মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই পর্ব ৯+১০।

0
456

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই
#মম_সাহা

পর্বঃ নয়

ভীষন যত্নে বিষন্নতা মাখানো দিন দুই পাড় করলো তিস্তা। মাস্টারমশাই ছাড়া কেবল মাস্টারমশাই এর বাড়িটা না, এ গ্রামের রাস্তা, স্কুলের মাঠ, মধুসখী’র ঘাট, তিস্তার পাড়, আর সপ্তদশী’র হৃদয় খানা যেনো হাহাকার করে উঠছে। এ কেমন যন্ত্রণা! এ কেমন রিক্ততা? পুরো দুনিয়া যেনো ধূ ধূ মরুভূমি। গ্রীষ্মের চৌচির হওয়া পুকুরের মতন ভীষণ খড়া পড়েছে হৃদয়ে। ইশ, একটু বৃষ্টি, একটু প্রিয় মানুষের দেখতে পাওয়ার তৃষ্ণায় ছোট্ট লাল হৃদয়টা বিষন্নতায় নীল হয়েছে। বেদনার রঙ যে নীল!

চারদিকে আধাঁর করা সন্ধ্যা নেমেছে। তিস্তার রুমের দরজাটা হা করে খোলা। চাঁদ উঠেছে আকাশে। বেশ বড়সড় চাঁদ। রাত হলে বিদ্যুৎ থাকে না। এইতো বছর পাঁচেক আগে গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। কেবল নামের আসা আরকি। দিনের বেলায় সূর্য তার উদার হস্তে দু’হাত ভরে অনেক আলো দান করে। আর তখনই ঘরে ঘরে কৃত্রিম আলো মানে বিদ্যুৎও থাকে। কিন্তু যেই সূর্য ঢেকে যায় আধাঁরে তখনই কৃত্রিম আলোও চলে যায়। বিদ্যুৎ টা ঠিক সুসময়ের বন্ধু প্রবাদটার উদাহরণ হয়েছে।

গ্রীষ্মকালের দিনের উত্তপ্ত রোদ টিনের চালে পড়ে ঘর গরম হয়ে থাকে। রাত হলে ধীরে ধীরে সে গরম কেটে যায়। ঠান্ডা ভাব আসে। তবে আজ চারদিকে বাতাস নেই। কেমন থম মারা আবহাওয়া। তিস্তা হঠাৎ অনুভব করলো পাশের রুম থেকে বাবা,দাদী আর আম্মার কেমন যেনো ফিসফিস কণ্ঠ ভেসে আসছে। তিস্তা কান খাড়া করলো। আজকাল সবাই যেনো তার গোপনে কিছু বলে। কেনো? কী এমন কথা আছে যে সে জানতে পারবে না?

কোনো বাহ্যিক শব্দ না থাকায়, পাশের রুম থেকে কথা গুলো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তিস্তার মা রুক্ষ স্বরে বলছে,
-‘না,আমার মেয়ে এখনো ছোট। পাত্র যত সুপুরুষই হোক না কেনো বিয়ে দিবো না।’

তিস্তার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে। তার বিয়ের কথা হচ্ছে কেন আজকাল? সে কাউকে বিয়ে করবে না। মাস্টারমশাই যে অনেক রাগ করবে তার উপর।

তিস্তার ভাবনার মাঝে দাদীর গলা ভেসে এলো। সে বুঝানোর চেষ্টা করে বলছে,
-‘মাইয়া মানুষ পাড় করা হইলো বড় দায়িত্ব। কার, কী, কখন হইয়া যায় কে জানে! এর আগে ঘাঁড় থেকে বোঝা নামানো ভালা।’

-‘আম্মা,আপনি উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না। আমার মেয়েটা ছোট। আর এসব ও শুনলে কষ্ট পাবে। এ কথা ওর কান অব্দি যেনো না পৌঁছায়।’

তিস্তা ছোট্ট শ্বাস ফেলে। যাক, বাবা মা তো তার পক্ষেই। হঠাৎ দাদীর হেয় কণ্ঠে বলা কথা ভেসে এলো,
-‘মাইয়া মানুষ হইলো অল্প সময়ের অতিথি। তাগোরে কয়েকবছর যত্ন কইরা পাইলা মাইনষের হাতে তুইলা দেওয়া হইলো উচিৎ কাম।’

-‘আমি তো আমার তিস্তাার মাঝে আপনারে দেখি আম্মা। মেয়ে মানুষ অল্প সময়ের অতিথি কেনো হবে? মেয়ের মাঝে যেখানে আমি আমার মা’কে দেখি!’

