্যে তৃতীয় কেউ আসুক,আমি জানি আপনি সব সামলে নিতে সক্ষম, কিন্তু আমি আর কোনোরুপে আপনাকে কোনোধরনের কম্প্রোমাইজ, সেক্রিফাইজ করতে দিতে পারি না।তবে আল্লাহ যদি এই দুই বছরে আমাদের মধ্যে কাউকে নিয়ে আসেনও তবে তাকে স্বাগতম করারও কোনো কমতি রাখবো না আমি।কিন্তু নিজে থেকে আনার চেষ্টা একদম না,ঠিক আছে।
কিন্তু দুবছর পর যদি বাচ্চা না হয়।আবারও ঠোঁট উল্টিয়ে বললো আঁখি।
আমার মিস আঁখি ধৈর্য্য হারতে কখন থেকে শিখলেন?উপরওয়ালার উপর বিশ্বাস আছে না,উনি কখনো আমাদের খালি হাতে ফিরাবেন না,আমাদের জীবনে এখন আলোকিত অধ্যায় শুরু হয়েছে আর সারাজীবন সে আলো প্রজ্বলিত থাকবে ইনশাআল্লাহ।
ইনশাআল্লাহ।
তাছাড়া আমরা এখনও বুড়ো হই নি যে দুবছর পর বাচ্চা হবে না বুঝেছেন মিস আঁখি।মানুষের তো বুড়ো বয়সেও বাচ্চা হয়।
হুম,তবে আপনি বুড়ো হতেও কম হন নি।আসতো বুড়ো বর আপনি আমার।
ও হ্যলো আমার বয়স মাত্র ৩০,এতো ভাব দেখাবেন না আমায়।
হুহ,আমার থেকে পুরো ৭ বছরের বড় আপনি,হলেন না বুড়ো।কথাটা বলে আদৃতের পেটে একটা চিমটি কেটে দৌঁড় দিলো আঁখি হাসতে হাসতে।
আপনাকে আমি আজ ছাড়ছি না।
কথাটা বলে আদৃতও ওর পিছু ছুঁটলো।
দেখতে দেখতে আড়াই বছর কেটে গেলো,আয়ানের এখনও খোঁজ নেই,আরোহী আদৃতের সামনে ভুলেও পরে না,তবে মনের ব্যাথা ওর এক চুলও কমে নি,আঁখি আদৃতের ভালোর জন্য প্রতিনিয়ত দোয়া চায় আল্লাহর কাছে,এদিকে আঁখি ডাক্তারি কমপ্লিট করেছে, এখন আঁখিও একজন সার্জন,আদৃতের সাথে ওদের হাসপাতালে জয়েন করেছে,সায়েদাও ডাক্তারি কমপ্লিট করে ওদের হাসপাতালে জয়েন হয়েছে,সায়েদা বাচ্চা নিতে চাইলেও তাজবীর নেয়নি, তাজবীরও আদৃতের ন্যায় আগে সায়েদার ডিগ্রিটাই চেয়েছিলো,ওর আর ওর স্বপ্নের মধ্যে তৃতীয় কাউকে আসতে দিতে চায় নি সেও।আয়েশা নোমানের কোল আলো করে এসেছে এক রাজকন্যা, নাম রেখেছে ওর আয়মান,সবার চোখের তারা ও।
আঁখি কনসিভ করেছে আজ দুমাস,আদৃত তো এখন থেকেই ওকে চোখে চোখে রাখছে,বাবা হবার কথা শুনে কতোটা খুশি হয়েছে আদৃত তা কথায় ব্যক্ত করার মতো নয়,দুজনেরই চোখে সুখে সেদিন জল ঝলকে এসেছিলো,দুজনের জীবনের অনেক বড় অপূর্ণ স্বাদ পূর্ণ হওয়ার বার্তা যে অবশেষে এলো।
ছয় মাস পর দেশে ফিরলো আয়ান,এতোটা দূরে থেকেও পারে নি এই দুইবছর আঁখিকে একটুও ভুলতে,বরং ওকে দেখার জন্য যেনো দুটি চোখ পুড়ে যাচ্ছিলো,তাই এবার দেশে ফিরে এলো আঁখিকে একনজর দেখবে বলে,তবে ওর সামনে যাওয়ার ক্ষমতা হয়ে উঠছে না আয়ানের আর তাই ওর পছন্দের একটা পার্কে বসে রয়েছে এসে,এই পার্কে যে ওরা দুজন প্রায়ই আসতো,ব্যাথার্থ মন নিয়ে বসে ছিলো