#মনমোহিণী
#Part_06
#Writer_NOVA
দুই মিনিট যাবত দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। চোখ দুটো হাতে থাকা মোবাইলের দিকে থাকলেও কান দুটো খাড়া হয়ে আছে তায়াং ভাইয়ার কথা শুনার জন্য। খালামণির রুমের বরাবর তায়াং ভাইয়ার রুম। তবে দরজা বরাবর নয়। চার বন্ধু মিলে শলাপরামর্শ করছে ভাইয়াদের পুরান বাড়িতে যাবে। সেখানে দুটো নারিকেল গাছ আছে। গাছ থেকে নারিকেল ও ডাব পারাই এখন তাদের উদ্দেশ্য। আমি নিশ্চিত আমাদের দুই বোনকে নিয়ে যাবে না। তাই ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছি কখন তারা বেরুবে আর তাদের লেজুড় জুড়ে আমরাও যাবো। ভাইয়া সবাইকে তাড়া দিয়ে বললো,
‘জলদী উঠ। সন্ধ্যা হলে গাছে উঠার জন্য মানুষ পাওয়া যাবে না।’
‘কই যাবি?’
শাহেদ ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো। এতে সম্ভবত কেউ একজন শাহেদ ভাইয়ার পিঠে জোরে থাপ্পড় মেরেছে। শাহেদ ভাইয়ার চেঁচানোর আওয়াজ পাওয়া গেলো। কে মেরেছে আমি জানি না। আমি শুধু তাদের কথার শব্দ পাচ্ছি। কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
‘এতখন কোথায় ছিলি? আমরা কি নিয়ে কথা বলছিলাম বল তো?’
ইমরান ভাইয়ার গলা পাওয়া গেলো। শাহেদ ভাইয়া কাতর গলায় বললো,
‘আমি শুনতে পাইনি বলেই তো জিজ্ঞেস করছি।’
‘শুনতে পারবি কি করে? মনটা তো পরে আছে গার্লফ্রেন্ডের কাছে।’
এনাজ বললো। তারপর একদফা ধুম ধারাক্কা মারপিট চললো। আমি সেদিকে কান দিলাম না। তায়াং ভাইয়া দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো। আমাকে এড়িয়ে খাবার রুমে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। কাঙ্ক্ষিত বস্তুটা খুঁজে না পেয়ে চিল্লিয়ে উঠলো।
‘আম্মু, কাচি (কাস্তে) কই?’
কাস্তে কে অনেক আঞ্চলিক ভাষায় কাচি বলা হয়। আমরাও বলি। খালামণি বললো,
‘খাটের নিচে।’
‘পাই না তো।’
‘খুঁজে দেখ।’
‘তুমি দিয়ে যাও।’
‘আমি যদি এসে পাই না তাহলে তোর খবর আছে।’
খালামণি তেতে উঠে বললো। আমি মুখ টিপে হেসে উঠলাম। ভাইয়া কিছু সময় এদিক সেদিক খুঁজলো।
‘কিরে তানভীর পাইছিস?’
‘হুম পাইছি।’
‘না খুঁজে ষাঁড়ের মতো চিৎকার পারে।’
এবার আমি হো হো করে উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম। ভাইয়া আমার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হাত উঠিয়ে মারতে উদ্যত হলে আমি লাফিয়ে পিছনে সরে গেলাম।উপরের পাটি দাত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধমকে উঠলো।
‘হোপ।’
আমি ওর ধমক গায়ে মাখলাম না। মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কোথায় যাবি ভাইয়া?’
সব জেনেও না জানার ভান করে তাকিয়ে রইলাম। ভাইয়া জিহ্বা বের করে ভেংচি কাটলো।
‘তোকে বলবো কেন?’
‘বল না প্লিজ।’
‘পুরান বাড়িতে যাবো ডাব পারতে।’
‘আমিও যাবো।’
‘কই যাবি?’
‘তোদের সাথে।’
‘যা ভাগ।’
‘এমন করিস কেন? নিয়ে যা না।’
অনুনয়ের সুরে বললাম। ভাইয়া পাত্তা না দিয়ে বললো,
‘বিরক্ত করিস না। সর এখান থেকে।’
আমি খালামণিকে ডেকে বিচার দেওয়ার ভঙ বললাম,
‘খালামণি দেখো ওরা পুরান বাড়িতে ডাব পারতে যাবে। কিন্তু আমাদের নিবে না।’
খালামণি রুম থেকে উত্তর দিলো,
‘তানভীর ওদের নিয়ে যা।’
‘ওরা ঐখানে গিয়ে কি করবে আম্মু?’
