#মনমোহিণী
#Part_07
#Writer_NOVA
সকাল বেলা পুকুর ঘাটে বসে সানন্দে নিমের ডাল দিয়ে দাঁত ঘষছে তিন বন্ধু। তায়াং ভাইয়াকে দেখা গেলো বালতি হাতে মাছদের খাবার দিতে। খালামণি লাড়কির ঘর থেকে এক আঁটি পাটকাঠি এনে চুলো ধরাতে লেগে গেছে। আমি একবার পুকুরঘাটের দিকে উঁকি দিলাম।
‘বুঝলি, এরেই কয় কপাল!সকাল সকাল রায়হান বউ জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। আর আমরা চার ভাদাইম্মা নিমের ডাল দিয়া দাঁত মাজি।’
ইমরান ভাইয়া বললো। তায়াং ভাইয়া এক বাটি মাছের খাবার পুকুরে ছুড়ে মেরে পাড় থেকে চেচিয়ে বললো,
‘কেন তোর কি হিংসে হয়?’
‘না ভাই।কষ্টে বুকের বা পাশটায় চিনচিন ব্যাথা করে।’
ইমরান ভাইয়া এক হাতে বুকের বা পাশ ধরে কষ্ট পাওয়ার ভান করে বললো।শাহেদ ভাইয়া মুখে জমে থাকা ফেনা থু করে ফেলে ইমরান ভাইয়ার কথার উত্তর দিলো।
‘তোদের বিয়ে করতে মানা করছে কে শুনি?’
‘আহ্ যেই চেহারা! এই চেহারায় মাইয়া দিবে কেডা?যেই চেহারা কু’ত্তায়ও পছন্দ করবো না।’
‘আফরান নিশোর নাটকের ডায়লগ কম মা’র।’
শাহেদ ভাইয়া ধমকে উঠলো।ইমরান ভাইয়ার কথায় আমি ফিক করে হেসে উঠেছি। হাসির শব্দ পেয়ে তিনজন ঘুরে তাকালো। ইমরান ভাইয়া আফসোসের সুরে বললো,
‘আমার দুঃখে তুমি হাসো খালাতো বোইন? কেউ আমার দুঃখ বুঝলো না।’
আমি মুখ টিপে হেসে বললাম,
‘কু’ত্তা না মানুষই পছন্দ করবো ভাইয়া।’
‘ও যদি নিজের জন্য কু’ত্তা পছন্দ করলে আমাদের কি বলো তো নোভা?’
শাহেদ ভাইয়া আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। আমি ঠোঁট চেপে হাসলাম। ইমরান ভাইয়া লুঙ্গি গোড়ালির দিক থেকে কিছুটা উচু করে শাহেদ ভাইয়াকে লাথি মারলো। ব্যাস দুজন লেগে গেছে। এনাজ এর মধ্যে একটা কথাও বললো না। আমার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে নিমের ডাল দিয়ে জোরে জোরে দাঁত ঘষতে লাগলো। আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,
‘আস্তে ঘষেন।এতো ঘষলে তো দাঁত ক্ষয় হয়ে যাবে।’
এনাজ চোখ ছোট করে তীর্যক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো।আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চলে এলাম।শান্তি লাগছে, তার কথা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি।আমি আবার কারো ঋণ রাখি না।
‘খালামণি কি রান্না করবা?’
‘ভাঁকা।’
‘ভাঁকা জানি কি?’
