মনের_অন্দরমহলে পর্ব ৭

0
2488

#মনের_অন্দরমহলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৭

মনের_অন্দরমহলে অজানা শিহরণ বইছে আমার মনে। এক অদ্ভুত অনুভূতি! মৃদু বাতাসে অনুভূতিটা প্রগাঢ় হচ্ছে। কানে বার বার আয়াশের বলা একই কথা বাজছে,
–“মায়ের পর আমার বুকে তোমার স্থান নিশাপাখি!!”

অদ্ভুত সুন্দর ছিল কথাটি। নারী হিসেবে কথাটি আমার মন অবধি ছুঁয়ে ফেলেছে। যা অতি ভয়াবহ ব্যাপার। কারো কথা মন ছুঁয়ে ফেললে সেই মানুষটার কথা ভালো লাগে। সবসময় তার কথা শুনতে ইচ্ছে করে। মন বলে, ‘ইশশ….যদি আরেকবার সে এই কথাটা বলে!’ এটা কীসের লক্ষণ জানা নেই। জানতেও চাই না। হৃৎস্পন্দন জানান দিচ্ছে সেও কথাটি শুনে ভীষণভাবে অস্থির হয়ে পড়েছে। ছুটে চলেছে দ্রুত গতিতে।

–“আমার মা জন্মান্ধ হওয়ায় মায়ের হাজার চিকিৎসা করেও লাভ হয়নি। নানাভাইয়ের অঢেল সম্পত্তি টাকা-পয়সা থাকা সত্ত্বেও দৃষ্টি ফিরে আমার মা। দেশ-বিদেশের ডক্টরের সঙ্গে আলাপ করেও সকলেই হতাশ হয়েছিল নানুভাই। কিন্তু তুমি চিন্তা করবে না নিশাপাখি। আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমার আই স্ট্রান্সফরমেশন করিয়ে নেব। দেখতে পাবে তুমি। আমাকে দেখতে পাবে। ততদিনে আমি তোমার হাজবেন্ড হয়ে যাব।”

আমি চুপ করে আয়াশের কথা শুনছি। খুব আগ্রহের সঙ্গেই শুনছি। আয়াশকে বিয়ে করার ইচ্ছে আমার ছিল না এখনও নেই। সুতরাং, উনার টাকা দিয়ে নিজের দৃষ্টি ফেরালে আমার আত্মসম্মানে আঘাত লাগবে। গলা খাঁকারি দিয়ে শান্ত কন্ঠে বললাম….
–“আপনার টাকায় নিজের দৃষ্টি ফেরানোর কোনো মানে হয় না।”

–“কেন?”
ক্রুদ্ধ হয়ে প্রশ্ন করলেন আয়াশ। আমি খানিকটা আঁতকে উঠে আমতা আমতা করে বললাম…..

–“এটা তো অনেক টাকার ব্যাপার তাই বলছিলাম। আর আই ট্রান্সফরমেশন করিয়ে নেব বললেই তো হয় না। আমার জানা মতে অনেক নিয়ম আর ঝামেলা থাকে। কেউ চোখ দান না করলে কি করে অপারেশন হবে?”

–“সেসব নিয়ে চিন্তা করবে না। সব দায়িত্ব আমার। এখন এসব কথা বাদ দাও। শুধু কালকের বিয়ের কথা ভাবো বুঝলে?”

আমি মুখে জড়ো হাসি ফুটিয়ে তুললাম। আমার তো হাসিই পাচ্ছে না। বিয়ের কথা ভাবলে হাত-পা কাঁপছে। টুংটাং শব্দে নড়েচড়ে বসলাম আমি। মনে চলছে ঝড় কিন্তু হাবভাবটা এমন করতে হচ্ছে যেন আমার কিছুই হয়নি। আয়াশ সুর তুলতে তুলতে আমার উদ্দেশ্যে বললেন……
–“একটা গান গাইবে?”

–“আমি গান পারি না।” (থতমত খেয়ে)

–“নাকি গাইতে চাও না? মিথ্যে বলছো কেন? আমি প্রথম যেদিন তোমায় দেখেছিলাম সেদিন তুমি গানই গাইছিলে। মুখরিত ছিল সেই পরিবেশ। আজ বলছো গাইতে পারো না?”

