মনের মহারাণী পর্ব ১১+১২

0
768

গল্প:-#মনের_মহারাণী
লেখিকা:-#Sohani_Simu
পর্ব:১১+১২

নাসির ভাইয়াদের বাসা থেকে ফিরছি।নির্জন রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে।রাস্তার দুধারে কাশফুলের গাছ।এখন শরৎকাল নয়,বর্ষাকাল তাই কাশফুল নেই।চোখে পরার মতো শুধু কাশফুলের এই সবুজ প্রান্তর আর ঘন কালো মেঘে ঢাকা আকাশ।যেকোন সময় বৃষ্টি নামবে।ইতিমধ্যে বাতাস শুরু হয়েছে।কাশফুলের গাছগুলো হাওয়ায় দুলছে।আমি ফ্রন্ট সিটে বসে নিস্তেজ হয়ে সিটে হেলান দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি।জানালার কাচ বন্ধ করে গাড়িতে এসি দেওয়া আছে।বাইরে বাতাস দেখে উমান এসি অফ করে জানালা খুলে দিলেন।আমি ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকালাম।উনি মুখে হাসি ঝুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ফ্রেশ এয়ার ইজ গুড ফর হেল্থ।’

আমি মুখ ভেংচিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।উনি সামনের দিকে তাকিয়ে রাগী কন্ঠে বললেন,

‘বাট ইউ!!’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিরক্ত কন্ঠে বললেন,

‘গুড ফর নাথিং।’

আমি উনার দিকে চোখ কটমট করে তাকালাম।মনে মনে দুচারটে গালি দিয়ে রাগী মুখ করে বললাম,

‘আপনিই গুড ফর নাথিং।অপদার্থ,ফালতু,গুন্ডা একটা!!’

উনি মুচকি হেসে বললেন,

‘আর কি?’

আমি বুকে হাত গুজে মুখ ফুলিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।অনেক রেগে আছি।নাসির ভাইয়াদের বাসায় থাকতে চেয়েছিলাম উনি থাকতে দিলেননা।নিষাদ ভাইয়ার সাথে তো দেখায় হল না।উফ্ কতদিন দেখিনি নিষাদ ভাইয়াকে!নিষাদ ভাইয়া সেই যে ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার ওর আমাদের বাসায় মিষ্টি নিয়ে গিয়েছিলেন তারপর আর জাননি।প্রায় পাঁচমাস হল উনার সাথে দেখা নেই।আজকেও হলনা শুধু মাত্র এই উমান গুন্ডাটার জন্য।উনি ওখানে দুপুরের খাবারটা পর্যন্ত খেতে দিলেননা আর এখন আমাকে বলছেন গুড ফর নাথিং,হুয়াই?মনের মধ্যে প্রশ্ন আসতেই উমানের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বললাম,

‘এই লোক?আপনি আমাকে গুড ফর নাথিং বললেন কেন?’

উনি সামনের দিকে তাকিয়েই বললেন,

‘এমনি।’

‘এমনি নয়,বলুন কেন?’

উনি একবার আমার দিকে তাকালেন।মুচকি হেসে সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ওসব কথা বাদ দে।আই লাভ ইউ।এখন বল আই লাভ ইউ কেন বললাম।’

আমি বাঁকা চোখে উনার দিকে তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম,

‘কেন আবার,কথা ঘুরানোর জন্য।’

উনি ব্রেক কষলেন।আমি সামান্য সামনে দিকে ঝুকে আবার ঠিক হয়ে বসে উনার দিকে তাকালাম।উনি আমার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললেন,

‘কথা ঘুরানোর জন্য?’

আমি তেজি গলায় বললান,

‘তা নয় তো কি?আমাকে ওই বাসায় দিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?আর এতবার ড্রেস চেন্জ করেন কেন?আপনি কি নিজেকে সিনেমার হিরো মনে করেন?বাস্তবে তো হনুমানের মতো চেহারা।’

উনি আমার কথা শুনে কয়েকসেকেন্ড ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন তারপর মৃদু হেসে বললেন,

‘নিষাদের সাথে দেখা হলনা সেজন্য আমার উপর রেগে আছিস?’

আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললাম,

‘না।’

‘মিথ্যুক।’

আমি রেগে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘আপনি মিথ্যুক।’

উনি আমাকে ধমক দিয়ে বললেন,

‘শাট আপ!’

আমি কেঁপে উঠে ভীত চোখে উনার দিকে তাকালাম।উনি রেগে বললেন,

‘আর একবার নিষাদের কথা মনে আনলে তোকে…….।’

আমি মুখ কাঁচুমাচু করে মাথা নিচু করে বললাম,

‘নিষাদ ভাইয়া তো…’

উমান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আমার কথার মধ্যেই বললেন,

‘অন্যকিছু বল।’

আমি উনার দিকে ঘুরে বললাম,

‘বাসায় গিয়ে আমার ডায়েরী আমাকে ফেরত দিবেন।’

উনি মৃদু হেসে বললেন,

‘দিব,দুইবার পরেছি আর একবার পড়তে হবে।তিনবার পড়েই দিয়ে দিব।’

আমি ঠোঁট উল্টালাম আর লজ্জায় অন্যদিকে তাকালাম।আমি ভেবেছিলাম উনি ডায়েরীটা তেমনভাবে দেখেননি কিন্তু উনি দুই পড়ে ফেলেছেন অলরেডি।ওটা নিয়ে আর কি হবে।সব তো উনি পড়েই ফেলেছেন।আমি মিনমিন করে বললাম,

‘পড়েই যখন ফেলেছেন তাহলে লাগবেনা ওটা আর।’

উনি কিছু বললেন না।গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হতেই উনি জানালার কাচ লাগিয়ে দিলেন।আমি ভ্রু কুচকে বললাম,

‘আরে কাচ লাগিয়ে দিলেন কেন?বৃষ্টি দেখব।’

উনি সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ভেতর থেকেই দেখা যাচ্ছে।’

‘হাত দিব আমি বৃষ্টির পানিতে।’

উনি শান্ত কন্ঠে বললেন,

‘দরকার নেই।ঠান্ডা লাগবে।’

আমি দুই হাতে উনার বাম হাতের কনুই এর ভাজ জরিয়ে ধরে বললাম,

‘প্লিজ,প্লিজ,প্লিজ গাড়ি থামান।বৃষ্টির পানিতে হাত দিতে হয়।বৃষ্টির পানি স্পর্শ করা সুন্নত আর আল্লাহ্ যখন খুশি হন তখনই বৃষ্টি দেন।আল্লাহ্ এখন অনেক খুশি।’

উনি আমার হাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে গাড়ি একটা টং এর টি স্টলের পাশে সাইড করলেন।স্টলের ছোট্ট ছাউনির নিচে চার-পাঁচটা লোক কোন মতে পানির থেকে গা বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।এছাড়া রাস্তায় দুয়েকটা গাড়ি চলছে।উমান গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে দিলেন।আমি খুশি হয়ে ডান হাতটা বারিয়ে দিলাম।হাতের উপর ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পরতে লাগলো।প্রায় এক মিনিট অপেক্ষা করার পর আমার হাতের তালু পানিতে পূর্ণ হল।হাত ভেতরে নিয়ে এসে উমানের দিকে তাকালাম।উনি অন্যরকমভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।উনার তাকিয়ে থাকা দেখে আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু উনি মুহূর্তেই স্বাভাবিক হলেন।আমি মুচকি হেসে আমার ডান হাতের তালু উনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,

‘নিন আপনিও হাত দিন।’

