গল্প:-#মনের_মহারাণী
লেখিকা:-#Sohani_Simu
পর্ব:-২৯+৩০
আজকে বাবা আসবে বলে সকাল থেকেই বাসায় উৎসব মুখর পরিবেশ। আম্মুরা কিচেনে ব্যস্ত।কাজের লোকগুলো ড্রইংরুম ঝাড়া মোছার কাজ করছে।উর্মি আপুও আজ উপর থেকে নিচের রুমে শিফট হচ্ছে।প্রেগন্যান্ট অবস্থায় বার বার উপর নিচ করতে আপুর প্রবলেম হচ্ছে।তাই কাজের লোক দিয়ে নিচের একটা রুমে আপুর সব জিনিসপত্র আনিয়ে নেওয়া হচ্ছে।ওদিকে প্রীতি আপু আবার কাজের সময় হাতে মেহেদি লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।ঢং দেখলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।উমান এখন বাসায় নেই সেজন্য প্রীতি আপুকে পাত্তা দিচ্ছিনা,যা খুশি করুক। আমি আম্মুর রুমে বসে একটু পড়াশুনা করছি কারন কয়দিন ধরে ঠিকমতো পড়াশুনা করছিনা দেখে আম্মু খুব বকছে।
সকাল দশটা বাজে।বিছানায় বালিশ ছাড়া চিৎ হয়ে শুয়ে মুখের উপর বই রেখে চোখ বন্ধ করে মনে মনে বায়োলোজি পড়া মুখস্থ বলছিলাম।হঠাৎ মাথায় কারও হাতের স্পর্শ পেয়ে মুখের উপর থেকে বই সরিয়ে দেখি দাদি।ব্যস্ত হয়ে উঠে বসে বললাম,
‘দাদি আপনি…।
দাদি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েছেন।হয়তো ভেবেছিলেন আমি ঘুমিয়ে গিয়েছি।দাদি হঠাৎ কোন কথা খুঁজে পেলেন না।আমিও বড়দের সাথে কথা বলতে কেমন যেন লজ্জাবোধ করি।আম্মু এজন্য বকাবকি করলেও বাবা বলে একসময় ঠিক হয়ে যাবে।ছোটবেলা থেকে এদের সবাইকে কাছে পেলে আমার একটুও লজ্জা করত না।হঠাৎ করে এতগুলো আত্মীয়স্বজন পেয়ে কোথাও একটা জড়তা রয়ে গিয়েছে।তবে সময়ের সাথে সাথে সব জড়তা কেঁটে যাবে।যেমন আগে উমানকে যতটা ভয় পেতাম এখন ততটা ভয় আর পাইনা আর পটর পটর কথাও বলতে পারি আগের চেয়ে অনেক বেশি।দাদি বিছানার ধারে বসে বললেন,
‘আপনি নয় তুমি বলিস।নাতি-নাতনি সবাই আমাকে তুমিই বলে।’
আমি নম্র কন্ঠে বললাম,
‘ঠিক আছে দাদি।’
দাদি বিছানায় পরে থাকা আমার এলোমেলো বই গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তুই এবার কোন ক্লাসে?’
আমি কোন ক্লাসে পড়ি দাদি সেটা জানে তারপরও বললাম,
‘ক্লাস টেন।’
দাদির ভেতর কেমন যেন একটা অস্থিরতা।কিছু একটা বলতে চেয়েও বলছে না।আমিও কিছু বলছিনা।কিছুসময় পর দাদি আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোর কি মনে হয় তোর বাবা আজকে আসবে এই বাসায়।’
স্বাভাবিকভাবেই বললাম,
‘হ্যাঁ উম ভাইয়াকে তো বলেছে আমাদের নিতে আসবে।’
বলতে বলতে আমার মন খারাপ হয়ে গেল কারন বাবা যদি আমাদের ঢাকায় নিয়ে যায় তাহলে উমানের সাথে আর থাকা হবেনা।উমানকে রেখে ঢাকায় গেলে অনেক খারাপ লাগবে।দাদি আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তোর বাবা তোর কথা খুব শোনে তাইনা?’
আমি মুচকি হেসে বললাম,
‘বাবার কাছে যেটাই নিতে চাই বাবা সেটায় এনে দেয়।একবার জানো কি হয়েছিল?’