‘যেতে চাইছে যখন মানা করিস না।’
আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘দুই মিনিট সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে বাইরে দেখতে চাই। নয়তো রেখেই চলে যাবো।’
আমি সম্মতি পেয়ে দৌড়ে তন্বীর রুমে ঢুকে ওড়না পাল্টে নিলাম। মাথা আঁচড়িয়ে ঝুটি পাকাতে পাকাতে তন্বীকে বললাম,
‘জলদী রেডি হো। এক জায়গায় যাবো।’
সন্ধ্যার আগেই দুই কাদি ডাব নিয়ে আমরা বাসায় ফিরলাম। সাথে ছয়টা নারিকেল। বাসায় ফিরতেই ইমরান ভাইয়া দা দিয়ে ডাব কাটতে লেগে গেলো। আমরা ততক্ষণে কলপাড়ে হাত-পা ধোয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছি। ইমরান ভাইয়া তন্বীকে বললো,
‘গ্লাস নিয়ে এসো।’
‘গ্লাস দিয়ে কি করবি? কেটে যার যার হাতে দিয়ে দে।’
শাহেদ ভাইয়া বললো। শাহেদ ভাইয়ার কথার পিঠে এনাজ বললো,
‘পাইপ ছাড়া কি করে খাবি?’
‘তার ব্যবস্থা আমি করছি।’
তায়াং ভাইয়া বললো। ডাবের খোসার কাটা এক ছোট টুকরো আমার শরীরে ছুঁড়ে মারলো। আমি চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকাতেই আমাকে বললো,
‘রান্নাঘর থেকে ভালো দেখে কতগুলো পাটকাঠি নিয়ে আয় তো।’
‘পারবো না। নিজেরটা নিজে করে খা।’
‘মনে রাখিস। তাহলে আমিও কিন্তু তোর ভাগের ডাব কেটে দিবো না।’
আমি দাঁত কিড়মিড় করে ওর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালাম। এখন যদি ওকে আমি চিবিয়ে খেতে পারতাম তাহলে শান্তি লাগতো। ধুপধাপ পা ফেলে রান্নাঘর থেকে ভালো দেখে কতগুলো পাটকাঠি এনে দিলাম। সেগুলো ধুয়ে ভেতরে ফুঁ দিয়ে পরিষ্কার করে ডাবের পানি খাওয়ার জন্য উপযোগী করা হলো। যার যারটা সেই করে নিয়েছে।
★
সাদা মেঘের ফাঁকে এক ফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে। তা থেকে ঠিকরে যতটুকু জোস্না ধরণীর বুকে পরছে তাতে পথ চলতে আমাদের অসুবিধা হচ্ছে না।একটু আগে আমি বায়না ধরেছিলাম রাতে নদীর পাড়ে হাঁটতে বের হবো। তায়াং ভাইয়া কিছুতে আমাদের নিয়ে বের হবে না। রিতীমত যুদ্ধ করে ভাইয়াকে রাজী করিয়েছি। এর জন্য এই অব্দি কম কথা শুনায়নি। বোনদের নিয়ে ঘুরতে বের হতে ওর এতো কষ্ট লাগে কেন তা খুঁজে পাই না। মনে হয় কলিজা ছিঁড়ে যায়।
চারিদিকে শুনশান নীরবতা। মাঝে মাঝে কংক্রিট বিছানো রাস্তায় শা গতিতে দু-একটা ভ্যান গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। গ্রামের ভেতর দিকের রাস্তায় ভ্যান দিয়ে মানুষ যাতায়াত করে। ভ্যানে চড়ে কোথাও যেতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। বড় রাস্তায় দেখা মিলে ব্যাটারি চালিত অটো। এদিকে রিকশা একেবারেই দেখা যায় না। যা আছে ভ্যান আর অটো।
খালের ওপরের রাস্তা পার হয়ে আমি মেপে মেপে পা ফেলছিলাম। সবাই আগে চলে গেছে।রাতের পরিবেশ তন্ময় হয়ে দেখতে দেখতে আমি পিছু পরে গেছি।
‘জলদী হাঁটো।’
এনাজ পাশ থেকে বললো। আমি একবার সামনে তাকিয়ে ফের পাশে তাকালাম। উনি মোবাইল চাপতে চাপতে আমার পাশাপাশি হাঁটছে। চারিদিকে নজর দিতে দিতে উনাকে দেখিনি।
‘আপনাদের বাসা কোথায়?’
হাঁটতে হাঁটতে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম। এনাজ মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে আমার চোখের দিকে তাকালো।আবছা আলোতে আমি দেখলাম প্রথম দিনের মতো আবারো নজরকাড়া দৃষ্টি।বিব্রত হয়ে চোখ নামিয়ে ফেললাম।
‘ঢাকায়।’
‘ওহ।’
‘তুমি কি আগে কখনো তায়াংদের বাসায় যাওনি?’
একটা ছোট কংকর আমার জুতার ভেতর ঢুকে গেছে।হাঁটতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। পায়ে ব্যাথা পাচ্ছি দেখে বারবার পায়ের দিকে নজর দিচ্ছিলাম। এনাজের প্রশ্ন শুনে বললাম,
‘যেতাম তবে কম।আমার ঢাকা পছন্দ নয়।’
‘তোমাকে আগে কেনো দেখিনি বলো তো?’
‘সেম কোশ্চেন আমারো।’
দুজন একসাথে মুচকি হেসে উঠলাম। হাত কচলাতে কচলাতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘আপনার ভাইয়ার সাথে বন্ধুত্ব কত বছর ধরে?’
‘অনেক বছর। একসাথে হাইস্কুল, কলেজ, ভার্সিটি পেরিয়েছি।’
‘আপনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন?’