তিস্তার চোখ গড়িয়ে সামান্য অশ্রুকণা বালিশের উপর পড়লো। জল গুলো শুষে নিলো নরম তুলোর দল, দাঁগ রেখে দিলো বালিশের কভার খানা। জীবনও ঠিক এমনই। কেউ ক্ষত মুছানোর চেষ্টা করে, আর কেউ আমাদের ত্রুটি গুলো যত্নে রেখে দেয়। সারাজীবন আমাদেরকে সেই ত্রুটি মনে করিয়ে আমাদের মুক্ত হয়ে উড়ার ডানা গুলো কেটে দেয়।

তিস্তা পাশের বালিশটা নিয়ে মুখের উপর চেঁপে ধরলো। কান্না গুলো যেনো দরজা পেরিয়ে পাশের ঘরে না যেতে পারে। তার চোখের জল যেনো না ঝরে তাই নিয়ে বাবা-মায়ের কত চিন্তা, আর সে এমন অশ্রু বিসর্জন করছে দেখলে তাদের কতটা না কষ্ট হবে!

প্রনয় মানে এক ঝাঁক বিষন্নতা। বালিশে মুখ চেঁপে কান্নার নাম প্রনয়। মুখে হাসি রেখে ভিতরে অনলে পু’ড়ে যাওয়া হলো প্রনয়।

সপ্তদশী বুঝে, মাস্টারমশাই এর জন্য হওয়া অনুভূতি গুলো তাকে আজীবন এক ব্যাথাময় সুখ দিবে। কী লাভ তবে এত ভেবে! নীল রঙটা বেছে নিয়েছে তো সে নিজ ইচ্ছায়। আর সামান্য বেদনা সহ্য করতে পারবে না?

______

‘আজকাল তোমার কী হয়েছে? খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছো দেখি! সারাদিন জানালার শিকলটা ধরে কাটিয়ে দিচ্ছো। পরীক্ষা যে সামনে মনে আছে?’

মায়ের কথায় ধ্যান ভাঙে তিস্তার। মৃত দৃষ্টিতে মায়ের পানে তাকায়। তনয়া বেগম এগিয়ে আসে। একটু আগে রান্না শেষ হলো। গরম ভাত আর গরম ডালের সাথে বড় মাছের এক টুকরো ভাজি নিয়ে মেয়ের রুমে এসেছেন। মেয়েটা আজকাল কেমন মন খারাপ হয়ে থাকে।

মায়ের মুখখানা লাল হয়ে আছে গরমে। তিস্তা একটু নড়েচড়ে বসলো। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে বললো,
-‘না তো আম্মা,কী হবে আমার! কিছুই হয় নি।’

তনয়া বেগম চৌকির উপর বসলেন। ভাত মাখিয়ে মাছের কাটা বেছে মেয়ের মুখের সামনে এক লোকমা ধরে বললেন,
-‘আমি তোমার পেট থেকে হয় নি, তুমি আমার পেট থেকে হইছো। আজকাল কথা লুকাতেও শিখেছো। তা স্কুল যাও না কেনো?’