দাদি শোনার জন্য কৌতূহলি হয়ে বলল,
‘কি হয়েছিল?’
আমি সামনে থেকে বইপত্র ঠেলে সরিয়ে বললাম,
‘আমি একবার বাবার সাথে খেলনা কিনতে গিয়েছিলাম।দোকানের বাইরে একটা মেয়ের হাতে খেলনা পেঙ্গুইন দেখে আমার ওটাই পছন্দ হয়েছিল।তারপর বাবাকে বললাম ওটা নিব।বাবা ওই মেয়ের বাবা-মার সাথে কথা বলে অনেক রিকুয়েস্ট করেও ওরা ওটা আমাকে দিবেনা বলছিল।তখন বাবা….।
এটুকু বলতেই উমান দরজার কাছে এসে ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
‘মিতি,শোন,আয়,আয়,তাড়াতাড়ি আয়।’
আমি উমানের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘কেন?কি হয়েছে?’
উমান বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘উফ্ আয় না,দাদির সাথে পরে কথা বলিস।’
আমি দাদির দিকে তাকালাম।দাদি কিছু না বলে গম্ভীর মুখ করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।উমান আর দাদির সম্পর্ক খুব একটা ভাল দেখিনা।দাদি উমানকে কিছু না বললেও উমান দাদিকে অনেক কথা শুনান।সেজন্য দাদি উমানকে খুব একটা ঘাটায়না।দাদি যেতেই আমি বিছানা থেকে নেমে উনার কাছে গিয়ে বললাম,
‘কি হয়েছে?’
উমান মুচকি হেসে আমার একহাত ধরে বললেন,
‘বলছি চল।’
বলেই উনি হাঁটা দিলেন।ড্রইংরুম দিয়ে যাওয়ার সময় কিচেনের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,
‘আন্টি?আম্মু?মিতিকে নিয়ে আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।’
আম্মুরা কিচেন থেকে শুনতে পাবেনা।আশেপাশে থাকা কাজের লোক শুনেছে তাতেই চলবে।উমান আমাকে নিয়ে গাড়িতে বসে আমার সিটবেল্ট বেঁধে দিতে লাগলেন।আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
উমান মুচকি হেসে বললেন,
‘গেলেই দেখতে পাবি।’
উনি কিছুতেই বলতে চাইছেন না।গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গেইটের কাছে এসে নানুকে দেখেই গাড়ির জানালায় উঁকি দিয়ে হাত নাড়িয়ে বললাম,
‘না…নু,টাটা!!’
নানুও হাসতে হাসতে হাত উঠালো।উমান গাড়ি থামায়নি তাই নানুর সাথে আর কথা হল না।প্রায় আধ ঘন্টা পর সাদা রঙ করা একটা বাসার সামনে এসে গাড়ি থামলো।উমান গাড়ি থেকে নেমে আমাকে নিয়ে বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজাতেই শিপন ভাইয়া এসে দরজা খুলে দিলেন।আমি উনাকে দেখেই অবাক হয়ে বললাম,
‘ভাইয়া আপনি এখানে? আপনাকে তো আমি বাসায় দেখে আসলাম।’
শিপন ভাইয়া উল্টো দিকে ঘুরে বাসার ভেতর যেতে যেতে বললেন,
‘এটা কিন্তু তুই পুরো ঢপ মারলি।কাল রাতে তোর সাথে একবার দেখা হয়েছিল তারপর আর হয়নি।’
আমি উমানের সাথে উনার পেছন পেছন যেতে যেতে বললাম,
‘অহ হ্যাঁ কাল রাতের পর তো আপনাকে আর দেখিনি।আমি ভেবেছিলাম আপনি ওই বাসাতেই আছেন।’
শিপন ভাইয়ার পেছন পেছন একটা রুমে আসলাম।এটা একটা স্টাডি রুম।সাদ ভাইয়া একটা প্লেটে বিভিন্ন রকম খাবার জিনিস নিয়ে চেয়ারে বসে খাচ্ছেন।উমান আর শিপন ভাইয়া সাদ ভাইয়ার পাশে গিয়ে বসলেন।আমি দাঁড়িয়ে থেকে ভ্রু কুচকে বললাম,
‘আমরা এখানে কেন এসেছি?’
