মনের মানুষ শেষ পর্ব

0
1044

#মনের_মানুষ
#সুচন্দ্রা_চক্রবর্তী
#সপ্তম_পর্ব(অন্তিম_পর্ব)

প্রায় কয়েকমিনিটের মধ্যেই চলল গুলি।কিন্তু সেই গুলি হেমন্তর বুকে লাগল না,লাগল অস্মিতার পিঠে।অস্মিতা তাড়াতাড়ি সরিয়ে দিতে গিয়েছিল হেমন্তকে,আর তাতেই ঘটল অঘটন।গুলি লাগল এসে অস্মিতার পিঠে।লুটিয়ে পড়ল অস্মিতা হেমন্তর বুকে।হেমন্ত দু’হাতে অস্মিতাকে তুলে ছুটল হসপিটালে।
দুস্কৃতিগুলো ছুটে পালিয়ে গিয়েছে ততক্ষণে।অস্মিতাকে যখন বেডে শুইয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল অপারেশন থিয়েটারে,গোলমালে অস্মিতার চুল এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল,সরে গিয়েছিল সিঁথিও,আর সিঁথি সরে গিয়ে সিঁদুর দেখা যাচ্ছিল,আর এই সিঁদুর হেমন্তর চোখ এড়ায়নি,সে শুধু অস্ফুটে বলে উঠল, ‘অস্মি,আজও?’

অস্মিতা কোমায় চলে গেল।খবরটা শুনে ভীষণভাবে ভেঙে পড়লেন সুমিত্রা।বললেন, ‘আমি বেশি কিছু বলব না হেমু,শুধু এটুকুই বলব,তোকে যখন শ্যুট করতে এল গুন্ডাগুলো,দুটো মেয়েই উপস্থিত ছিল সেখানে,একজন আগ্নেয়াস্ত্র দেখেই ভয়ে জায়গা ছেড়ে পালিয়েছে,আর আরেকজন আজ হাসপাতালে কঠিন লড়াই করছে,যে লড়াইয়ে হেরে গেলে সে তার স্যারের কাছে চলে যাবে।অবশ্য তোর বাবা বোধহয় এটাই চান।ইহলোকে তো আর মেয়েটা কষ্ট,অসম্মান ছাড়া আর কিছুই পেল না,হয়ত পরলোকে গিয়ে ওর স্যারের কাছে আদরে,যত্নে থাকবে!’ কান্নায় গলা বুজে আসে সুমিত্রার।