তিস্তা ভাতটা মুখে নেয়। চুপ করে থাকার মোক্ষম মাধ্যম এটা।

তনয়া আবার মাছের কাটা বাছতে ব্যস্ত হয়ে যায়। কাটা ছাড়াতে ছাড়াতে বলে,
-‘আবেগের বয়সে আবেগ দেখাতে গিয়ে বিবেকের কাছে লজ্জিত হইও না। মেয়ের জাত এমনেতেই দুর্বল ভাবে মানুষ। তার উপর যদি আবেগ ধরে বসে থেকে সব জলাঞ্জলি দেও তাহলে তুমি মূর্খ। যা হচ্ছে তা বদলানোর সাধ্যি তোমার না থাকলে তা নিশ্চুপে হতে দেও আর নিজের কাজ নিজে করে যাও।’

তিস্তা জানালার বাহিরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। মা কী তবে কিছু বুঝে গেলো?

কোনোমতে সে ভাতটা গিলে নিলো। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
-‘আরে না আম্মা। তুমি ভুলভাল বলছো। কয়দিন পর পরীক্ষা তো, তাই আমি পড়াশোনায় মন বসাতে চাইছি। স্কুল গিয়ে আর কী হবে? সব পড়া তো দাগানো শেষ। এখন বাড়িতে পড়বো। আর মাস্টারমশাইও তো নেই।’

মাস্টারমশাই এর কথা মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই কথা থেমে গেলো তিস্তার। মাস্টারমশাই নেই! কে বলেছে নেই? সবসময় স্ব শরীরে থাকাকেই থেকে যাওয়া বলে? না থেকেও যে সারাটা সময় ভীষন গভীরে লেপ্টে থাকে, তাকে থাকা বলে না?

তনয়া বেগম আর কিছু বললেন না। মেয়েকে চুপচাপ খাইয়ে দিলেন। এঁটো থালাটা নিয়ে উঠে দরজা অব্দি গিয়ে ফিরে তাকালেন। বেশ শীতল কণ্ঠে বললেন,
-‘ভালো নাম্বার না করলে মাস্টারমশাই রাগ করবে। তুমি কী চাও, তোমার মাস্টারমশাই অন্য লাল টুকটুকে বউ নিয়ে আসুক রাগ করে?’

তিস্তা উত্তর দেয় না। কেবল ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। মা কি বললো? অন্য বউ মানে!

তনয়া বেগম চাপা হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মায়ের মন মেয়েকে না বুঝলে কাকে বুঝবে?

_____

বাহিরে রাতের আঁধারে হুতুম পেঁচা ডাকছে। রাতের বিভীষিকাময় আঁধারকে আরও একধাপ ভয়ঙ্কর অবস্থায় রূপান্তরিত করছে এ ডাক।

হারিকেনের আলোটা উঠোনের মাঝে নিভু নিভু ভাবে জ্বলছে। পিঁড়ি পেতে বসে আছে তিস্তা তার বাবার ফেরার অপেক্ষায়। লতিকা বেগম ক্লান্ত হাতে, তালপাতার হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে। তনয়া দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

দূর হতে শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে। লতিকা বেগম বাতাস করতে করতে বললেন,
-‘যা তিস্তা, ঘরে গিয়া ঘুমা। এত রাতে মাইয়া মাইনষের বাইরে থাকতে নাই।’

তিস্তা দাদীর কথায় একটু বিরক্ত হলো। সবার বাবার জন্য চিন্তা হচ্ছে আর দাদী কিনা আজগুবি ভাবনায় ব্যস্ত।

তনয়া বেগম নিজের মেয়ের অভিব্যক্তি বুঝলেন। ছোট্ট কণ্ঠে বললেন,
-‘থাক না আম্মা। উনি আসলে নাহয় যাইবো।’

দাদী আর কিছু বলতে যাওয়ার আগে হুড়মুড় করে তাদের বাড়িতে কেউ প্রবেশ করলো। ভড়কে গেলো তারা তিনজন। দাদী ভীত কণ্ঠে বললো,
-‘কে? কে রে?’

ব্যতিব্যস্ত এক পুরুষালী কণ্ঠে কেউ বললো,
-‘চাচী, আমি। আমি আলতাফ।’

সবাই একটু ধাতস্থ হলো। তাদের প্রতিবেশী চাচার ছেলে আলতাফ। দাদী বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
-‘আঃ মরণ। দাম’ড়া হইছোছ কী বাতাসে? এমন কইরা কেউ আহে?’