উমান ওয়েফারের মতো বিস্কুটে কামড় দিয়ে বললেন,
‘বলছি আয় এখানে।’
কয়েকধাপ হেঁটে গিয়ে উনার পাশে দাঁড়ালাম।উনি আমাকে পাশের চেয়ারে বসিয়ে আমার মুখে সন্দেশ গুজে দিয়ে বললেন,
‘এটা আমাদের ফুপ্পির বাসা।চাচ্চু আর ইমরুল আঙ্কেল বিকেলের দিকে এই বাসায় আসবে।তোকে যে জন্য ডাকা হয়েছে সেটা ভাল করে মন দিয়ে শোন।খুবই সিম্পল কথা কিন্তু কাজটা আবার খুবই কঠিন।’
আমি উনার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বললাম,
‘কি কাজ?বাবা এখানে কেন আসবে?’
সাদ ভাইয়া বললেন,
‘তোদের নিতে।’
শিপন ভাইয়া বললেন,
‘তোর কিন্তু আজকে অনেক বড় একটা কাজ করতে হবে।’
উমান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘তুই চাচ্চুকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাবি,এ্যাট এনি কস্ট।’
আমি সবার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘আমি নিয়ে যাব কেন?বাবা তো এমনিই যেতে চেয়েছে।’
উমান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘যেতে চায়নি।বাসায় আমি মিথ্যে বলেছি।এখন তোকে সেই মিথ্যেটাকে সত্যি করতে হবে।চাচ্চু ওই বাসায় কখনও না যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে।তুই চাচ্চুকে জোর করে নিয়ে যাবি।যদি না পারিস তোকে কিন্তু…..’
উনি আমাকে শাসাচ্ছেন।আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
‘না পারলে কি?’
উমান আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন,
‘না পারলে তোকে বাদ দিয়ে প্রীতিকে বিয়ে করব।’
কিঞ্চিত রাগ নিয়ে বললাম,
‘আর যদি পারি?’
উমান মুচকি হেসে কানেকানে বললেন,
‘পারলে তোকেই বিয়ে করব আর অনেক আদরও করব।’
‘আমি চেঁচিয়ে বললাম,
‘লাগবেনা আদর আমার অন্য কন্ডিশন আছে।’
শিপন ভাইয়া আর সাদ ভাইয়া মুচকি হাসছেন।উমানের ফিসফিস করে বলা অর্ধেক কথা ফাস করে দিয়েছি তাই উনি কপাল ডলতে ডলতে কি যেন বিরবির করলেন।তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আচ্ছা বল কি তোর কন্ডিশন?’
উনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,
‘আমাদের সাথে আপনাকেও ঢাকায় নিয়ে যাব।’
উমান ডান হাতের তিন আঙুল দিয়ে আমার কপালে ধাক্কা দিয়ে বললেন,
‘গাধি।’
আমি ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকালাম।উনি কিছু একটা ভেবে মুচকি হেসে বললেন,
‘ওকে ডান।তুই চাচ্চুকে আমাদের বাসায় যদি একদিন রাখতে পারিস আমি তোর সাথে ঢাকায় যাব,রাজী?আর যদি না পারিস আমি যেটা বলেছি সেটায় করব। ‘
দ্রুত বললাম,
‘রাজী রাজী,ঠিক আছে।’
উনারা সবাই হো হো করে হাসলেন।আমি মুখ ফুলিয়ে মনে মনে ভাবলাম ঠকে গেলাম নাতো?উমান হাসি থামিয়ে সাদ ভাইয়া আর শিপন ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘রান্না-বান্না কিছু করবি নাকি না খেয়ে থাকব দুপুরে?ক্ষুধা লেগেছে ইয়ার কিছু নিয়ে আয়।’
সাদ ভাইয়া ঝাল চানাচুরের প্যাকেট ছিড়ে বললেন,
‘ওই বাসায় কত ভাল ভাল রান্না হচ্ছে আর তুই এখানে খাবি?পারবোনা রান্না করতে।’
শিপন ভাইয়াও মুচকি হেসে বললেন,
‘হুম দুপুরে ওই বাসায় গিয়ে খাব আমরা।’
উমান আমার হাত ধরে রুম থেকে বেড়িয়ে এসে কিচেনে এসে ফ্রিজ থেকে আপেল বের করে খেতে লাগলেন।আমি ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।উনি আমার দিকে আপেল এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘খাবি?’
‘না।’
‘কি খাবি?কেক দিব?’
উল্টো দিকে ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে বললাম,
‘কিছু খাবনা,ফুপ্পির বাসা একটু ঘুরে দেখি।আচ্ছা আপনি আমাকে ফালতু একটা কথা বলার জন্য এতদূর নিয়ে আসলেন?’
উনি আমার পেছন পেছন আসতে আসতে বললেন,
‘ফালতু কথা??এটা অনেক সিরিয়াস,তুই বোকা তাই বুঝতে পারছিস না।চাচ্চু ওই বাসায় কিছুতেই যেতে চাইবেনা।ত্যাজ্যপুত্র বুঝিস?চাচ্চুকে ত্যাজ্য করা হয়েছে।দাদুর যত সম্পদ আছে সবকিছু থেকে বঞ্চিত।’
আমি পেছন ফিরে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘আমার বাবার অনেক টাকা আছে,আপনাদের টাকা-পয়সা আমাদের লাগবেনা।’
উনি পাশেই একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে আপেল খেতে খেতে বললেন,
‘কচু আছে।তোর বাবার কিছু নেই।আমাদের কতকি আছে জানিস?আচ্ছা শোন,চাচ্চুকে কিভাবে রাজী করাবি?প্ল্যান কি?’
আমি ঠোঁট উল্টে ভাবুক হয়ে বললাম,
‘বাবাকে বলব দাদুর বাসায় কয়েকদিন থাকবো।’
‘তাহলেই থাকবে?’
‘না থাকলে অনেক জেদ করব।’
উমান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললেন,
‘জেদ করলে হবেনা।জেদ করলে যদি হতো তাহলে আমিই পারতাম।জোর করে যদি হতো তাও পারতাম কিন্তু ওসব করলে আগের চাচ্চুকে পাওয়া যাবেনা।তাই আমাদের যা করার মন থেকে করতে হবে।সবসময় আবেগে নাড়া দিতে হবে বুঝেছিস?’
উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘হুম।বাবা আসলে বাবাকে একটুও জোর করবনা।এমনি ওই বাসায় যাওয়ার জন্য বলবো।’
‘বলবি,অনেকবার বলবি কিন্তু একটু আবেগ নিয়ে বলবি।যেমন আমার ওখানে থাকতে ভাল লাগছে,সবাইকে ছেড়ে থাকতে ভাল লাগবেনা,এখানে না থাকলে দাদি খুব কষ্ট পাবে,দাদু তো কষ্ট পেতে পেতে মারাই গিয়েছে,নানু-নানিরাও অনেক কষ্ট পায়।শেষ বয়সে এসে এরা আর কত কষ্ট পাবে?এসব বলে বুঝাবি ওকে?’
আমি মাথা নাড়ালাম।হঠাৎ খেয়াল করলাম কথা বলতে বলতে আমরা ছাদে চলে এসেছি।উমানের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললাম,
‘আমরা ছাদে কেন আসলাম?উফ্ কি গরম এখানে!’
উমান চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে গ্রীল করার জন্য শিক আর উনুন নিয়ে নিচে নেমে আসলেন।আমি উনার পেছন পেছন আসতে আসতে বললাম,
‘আপনি এই দুপুরবেলা গ্রীল করবেন?বাসায় যাব কখন?’
উমান আমাকে কিছু না বলে সাদ ভাইয়া আর শিপন ভাইয়াকে ডাকলেন।বাসায় আম্মুরা কত মজার মজার খাবার রান্না করছে সেসব রেখে এখন এসব পোড়া মাংস খেতে হবে।আর উনারা রান্নায় এত পটু কেন?একটু কিছু হলেই উল্লাসে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
চলবে………..
★মিতির ব্যাপারে কিছু কথা……..
গল্পের শুরুর দিকে খেয়াল করলে দেখবেন বাবা-মাকে হারিয়ে মিতি অন্যরকম ছিল।তখন তার চিন্তা ছিল তাকে বড় হতে হবে আর ছোট বোনটারও দায়িত্ব নিতে হবে।তারপর মিতি যখন দেখলো সে আর একা নয় বাবা-মা আছে তখন তার সব চিন্তা-ভয়-দায়িত্ব শেষ হয়েছে।যতই দিন যাচ্ছে সে আবার আগের মতো হয়ে যাচ্ছে।গল্প পড়ে আপনারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আগের মিতি তার বাবা-মার অনেক আদরের মেয়ে ছিল।সারাজীবন একটা ছোট্ট পরিবারে এমন আদরে বড় হওয়া ম্যাচিউরনেস না থাকা একটা মেয়ে একটু আল্হাদি হবে না?
