মনের_অন্দরমহলে পর্ব ৫৬

0
2044

#মনের_অন্দরমহলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৫৬

থম মেরে আধশোয়া রয়েই রয়েছেন আয়াশ। ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছেন। পানির ঝাপ্টা এসে পড়ছে উনার গায়ে। উনার বুকে লেপ্টে এখনো শার্টের কলার ধরে উনার ওপর আধশোয়া হয়ে রয়েছি আমি। আয়াশের চোখের পলকও পড়ছে না। না রয়েছে নড়াচড়া। আমি এখনো চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছি। দুজনই দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি শুধু আমার দৃষ্টিটা অভিমানের এবং উনার দৃষ্টি বিস্ময়ের। এতোক্ষণেও উনার নড়াচড়া না দেখে খানিকটা ঘাবড়ে গেলাম আমি। কি হলো উনার? ঠিকঠাক আছেন তো? কলার থেকে হাত সরিয়ে উনার গালে হাত রেখে ঝাঁকিয়ে বললাম,

–“এই? কি হলো আপনার? আপনি ঠিক আছেন?”

আয়াশ এবার আমার দিকে ইশারা করে নিজের গলা দেখিয়ে বললেন,
–“বাইট হেয়ার!”

–“হোয়াট?”
চরম বিস্ময় নিয়ে তাকালাম এবার আমিও। আয়াশ আবারও গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন,
–“এখানে বাইট করো! রাইট নাউ।”

ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম আমি এবার। এই লোকটা কি অবশেষে এক ধাক্কায় পাগল টাগল হয়ে গেল? এক ধাক্কায় মাথার তার ছিঁড়ে টিরে গেল? মাথায় প্রশ্নের বোঝা সইতে না পেরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম আমি। তৎক্ষনাৎ ঝড়ের গতিতে আমার কোমড়ে নিজের শক্ত হাতটা রেখে নিজের সঙ্গে আরো চেপে ধরলেন আয়াশ। রাগে কটমট করে বললেন,
–“এখান থেকে উঠলে খবর আছে।”

আমি কি কথা শোনার পাত্রী? না একদম না। উনার হাত খামচে, চিমটি কেটে ওঠার চেষ্টা করলাম। লাভের লাভ কিছুই হলো না। বাংলায় পাঁচের মতো মুখখানি করতেই আয়াশ বললেন,
–“তুমি কি ভেবেছো? আমায় প্রথমে ধাক্কা মেরে ফেলতে পেরেছো বলে তোমার শক্তি বেড়ে গেছে? নেভার। তখন রেডি ছিলাম না তোমার ভয়ানক কার্যকলাপের জন্য। তাই পড়ে গেছি। এখন প্রশ্নটা হলো তুমি কি সত্যিই আমায় ধাক্কা মেরে ফেলেছো নাকি আমি পড়ে গিয়ে তোমার কথাগুলো কল্পনায় শুনেছি?”

–“কল্পনা মানে?”

–“মানেটা হলো এই যে আমি কি স্বপ্ন দেখছি এখনো? যদি দেখে থাকি তাহলে আমায় জাগিয়ে দাও। নয়ত এবার স্বপ্নের ঘোরে সেন্স হারিয়ে ফেলব নিশ্চিত!”

সন্দিহান হয়ে তাকালাম উনার মুখের দিকে। পানিতে ভিজে চুপসে গেছেন উনি। চেহারায় বেড়েছে এক অন্য ধরনের লাবণ্য। আহা…মানুষটা এতো সুন্দর কেন? নাকি আমার চোখে একটু বেশিই সুন্দর? ভালোবাসি বলে? ভাবনা থেকে বেরিয়ে বললাম,
–“তার জন্য আমায় কি করতে হবে?”

–“বাইট হেয়ার! আই সেইড দ্যাট।”
রাগের চোটে গলায় দাঁত বসিয়ে দিলাম আমি। স্বপ্ন কোন দিক মনে হয় উনার। মাথা উঠিয়ে দেখি উনি স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। একটা বড় শ্বাস নিয়ে বললেন,

–“মানুষের বাইট ছিল নাকি পিঁপড়ের বাইট বোঝা গেল না।”

গাল ফুলিয়ে তাকাতেই আমার কানের পাশ থেকে চুল সরিয়ে উনি ফিসফিস করে বললেন,
–“ভালোবাসো এই মাছ বিক্রেতা আই মিন সেলফিশকে?”