‘হুম।’
‘ভাইয়াদের বাসায় যেতেন না?’
‘হুম যেতাম তো।’
‘দেখুন কান্ড! আমি আপনাকে কখনো দেখিনি।’
‘আমিও না। এমন কি আমি জানতামও না তায়াং এর এতবড় একটা খালাতো বোন আছে। আমি জানতাম ওর ছোট দুটো খালাতো বোন আছে। তাই ভেবেছিলাম অনেক ছোট।’
‘পড়াশোনা তো শেষ। এখন কি করছেন?’
‘বেকার ঘুরিফিরি।’
মুখ টিপে হেসে বললো। আমি চোখ ছোট ছোট করে বললাম,
‘সত্যি বলেন।’
‘আব্বুর একটা কাপড়ের দোকান আছে। সেখানে বসা হয়। চাকরীর জন্য চেষ্টা করছি।’
‘ওহ আচ্ছা! বাড়িতে কে কে আছে আপনার?’
‘মা-বাবা, আরেক ছোট ভাই।’
‘বাহ্ ভালোই তো। আমাদের মতো ছোট পরিবার।’
‘একটা ছোট বোন ছিলো।’
আস্তে অথচ কাটা কাটা সুরে সে বললো। আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ছিলো বলতে?’
‘এখন নেই।’
‘কি হয়েছে?’
‘ভুয়া চিকিৎসায় মারা গেছে।’
শেষের কথাটা বলার সময় তার কন্ঠ জড়িয়ে যাচ্ছিলো। যাতে স্পষ্ট বিষাদ মাখা ছিলো। আমি কিছুটা ইতস্তত হয়ে বললাম,
‘দুঃখীত!’
এনাজ দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
‘না না ঠিক আছে।’
কিছু সময় আবার নীরবতা। ঝোপঝাড় থেকে পোকা-মাকড়ের ডাক ভেসে আসছে। মাথার ওপর দিয়ে একটা বাদুড় চেচিয়ে ডাকতে ডাকতে তার গন্তব্যে চলে গেলো। আমি একটু থেমে নিচুস্বরে বললাম,
‘আমি জানি আমার বিষয় কিছু বলতে হবে না। ভাইয়ার থেকে সব জেনে নিয়েছেন।’
আগ্রহ ভরা চোখে এনাজের দিকে তাকালাম। এনাজ পিটপিট চোখে হেসে উঠলো৷ এতে আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম আমি ঠিক ধরতে পেরেছি।
‘তোমাদের মেয়েদের একটা বিষয় আমার ভালো লাগে। তা হলো কোন ছেলেটা তোমাদের দিকে কোন নজরে তাকাচ্ছে তোমরা চট করে বুঝে ফেলতে পারে। যা ছেলেরা পারে না।’
এনাজের কথার মাঝে আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গেছি।জুতার ভেতর কংকরটা এতো জ্বালাচ্ছে যে শান্তিমতো হাঁটতে পারছি না। এনাজ জিজ্ঞেস করলো,
‘কোন সমস্যা?’
‘জুতায় ইটের কোণা ঢুকছে। এটাই বড্ড জ্বালাচ্ছে।’
‘জুতা খুলে উপুড় করে কয়েকবার ঝাড়া দাও।’
আমি তাই করলাম। এখন শান্তি। অনায়াসে হাটা যাচ্ছে। তন্বী সামনে থেকে চেচিয়ে বললো,
‘নোভাপু আছো?’
আমি হাত উঁচিয়ে বলছি,
‘হ্যাঁ,আছি।’
‘না,তোমার বোনকে বেচে দিছি।’
এনাজের কথায় আমি ফিক করে হেসে উঠলাম। টুকটাক নানা কথা বলতে বলতে আমরা পথ চলতে লাগলাম। নদীর পাড়ে অনেক সময় দাঁড়িয়ে আমরা গল্প করলাম।আবছা চাদের আলোর সাথে ঝিরিঝিরি বাতাস। পরিবেশটাকে মোহনীয় করে তুলছে। একটা ছোট ট্রলার ভটভট শব্দ করে চলে গেলো।নদীর কোল ঘেঁষে ছোট একটা বাজার।মাছ, মাংস থেকে শুরু করে চাল, ডাল,আটা,শাক-সবজি নিত্য ব্যবহার্য যাবতীয় জিনিসপত্র পাওয়া যায়। আমরা বাজারের কিনার দিকের এক টং দোকান থেকে খাঁটি গরু দুধের চা খেলাম। মোড়ের দিক থেকে ঝালমুড়ি খাওয়া হলো।ইমরান, এনাজ, শাহেদ ভাইয়ার সাথে আমি অনেকটা ফ্রী হয়ে গেছি।ইমরান ভাইয়া ভীষণ মজার মানুষ। এমন এমন কথা বলে যে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। হাসি-ঠাট্টায় জম্পেশ আড্ডা দেওয়া হলো। আরো কিছু সময় এদিক সেদিক ঘুরে আমরা বাড়ির পথ ধরলাম। ঘন্টাখানেক আমাদের চমৎকার সময় কেটেছে।
#চলবে