উনি মুচকি হেসে বিসমিল্লাহ্‌ বলে উনার হাতের তর্জনী আঙুল বারিয়ে দিয়েও থেমে গেলেন।কিছু একটা ভেবে ফট করে আমার হাতের পানি এক চুমুকে খেয়ে নিলেন।উনি তো খুব খুশি কিন্তু আমার মন খারাপ হয়ে গেল।কারন আমি বৃষ্টির পানি স্পর্শ করার আগে বিসমিল্লাহ বলিনি।উমানের বলা দেখে খেয়াল হল।ধূর কিছু ভাল লাগছেনা বলেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসলাম।উমান রেগে গেলেন।আমার সিটে এসে দরজায় উকি দিয়ে চেঁচামেচি করতে লাগলেন।কে শুনে কার কথা।আমি হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দূরে চলে আসলাম।রাস্তায় সামান্য নিচু এক জায়গায় বৃষ্টির পানি জমা হয়েছে সেখানে পা ডুবিয়ে মজা করতে লাগলাম।বৃষ্টির তেজ ধীরে ধীরে বেরেই চলেছে।আমি এখনও সেরকমভাবে ভিজিনি তবে পাঁচমিনিট দাঁড়িয়ে থাকলে কাকভেজা হয়ে যাব।উমান গাড়ি থেকে চেঁচিয়ে যখন বুঝলেন আমি এখন গাড়িতে ঢুকবোনা।উনি গাড়ি নিয়েই আমার দিকে এগিয়ে আসলেন।আমিও দৌঁড়ে চলে যেতে লাগলাম।পেছনে তাকিয়ে দেখি উনি রেগে গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছেন।আমি ঠোঁট উল্টে আবার দৌঁড়।উনিও দৌঁড়ে এসে আমার বাম হাত ধরে ফেললেন।আমি যাবনা বলে চেঁচামেচি শুরু করলাম।উনি আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে গাড়ির কাছে আসতেই টি স্টলে থাকা চার-পাঁচজন লোক উনার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,

‘কি ভাই,জোর করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’

উনি রেগে বললেন,

‘সরুন সামনে থেকে,ভিজে যাচ্ছি।’

একটা তরুন ছেলে উমানের কালো শার্টের কলারের নিচে খামচে ধরে বললেন,

‘আগে বল মেয়েটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?ছাড় ওকে।’

আমি হা করে উমানের দিকে তাকালাম।উনি নিজের বুকের দিকে তাকালেন তারপর সামনের ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘বউ হয় আমার।’

বাকি তিনজন মধ্যবয়সী লোক বললেন,

‘বউ হয় তাহলে জোর করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?তখন থেকে দেখছি মেয়েটার পেছনে লেগে আছো।মতলব বুঝিনা ভেবেছো?’

উমান কিছু বলার আগেই কম বয়সি ছেলেটা মস্তানের মত ভাব দেখিয়ে উমানের শার্ট আর একটু টেনে উমানকে নিজের কাছে নেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু এক চুলও নড়াতে পারলোনা।তাও ছেলেটি ভাব দেখিয়ে বলল,

‘বাঁচতে চাস তো ছেড়েদে মেয়েটিকে নাহলে আমাকে চিনিস?হেব্বি গরম রক্ত আমার।’

উমান ছেলেটির দিকে রাগী চোখে তাকালো।আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বাকি তিনটে লোকের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘আপনারা মিতির সাথেই কথা বলুন।ওর থেকেই শুনুন আমি ওর কে হই।’

লোকগুলো আমার দিকে তাকালেন।আমি ভয়ে ভয়ে উমানের একহাত জড়িয়ে ধরে মাথানিচু করলাম।একটা লোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘এই ছেলেকে চিনো তুমি?ও সত্যি তোমার স্বামী হয়?’

আমি মাথা নাড়ালাম।লোকগুলো তাও সন্তুষ্ট হলেন না।আমাকে বললেন,

‘তুমি ভয় পেয়না মা।আমাদেরকে সত্যি বলে দাও আমরা দরকার হলে এই ছেলেকে পুলিশে দিব।তোমার কোন ভয় নেই।’

আমি উমানের হাত আরো শক্ত করে ধরে মিনমিন করে
বললাম,

‘সত্যি বলছি।’

তিনজন লোক নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগলেন।তারপর আমাকে আর উমানকে কিছু কটু কথা শোনাতে শোনাতে ছাউনির দিকে চলে গেলেন।উমান এক ঝটকায় সামনের ছেলেটির থেকে শার্ট ছাড়িয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন,

‘যা বস এবার গাড়িতে।’

আমি গাড়ির দিকে না তাকাতেই উমান ছেলেটিকে একটা থাপ্পড় দিয়ে রাগী কন্ঠে বললেন,

‘লেট মি সি,হাউ হট ইউর ব্লাড ইজ।’