★আরেকটা প্রশ্ন…..মিতি উমানকে কেন বুঝেনা?
মিতি কি বুঝবে???
উমান ছোট মেয়েকে বিয়ে করেছে।যা বুঝার উমানকে বুঝতে হবে।অনেক মেয়ে বয়সের তুলনায় বেশি পেকে যায়।মিতি সেই টাইপের মেয়ে নয়।
★সাইলেন্টদের বলেছিলাম রেসপন্স করতে।
যাইহোক,সাইলেন্ট থেকে প্রমাণ করে দিয়েছেন আপনি সাইলেন্ট।নিজের মান রেখেছেন।
গল্প:-#মনের_মহারাণী
লেখিকা:-#Sohani_Simu
পর্ব:৩০
বাবা আসার পর থেকে দাদির বাসায় যাওয়ার জন্য আমি বাবার সাথে ঘ্যানঘ্যান করছি।বাবার এক কথা।ওখানে কিছুতেই যাবেনা।আমার ঘ্যানঘ্যানানিতে সবাই বিরক্ত।উমানের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে উনি সবচেয়ে বেশি বিরক্ত।উনি আমার দিকে যেমন করে তাকাচ্ছেন মনে হচ্ছে উনি বলছেন ‘তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না,গাধী একটা’।
সবাই ড্রইংরুমের সোফায় বসে আছি।সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তাও বাবাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারছিনা।মনে মনে ভাবছি কি করা যায়।আমি আসলে সবাইকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে আমি যদি বাবাকে কিছু বলি বাবা সেটা কখনও ফেলবেনা তাই উমানের শিখিয়ে দেওয়া কথাগুলো এখনও বাবাকে বলিনি।আমি এবার সেসব বলার আগেই উমান বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘দাদির জন্য হলেও তোমাকে এবার যেতে হবে।দাদি খুব অসুস্থ।’
বাবা গম্ভীর হয়ে উমানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আমি ছেলে হয়ে উনার সুস্থতা কামনা করছি। কিন্তু তুই আমাকে ওই বাসায় যেতে বলিস না প্লিজ,আমি যাবনা।’
উমান সামনের সোফা থেকে উঠে এসে বাবার অন্যপাশে বসলেন।একটু অশান্ত হয়ে বললেন,
‘দাদুর শেষ ইচ্ছা ছিল তোমাকে একবার চোখের দেখা দেখবে,দেখা হল না।দাদির অবস্থাও ভাল না।নানুও মুক্তি চায়।বয়স হয়ে গিয়েছে,আর কত?তুমি গিয়ে না বললে হয়তো চাকরি ছাড়বেনা।কোন একদিন দেখা যাবে দরজাতেই মরে পরে আছে।ওদেরকে একবার সুযোগ দাও।থাকতে হবেনা ঘুরে আসো গিয়ে একবার।’
এবার ইমরুল আঙ্কেলও কথা ধরলো।একে একে সাদ ভাইয়া,শিপন ভাইয়াও।বাবা আর না করলো না।যাওয়ার জন্য মত দিল।আমরা সবাই একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললাম।বাবা পকেট থেকে ফোন বের করে আম্মুকে কল দিল।আম্মু কল রিসিভ করতেই বাবা গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘মোহনা,মিনিকে নিয়ে রেডি হয়ে থাকো আমরা আজই ঢাকায় যাব।’
আম্মু কি বলল শুনতে পেলাম না।বাবা কল কেঁটে উঠে দাঁড়ালো।কালো ব্লেজারটা হাতের ভাজে নিয়ে উমানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘চল।’
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে তাই আমরা দ্রুত ফুপ্পির বাসা থেকে বেড়িয়ে আসলাম।গাড়িতে উমান আর সাদ ভাইয়া সামনে আর আমরা বাকিরা পেছনে বসেছি।দ্রুত ড্রাইভ করার জন্য আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই দাদির বাসায় চলে আসলাম।গেইটে নানুকে দেখেই উমান গাড়ি থামিয়ে দিলেন।সবাই গাড়ি থেকে নেমে আসলাম।আমি দৌঁড়ে গিয়ে নানুর এক হাত ধরে দাঁড়িয়ে বাবার দিকে তাকালাম।বাবা শিপন ভাইয়ার হাতে ব্লেজারটা ধরিয়ে দিয়ে নানুর সামনে এসে দাঁড়ালো।নানুকে সালাম করে বলল,
‘কেমন আছো চাচা?’