‘বৌয়া।’
‘ওহ আচ্ছা।দাও আমি আলু কুচি করে দেই।’
বটি নিয়ে আলু কাটতে বসে পরলাম। চালের সাথে ডাল, আলু কুচি দিয়ে তৈরি করা হয় এই মুখরোচক খাবার।সাথে কয়েকরকম ভর্তা হলে তো কথাই নেই।স্বাদ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এই খাবার বানানোর উপকরণ হলো চাল, ডাল, আলু,কাঁচা মরিচ কিংবা শুকনা মরিচ,তেল,লবণ, পানি। অনেকে ডাল, আলু দেয় না।শুধু চালের সাথে বাকি উপকরণ দিয়ে বানায়।চাল, ডাল, আলু ধুয়ে এক পাত্রে রাখা হয়। কালারের জন্য অল্প পরিমাণ হলুদ গুঁড়া দেওয়া হয়।এটা অপশনাল, না দিলেও চলে। তবে দিলে সুন্দর একটা কালার আসে।এর সাথে কাঁচা মরিচ ফালি করে কেটে দেওয়া হয় নয়তো শুকনো মরিচ। লবণ, তেল, পরিমাণমতো পানি দিয়ে একসাথে মেখে অল্প আঁচে রান্না করা হয় বৌয়া।অঞ্চলভেদে এই খাবারের নাম ভিন্ন। আমাদের অঞ্চলিক ভাষায় বলে বৌয়া। মাদারীপুরের ভাষায় ভাঁকা।
খালামণি চাল, ডাল ধুয়ে এনে আমার সামনের পাত্রে রেখে বললো,
‘তন্বী উঠেনি?’
‘না ঘুমায়।’
‘বাড়িতে মেহমান আসলে ওর ঘুম বেড়ে যায়।’
পুকুর ঘাট থেকে তাদের হাসির শব্দ কানে ভেসে আসছে। জোরে জোরে চেচিয়ে কথা বলছে। একজন আরেকজনকে পচানি দিয়ে আবার উচ্চস্বরে হেসে উঠছে৷ আমি সেদিকে কান না দিয়ে খালামণিকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কি কি ভর্তা বানাবা?’
‘আলু, বেগুন, মরিচ, লাউ শাক,কালোজিরা। আর ভাবছি ডিম ভাজবো।’
‘আহা, ইয়াম্মি খাবার। শুনেই তো জিভে জল চলে এলো।’
দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলাম।খালামণি আমার কথা শুনে নীরবে হেসে উঠলো। আমি মনোযোগ দিলাম আলু কুচি করতে।
★
হৈ-হুল্লোড়ে মাথা ধরে যাওয়ার উপক্রম। চার বাঁদর গিয়েছে পাশের মাঠে ক্রিকেট খেলতে। খেলার থেকে চেঁচাচ্ছে বেশি। একটু পরপর এতো জোরে চিল্লানি দিয়ে উঠে যে মাথার মধ্যে টক করে চিলিক দিয়ে উঠে। আমি ও তন্বী বসেছিলাম উঠানের সামনের দিকে থাকা পাকা বেদীতে। কিন্তু এদের জন্য বোধহয় বসে থাকা যাবে না। খালামণি পিঠে বানাবে। তাই নারিকেল কোড়াতে লাগিয়ে দিয়েছে আমাদের দুই বোনকে। কোরানী দিয়ে নারিকেল কোড়াতে কোড়াতে দুই বোন গল্প জমিয়েছিলাম।
‘দেখছো কি চিল্লাইতাছে? শুধু শুধু চিল্লাইতাছে।’
তন্বী বিরক্তি নিয়ে বললো। আমি একবার পিছন ফিরে তাদের অবস্থান দেখে একগাল হেসে নিজের কাজে লেগে গেলাম। আমি যেখানে বসে আছি সেখান থেকে মাঠ স্পষ্ট দেখা যায়। তায়াং ভাইয়া বোলিং করছে। এনাজ ব্যাটিং-এ আছে। ইমরান ভাইয়া ফিল্ডিং-এ দাঁড়িয়ে চেচাচ্ছে। এলাকার অনেক ছেলেপেলে আছে।
‘তোমার বিরক্ত লাগতাছে নোভাপু।’
‘হুম একটু-আধটু!’