ছেলেটার দাঁত ভেঙ্গে গিয়েছে,মুখের ভেতর রক্ত দেখা যাচ্ছে।গালে হাত দিয়ে ব্যথায় মুখ কুচকে ফেলেছে একদম।আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে উমানের দিকে তাকালাম।উনি চোখমুখ শক্ত করে ভেজা শার্টের অল্প ভাজ করা হাতা কনুই পর্যন্ত ভাজ করছেন।উনার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে উনি এখন এই ছেলেকে আচ্ছা মতো ধোলায় দিবেন।উমান আমার দিকে তাকিয়ে আবার ধমক দিয়ে বললেন,

‘দাঁড়িয়ে আছিস কেন?তোরও থাপ্পড় খাওয়ার শখ হচ্ছে?’

আমি ভয়ে তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে উঠে বসলাম।উমান ছেলে টাকে এত মারছেন দেখে আমি শিহরিত।কেউ থামাচ্ছেওনা উনাকে।ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোও এগিয়ে আসছেন না।উনাদের বুদ্ধি ভার,উনারা হয়তো বুঝতেই পারছেন এসব ঝামেলায় উমানের কোন প্রবলেম হবেনা কারন উনি সত্যি ছিলেন।উল্টো উমানই যদি পুলিশের কাছে গিয়ে লোকগুলোর নামে অভিযোগ করেন উনারা ফেঁসে যাবেন।তাই বলে লোকগুলো উমানকে আটকাতেও আসবেনা?একটু আগেই তো আমার উপর দরদ একদম উতলে উঠছিল।এখন কোথায় গেল সেই দরদ???

চলবে………..

গল্প:-#মনের_মহারাণী
লেখিকা:-#Sohani_Simu
পর্ব:১২

হেঁচকি তুলে কাঁদছি আর জুতো খুলছি।উমান গাড়ি পার্ক করে এসে আমার পেছনে দাঁড়ালেন।আমি দ্রুত জুতো খুলে র্যাকে রেখে নিজের রুমে আসতে লাগলাম।উমান পেছন থেকে রাগী কন্ঠে বললেন,

‘দুমিনিটে চেন্জ করে ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিবি।’

আমি কাঁদতে কাঁদতে দৌঁড়ে রুমে আসলাম।খুব কান্না পাচ্ছে।ওই ছেলেটিকে আধমরা বানিয়ে তারপর গাড়িতে এসে আমাকে বকতে শুরু করেছিলেন।পুরো রাস্তা আমার উপর রাগারাগি করেছেন আর জোরে জোরে ধমক দিয়েছেন।আর আমাকে কান খুলে শুনে নিতে বলেছেন উনার সব কথা যেন আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করি নাহলে আমাকেও ওই ছেলের মতো মাইর দিবেন।

হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে গায়ে ওড়নাটা চাদরের মতো করে জড়িয়ে নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলাম।হালকা শীত করছে।মাথাটা ভার ভার লাগছে সাথে নাকও বন্ধ হয়ে আসছে।বৃষ্টিতে ভিজে আর অনেকক্ষণ ভেজা পোষাকে থাকায় ঠান্ডা লেগে গিয়েছে।ক্লান্ত লাগছে,জ্বর আসতে পারে তাই বিছানায় গিয়ে শুলাম।কম্বল মুড়ি দিতে না দিতেই উমানের ডাক শুনতে পেলাম,

‘মিতি?কাম হেয়ার।’

আমি একটু বিরক্ত হলাম কিন্তু উনার ভয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা ছেড়ে বাইরে আসলাম।কিচেন থেকে উনার কথা বলার আর পানি পরার আওয়াজ আসছে তাই কিচেনে গেলাম।উমান সিংকে হাত ধুচ্ছেন আর কাঁধের সাহায্যে কানে ফোন ধরে রেখে কথা বলছেন।আমি মুখ মলিন করে বললাম,

‘ডেকেছেন?’