শিহরন বয়ে গেল আমার সারা অঙ্গে! খামচে ধরলাম উনার শার্ট। আয়াশ মুচকি হেঁসে তাকিয়ে বললেন,
–“তুমি তো আমার থেকেও ডেঞ্জারাস! আমার থেকেও বড় সেলফিশ! জেলাসি সব লুকোনো কথা বের করে দিল?”

লজ্জায় তাকাতে পারছি না আমি। নখ খুঁটছি আয়াশের বুকে। উনি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন,
–“এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না একটা মেয়ে যে কিনা ভালোবাসার কথা বলতে বললে লজ্জায় পালিয়ে যেতো সেই মেয়ে নিজে থেকে এসে গুন্ডিদের মতো লাইক লেডি ডনের মতো শার্টের কলার ধরে হুমকি দিয়ে বলল ‘ভালোবাসি’ হাউ ইজ ইট পসিবল। আমার এখনো মনে হচ্ছে আমার ঘুমের মধ্যে আছি। নেশার মধ্যে আছি। যদি তাই হয় তুমি প্লিজ আমাকে জাগিয়ে দাও। যদি সেটা না হয় তাহলে আবারও নিজের মনের কথা উজাড় করে দাও!”

বলেই চোখ বুঁজলেন আয়াশ। একধ্যানে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ঢক গিললাম আমি। দুরুদুরু মন নিয়ে এগিয়ে গেলাম উনার দিকে। কানের কাছে যেতেই আমার গালের সাথে উনার গাল লেগে গেল আমার। অতি ধীর গলায় বললাম,
–“প্রায় এক বছর ধরে লুকিয়ে ভালোবেসেছি একজনকে। আমিও নিজেও বুঝিনি যে এটা ভালোবাসা ছিল। তার ভালোবাসা দেখে আমি তাকে ভালোবেসেছি। তার এই সুন্দর স্বার্থপরতা দেখে আমি ভালোবেসেছি। এতো বড় স্বার্থপর মানুষ আমি দেখিনি। ভালোবাসি আপনাকে।”

আমার দিকে নিভু নিভু চোখে তাকালেন উনি। চোখে সেই রাজ্যের স্নিগ্ধতা! আমি উনার বুকে মাথা রেখে নিজের বুক লুকিয়ে ফেললাম। অনুভব করলাম উনি আমায় ধরে উঠে বসছেন। তবুও আমার হেলদোল হলো না। এবার উনার চোখে তাকানো মানে আমি মরে যাব। তার থেকে ভালো তাকাবো না। আয়াশ আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলেন নিজের সঙ্গে। সন্ধ্যার খোলা আকাশ, অর্ধ চাঁদ, সন্ধ্যাতাঁরা, এই বিস্তৃত সমুদ্র এবং সমুদ্রের উতলে পড়া ঢেউ সবকিছু সাক্ষী হলো এই সুন্দর মূহুর্তের। থেমে যদি যেতে এই ভালোবাসাময় মূহুর্ত তাহলে কি খুব ক্ষতি হতো?

–“তুমি হয়ত নিজের অনুভূতি বুঝতে পারো নি। কিন্তু আমি আমার কথামতো তোমার কর্মকান্ডে বুঝে নিয়েছি তুমি আমায় ভালোবাসো। তোমার অনুভূতিরা হয়ত তোমার আগে আমায় জানান দিয়েছে তোমার মনের কথা।”

মাথা উঠিয়ে তাকালাম আয়াশের কথায়। হতবিহ্বল হয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
–“তাহলে, আপনি আমায় বাড়ি এনে ডিভোর্সের কথা বললেন কেন?”