তখনি দেখতে পেলো সেই পার্কে নিজের মন পিঞ্জরে বসবাস করা রমনীকে,সে যে আগের থেকেও আরও বেশি সুন্দরী হয়ে উঠেছে,অনেকটা গুলুমুলু,নাদুসনুদুস হয়ে গেছে যেমনটা বাচ্চা গর্ভে থাকাকালীন সব নারীই হয়ে থাকে,আদৃতকে জড়িয়ে ধরে হাঁটছে আঁখি সেই পার্কে,আদৃত ওকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে রেখেছে,খুব খেয়াল নিয়ে হাঁটাচ্ছে ওকে,এমন সময় যে প্রতিটা নারীই নিজের স্বামীর সঙ্গ চায়,আয়ান ব্যর্থ হলেও আদৃত কোনো দিক থেকেই কখনো আঁখিকে নিরাশ করে নি,না করবে,ছায়ার মতো লেগে থাকে আঁখির সাথে, আদৃত যে আঁখির ঢাল,আঁখি আদৃত মনের সুখে বিচরন করছে পার্কটাতে,নিজেদের মধ্যে রঙিন গল্প করতে ব্যস্ত দুজন খেয়াল করি নি আয়ানকে,এদিকে পোড়চ্ছে আয়ানের প্রেমিক হৃদয়,আঁখি যে জীবনে সত্যিই অনেক এগিয়ে গেলো তবে আয়ান এখনও সেখানেই পরে রয়েছে যেখানে দুবছর আগে ছিলো।পারলো না আর সইতে,জীবন নিঃস্ব হয়ে গেছে ওর এক নিমিষেই, সেদিন অতিরিক্ত পীড়ায় অনেক বড় পদক্ষেপ নিলো আয়ান,বাড়ি চলে এসে রুমের দরজা বন্ধ করে নিজেকে শেষ করে দিতে বিষ পান করলো,তবে বাড়ির দেখাশোনায় কাজের লোক থাকায় ওরা কিছুটা অনুমান করে আয়ানকে ডাকতে শুরু করে, অনেকবার ডাকার পরও সারা না দিলে ওরা চারজন মিলে আশপাশ থেকে লোক ডেকে দরজাটা ভাঙতে সক্ষম হয় অনেক কষ্টে। তারপর আয়ানকে হাসপাতালে নেওয়া হয়,খবরটা চৌধুরী বাড়ি পোঁছে দেয় কাজের লোক।
জ্ঞান ফিরে আঁখিকে পাশে বসা পায় আয়ান,কি বলবে আর করবে কিছু ভেবে পাচ্ছে না,চোখের নোনাজল আঁখির অগোচর করার চেষ্টাতে চেহারা অপর পাশ করে নেয়,আঁখি আলতো করে আয়ানের মাথায় সহানুভূতির হাত বুলিয়ে বলে।
আয়ান জীবন কোনো ঠুনকো নয় যে চাইলেই দেওয়া যাবে,আল্লাহ প্রদত্ত জীবন নিজে থেকে শেষ করে দেওয়াও যে আরেকটা অনেক বড় পাপ।জেনেশুনে কেনো আবার পাপ করতে যাচ্ছিলে বলো,আমি জীবনে অনেক এগিয়ে গিয়েছি, এতোটা এগিয়েছি যে সেখান থেকে ফিরে আসা কোনো মতেই সম্ভব নয়,তাই তোমাকেও এবার জীবনে এগুতে হবে,এভাবে নিজেকে শেষ করে দেওয়াতে কোনো সমাধান হতে পারে না,তুমি আমাকে প্রমিজ করো আর কখনো এমনটা করবে না।জীবনে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাববে।
এগিয়ে যেতে পারবো কি না জানি না,তবে আর এমনটা করবো না কথা দিচ্ছি,তুমি সুখে থাকো এটাই চাইবো দূর থেকে।ব্যাথা ভরা কন্ঠে কথাগুলো বললো আয়ান।