উমান ভ্রু কুচকে পেছনে তাকালেন।টাওয়ালে হাত মুছে ফোন হাতে নিয়ে কানে ধরে মুচকি হেসে বললেন,

‘কথা বলো ওর সাথে।’

উনি আমার সামনে এসে আমার দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বললেন,

‘আম্মুর সাথে কথা বল।’

আমি তো মহা খুশি।উনার হাত থেকে ফোনটা একরকম কেড়েই নিলাম।উত্তেজিত হয়ে কথা বলতে বলতে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলাম কিন্তু ফোনের ওপাশের মানুষের কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল কারন আমি ভেবেছিলাম উমান আমার আম্মুর কথা বলছিলেন কিন্তু এখন কথা শুনে বুঝতে পারছি এটা উমানের আম্মু,আমার বড়াম্মু।উনি আমার খোঁজ খবর নিলেন।মিনির সাথে আর উর্মি আপুর সাথে একটু কথা বলিয়ে দিয়ে বড়াম্মু কল কেঁটে দিলেন।আমি মন খারাপ করে আবার কিচেনে ফিরে আসলাম।উমানের দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বললাম,

‘আপনার ফোন।’

উনি তরকারি রান্না করছেন তাই ব্যস্ত হয়ে বললেন,

‘রাখ ওখানে।’

আমি উনার ফোন কেবিনেটের উপর রেখে দিলাম।কিচেনের দরজার কাছে আসতেই উমান ডাকলেন,

‘ওই।’

আমি পেছনে ঘুরে উনার দিকে তাকালাম।উনি প্যানে ঢাকনা বসিয়ে ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকালেন।চোখের ইশারায় আমাকে উনার কাছে ডাকলেন।আমি বিলম্ব না করে উনার সামনে এসে দাঁড়ালাম।উনি ভ্রু কুচকে আমার গালে কপালে হাত দিয়ে চিন্তিত হয়ে বললেন,

‘এমন ফ্যাকাশে মুখ করে ঘুরছিস কেন?’

তারপরই চেচিয়ে বললেন,

‘জ্বর এসেছে,ভেরি গুড।এখনও বৃষ্টি হচ্ছে।তখন ভেজা কম হয়েছে,এখন আবার ভিজবি।ছাদে চল।’

আমি গাল থেকে উনার হাত সরিয়ে দিয়ে মুখ কাচুমাচু করে বললাম,

‘জ্বর আসেনি,এমনি একটু শীত করছে।’

উনি চোখ গরম করে আমার দিকে তাকালেন।আমি মাথা নিচু করে আড় চোখে উনার দিকে তাকালাম।উনি সসপ্যানে পানি ঢেলে আরেকটা স্টোভে বসিয়ে দিলেন।স্টোভের আচ বারিয়ে দিয়ে আমার একবাহু শক্ত করে চেপে ধরে টানতে টানতে আমাকে রুমে নিয়ে আসলেন।আমাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে চোখ রাঙিয়ে আর শাসিয়ে আমাকে চুপ করে বসে থাকতে বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।আমি নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা তাই মুখ হা করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে উনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম কি করতে চলেছেন উনি!

একটু পর উমান রুমে ঢুকলেন।আমি বিছানায় হেলান দিয়ে বসে কপাল টিপছিলাম উনাকে আসতে দেখেই সোজা হয়ে বসলাম।উনার কাঁধে একটা সাদা টাওয়াল ঝুলানো আর হাতে একটা কাচের বাটি।উনি বাটিটা আমার সামনে রেখে আমার পাশে বসলেন।বাটিতে ধোঁয়া উঠা গরম পানি।এটা কি উনি আমাকে খেতে বলবেন নাকি!!ভয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে উমানের দিকে তাকালাম।উনি ট্রাউজারের পকেট থেকে ভিক্স ভাপোরাবের নীল কৌটটা বের করে আঙুলের ডগায় কিছুটা ভিক্স নিয়ে পানির মধ্যে দিলেন।আমার মাথায় টাওয়াল দিতেই আমি বুঝে গেলাম আমাকে এখন কি করতে হবে।

প্রায় পাঁচমিনিট ধরে গরম পানির ভাব নিয়ে এখন একটু স্বস্তি বোধ করছি।বন্ধ নাক খুলে গিয়েছে।টাওয়াল দিয়ে মুখের উপরের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে উমানের দিকে তাকালাম।উনি আমার কাঁধে হাত রেখে ভ্রু কুচকে বললেন,

‘ফিলিং বেটার নাউ?’

