চুলের মুঠি ধরে ঘর থেকে বের করে দিল আমাকে। আমি কিছু বুঝতে পারার আগেই মুখের সামনে দরজাটা বন্ধ করে দিল। প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও এখন বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা ঠিক কি হয়েছে। একজন আশ্রিতার সাথে এর থেকে ভালো ব্যবহার কেই বা করে।
ঘরের ভেতর থেকে আমার মামি চিৎকার করে বলল, এই ফকিন্নির মেয়ে। কোন সাহসে আমার মেয়ের রুমে শুয়েছিস। আর কোনদিনও এদিকে পা বাড়াবি না। মা-বাবার সাথে বন্যায় ডুবে মরতে পারলি না। আপদ আমাদের ঘাড়ে এসে জুটেছিস এখন ঘরবাড়িও দখল করছিস।
মামির কথা শুনে লজ্জায় অপমানে আমার কান্না পেয়ে গেল।
আমি ঝিনুক। গতবছর সিলেটের ভয়াবহ বন্যায় নিজের পুরো পরিবারকে হারানোর পর মামার বাড়িতে আশ্রিত হয়ে আছি। সবেমাত্র এইচএসসি দিলাম আমি। গতকাল আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম জন্য আমার মামাতো বোন স্নিগ্ধা আপি আমাকে নিজের ঘরে এনে রেখেছিল। এখন তাই মামি আমাকে এভাবে ঘর থেকে বের করে দিল।
এই বাড়িতে নানী,মামা ও স্নিগ্ধা আপি শুধুমাত্র আমাকে ভালোবাসে। মামি আমাকে দুচোখে সহ্য করতে পারে না। আমার মামা লন্ডনে থাকে। নানীও অসুস্থতার কারণে শয্যাশায়ী থাকেন অধিকাংশ সময়। স্নিগ্ধা আপিও ভার্সিটিতে। এই সুযোগে মামি আমার উপর অকথ্য অত্যাচার করে। আমাকে দিয়ে বাড়ির সব কাজ করিয়ে নেয়। কাজের লোকের মতো ব্যবহার করে আমার সাথে।
মামি দরজা খুলে আমার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, এখনো এখানে আছিস কেন? যা রান্নাবান্না কর। খাওয়ার সময় তো রাক্ষসের মতো গিলিস। কাজের সময় কেন বলতে হয়?
মামির কথার বিপরীতে কিছু বললাম না আমি। আশ্রিতাদের কথা বলা সাজে না। তাই চুপচাপ কাজে মন দিলাম। রান্নাবান্না শেষ করে, ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিলাম। এমন সময় কলিং বেলের আওয়াজ শুনে বিরক্ত হয়ে যাই আমি। না জানি এই ভরদুপুর বেলা কে এলো।
এসব ভাবনা চিন্তা করে দরজা খুলতে গেলাম আমি। নাহলে তো আবার মামির বকা শুনতে হবে। দরজা খুলেই অবাক হয়ে যাই আমি৷ কারণ মামা ফিরে এসেছে। আমাকে দেখে খুব সুন্দরভাবে হাসে মামা। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চায়, কেমন আছিস ঝিনু?
মামা ছোটবেলা থেকে আমাকে ঝিনু বলেই ডাকে। আমিও মৃদু হেসে মামাকে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছ? তুমি যে আসবে সেটা তো জানাও নি।
আমি তোদেরকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। তাই আগে কিছু বলিনি।
আমি আর বেশি কথা না বাড়িয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালাম। মামা বাড়িতে ঢুকেই মামিকে ডাকাডাকি শুরু করলেন। মামিও মামাকে দেখে আমার মতোই অবাক হয়ে গেছে।
মামা একগাল হেসে মামিকে বলে, এবার আমি দেশে এসেছি একটা ভালো কাজে। যেটা জেনে তুমিও খুশি হবে।
কি কাজে এসেছ?