আয়াশের রাগান্বিত গলায় ভয়ে গুটিশুটি মেরে বসে রইলাম। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ভাবতে লাগলাম কি করা যায়। দুই লাইন গেয়ে দিলে খুব একটা ক্ষতি হবে না। কিছু বলতে উদ্যত হতেই আয়াশ বললেন…..
–“আমার একটা শখ হচ্ছে আমি হারমোনিয়ামে সুর তুলব আর তুমি গাইবে। যেদিন তোমায় গান গাইতে দেখেছি প্রথমবার সারারাত কানে শুধু তোমার সেই গানের কন্ঠ বেজেছে। বালিশ দিয়ে চেপে ধরেও শান্তি পাইনি। সেদিন এই ইচ্ছে পুষেছি যে তুমি গাইবে আর আমি সুর তুলব।”

–“ঠিক আছে গাইছি।”

কাঁপা কাঁপা গলায় একটা গান ধরলাম আমি।
–“তুই হাসলি যখন! তোরই হলো এই মন।
তুই ছুঁলি যখন! তোরই হলো এই মন।
দুচোখে আঁকছে শীত। বাহারি ডাকটিকিট।
দুচোখে আঁকলো শীত। বাহারি ডাকটিকিট।
আলসে রোদের চিঠি পাঠালো পিয়ন।
তুই ছুঁলি যখন! তোরই হলো এই মন।”

গানটি গাইতে গাইতে নিজের মুখে হাসির রেখা চলে এসেছে তার আমার নিজেরই জানা নেই। পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম আমি আয়াশকে নিয়ে ভয়াবহ কিছু ফিল করছি যা আমার ফিল করা উচিত নয়। তাকে গানের প্রত্যেকটা অক্ষরে অক্ষরে খুঁজেছি। তাকে নিয়েই যেন গানটি ছিল আমার। এসব হওয়া অনুচিত। কারণ আমাদের দুজন দুইরকম। কারো সঙ্গে কারো মিল হওয়া উচিত নয়। আর উনার সেই পাগলামি আচরণ আমি কি করে ভুলে যাচ্ছি?

আয়াশ আমার কোমড় ধরে নিজের কাছে টেনে নিতেই দম যেন আঁটকে এলো আমার। নিজের হাতের মুঠো শক্ত করে নিজের জামা চেপে ধরে ফেললাম। আমার কপালে আলতো ঠোঁটের ছোঁয়া দিতেই ঠোঁটজোড়া হা হয়ে এলো আমার। উনি মুখে ফুঁ দিতেই আমি হা বন্ধ করে ফেললাম। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেও যেন আমি নিতান্তই কোনোদিক থেকে ভীষণ দুর্বল। আয়াশ শীতল কণ্ঠে বললেন….

–“গানটা কি আমাকে নিয়ে ছিল?”

–“জানি না।”
শ্বাসরুদ্ধকর কন্ঠে বলে দিলাম। আয়াশের মৃদু হাসির আওয়াজ এলো। আমার কানের নিচে এক হাত দিয়ে আমায় আলতো ভাবে চেপে ধরে বললেন….

–“আই নো গানটা আমার জন্যই ছিল। তোমার কন্ঠ আর চেহারা এই কথায় বলছে। তাছাড়া, তোমার গানে ছুঁয়ে দেওয়ার কথা ছিল না? আমি ছাড়া কে তোমায় এতো গভীরভাবে ছুঁয়েছে হু? নীলাদ্র স্পর্শ করেনি তো? করেছে নাকি এতো গভীর স্পর্শ? বলো?”

নিজেই নীলাদ্রের প্রসঙ্গ তুলে নিজেই ক্রমশ রেগে যাচ্ছেন উনি। আমি উনাকে রাগাতে না চাইলেও নিজে থেকে রেগে যাচ্ছেন। কিছু কিছু মানুষের সেকেন্ডের সেকেন্ডে রাগ না করলে পেটের খাবার হয়ত হজম হয় না। আয়াশও তেমনই একজন মানুষ। উনাকে শান্ত করানোর জন্য বললাম…..
–“না। আপনি ভুল ভাবছেন।”

–“সত্যি ও তোমায় টাচ করেনি?”