আমি মাথা নাড়ালাম।উনি ডান হাতের তর্জনী আঙুলে কিছুটা ভিক্স নিয়ে আমার কপালে মালিশ করতে করতে বললেন,

‘শুয়ে পড়,আমি খাবার নিয়ে আসছি খেয়ে ঘুমাবি।’

আমি মিনমিন করে বললাম,

‘খেতে ইচ্ছে করছে না।’

উনি কিছু বললেন না।গরম পানির বাটি নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।আমি বিছানা থেকে নেমে ব্যালকনিতে আসলাম।বাইরে এখনও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পরছে।ব্যালকনির গ্রীলে ফোঁটা ফোঁটা পানি জমে আছে।আমি সেগুলো হাত দিয়ে ছুয়ে দিচ্ছি।মিনি এখানে থাকতে এই পানি গুলো আঙুলের ডগায় নিয়ে ওর মুখে ছিটিয়ে দিতাম আর ও আম্মুর কাছে গিয়ে আমার নামে নালিশ করতো।কত দুষ্টু মিষ্টি ছিল সেই দিন গুলো ভাবতেই আমার মন খারাপ হয়ে গেল।ব্যালকনি থেকে বেরিয়ে ডাইনিংয়ে আসলাম।উমান ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আমার প্লেটে ভাত বাড়ছেন।আমি গিয়ে পেছন থেকে উনাকে জরিয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম।উনি আমার হাতের উপর হাত রেখে বললেন,

‘মিতি?হোয়াট হ্যাপেন্ড?শরীর খারাপ লাগছে?’

আমি উনার পেটের কাছে টিশার্ট খামচে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললাম,

‘ওদের কথা মনে পরছে,সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।’

উমান আমার হাত থেকে উনার টিশার্ট ছাড়িয়ে নিলেন।আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার দুইগালে হাত রেখে চোখ মুছে দিয়ে মুখ মলিন করে বললেন,

‘ডোন্ট ওয়ারি,সামনের উইক রাজশাহী ফিরে যাব।এখানে একা একা তাই ভাল লাগছেনা।ওখানে গেলেই ভাল লাগবে দেখিস।এখন খাবি চল।’

উনি টেবিল থেকে আমার প্লেট হাতে নিয়ে আমাকে একপাশ থেকে জরিয়ে ধরে ড্রইং রুমে আসলেন।টিভি অন করে সোফায় বসে আমার হাতে রিমোট দিয়ে উনি প্লেটে ভাত মাখাতে লাগলেন।আমি মুখ ফুলিয়ে কার্টুন নেটওয়ার্কে দিয়ে সোফায় পা তুলে বসলাম।উমান আমার মুখে খাবার তুলে দিতেই আমি মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালাম।উনি রেগে গেলেন।ওই ছেলের কথা মনে করিয়ে দিতেই আমি আর কথা বাড়ালাম না।উনার হাতে গপাগপ খেতে লাগলাম।উমানও আমার সাথে খেয়ে দুপুরের খাবারের পর্ব মিটিয়ে নিলেন।রুমে এসে আমাকে একটা প্যারাসিটামল দিলেন উনিও একটা নিলেন।আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘আপনারও জ্বর এসেছে?’

আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম উমান আমাকে কোলে নিয়ে মুচকি হেসে বললেন,

‘না আমার মহারাণীর জ্বর হয়েছে।আমারও যেন না হয় সেজন্য আগেই মেডিসিন নিলাম।’

আমি উনার গলা জরিয়ে ধরে ভীত কন্ঠে বললাম,

‘আমার জ্বর হয়নি,কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?লাগছে,নামিয়ে দিন।’

উনি হাঁটতে হাঁটতে ভ্রু কুচকে বললেন,

‘এখনও ব্যথা আছে?’