ঝিনুকের বিয়ে দিতে।
মামি কতটা খুশি হলেন সেটা আমি বুঝলাম না। একদিক দিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিতে পারলে তার ভাষায় “আপদ বিদায় হবে।” কিন্তু আরেক দিক দিয়ে দেখতে গেলে বিনা পয়সার একজন কাজের লোক হারাতে হবে।
তবে আমি বেশ মনযোগ দিয়ে তাদের কথোপকথন শুনতে লাগলাম। যদিও হঠাৎ করে বিয়ের কথা শুনে অবাক হয়ে গেছি তবে এই বাড়ি থেকে বিদায় নিতে পারলে আমি নিজেও অনেক বেশি খুশি হবো।
মামা এবার আমার কাছে আসলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোর রাজকপাল আছে রে ঝিনু। জানিস বিদেশে আমার কোম্পানির যে বস উনি একজন বাংলাদেশী। আমার ফোনে তোর ছবি দেখে তোকে ওনার খুব পছন্দ হয়েছে। তাই নিজের একমাত্র ছেলের সাথে তোর বিয়ে দিতে চায়।
মামার কথা শুনে আমার নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমার মতো একটা সাধারণ মেয়েকে এত বড় মাপের একজন মানুষ পছন্দ করেছে ভেবেই অবাক লাগছে। আমি অনেক খুশি হলাম। কিন্তু আমার এই খুশি বেশিক্ষণ টিকল না।
মামির বোধহয় সহ্য হলোনা যে এত ভালো ঘর থেকে আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। তাই তিনি ফোঁড়ন কে*টে বললেন, ঝিনুক তো এখনো অনেক ছোট। সবেমাত্র ইন্টার পাশ করল। এখনই ওর বিয়ে দেওয়ার কি দরকার? আরো পড়াশোনা করুক আগে।
তুমি এসব নিয়ে ভেবোনা শাহানাজ ওনারা অনেক ভালো মানুষ। বিয়ের পরেও ঝিনুককে অবশ্যই পড়াশোনা করতে দেবে।
মামার এই কথায় মামি যে একটুও খুশি নয় সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি সেসবে কোন মাথা ঘামালাম না। আমার তো শুধু এই বাড়ি থেকে, মামির অত্যাচার থেকে মুক্তি পেলেই হলো।
মামা এবার আমার কাছে এসে জানতে চাইল, বল ঝিনু তুই কি এই বিয়েতে রাজি আছিস?
আমি হ্যাঁ বা না কিছু বলতে যাব তার আগেই মামি বলল, ওর সবেমাত্র ১৭ বছর বয়স। রাজি থাকলেও বিয়ে হবে না। ১৮ এর আগে কেউ বিয়ে করে নাকি?
মামা বিরক্ত হয়ে বলল, আর মাত্র ১৫ দিন পর ঝিনুর ১৮ বছর হয়ে যাবে। তখন আর বিয়েতে কোন অসুবিধা নেই।
মামার কথায় ভরসা পেয়ে আমি বললাম, আমিও বিয়েতে রাজি আছি মামা।
কথাটা বলামাত্রই দেখতে পেলাম মামি আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়েছে। আমার তখন এত কিছু ভাবার নেই। আমার মাথায় একটাই কথা ঘুরছে যে করেই হোক মামীর অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে হবে।
মামা আমার কথা শুনে প্রসন্ন হলেন। আমার গাল টিপে দিয়ে বললেন, ঠিক আছে তাহলে আমি ওনাদের জানাচ্ছি। তোর ১৮ বছরের জন্মদিনে ওরা তোকে দেখতে আসবে৷ তারপর বিয়েশাদির ব্যাপারে ভাবা যাবে।
আমি খুব খুশি হলাম মামার কথা শুনে। যার আর বেশিদিন লাগবে না। আমি বোধহয় খুব জলদি এই নরক থেকে মুক্তি পাবো। সৃষ্টিকর্তাকে অনেক ধন্যবাদ জানালাম।
❤️
বিকেলে স্নিগ্ধা আপি ভার্সিটি থেকে ফিরল। মামার কাছ থেকে আমার ব্যাপারে সব শুনে আমার রুমে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমাকে বলল, মেনি মেনি কংগ্রাচুলেশনস। ড্যাডির কাছে শুনলাম তোর নাকি বিয়ে হতে চলেছে। আমি খুব খুশি। তোর হবু বরের ফোন নম্বর বা এমন কিছু কি আছে তোর কাছে?