তার কয়েকদিন পর আঁখি আদৃত মিলে আরোহী আয়ানের সাথে কথা বললো,দুজন নিঃস্ব মানুষ,একই পরিস্থিতির স্বীকার, তাই ওরাই পারবে একে ওপরের ব্যাথা অনুভব করে তার ওষুধের মতো কাজ করতে,কথায়ই আছে কাটায় কাটা তুলে,বিষ বিষকে কাটে।তাই অনেক বুঝানোর পর দুজন জীবনে আবারও এগিয়ে যাওয়ার কথা মেনে নেয়,আঁখি আদৃতের কথা ফেলতে পারে না দুজন,অতঃপর ঘরোয়াভাবে দুজনের বিয়ে সম্পন্ন হয়,এখন দুজন আসতে আসতে একে ওপরকে জানার চেষ্টা করছে,ওরা বাসর রাতেই বোঝাপড়া করেছে আগে দুজন একে ওপরকে জানবে বুঝবে তারপর না হয় সম্পর্কে এগুবে,দিনের পর দিন কাটছে, এতোদিনে আঁখির কোল আলো করে এসেছে দুই রাজকুমার,আঁখির স্বপ্ন পুরন করে আল্লাহ ওকে শেষমেষ জমজ বাচ্চার মুখ দেখালেন,দুটাই দেখতে একই রকম একদম আঁখি আদৃতের সংমিশ্রণ।সবাই অনেক খুশি,আঁখি আদৃত সেদিনও অনেক কেঁদেছিলো খুশিতে।সায়েদার কোল আলো করেও আসলো একটা ফুটফুটে মেয়ে,তাজবীরের খুশির তো ঠিকানা নেই ও বাবা হয়ে গেলো অবশেষে।
দেখতে দেখতে কেটে গেলো চারটে বছর।
আঁখি আয়নাতে চুল আছড়াচ্ছে,চুলগুলো আগের অবস্থানে ফিরে গেছে ওর,কোমরের নিচ অব্দি ঢলে পরেছে, চুল আছড়াতে মগ্ন আঁখি তখনি ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো আদৃত, তারপর ওকে হেচকা টানে নিজের দিকে ঘুরালো,ওর অধরের পানে এগিয়ে গেলো বিনা বাক্যে তবে আঁখি ওকে তা করতে না দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরলো।
আপনি না দিন দিন লুচুদের লিস্টে নাম লিখাচ্ছেন।
হুম আপনার জন্য আমি এই উপাধীও পেতে রাজি ডা.সাহেবা।
মুখ থেকে আঁখির হাত সরিয়ে নেশাক্ত স্বরে কথাটা বলে আবারও আঁখির অধরের পানে এগিয়ে গেলো।
আরে কি করছেন দরজা খোলা বাচ্চারা এসে যাবে।
আসলে আসুক ওরাও তো জানবে ওদের বাবা কতো রোমান্টিক।
রোমান্টিক না ছাই।
কথাটা বলে আঁখি আদৃতের পেটে দিলো একটা গুঁতো, তৎক্ষনাৎ বাচ্চারা ছুঁটে আসলো রুমে।
আহনাফ আর আরহান ওদের দুই রত্ন,ওরা শুধু দেখতেই একরকম না কন্ঠস্বরও একই।রুমে ঢুকে এবার আহনাফ বললো।
বাবা ও বাবা তলো না ফুতবল খেলি।
তারপর আরহান বললো।
ও মা তুমিও তলো না।
দুজন এখনও ভালো করে কথা বলা শিখে নি,তুতলিয়ে কথা বলে,ওদের কথা শুনে আদৃত আঁখি দুজন এক এক জনকে কোলে তুলে দুজনের গালে পাপ্পি দিলো।
আদৃত এবার আঁখিকে উদ্দেশ্য করে বললো।
কি বাত্তাদেল মা ফুতবল খেলবে।
জি খেলবো বাত্তাদেল বাবা।
হা হা হা।
দুজনই হাসতে লাগলো,ওদের বাচ্চারা কিছু না বুঝতে পেরে দাঁত কেলিয়ে হাসলো।মা বাবা হাসছে তাই।
দুজনই হাসতে হাসতে ওদের নিয়ে বাইরের দিকে গেলো,বাচ্চাদের সাথে খেলতে মগ্ন হলো ওরা,সাথে আয়মানও আছে,নোমানও এসে এবার যোগ দিলো,আয়েশা বসে ওদের খেলা দেখছে আর হাসছে,কোলে ৬ মাসের ছেলে আমান।