‘একটু একটু।’

উনি আমার গালে কিস করে বললেন,

‘গেট ওয়েল সুন।’

আমি উপরের ঠোঁট মুখের মধ্যে নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলাম।উমান আমাকে নিয়ে বাবার ঘরে আসলেন।আমাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে আমার গালে গাল ঠেকিয়ে বললেন,

‘এটা সুখ আর ভালোবাসার ঘর।দুঃখ এখান থেকে নির্বাসিত।আগে একটা ঘুম দিয়ে নিই তারপর তোর ক্লাস নিব।’

আমি একটু সরে যাওয়ার চেষ্টা করে ভ্রু কুচকে বললাম,

‘কিসের ক্লাস?’

উনি আমাকে শক্ত করে জরিয়ে ধরে বললেন,

‘ভালোবাসা শিখানোর ক্লাস।’

আমি চোখ গোল গোল করে বললাম,

‘না।’

উনি আমার পেট জরিয়ে ধরে বললেন,

‘কিসের না?আমার ভেতরের ভালোবাসা জানতে ইচ্ছে করেনা তোর?আমি তোর মতো পুডিংহেড আর পিচ্চি মেয়েকে কেন বিয়ে করলাম জানতে ইচ্ছে করেনা?’

আমি উনার দিকে পাশ ফিরে কৌতূহলি হয়ে বললেন,

‘কেন?’

উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে সটান হয়ে শুয়ে আমার ওড়না চোখের উপর দিয়ে বললেন,

‘ভালোবাসি তাই।’

আমি ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘পুডিংহেড মানে কি উম ভ..।’

জিভে কামড় দিয়ে চুপ হয়ে গেলাম।ভাইয়া বলা যাবেনা।উনি ঘুমানোর চেষ্টা করে বললেন,

‘পুডিংহেড মিনস আমার মনের মহারাণী,এটায় জানিস না গাধি একটা।’

আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,

‘আমি ইংলিশ বেশি জানিনা।বাবা বলেছে এসএসসি শেষ হলে যখন ছুটি থাকে তখন ইংলিশ সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিবে। তখন অন্য পড়া থাকবেনা তাই ভাল করে ইংলিশ শিখা যাবে।’

উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।চোখের উপর থেকে ওড়না সরিয়ে আবার আমাকে জরিয়ে ধরে বিরবির করে বললেন,

‘আ’ম সরি,পুডিংহেড মানে হাবাগোবা।আর বলবোনা সরি।’

কি?আমি হাবাগোবা?মনে মনে কথাটা বলেই আমি নড়েচড়ে উঠে মুখ ফুলিয়ে বললাম,

‘সরুন,আপনি একটা গুন্ডা,মহাগুন্ডা।’

উনি এক ধমক দিয়ে বললেন,

‘শাট আপ!ঘুমোতে দে আর তুইও ঘুমা নাহলে আমাকে চিনিস?হেব্বি গরম রক্ত আমার।’

উনার গরম রক্তের কথা শুনে রাস্তায় ওই ছেলেটির কথা মনে পড়তেই শুকনো কাশি দিয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে কাঁপা গলায় বললাম,

‘ঘুমোচ্ছি ঘুমোচ্ছি,রেগে যাবেননা প্লিজ!’

মৃদু হাসির শব্দ কানে আসলো।লজ্জা পেয়ে ঠোঁট উল্টে একহাতে মুখ ঢেকে অন্যপাশ ফিরে শুলাম।চোখ বন্ধ করেই বুঝতে পারছি উমান উঠে বসে কম্বলের ভাজ খুলে কম্বল গায়ে দিয়ে আবার শুয়ে পরলেন।একটু পর উনি আমাকেও কম্বলের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলেন।কিছুক্ষণ আমার চুলের মধ্যে মুখ গুজে থেকে তারপর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন,

‘নাইস ফ্রেগরেন্স।’

আমি বুঝতে পারলাম না ফ্রেগরেন্স মানে কি।তবে ধারণা করলাম চুলের গন্ধ টন্ধ হবে হয়তো।উনি আমাকে মাথামোটা বলবেন সেজন্য উনাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েও করলাম না।তারপরও সঠিক অর্থ জানার জন্য মনে মনে ভাবলাম পরে একসময় ইংলিশ ডিকসনারীতে দেখে নিব।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here