‘আমার মাথা ধরে যাচ্ছে।’
‘অনেকদিন পর খেলছে তো খুশিতে হুশ নেই।’
‘হুশ আমি ফেরাচ্ছি।’
তন্বী উঠে মাঠের দিকে চলে গেলো। কাঁঠাল গাছের সামনে দাঁড়িয়ে ভাইয়াকে বললো,
‘এতো জোরে চেঁচাচ্ছিস কেন? আস্তে খেল। তোদের চিৎকারে বিরক্ত লাগতেছে।’
‘হোপ! এখানে কি? যা, বাড়ির ভেতরে যা।’
তায়াং ভাইয়া হাত উঠিয়ে থাপ্পড় দেখিয়ে তন্বীকে শাসালো।আমি উঠে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম।তাই সবকিছু নজরে এসেছে। এনাজের দিকে তাকাতে সে হাত নাড়িয়ে হাই জানালো। আমি ভ্রু কুঁচকে ভেংচি কেটে অন্য দিকে তাকালাম। সে নিশ্চয়ই কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাতে আমার কি? আমি তো আর তার দিকে তাকাচ্ছি না।
‘নোভা।’
এনাজের ডাক শুনে চট করে ওর দিকে তাকালাম। এই যা বলেছিলাম তো আর তাকাবো না। হাত নাড়িয়ে আবারো হাই জানালো।
‘খেলবা?’
ইমরান ভাইয়া দূর থেকে জিজ্ঞেস করলো। আমি হেসে মাথা নাড়িয়ে বললাম,
‘না!’
‘কেন?’
তায়াং ভাইয়াকে ইশারায় দেখিয়ে মুখ নাড়িয়ে বললাম,
‘ছেঁচা দিবে।’
‘বুঝি না। কি বলো?’
এনাজ আমার কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো। ইমরান ভাইয়া বললো,
‘চলে এসো খালাতো বোন।’
ইমরান ভাইয়াকে থামিয়ে দিয়ে এনাজ বললো,
‘এখানে আসার দরকার নেই। মাথার মধ্যে কি কমন সেন্স আছে নাকি গেছে?’
আমার দিকে ঘুরে হাত নাড়িয়ে বললো,
‘ভেতরে যাও।’
‘মাঠের মধ্যে একটা পা রেখে দেখ। ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে পা ভেঙে ফেলবো। বাড়িতে যা।’
তায়াং ভাইয়া হুংকার দিয়ে উঠলো। মন খারাপ হয়ে গেলো। সবার সামনে এমনি বলবে? আমি কি খেলতাম নাকি। মুখ ঝামটা মেরে তন্বীকে টেনে বাড়ির ভেতর চলে গেলাম।
★
আজ আকাশে চাঁদ নেই। বরং হাজারো তারার মেলা। মাঝে মাঝে ভেসে আসছে নিশাচর পাখির ডাক। পাশের কোন গর্ত থেকে একঘেয়ে সুরে তুরকুলা পোকা ঝিঁঝিঁ শব্দে ডাকছে। আমড়া গাছের ডালে বসে দুবার হুতোম প্যাঁচা ডাকলো। নাগ বারান্দায় বসে সবাই একসাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তায়াং ভাইয়া উঠে নিচ থেকে একটা ঢিল তুলে নিলো। শাহেদ ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো,
‘ঢিল দিয়ে কি করবি?’
‘দেখ কি করি!’
ভাইয়া হাতে থাকা মাটির ঢিলটাআমড়া গাছে থাকা হুতোম প্যাঁচাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়লো।ঢিলটা নিশ্চয়ই একদম প্যাঁচার গায়ে লেগেছে। কিছু সময় ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে অন্য দিকে শা গতিতে উড়ে চলে গেলো। তায়াং ভাইয়া আমার পাশে এসে বসে বললো,
‘অনেকখন ধরে ডাকছিলো। মাথা ধরে গেছে।’
বারান্দার লাইট নেভানো।বাড়ির দক্ষিণ কোণায় একটা ছোট এনার্জি লাইট জ্বলছে। সেখানে অনেকগুলো উইপোকা উড়ে বেড়াচ্ছে। লাইট জ্বালালেই এরা দল বেঁধে বিনা দাওয়াতে চলে আসে। খালামণি মালপোয়া পিঠা ভাজছে। সেই ঘ্রাণ একটু পরপর নাকে এসে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। বিবি খানা পিঠাও বানাবে।আমাদের গল্পের বিষয়বস্তু হলো ভুত।সবাই নিজের জানা গল্পগুলো বলছে।ইমরান ভাইয়া তার চাচার সাথে ঘটে যাওয়া একটা হরর গল্প শুনাচ্ছিলো।আমরা সবাই তন্ময় হয়ে গল্পের ভেতর ঢুকে পরেছি।
‘তায়াং বাজার থেকে চিনি নিয়ে আয় তো।’
হঠাৎ করে খালামণির গলার স্বরে পেয়ে সব কয়টা ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠলাম।
‘আন্টি ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।’
শাহেদ ভাইয়ার কথা শুনে খালামণি হেসে উঠলো। তায়াং ভাইয়া বললো,
‘চিনি কি একটুও নেই?’