ওদের সুখি পরিবার, সবার দিন ভালো কাটছে,আরোহী আয়ানও নিজেদের সম্পর্ককে একটা আলাদা রুপ দিতে পেরেছে,হয়তো আদৃত আঁখিকে ভুলে যাওয়া ওদের পক্ষে কখনোই সম্ভব না,তবে একে অপরের সাথে জীবনের বাকি সময়টা কাটিয়ে দিতে চায়,ওরা যে একে অপরের পরিপুরক হতে পেরেছে,এক ছাঁদের নিচে থাকতে গেলে ভালোবাসা নামক সম্পর্কের উৎপত্তি হয়েই যায় দুটি মনে,যেমন হয়তো ওদের ক্ষেত্রেও হয়েছে অবশেষে ,তবে জীবনে অনেক বড় অপূর্ণতা রয়ে গেছে ওদের,কোনোরুপে ওরা বাচ্চা নিতে সক্ষম হচ্ছে না,অনেক কিছু করার পরও ওদের বাচ্চা হচ্ছে না,ডাক্তার হয়েও কিছু করতে পারছে না আয়ান,আল্লাহ না চাইলে যে কোনো কিছুই সম্ভব নয়,সারোগেছিতেও দুজন বাচ্চা নিতে ইচ্ছুক নয়,দুজনই পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে আল্লাহর ইবাদত করে দিন কাটায়,জীবনের করা পাপের জন্য মাফ চায়,তওবাও করেছে অনেক আগে নিজেদের করা পূর্বের পাপের জন্য,আঁখি ওদের বলেছে ধৈর্য্য রাখতে আল্লাহ ওদের দিকে মুখ ফিরিয়ে একদিন না একদিন তাকাবেনই,অবশেষে বিবাহিত জীবনের পাঁচ বছর পর আরোহী কনসিভ করে,আয়ান আরোহী দুজনই অনেক খুশি,আয়ান দিন রাত ওর খেয়াল রাখছে,আরোহীকে বিয়ে করার পর মাকে নিয়ে আসে আয়ান,আরোহী নিজের মায়ের মতোই উনার খেয়াল রাখে যেমনটা আঁখি রাখতো,উনি ওদের সাথে এখন অনেক ভালোই আছেন।সায়েদার কোল আলো করে এলো এবার এক রাজপুত্র, মেয়ের নাম সাফরিন আর ছেলের নাম রেখেছে তাহসান।
একটু আগে জামায়াতে ইশার সালাত আদায় করলো আদৃত পরিবার,আদৃত সামনে বসে ইমামতি করে আর পিছনে আঁখি আর ওদের বাচ্চারা,বাচ্চাদের এখন থেকেই আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকার শিক্ষা দিচ্ছে ওরা,লক্ষ্য পুর্নাঙ্গ মানুষ বানানো,আদৃত মসজিদে গেলে ওদের সাথে করে নিয়ে যায় আর যেদিন ঘরে নামায পড়ে সেদিন এভাবেই পড়ে।এবার দুজনকে ঘুম পারিয়ে দুজন দুদিক থেকে ওদের মাথায় হাত বুলাচ্ছে,ওদের পালনের জন্য এক্সট্রা লোক কখনো রাখে নি আদৃত আঁখি,নিজেরাই একসাথে বড় করেছে দুজনকে,কখনো ভারটা একজনের ঘাড়ে যেতে দেয় নি,আদৃতের আঁখির প্রতি সম্মান আর ভালোবাসা দিন দিন যেনো বেড়েই চলেছে,সবার সামনের গম্ভীর পুরুষ আঁখির সামনে যেনো আলাদা কেউ একজন,যে কিনা এখনও কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকায় না সে আঁখির কাছে পৃথিবীর বেষ্ট রোমান্টিক হাসবেন্ড, জানে আঁখি আদৃতের ভালোবাসায় কোনো খাঁদ নেই,নির্ধিদায় যে পারবে আঁখি লোকটার সাথে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে।
এবার আদৃত আঁখির হাত ধরে বললো।
আমার আপনার কাছে আজ আরেকটা জিনিস চাই ডা.সাহেবা।
তবে বলেন কি চাই আপনার?