–“না।”
বলেই শ্বাস ছাড়লাম আমি। আসলেই নীলাদ্র আমার কাছে আসার সুযোগ পায়নি কখনো। হাতটা অবধি সীমাবদ্ধ ছিল। ও নিজে থেকেই আমার সুবিধা-অসুবিধা বুঝে নিতো। আয়াশের কথায় নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলাম আমি।

–“জানো, সেদিন দূরবীনে আঁটকে গেছিলে তুমি। এক হাসিতে আহত করেছিলে আমায়। ক্ষত-বিক্ষত করছিলে আমার হৃদয়কে। যেই আমি সেদিন জুহায়ের কে মন বলে কিছুই নেই বলেছিলাম সেই আমি প্রথমবার অনুভব করলাম আমার মন কোথাও উপস্থিত আছে। আর সে ভীষণভাবে তোমাকে চাইছে। তোমার উড়ে যাওয়া চুলগুলো যখন তোমার মুখে পড়ছিল তুমি যেমন বিরক্ত হচ্ছিলে আমিও তেমন খুশি হচ্ছিলাম। তোমার বিরক্তিমাখা চেহারাতেও ছিল এক অন্যরকম সৌন্দর্য। মুখ থেকে এক উদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করেছিলাম তা হলো, মায়াবিনী! মায়া দিয়ে পরিপূর্ণ তুমি। যেই মায়া গ্রাস করেছে আমায়। একবারের জন্যও মনে হয়নি তুমি অন্ধ। যখন জানলাম তুমি অন্ধ তখনই মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। মনটা জানালো তোমাকে না পেলে সে শান্ত হবে না কিছুতেই। এমন অস্থির আমি কখনো হইনি। কখনো না। তুমি আমায় ছেড়ে যাবে না তো নিশাপাখি?”

আমার হাত নিজের হাতে মুঠোবন্দি করেন আয়াশ। আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছে। শেষ প্রশ্নে জবাব খুঁজছি মনে মনে। কি বলব? আমি উনার সঙ্গে থাকতে পারব না? যদি এটা বলি তাহলে নতুন কোনো ঝড় বয়ে নিয়ে আসবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মিথ্যে বলব? কি করে মিথ্যে বলব ভেবে পাচ্ছি না।

–“বলো আমায় ছেড়ে যাবে না!” (ঝাঁকুনি দিয়ে)

–“হুমম যাবো না।”

আমার কথায় যেন আশ্বস্ত হলেন উনি। চলে গেলেন খাবার আনতে। তখন তো আমায় খাওয়াতে পারেননি। আমি ‘না’ বলা সত্ত্বেও আমায় বেডে এনে বসিয়ে দিয়ে চলে গেলেন বাইরে। ফিরে এসে খাইয়ে দিয়ে পাশের ঘরে আমায় নিয়ে এলেন আয়াশ।

–“রাত অনেক হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়া দরকার তোমার। আদারওয়াইজ, কাল স্টেবল থাকতে পারবে না। বিয়েতে খুব বেশি লোক থাকবে না। যত লোক আসবে তোমার ওপর নজর দিবে। এটা তো হতে পারে না। আমি শুধু তোমার ওপর নজর দেব। বাট একটা স্ট্রেস তো হবেই। ঘুমিয়ে পড়ো।”

আয়াশের কথা শুনে বললাম…..
–“আর আপনি?”

–“আমি এইতো বসে আছি। ল্যাপটপ আর দরকারি কাগজপত্র এনেছি এখানে কেস নিয়ে স্টাডি করব। তোমায় ডিস্টার্ব করব না প্রমিস।”

আমি শোয়া থেকে তড়িৎগতিতে উঠে বসলাম। চোখজোড়া বড়সড় হয়ে এলো আমার।
–“আপনি এই ঘরে থাকবেন কি করে?”

–“কেন থাকব না? আমার বাড়িতে এমন কে আটকাবে?”

আয়াশ কথাগুলো এমনভাবে বললেন যেন উনার কাছে বিষয়টা স্বাভাবিক। আমার মনের কথা যেন কোনোভাবে বুঝে গেলেন উনি। আশ্বাস দিয়ে বললেন…..
–“আরে বাবা তোমার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাবো না সম্পর্ক লিগ্যাল না হওয়া অবধি। চিন্তা করছো কেন? আমাকে চেয়ার বা সোফা দিলেই হবে।”

–“না। আপনি এই ঘরে থাকতে পারেন না। বোঝেন না কেন? আপনি থাকলে আমি ঘুমাতে পারব না। আর কোনোভাবে বাইরের কেউ যদি জেনে যায় একই ঘরে বিয়ের আগে আছি ওরা কি ভাববে? ছি!”
বিষয়টা কোনো বিশ্রী হবে ভাবতেই গা গুলিয়ে এলো আমার। মুখ হাত দিয়ে ঢেকে নিলাম।

–“কিন্তু তুমি যদি পালিয়ে যাও?”