কেটে গেছে প্রায় সাত-আটটা মাস।প্রাঞ্জলসহ গুন্ডাবাহিনী ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে।আর অস্মিতা আজও অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে হসপিটালের বেডে।সুমিত্রা,হেমন্ত যতবারই জিজ্ঞেস করেছেন ডাক্তারকে, ডাক্তারবাবু বলেছেন, ‘হয়ত বা উনি বাঁচার ইচ্ছেটুকু হারিয়ে ফেলেছেন,আর সুস্থ জীবনে ফেরার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না…..’
সবটা শুনে অস্মিতার কাছে এসে কেঁদে পড়েছিলেন সুমিত্রা, ‘আমি কি কেউ নই মা তোর জীবনে?হেমুই সব হল রে?’
কেটে গেল আরও দু-আড়াই মাস।গোধূলি লগ্নে যখন অস্তগামী সূর্যের আলোয় রাঙা হয়ে উঠল আকাশ,ফাগুনের রঙ মেখে বন হয়ে উঠল পলাশের আগুনে রাঙা,তখনই বিয়ের পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে হেমন্ত এল জ্ঞানহীন অস্মিতার কাছে,কোমায়।সাথে সিঁদুরের কৌটোটাও ছিল,কৌটোটা বের করে এক চিলতে সিঁদুরে রাঙিয়ে দিল সে অস্মিতার সিঁথি,তারপর বলল, ‘আজকের দিনটায় তুমি এইভাবে শুয়ে আছ?আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী অস্মি,আজকের দিনে তোমায় সিঁদুর পরাব না,তা কি হয় বলো প্রিয়তমা?বুঝেছি,তুমি অবাক হচ্ছ তো?ভাবছ হেমন্তদা তো কোনোদিন আমায় ভালোবাসেইনি,তাহলে আজ এসব কি?হ্যাঁ অস্মি,তুমি যেদিন সুস্থ ছিলে,সেদিন আমি তোমায় ভালোবাসিনি,তোমায় চিনেও চিনতে পারিনি, দূরে সরিয়ে দিয়েছি,কিন্তু আজ আমার সবটা ভুল ভেঙেছে।আমি জানি অস্মি,নিশ্চয়ই তুমি ভাবছ স্বরলিপির কি হল?অস্মি,লিপি চেঁচিয়ে বলত,যে ও আমায় নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে,কিন্তু জানো,যেই বন্দুক হাতে কিছু লোককে ও সেদিন এগিয়ে আসতে দেখল,আমার কথা এতটুকুও না ভেবে ও চম্পট দিল নিজেকে বাঁচানোর জন্য!আমি তবু কিচ্ছুটি মনে করিনি জানো অস্মি,কিন্তু দিন দিন ওর দুর্ব্যবহার মাত্রাছাড়া হতে শুরু করল।সপ্তাহে তিন দিন আমি দেখতে আসি তোমায়,তাতেও ও রাগারাগি করে,বিরক্ত হয়।যে ওর ভালোবাসার মানুষটিকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে এগিয়ে এসেছে,পরোয়া করেনি মৃত্যুভয়কেও,তার প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধা,কৃতজ্ঞতাবোধটুকুও ওর নেই।অস্মি,অকৃতজ্ঞ মানুষ নিয়ে আমি চলতে পারব না সারাটাজীবন,তাই বারবার ওকে বলেছিলাম নিজের এই স্বভাব শুধরে নিতে,কিন্তু না!দিনে দিনে ওর আক্রমণাত্মক মনোভাব ক্রমশ বাড়তে লাগল,শেষে নিজেই সরে গেল আমার জীবন থেকে।কি বলব অস্মি,ব্রেকাপ হলে মানুষ ডিপ্রেশনে চলে যায়,আমি যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।ভাবলাম,যাক,একজন টক্সিক মানুষ চলে গেছে আমার জীবন থেকে।উপলব্ধি করলাম,হীরে ছেড়ে একটা চকচকে কাচের পেছনে ছুটেছি এতদিন আমি।আসলে আমার বাবার চোখ ছিল জহুরির চোখ,তাই আমি ভুল করলেও তিনি ভুল করেননি আসল রত্ন চিনে নিতে।’ একটু থামল হেমন্ত,তারপর অস্মিতার হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘আই লাভ ইউ অস্মি,আই লাভ ইউ সো মাচ!হয়ত কথাটা বলতে বড্ড দেরি করে ফেললাম,কিন্তু আমি জানি অস্মি তুমি তোমার হেমন্তদার কথা শুনতে পাচ্ছ,আমার হাতের উষ্ণ ছোঁয়া অনুভব করতে পারছ!’ চোখের জল মুছে হেমন্ত চলে গেল।
পরেরদিন সকালেই সুমিত্রার ফোনটা বেজে উঠল।যে ডাক্তারবাবুর তত্ত্বাবধানে আছে অস্মিতা,তাঁর ফোন এসেছে।তাড়াতাড়ি গিয়ে ফোনটা ধরলেন সুমিত্রা, ‘হ্যালো ডাক্তারবাবু,বলুন।’
— ‘ম্যাডাম,আপনার বৌমা কাল রাতেই রেসপন্স করছিল একটু একটু,আজ তার জ্ঞান ফিরেছে একটু আগে,আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন!’
হেমন্ত আর সুমিত্রার আনন্দ আর ধরে না।হসপিটালে গেলেন তাঁরা তাড়াতাড়ি।ডাক্তারবাবু বললেন, ‘জ্ঞান ফিরেছে,উনি ঘুমোচ্ছেন এখন।’
হেমন্ত মনে মনে বলল,’আমি জানতাম অস্মি তুমি ফিরবে,তোমায় যে ফিরতেই হত,নইলে মিথ্যে হয়ে যেত দুজনের ভালোবাসা।’
প্রায় তিন চারদিন পর অস্মিতাকে নিয়ে যাওয়া হল বাড়িতে।অস্মিতা এখন পুরোপুরি সুস্থ।সুমিত্রা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হেমু তো শুধু নিয়মমাফিক সিঁদুরটুকু পরানো ছাড়া আর কিছুই করেনি,তবু এত ভালোবাসিস আমার ছেলেটাকে?’
— ‘তুমি ভুল করছ আন্টি’,অস্মিতা গম্ভীর গলায় বলল,’আমি স্যারকে শেষ সময়ে কথা দিয়েছিলাম,ওঁর ছেলেকে ভালো রাখব,যত্নে রাখব,তাই সেই কথাটা রাখতে….’
— ‘সেই কথাটা রাখতেই তুই ওকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবনের কথাটুকুও ভাবিসনি,এটাই বলবি তো?ওরে বোকা মেয়ে,তোর দ্বিগুণের চেয়েও বেশি বয়স আমার,তোর মনের কথাটুকু আমি বুঝব না?’
— ‘আন্টি না গো,আমি সত্যি বলছি,হেমন্তদাকে আমি কোনোদিনও ভালোবাসিনি,আজও বাসিনা।’
— ‘এসব তোমার অভিমানের কথা অস্মি।যাকে তুমি ভালোইবাসোনা,তার সাথে ডিভোর্সের পরও সিঁদুর কেন পরতে তুমি?’ হেমন্ত বলল।
— ‘ওটা একটা অভ্যাস মাত্র।’
— ‘অস্মি মা’, অস্মিতার মাথায় হাত বুলিয়ে সুমিত্রা বললেন, ‘ছেলেটা যেদিন থেকে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে,প্রচন্ড অপরাধবোধে ভুগছে,ভালো করে খাচ্ছে না,ঘুমোচ্ছে না,শুধু সারাদিন আনমনা হয়ে বসে আছে আর তোর ছবি দেখছে।ওর ভুলের শাস্তি ও যথেষ্ট পেয়েছে মা,আর ওকে দূরে সরিয়ে দিসনা,কাছে টেনে নে ওকে!’

আজ ব্যানার্জীবাড়িতে অনুষ্ঠান।অস্মিতা আর হেমন্তর আবার বিয়ে হবে আজ।

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here