লোকটা যেনো গায়ে মাখলো না দাদীর কথা। কেবল উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
-‘আহা চাচী, আপনারা আমার সাথে বাজারে চলেন। তাড়াতাড়ি।’

এই সময় এমন কথা শুনে সবাই বিস্মিত হয়। দাদী অবাক কণ্ঠে বলে,
-‘এই রাইতে আমরা বেডি মানুষ গঞ্জের হাটে গিয়া কী করমু? নেশা করছোছ নাকি রে ছেমরা?’

ছেলেটা নিজের কণ্ঠে আকুতি ঢেলে বললো,
-‘না চাচী। আপনাগো সর্বনাশ হইছে। আমান ভাই এর পরাণ যে যায় যায় অবস্থা। বড় পথ দিয়া আসার সময় তার সাইকেল নাকি গাড়ির লগে ধাক্কা খাইছে। পা’টা শেষ। জানটা না আবার চইলা যায়। তাড়াতাড়ি চলেন।’

কথাটা মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছাতেই সবার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। ভুল শুনছে না তো? হুতুম পেঁচা’র কু ডাক বুঝি সত্যি হলো!

#চলবে

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই
#মম_সাহা

অন্তিম পর্বঃ দশ

উঠানের এক পাশে থাকা ছোট্ট চৌকিখাটে শুয়ে আছে আমান শেখ। তনয়া বেগম স্বামী’র পায়ের মাঝে তেল মালিশ করছেন। ভাগ্যের জোড়ে টানা তিনদিন হসপিটালে থাকার পর বেঁচে ফিরেছেন আমান শেখ, তবে হাঁটাচলা’র শক্তি প্রায় নেই বললেই চলে। গঞ্জের হাটে এ কয়েকদিন তিস্তা বসেছে। বাবা হলো একটি সংসারের বটবৃক্ষ, যে বৃক্ষ নিজের সর্বাঙ্গ দিয়ে রোদ্র শুষে ছায়া দেয়। কিন্তু সেই বটবৃক্ষের একটু ক্ষতিতে তার ছায়ায় থাকা ছোট্ট ছোট্ট বীজ গুলো নিস্তেজ হয়ে যায় রৌদ্রের উত্তপ্তায়। বাস্তবতার কষাঘাত থেকে বাবা যেভাবে আগলে রাখে তেমন করে আর কে-ইবা পারে!

বাবা অসুস্থ হওয়ার পর বিভিন্ন দুর্যোগ বয়ে যাচ্ছে পরিবারটার উপর। পরিবারটার হাল ধরলো উড়ন্ত, ছুটন্ত তিস্তা। যে তিস্তার বোকামো দেখে তার মাস্টারমশাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলো, শরীরে যত্ন নিতে কবে শিখবি তুই! আজ সে তিস্তা পুরো একটি সংসারের যত্ন নিচ্ছে। এইতো, পনেরটা দিন সে দিব্যি কাটালো মাস্টারমশাই বিহীন। আর, তার মাঝের দশদিন ধরে টানছে সংসারের বোঝা। বটবৃক্ষের ছায়ায় থাকা সবচেয়ে ছোট্ট আদুরে বীজটা আজ নিজের সবটুকু উজাড় করে একটু ছায়া দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে পড়ে লেগেছে।

আমান শেখ কতক্ষণ ঝিমিয়ে থাকা আকাশটার দিকে তাকিয়ে রইলো। খুব গভীর ভাবে কী জেনো ভাবলো। তারপর খুব গোপনে এক অক্ষমতা মাখানো হতাশার শ্বাস ফেললো।

তনয়া বেগম স্বামীর গোপনীয় শ্বাসটার ভয়াবহ আর্তনাদ শুনতে পেলেন বোধহয়। তেলটা স্বামীর বা’হাতে মাখতে মাখতে বললেন,
-‘নিজেকে আপনি এত অসহায় কেনো ভাবছেন? একটু ধৈর্য রাখুন। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