একটা রাজকুমারী। দিবেন কি আমায়?
রাজকুমারী তো আমারও চাই।
মিষ্টি হেসে বললো আঁখি।
অবশেষে আল্লাহর রহমতে আঁখি আদৃতের জীবনে আসলো এক অপরুপা রাজকুমারী, একদম দেখতে আঁখির মতোই হয়েছে,দুজন ওর নাম রাখলো আরশিয়া।
আয়ান আরোহীর কোলেও আসলো এক রাজকুমার,নাম রাখা হলো আহীর ওদের নামের সাথে মিলিয়ে।মিরা রাহমানের দিন ভালোই কাটছে ছেলে ছেলেবউ আর নাতিকে নিয়ে।
সবার দিন ভালোভাবে কাটতে লাগলো।তবে একজনের জীবন যে অভিশাপেই ভরে রইলো,মাহি যেদিন আয়নাতে নিজেকে দেখতে পেলো নিজের ভয়ংকর রুপ দেখে নিজেই জোড়ালো চিৎকার করে উঠলো,সব সৌন্দর্য ওর নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো,পা দুটিও নেই,হুইল চেয়ার ছাড়া চলতে পারে না,লোকে দেখলে ওকে একপ্রকার ভয় পায় ওর পাশেও আসে না, ৩ বছর জেলে কাটালো মাহি,আঁখি ওর অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারলে ওর বাবাকে বলিয়ে ওর উপর থেকে সমস্ত কেস তুলিয়ে নিলেও তিন বছর জেল হলো মাহির,ওর অবস্থার প্রতি দয়া করে ওকে ছেঁড়ে দেওয়া হলো,তবে বাড়িতে এসেও শান্তি টিকলো না জীবনে,ওর বাবা মারা গেলেন হঠাৎ বড় একটা রোগে,মারা যাওয়ার আগে ওর ভাই কি না কি বাবাকে কানমন্ত্র দিয়ে নিজের নামে সব সম্পত্তি লিখিয়ে নিলো,৫ মেয়ের পর উনার এক ছেলে ছিলো যার ফলস্বরূপ ওকে সবসময় আলাদা নজরে দেখা হতো,তাই পাঁচ মেয়ে আর বউকে কিছু না দিয়ে সব ছেলের নামেই লিখে দিলেন,উনি মারা যাওয়ার কিছুদিন পর ছেলে হুট করে একটা মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসে,তার কিছুদিন পর মা বোনকে ঘর থেকে বের করে দেয়,এই বলে ওর বউ নাকি মাহির মতো পঙ্গু, অবলা আর ওর মায়ের মতো বৃদ্ধ মহিলার দেখাশোনা করতে পারবে না,ও নিজেও ওদের দায় ভার নিতে পারবে না,ওখানে থাকাকালীন মাহিকে অনেক কথাও শুনতে হতো,তারপর মাহিকে নিয়ে ওর মা ঘর থেকে বেড়িয়ে আসেন,ওর অন্যান্য বোনেরা ওদের খোঁজ নিলেও কেউই ওদের দায় ভার নিতে চায় না,অবশেষে মাহির মা একটা ছোটো খাটো চাকরি খুঁজে পান খুবই অল্প বেতনে তাতে কোনো মতে একটা আধভাঙা ঘরে ভাড়া দিয়ে থাকে ওরা,দিনে একবার করে হলেও ভাড়ার তাড়া পেতে হয় ওদের,মাহি আন্দাজ করতে পারে মাও ওর উপর হাঁপিয়ে উঠেছেন,অনেক সময় ওকে সোজাসোজিই বলেন যে ও উনার মাথার বোঝা হয়ে গেছে,ও মরে গেলেই উনি বেঁচে যান,এদিকে মাহি না পারছে মরতে না পারছে বেঁচে থাকতে,নিজে থেকে মরতে গেলেও যে হাত নাড়তে হবে যার ক্ষমতা ওর নেই,এক্সিডেন্টে ওর একটা হাতও অবশ হয়ে গেছে এক হাতে চলে কোনোরকম,বলতে গেলে এখন ও সত্যিই বোঝা স্বরুপ, মনে মনে প্রায় প্রতিক্ষনে আল্লাহর কাছে মরন চায়, নিজের পাপের অনুশোচনা যে অনেক আগেই ওর মধ্যে ধরা দিয়েছে,কিন্তু সে অনুশোচনা করে এখন আর কোনো লাভ নেই।