আমি বলার মতো কিছু খুঁজে পেলাম না। আসলে বলার মতো কিছু নেই আমার কাছে। কারণ মামার কাছে এসব কিছু নিয়ে প্রশ্ন করিনি। আমার ভাবনা শুধু একটাই যেকোনো ভাবে এখান থেকে চলে যেতে চাই।
আমার নিশ্চুপ দেখে স্নিগ্ধা আপি সব বুঝতে পারল। দৌড়ে চলে গেল মামার কাছে। একটু পর ফিরে এসে বলল, তোর উডবি হাজবেন্ডের ফেসবুক আইডি নিয়ে এসেছি। এই দেখ কত হ্যান্ডসাম দেখতে।
আমি উৎসাহ নিয়ে তাকালাম। একবার তাকিয়ে দেখতেই দেখলাম শ্যামলা গড়নের একজন ছেলে। দেখতে খুব বেশি সুন্দরও না আবার খারাপও না। আমি ভাবলাম আপি কি আমার সাথে মশকরা করছে নাকি?
স্নিগ্ধা আপি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আরে এটা তো অন্য একজনের ছবি। তোর উডবি হাজবেন্ডের বন্ধু মনে হয়৷ দাঁড়া আমি ওনার পিক দেখাচ্ছি।
এরমাঝে মামি স্নিগ্ধা আপিকে ডাক দিল। আপি তড়িঘড়ি করে নিচে চলে গেল। আসলে মামিকে খুব ভয় পায় সে।
স্নিগ্ধা আপি চলে যাওয়ার পর আমি নিজের হবু বরকে নিয়ে কল্পনায় ব্যস্ত হয়ে গেলাম। কখনো বিয়ে-শাদির ব্যাপারে সেভাবে ভাবিনি। আমাদের বাড়ি গ্রামের দিকে ছিল। আমার বাবা একজন সাধারণ কৃষক ছিল তবে আমাদের কোন অভাব ছিল না। বাবা মা আর দুই ছোট ভাইকে নিয়ে আমার সুখের সংসার ছিল। আমার মামাও আগে গ্রামে ছিল। তারপর বিদেশে গিয়ে ভালো চাকরি পেয়ে গেল আর শহরে সেটেল্ড হলো।
গতবছর সিলেটের ভয়াবহ বন্যায় আমার পুরো পরিবারকে আমি হারিয়ে ফেলি। সেদিন রাতে প্রতিদিনকার মতো ঘুমিয়ে ছিলাম সবাই মিলে। ভোররাতের দিকে আচমকা টের পাই ঘরে পানি ঢুকছে৷ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পানির মধ্যে ডুবে যাই। আমি সাঁতার পারতাম। তাই কোনরকমে সাঁতরে বেরিয়ে আসি। আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে একটি শুকনো যায়গায় আবিষ্কার করি। সেইদিনের পর আর পরিবারের কারো খোঁজ পাইনি। তাই ধরেই নিয়েছি সবাই মারা গেছে। মামা আর নানী আমাকে এখানে নিয়ে আসে।
আমি নিজের গলার চেইন আকরে কাঁদতে থাকি। এটা আমার মায়ের দেওয়া। আজকাল মাকে অনেক বেশি মনে পড়ে। মা আমাকে কত আদর করতো। বাবাও কম ভালোবাসত না। ছোট ভাইরা তো আমি বলতে অজ্ঞান ছিল। সবকিছু কেমন এক নিমিষে বদলে গেল৷ জানিনা কি আছে আমার ভাগ্যে।
#চলবে
#মন_দিতে_চাই
#১ম_পর্ব
#লেখনীতে_সুপ্রিয়া_চক্রবর্তী