আয়াশ ঠোঁট টিপে হাসলেন। চোখ টিপ দিয়ে বললেন,
–“যদি এই মিষ্টি কন্ঠ থেকে ভালোবাসি শব্দটা না-ই শুনতে পারি তাহলে আমার সার্থকতা কোথায়? তাই তোমায় সকল অস্বস্তি কাটাতে এবং তোমার অনুভূতি প্রকাশ করাতে আমায় এই ছোট্ট নাটক টা করতে হলো। তাছাড়া তুমি কি ভেবেছিলে? আমি ডিভোর্সটা হতে দিতাম? নেভার! তুমি যদি নিজের কথাগুলো নাও বলতে তাহলেও আমি তোমায় দিনশেষে এখান থেকে প্রথমবার যেমন তুলে নিয়ে গেছিলাম ঠিক তেমনই তুলে নিয়ে যেতাম। আমি এতোটা উদার মনের নয় নিশাপাখি। আগেও বলেছি। যা আমার চাই তা চাইই চাই। ব্যাপারটা যদি আমার নিশাপাখির হয় তাহলে সবটা উজাড় করে হলেও চাই।”

–“আর মৃ…মৃধা?”

–“ওহ দিস গার্ল! হ্যাঁ এটা ঠিক আমায় কেসের জন্য এখানে আসতে হয়েছে। কয়েকদিন পর মিসেস. মালিহা, রক্তিম বাহাদুর আর নীলাদ্রকে কোর্টে চালান করা হবে। তার জন্য কিছু প্রুফ দরকার আছে। আর কক্সবাজারের পুলিশ স্টেশনে যোগাযোগ করতে। এই কক্সবাজারেও যে ওই বাহাদুরের বেশ কিছু কুকর্মের রাজত্ব আছে সেটা আমি জানি। আর বিরুদ্ধে আমি নিজে কেস নেব। তাই কেসের সূত্রে মৃধাও এখানে এসেছে। আর বার বার তোমায় ফোনে মৃধার কথা বলছিলাম না? আসলে তখন আমি রুমে শুয়ে ছিলাম আর তোমার কল আসা দেখছিলাম। আর মৃধা বিকেলে খবর পায় যে ওর মণিমা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ওকে ইমিডিয়েটলি যেতে হবে। আমি ফোন এখানে আনিনি। তাই বিষয়টা জানাতে ও এখানে আসে খুঁজতে খুঁজতে। তুমি এতটুকুই দেখেছিলে। আর গুন্ডির রুপ ধারণ করেছিলে।”

বলেই ফিক করে হেঁসে দিলেন আয়াশ। চক্ষু চরকগাছ এবার। ভনভন করে ঘুরছে মাথা। দাঁতে দাঁত চেপে তাকালাম উনার দিকে। অতঃপরই কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম,
–“আপনি একটা ঠকবাজ লোক। আমার জন্মদিনে আমাকে কাঁদাতে লজ্জা লাগল না? মায়া নেই আপনার মনে।”

–“আচ্ছা একটা কথা বলো। যদি এই কান্নাটা না করতে তাহলে কি এই সুন্দর মূহুর্ত আসতো? মাঝে মাঝে কান্না করতে হয় সুখের জন্য। আর আমি যে তোমার মুখে শুধু ‘ভালোবাসি শোনার জন্য চাতক পাখির মতো চেয়ে বসে ছিলাম? তার বেলায়? মুখ থেকে তো এতটুকু কথা বলতে গিয়ে যতবার হোঁচট খেয়েছো!”

–“জীবনে কাউকে এসব বলিনি তো। তাই তো বার বার হোঁচট খেয়েছি।”

–“আর কাউকে বলতেও হবে না। আমাকে ছাড়া।”

আমি উনার দিকে তাকালাম। উনি মৃদু হাসছেন। আজকের হাসিটা একটু বেশিই প্রাণবন্ত! কেন? আমার মুখ থেকে ‘ভালোবাসি’ শুনতে পেয়ে? ইশশ… তাহলে কত কষ্টটাই না দিয়েছি উনাকে। আমিও বড় মাপের বোকা। সামান্য একটা কথা বলতে এতো সময় লাগিয়ে দিলাম?

এবার উঠে দাঁড়ালাম আমরা। চারিদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে। আচমকা আয়াশ আমায় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
–“ইউ নো হোয়াট? বার্থডে টা তোমার। গিফট পাওয়ার কথাও তোমার। কিন্তু ঘটল উল্টোটা। আমি অনেক বড় গিফট পেলাম।”

আমি মুচকি হাসলাম। এটাও আমার কাছে অনেক বড় উপহার। যেটা আমি দ্বিধা ও দ্বন্দ্বে বলতে পারছিলাম না সেটা হঠাৎ করেই প্রকাশ করে দেওয়া উপহার স্বরূপ নয় কি?