নানু কাঁপা কাঁপা হাতে বাবার বুকে কাঁধে হাত বুলিয়ে সিক্ত কন্ঠে বললেন,
‘বুলবুল?এসেছিস?আমার ছোটন বাবা?আমার ছোটন?’
বলতে বলতে নানু কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন।বাবা সাদ ভাইয়াকে বলল নানুকে বাসায় দিয়ে আসতে।সাদ ভাইয়া গেটের পাশে দাঁড়ানো দুটো লোককে বলতেই উনারা এসে নানুকে ধরে নিয়ে গেলেন।নানুর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ডক্টর লাগানো লাগবে।গেইট থেকে বাসা প্রায় হাফ কি.মি. দূরের রাস্তা।আমরা বাকি পথ হেঁটেই গেলাম।বহু বছর পর বাবা নিজের বাসায় পা রাখলো কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে প্রতিদিন যাওয়া-আসা করে।দাদি,বড়াব্বু-বড়াম্মু,ফুপ্পি,আম্মু সবাই কান্না করছে কিন্তু বাবার চোখে এক ফোটাও পানি নেই।আমি আগেও কোনদিনও বাবার চোখে পানি দেখিনি।এতটা বছর আপনজন ফেলে বাবা ছিল কেমন করে!!আমি কখনও পারবোনা।
মিনি বাবার কোলে চড়ে আছে।বাবা দাঁড়িয়ে থেকে সবার সাথে কথা বলছে।আমি বাবার হাত ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে উমানের পাশে এসে দাঁড়ালাম।উমান দুইহাত পকেটে ঢুকিয়ে খুশি হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছেন।আমি উনার হাত ঝাকিয়ে বললাম,
‘দেখলেন তো বাবা চলে আসলো?’
উমান আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
‘তোর বাবা যে কত বড় খেলোয়ার তুই জানিসনা।দেখ কখন যেন বেঁকে বসবে।’
বলতে বলতেই বাবা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘আমার কারও উপর কোন রাগ অভিমান নেই।আমি কোনদিন কাউকে ত্যাজ্য করিনি তাই আবার নতুন করে শুরু করারও কোন মানে নেই।আমি আগে যেমন মায়ের ছেলে ছিলাম এখনও তেমনই আছি আর ভবিষ্যতেও থাকবো।ভাই-বোনের সাথে আমার সম্পর্ক কোনদিন খারাপ ছিলনা,সামনের দিনগুলোতেও খারাপ থাকবেনা।আমি চাই সবকিছু যেমন চলছিল তেমনই চলুক।আমি আমার কাজের জায়গায় ফিরতে চাই।মেয়েটারও লেখাপড়ার ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।আমাদের ঢাকায় ফিরতেই হবে।’
উমান আমার একহাত চেপে ধরে ব্যস্ত হয়ে বললেন,
‘তুই যাবি না বল।এখনই বল চাচ্চুকে।’
আমি ভ্রু কুচকে বললাম,
‘কেন বলব?আমি বাবার সাথে যাব।আপনিও যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু।’
উনি ভ্রু কুচকে বললেন,
‘তুই চাচ্চুকে আনতে পারিসনি।আমরা এনেছি।তোর কন্ডিশন কেন শুনবো?তুই আমার কথা না শুনলে আমি প্রীতিকেই বিয়ে করব। ‘
উমানের সাথে ঝগড়া শুরু করে দিলাম।অন্যদিকে আমাদের চলে যাওয়ার কথা শুনে বাবাকে সবাই আটকাচ্ছে।ওইদিকে হৈ চৈ ভালই হচ্ছে।উমান আমার কাঁধ জড়িয়ে ধরে মুচকি হেসে সামনের দিকে হাঁটা দিলেন।বাবার সামনে এসে থেমে আমাকে ছেড়ে দিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে কাঁচুমাচু করতে করতে বললেন,
‘চাচ্চু,আমি না তোমাকে না জানিয়ে একটা কাজ করে ফেলেছি।’
সাদ ভাইয়া ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন,
‘এই উম,না এখন নয়।’
উনি আমাদের বিয়ের কথা বলবেন মনে করে আমিও ভয় পেয়ে গিয়েছি।বাবা যদি অনেক রেগে যায় সেজন্য।বাবা মিনিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলল,
‘কি কাজ?’