আমান শেখ তাকালেন নিজের অর্ধাঙ্গিনী’র পানে। মানুষটা তাকে কত বুঝে! সেই ষোলো বছরের অবুঝ তনয়া আজ পঁয়তল্লিশের গিন্নী। তিস্তা পুরো ওর মায়ের মতনই হয়েছে। তনয়াও খুব ডানপিটে স্বভাবের ছিলো। সংসারের প্রথম কয়েকবছর তো ওর খেলতে খেলতে গেলো। কিন্তু বড় মেয়েটা গর্ভে আসার সাথে সাথে বদলে গেলো সব। খেলাঘর ভুলে আকড়ে ধরলো বাস্তবতার কাঠিন্য মাখা সংসার। পুতুলের জন্য বায়না করা মেয়েটা কোনো কিছুর অপূর্ণতায়ও কোনো অভিযোগ করতো না। একদম ছটফট করা মানুষটাও তার মেয়েকে দুষ্টুমির জন্য শাসন করতে ভুলে নি। মেয়ে জাত হলো পানির মতন। সময়ের গতিবেগে নিজের স্রোত বদলায়।

আমান শেখ বেশ হতাশার স্বরে বললো,
-‘তুমি বুঝো না, কোনো আমি আমাকে এত অসহায় ভাবছি! মেয়েটা আমার হঠাৎ কেমন বড় হয়ে গেলো দেখলে? আমার যে এমন বড় মেয়ে দেখতে ভালো লাগে না। চারপাশের মানুষ গুলো কেমন শত্রু হয়ে গেলো হঠাৎ করে। মেয়েটা দোকানে বসে দেখে সবার কী হম্বিতম্বি তুমি তো দেখলে। মেয়েটার না কোনো ক্ষতি হয়ে যায়।’

স্বামীর কথায় তনয়া’র খানিক বুকে মোচড় দিলো। এমন চিন্তা যে তার মাথায় আসে না তেমনটা না। যেদিন মেয়েটা প্রথম দোকানে গিয়ে বসলো, পুরো গ্রাম যেনো হুমড়ি খেয়ে পড়লো তাদের বাড়ি। কেউ বলছে মেয়ে মানুষ এত বাড়লে গ্রামে অনাসৃষ্টি হবে, কেউবা বলছে মেয়েটা নষ্টামির পথে পা দিয়েছে, কেউবা ধিক্কার জানাচ্ছে এমন বেলাল্লাপনা’র জন্য। কিন্তু এ মানুষ গুলোই এক মুঠো চাল দিয়ে তাদের ক্ষুদার দিনে পাশে দাঁড়ায় নি।

তনয়া চুপ রইলো। একটু ধাতস্থ করলো নিজেকে। তার ভয়টা সে নিজের মাঝেই রাখবে। ভয় হলো সংক্রামিত রোগের মতন, যা অনেক কিছু অর্জনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।

শীতল কণ্ঠে তনয়া বেগম বললেন,
-‘আপনি অত চিন্তা করবেন না। ভালো কিছুই হবে।’
-‘কয়দিন পর মেয়েটার পরীক্ষা। ভুলে গেছো তনু!’
-‘নাহ্, কিছুই ভুলি নি। ও দোকানে যাওয়ার সময় বই সাথে করে নিয়ে যায়। রাত জেগে দেখি পড়াশোনা করে। আপনি ঠিক হয়ে গেলেই তো আবার সব আগের মতন হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না। মেয়ে জাতি সময়ের বিবর্তনে কখনো ফুলের মতন নরম, কখনো কাঁটার মতন ধারালো, আবার কখনো বা পাথরের মতন শক্ত। আমার তিস্তাও সেই জাতেরই।’
-‘আমি আর কখনো ঠিক হমু তনু!’