সমুদ্রের পাড়ে বসে আছি আমরা এখনো। আয়াশের কাঁধে মাথা রেখে সমুদ্রের ঢেউ উপচে পড়া দেখছি। চাঁদের হালকা আলোতে চিকচিক করছে সমুদ্রের পানি। আমার হাতে আইসক্রিমের প্যাকেট। তাও আবার দুটো। দুইহাতে দুটো প্যাকেট নিয়ে বসে থেকে একবার ডানহাতের আইসক্রিমে কামড় বসিয়ে যাচ্ছি আর একবার বাম হাতের আইসক্রিমে। আয়াশ আমায় হালকা ধমকে বললেব,
–“ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার। একে তো ভিজে গেছো তার ওপর আইসক্রিম।”

–“দ্যাটস ইউ পানিশমেন্ট মি. রায়হান! আপনি আমার সাথে নাটক করেছিলেন না? এটা নাটক করার শাস্তি। তাছাড়া আমার জন্মদিন হিসেবে তো আমার এতটুকু ইচ্ছে আপনার পূরণ করায় উচিত তাই না?”

আয়াশ কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। ভেতরে ভেতরে রেগে যাচ্ছেন উনি সেটা বুঝতেই পারছি। আমি দাঁত কেলিয়ে আইসক্রিম খেয়ে যাচ্ছি। এক পর্যায়ে আইসক্রিম শেষ করে উনার দিকে তাকালাম। উনার কাঁধ জড়িয়ে বললাম,
–“শুনুন?”

–“হুমম?”

–“ভালোবাসি! এই বাজে, অসভ্য লোকটাকে ভালোবাসি। বড্ড ভালোবাসি।”
কথাটুকু বলা মাত্র একটুখানি বেহায়াপনা দেখিয়ে ফেললাম আমি। উনার গালে নিজের আইসক্রিম মাখা ঠোঁট দিয়ে চুমু খেয়ে বসলাম। গালে হাত দিলেন আয়াশ। ঘাড় ঘুড়িয়ে আমার দিকে তাকাতেই আমি উঠে ছুট লাগালাম। পেছনে তাকানোর সাহস হলো না আমার।

পরেরদিন…
রুদ্র হসপিটাল এসেছে অনেকক্ষণ। রাউন্ড দিয়ে নিজের কেবিনের দিকে আসছে সে। আসতে আসতে তার খেয়াল হলো আজকে আশেপাশে সিয়াকে দেখতে পেলো না। এখনো কি আসেনি মেয়েটা? কাল তো তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করেই চলে গেছিল ছুটি নিয়ে। আজকেও কি আসবে না? দম ফেলে ভাবনাচিন্তা না করে কেবিনের দিকে পা বাড়ায় রুদ্র। সিয়াকে একবার কল করা দরকার। কেবিনে ফোনটা রেখে এসেছে। হসপিটালের করিডোর পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতেই সে কয়েকটা ওয়ার্ডবয় এবং নার্সকে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখতে পায়। এটা তার কাছে নতুন কিছু নয়। প্রতিদিনই ইমারজেন্সি পেশেন্ট ভর্তি হয় এখানে। আজও হয়ত তাই। এটা ভেবে সে আনমনে হেঁটে যায় সেদিকেই। ডক্টরকেও তো দরকার সেখানে। আর রুদ্র সবসময় ইমারজেন্সি পেশেন্টকেই সামলায়। এবারও ব্যতিক্রম হলো না।

সামনে এগোতেই তার চোখে পড়ে স্ট্রেচারে আনা একটা মেয়েকে। আঁতকে ওঠে সে। অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
–“স…সিয়া…!”

চলবে….

[বি.দ্র. আজকের পর্বে শেষ হলো না ?। কালকের পর্বে শেষ হবে। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আর গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবতার সঙ্গে তুলনা করবেন না। ছোট পর্ব দেওয়ার জন্য দুঃখিত।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here