চৌধুরী বাড়িতে সবার সফলতার পদকের জন্য আলাদা কক্ষ তৈরি করা আছে,সেখানে আঁখি আদৃতের সফলতার পদকই বেশি শোভা পেয়েছে,দুজন মিলে এতোদিনে বেশ ভালোই নাম কামিয়ে নিয়েছে,সময়ের সাথে ওদের সফলতা বেড়েই চলেছে।
বারান্দার প্রান্ত ঘেষে বসে আছে দুটি প্রেমিক হৃদয়,যুবকের বুকে যে খুঁজে পেয়েছে রমনী শান্তির নীর,এই বুকেই যে আছে জীবনের সকল শুন্যতার পূর্নতা।বাচ্চারা ঘুমিয়ে আছে,প্রিয়সীকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিয়ে চাঁদ দেখতে ব্যস্ত আদৃত,ওর বুকে মাথা রেখে চাঁদের প্রতি দৃষ্টি অটল রেখেছে আঁখিও।পিনপিন নিরবতা কাটিয়ে প্রেমময় ভঙ্গিতে বললো এবার আঁখি।
ড.আদৃত,কখনো কি ভেবেছিলেন জীবন আমাদের এমন পূর্নতা দান করবে?
আদৃত ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি ফুঁটালো যাতে মিশে আছে অসীম প্রাপ্তির রেশ,এবার কন্ঠে ভালোবাসা মাখিয়ে বললো।
যেদিন বিয়ের সাজে তিনবার কবুল বলে আমার জীবনে এসেছিলেন সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম জীবন এখন আমাকে সব দিক থেকে শুধু পূর্নতাই দান করবে,কারন আমার সুখ- দুঃখ,হাসি-কান্না,চাওয়া-পাওয়া সবকিছুর শুরুতেও আপনি আর শেষেও আপনিই,আপনিই আমার পূর্ণতা।
কখনো ছেঁড়ে যাবেন না তো আমাকে?
আপনাকে ছেঁড়ে যেতে হলে শরীর থেকে হৃদয়টাকে বের করে দিতে হবে,নিশ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে,আপনি যে আমার আত্নার সাথে মিশে আছেন,আপনার পিছু তো আমি মরার পরও ছাড়বো না,হাসরের ময়দানেও যে আপনার পাশে আপনার পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো,আমাদের বন্ধন যে জনম জনমের,এই ভালোবাসার শেষ হয়তো কখনোই হবে না, আপনার বসবাস যে আমার মন পিঞ্জরায়,সেখানেই থাকবেন আজীবন।
কথাগুলো শুনে আঁখি আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আদৃতকে,আদৃতও সমতালে জড়িয়ে ধরে ওকে, দুজনেরই মন পিঞ্জরায় আজ শুধু সুখের ভেলা ভাসছে,নেই কোনো তিক্ত টান, নেই কোনো কষ্ট, আছে শুধু অসীম ভালোবাসা একে ওপরের জন্য।
Some love stories never end……………❤️
প্রথমেই দুঃখীত শেষ পার্ট দিতে এতো দেড়ি করার জন্য।উপন্যাসটি শেষ করতে যেয়ে আজ মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেলো,অনেক মায়া জমে গেছে এর প্রতি,এটা আমার জীবনের প্রথম সফলতা,যা আমাকে অনেক কিছু পাইয়ে দিয়েছে,আজ মনে ভয় হচ্ছে এর সাথে না আমি আবার আপনাদের সবার ভালোবাসা হারিয়ে যাই,আগামী গল্পগুলোতেও এভাবে সবার সমর্থন পাবো আশা করছি।