স্বামীর আকুতি মাখানো প্রশ্নে তনয়ার ছোট্ট হৃদপিণ্ড খানা ছলাৎ করে উঠে। উত্তর যে তার জানা নেই। বড় গাড়ির সাথে সাইকেলটা ধাক্কা খেয়ে পাশের খালে গিয়ে পড়ে। ডান পায়ে হাঁটু’র দিকটা বেশ নড়ে গেছে। বা পায়ে হাঁড় খানিকটা ভেঙেছে। সদরের ডাক্তার তো বলেছেন ঠিক হওয়ার আশা খুব কম। বাকিটা তো উপরওয়ালার হাতে।

______

বিকেল তখন ঠিক সাড়ে পাঁচটা। বিশাল ঝড়োয়া আবহাওয়া দেখে হাটের সব দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যে যার মতন ছুটছে নিজের বাড়িতে। রেডিওতে বার বার জানানো হচ্ছে সতর্ক বার্তা। ঝড় নাকি বেশ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করবে। হতে পারে বন্যা। সাবধান হতে বলেছে সাধারণ মানুষদের। সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা হলো তাদের এলাকা। ভীষণ ভয়ের আশংকা আছে। সাথে গ্রামের পাশেই বিশাল প্রলয়ঙ্কারী তিস্তা নদী। বন্যা হলে বাঁচার উপায় নেই।

তিস্তাও বাবার শখের দোকানখানা বেশ সাবধানে তালা মেরে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলো। ধুলোবালিতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। বড় রাস্তাটা থেকে নেমে মাটির রাস্তায় হাঁটা শুরু করলো তিস্তা। উদ্দেশ্য দুইটা। বাড়িও পৌঁছে যেতে পারবে খুব দ্রুত আর মধুসখীকেও দেখা হয়ে যাবে। মাস্টারমশাই গ্রামে নেই গুনে গুনে দিন পনেরো হলো। রোজ নিয়ম করে রেলস্টেশনে আর মধুসখী’র ঘাটে যায় তিস্তা। রেলস্টেশন যখন তাকে এক আকাশ বিষন্নতা, মাস্টারমশাই না আসার শূণ্যতা দিয়ে পাঠিয়ে দেয় তখন মধুসখী’র ঘাট হয় তার বিষন্নতা নিবারণের আশ্রয়। প্রতিদিনের রুটিনের হেরফের হয়নি আজও৷ ভীষণ খারাপ আবহাওয়া থাকা স্বত্বেও স্টেশনে গিয়েছে। মাস্টারমশাই বিহীন ট্রেণটা দেখে হতাশার শ্বাস ফেলেছে। আবার নতুন উদ্যমে এক বুক আশা জমিয়ে ফিরছে বাড়ির পথে।

_____

টিনের চালে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। সময়টা আনুমানিক রাত আটটা কী ন’টা হবে। তিস্তা’র বাড়িতে পাড়াপ্রতিবেশি’র ভীড়। দিকে দিকে লোক ছুটেছে তিস্তা’র খোঁজে। এমন ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করেও মানুষজন দাঁড়িয়ে আছে তিস্তাদের বাড়ির উঠোনে। মেয়েটা দোকান বন্ধ করে বাড়িই তো ফিরছিলো, কিন্তু বাড়ি অব্দি শেষ পর্যন্ত পৌঁছুতে কেন পারলো না সেই রহস্য জানার জন্যই মানুষ ভীড় জমিয়েছে তিস্তাদের বাড়ির উঠোনে।

হ্যাঁ তিস্তা বাড়ি অব্দি পৌঁছায় নি। কোথায় গেছে কেউ জানেনা৷ গ্রামের সব জায়গায় প্রায় খোঁজ করা হয়ে গেছে কিন্তু কোনো খবর পায় নি কেউ।

তনয়া বেগম ঠাঁই বসে আছে ঘরের দরজায়। মেয়েটা তার গেলো কোথায়! বাজার থেকে যখন সব লোক বাড়ি ফিরছিলো সে সবাইকে জিজ্ঞেস করছিলো তিস্তা কোথায়। সবার এক জবাব তিস্তা দোকান বন্ধ করে বাড়ির দিকেই আসছে। কিন্তু আধাঘন্টা, একঘন্টা করে যখন কতগুলো ঘন্টা কেটে গেলো তখন মায়ের মন কু ডাকতে শুরু করলো। খোঁজ নিতে শুরু করলো আশেপাশে। এ বাড়ি ওবাড়ি করতে করতে পুরো গ্রাম ছড়ালো, শেখদের বাড়ির ছোট মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