উমান কিছু বলার আগেই আমি গিয়ে আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম।সাদ ভাইয়া উমানের পাশে দাঁড়িয়ে উমানের একবাহুতে হাত রেখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘তেমন কিছু নয়।ওই কানাডা যাওয়া নিয়ে,এখন নয় পরে তোমাকে সব বলব।’
উমান সাদ ভাইয়ার হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘আরে ইয়ার ভয় পাচ্ছিস কেন?চাচ্চু কিছু বলবেনা।চাচ্চু শোন,আমি না মিতিকে এখানকার স্কুলে টিসি করিয়ে নিয়েছি।’
চোখ খিঁচে বন্ধ করে ছিলাম উনার কথা শুনে ফট করে চোখ খুললাম।স্বস্তির শ্বাস ফেললাম আমি আর সাদ ভাইয়া।বাবা এখনও কিছু রিয়েকশন দেয়নি।আমি গিয়ে বাবার পাশে দাঁড়ালাম।বাবা আমাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে আমার মাথায় চুৃুমু দিয়ে উমানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘টিসি ক্যান্সেল করিয়ে দে।আর কি করেছিস?আমার ল্যাব ঠিক আছে তো?’
উমান মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন,
‘আরেকটা কাজও করেছি।’
বাবা ভ্রু কুচকে বলল,
‘আবার কি করেছিস?’
সাদ ভাইয়া আবার উমানের হাত ধরেছেন।আমি বাবার শার্ট খামচে ধরে ভীত চোখে উমানের দিকে তাকালাম।উনি মুচকি হেসে বললেন,
‘টরেন্টোর একটা স্কুলে মিতির জন্য এ্যাপল্পিকেশন করেছি।ওখানে এস.এস.সি সিস্টেম নেই।একদম ডিগ্রী নিয়ে বের হবে।’
বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘অহ ভয় পাইয়ে দিয়েছিস একদম।ভেবেছি ল্যাব উল্টে-পাল্টে ফেলেছিস।আমার প্রিন্সেস কে তো আমি এ্যাবরোড পাঠাবোই তবে এখন নয়,বড় হোক আগে।’
সাদ ভাইয়া বললেন,
‘মামা,উম তোমাকে না জানিয়ে এত বড় বড় কাজ করল তাও তুমি রেগে গেলেনা!’
বাবা আমার মাথা হাত বুলিয়ে সাদ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘নিজের থেকে বেশি ভরসা করি তোদের।ভুল কিছু করবিনা জানি।এখানকার স্কুলে টিসি নেওয়ার কারন কি হতে পারে?উম মিতিকে রাজশাহীতে বিপদমুক্ত রাখতে চেয়েছিল।’
সাদ ভাইয়া ফট করে বললেন,
‘হ্যাঁ ঠিক ধরেছো।মাঝখানে সিচুয়েশন খারাপ দেখে উম মিতিকে বিয়েও করে নিয়েছে,তুমি প্লিজ ওকে কিছু বলনা।’
সবাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছে আর উমান বিস্ফোরিত চোখে সাদ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন।উনি ধারণাও করতে পারেননি সাদ ভাইয়া বাবাকে বলে দিবেন।আমিও ধারণা করতে পারিনি কারন সাদ ভাইয়া নিজে এতক্ষণ উমানকে আটকাচ্ছিলেন।শুকনো মুখ করে একবার বাবার দিকে আরেকবার উমানের দিকে তাকাচ্ছি।চারপাশ কেমন থম মেরে আছে।কারো নিঃশ্বাসের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে।কেন এত নীরবতা!!তবে কি এটা ঝড় শুরুর পূর্ব লক্ষণ!!
চলবে……….
লিখতে ইচ্ছে করছিল না জোর করে লিখলাম।রি-চেইক করা হয়নি।