‘থাকলে আনতে বলি?’
ভাইয়ার কন্ঠে বাজারে যাওয়ার অনিচ্ছা প্রকাশ পাচ্ছে। তবুও ভাইয়া উঠে বললো,
‘আমার সাথে কে যাবি বল?’
‘কিরে ভুতের গল্প শুনে কি তুই ভয় পাচ্ছিস তায়াং?’
এনাজের কন্ঠে কৌতুকের আভাস। ভাইয়া এনাজের বাহুতে দুম করে এক ঘুষি মেরে বললো,
‘তায়াং কিছু ভয় পায় না।’
‘কি ভয় পায় না তাতো দেখতেই পাচ্ছি।’
কথাটা বলে হাত দিয়ে মুখ আটকে হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করলাম। ভাইয়া চোখ গরম করে তাকিয়ে আমার চুল ধরে টান দিয়ে ধরলো। আমি ঠাস করে ওর হাতে থাপ্পড় দিতেই চুল ছাড়লো।অবশেষে শাহেদ ভাইয়া রাজী হতেই তায়াং ভাইয়া তাকে নিয়ে বাজারে চলে গেলো।
‘কি করা যায় বলো তো?’
তন্বীকে জিজ্ঞেস করলো এনাজ। তন্বী কিছু সময় ভেবে খুশি হয়ে বললো,
‘লুডু খেলবেন?’
‘হুম খেলা যায়।’
বারান্দার পাশের রুমে চারজন মিলে লুডু খেলতে বসেছি।জোর খেলা হবে। আমি ও ইমরান ভাইয়া, তন্বী ও এনাজ। দু পক্ষের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। কে আগে ছয় উঠাতে পারে, কার গুটি খাওয়া যায়। খেলার পাশাপাশি গরম গরম পিঠে খাচ্ছি। খালামণি একটু পরপর এসে পিঠা দিয়ে যাচ্ছে।
‘ইমরান ভাইয়া আপনি কিন্তু চোরাপানি করছেন।’
তন্বী ঠোঁট ফুলিয়ে বললো। ইমরান ভাইয়া মাথা নাড়িয়ে পিঠেতে কামড় বসিয়ে বললো,
‘একটুও না।’
‘দুই নাম্বারি তো তোরাও করছিস। আমরা কি তখন কিছু বলছি?’
আমার কথায় এনাজ বললো,
‘কোথায় করেছি দেখাও তো?’
‘কাঁচা গুটি পাকা বলে চালালো কে?’
‘তোমরা যে টিপ মেরে ছয় উঠালে সেই বেলা?’
‘দেখছেন আপনি?’
‘না, দেখে বলিনি।’
ইমরান ভাইয়া দুজনকে থামিয়ে বললো,
‘ঝগড়াঝাটি মাফ করো।খেলা এবার চালু করো।’
চুপচাপ খেলায় মনোযোগ দিলাম। আমার পাকা গুটি এনাজের কোটের সামনে দিয়ে আসতে নিলে ওর গুটি দিয়ে খেয়ে ফেললো। পাকা গুটির শোকে দাঁত কিড়মিড় করে এনাজের দিকে তাকাতেই সে ভ্রু নাচিয়ে শয়তানি হাসি দিলো। মনে মনে বললাম, ‘দাঁড়াও বেটা তোমার পেপসুডেন্ট টুথপেষ্টের এড দেওয়া ছুটাচ্ছি’।
#চলবে