মুখ থেকে হাত সরালাম আমি। এতোটা অবিশ্বাস নিয়ে কে ভালোবাসে? এই কথাটাই তো মিলাতে পারছি না। মা বলে, যে তোকে ভালোবাসবে সে তোকে অঢেল বিশ্বাসও করবে।
কিন্তু আয়াশের আচরণে অন্যকিছু মনে হয় আবার। বিরক্তি নিয়ে বলি……

–“এতোটা অবিশ্বাস করেন কেন আমায়?”

–“ভয় হয়। মায়ের মতো তুমিও পালিয়ে গেলে?”

হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম আমি। ইনিয়েবিনিয়ে বললাম…..
–“পালাবো না। একা একা আমি কি করে পালাবো? আপনিই বলুন। নিশ্চিন্তে যান। গিয়ে স্টাডি করবেন নাকি ঘুমাবেন তাই করুন। হয়ত লোকের কথায় আপনার কিছু যায় আসবে না তবে আমার সম্মান ধুয়ে যাবে।”

আয়াশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল…..
–“আমি যাচ্ছি। চোখ বুঁজে ঘুমিয়ে পড়ো ওকে? হ্যাভ এ সুইট ড্রিম।”
আচমকা আমার চোখের পাতায় চুমু খেতেই ফ্রিজড হয়ে গেলাম। কপাল কুঁচকে বিরক্ত হতে চেয়েও বিরক্তিটা মন থেকে এলো না। আয়াশের দরজা লাগানোর শব্দ পেয়েই উঠে বসলাম। বিরক্তিটা বার বার কমে যাচ্ছে কেন?

রাত কয়টা বাজে জানা নেই। বিয়ে আটকানোর চিন্তায় ঘুম চোখের পাতায় আসছেই না। একবার উঠছি এবার শুয়ে পড়ছি। সব মিলিয়ে নিজের ওপরই বিরক্ত আমি। মনটা পিছুটান দিচ্ছে বারবার। ভেবেছি অনেককিছু কিন্তু সফল হবো কিনা জানি না। তার আগে ঘুমটা দরকার। এই ভেবে শুয়ে পড়লাম চাদর মুড়ি দিয়ে। হালকা টেম্পারেচারে এসি চলছে। ঠান্ডা পরিবেশে সবে চোখটা লেগে এসেছে। ঠকঠক আওয়াজে আবার হালকা হয়ে এলো আমার ঘুম। চোখের পাতা মেলে কান পাতলাম ভালো ভাবে। এই রাতে সকলে ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা। আবার ঠকঠক আওয়াজ হতেই চুল ওপরদিকে ঠেলে উঠে বসলাম আমি। আয়াশ এলেন নাকি আবার? কিন্তু ভেতরে দরজা সামনের দিকে। তবে আওয়াজ অন্যদিক থেকে আসছে। মনে হচ্ছে বেলকনি থেকে আওয়াজ আসছে। ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম।

আওয়াজটা বন্ধ না হওয়ায় ধীর পায়ে সাবধানে বিছানা থেকে উঠে এগিয়ে গেলাম। দরজায় কান লাগিয়ে দিলাম। মনে হচ্ছে কেউ ফিসফিসিয়ে আমার নাম ডাকছে।
–“আনিশা?”

কোনো পুরুষের গলা। মিলিয়েও মেলাতে পারছি না।
–“আনিশা প্লিজ দরজাটা খোলো। তোমার হেল্পের জন্য এসেছি। প্লিজ!”

মনে হচ্ছে কোনো চেনা কেউ। এই ভেবে কাঁপা কাঁপা হাতে লকটা খুলে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত চেপে ধরতেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। জোরে চিৎকার দিতে উদ্যত হলেই আমার মুখটাও কেউ চেপে ধরল। ধীর গলায় ক্লান্ত কন্ঠে কেউ বলল…..
–“প্লিজ চিৎকার করো না। আমি অর্ক!!”

চলবে……

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here