মধ্যবয়স্ক পুরোহিত নেপাল ঠাকুর এ কথা শুনে ছুটে আসেন। ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছুটছেন তিস্তার খোঁজে। সন্তান হারানোর কষ্ট যে সে বুঝে।

তিস্তার দাদীর মাথায় পানি ঢালছে গ্রামের এক মহিলা। মানুষটা অতিরিক্ত চিন্তায় জ্ঞান হারিয়েছে। যতই সে কঠিন কথা বলুক, নাতনি যে তার চোখের মণি ছিলো।

পাড়া প্রতিবেশী নানান কথা বলছে। কেউ বলছে, মেয়েটাকে দোকানে বসিয়ে মানুষের লোভ আনিয়েছো, কেউবা করছে হা হুতাশ। কেউবা বলছে সব শত্রুদের চাল। সুখ সহ্য হয় নি।

পাশের বাড়ির আলতাফের মা স্বান্তনার স্বরে বললেন,
-‘চিন্তা কইরো না তোমরা। হয়তো বৃষ্টি দেইখা কোথাও আটকাইয়া গেছে। ফিইরা আসবো নে।’

তার সাথে তাল মিলালো আরও দুই এক মহিলা। হঠাৎ আলতাফ ছুটে আসলো ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে আরেক চাঞ্চল্যকর খবর জানালো। “গ্রামের কিনারায় সবচেয়ে ছোট বাড়ির মাইয়েটারেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ সন্ধ্যার দিকে তাদের পালা মুরগী গুলো খুঁজতে বের হয়েছিলো কিন্তু আর ফেরে নি।”

যেমন হুড়মুড় করে তিস্তাদের বাড়িতে ভীড় জমেছিলো, তেমন হুড়মুড় করে ভীড় কমেও গেলো। আবার নতুন কিছু শোনার লোভে গ্রামবাসীরা ভীড় জমাবে সে বাড়িতে। মানুষের কাজ তো এটাই। সাহায্য কম করবে কিন্তু মজা লুটবে পুরো ষোলো আনা।

সারারাত তুমুল বৃষ্টি হলো। তনয়া বেগম ঠাঁই দরজায় বসে রইলেন। মাঝে গিয়ে শাশুড়ির মাথায় পানি দিলেন। অবাক করা ব্যাপার হলেও সে কাঁদছে না। বরং নিজেকে শক্ত করছে। প্রকৃতির সাথে সাথে যে তাদের জীবনেও বড় ঝড় আসতে চলেছে তা টের পেয়েছে সে।

______

গত রাতের তুমুল বর্ষণের পরও আকাশ এখনো মেঘলা। সকাল হয়েছে যে বুঝাই যাচ্ছে না। কেমন যেনো প্রকৃতিতে সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব।

পুরো গ্রামের মানুষ জড়ো হয়েছে ঘোষদের পরিত্যক্ত জমিখানায়। কাল অব্দি জমিটা শুকনো খড়া ছিলো। আজ সে জমিতে হাঁটু সমান কাঁদায় ভরপুর। আর সেই জমিতে কাঁদায় মাখামাখি এক কিশোরীর মৃত শরীর। এইটা সেই পনেরো বছরের কিশোরী, যে মুরগী খুঁজতে গিয়ে ভোজ হয়েছে কোনো নরপশুর। মানুষ নামক পশুদের দারুণ খাবার হয়েছে। শরীরটার সাথে সাথে মেয়েটার জানটাও খেয়েছে। অবশ্য বেঁচে থাকলেও সমাজের মানুষ তাকে বাঁচতে দিতো না।

গ্রামের মানুষদের মাঝে ভীতি তৈরী হলো। মেয়েরা তাহলে আর নিরাপদ না!

তিস্তার খোঁজ মিলে নি তখনো। অবশ্য সবাই তিস্তার পরিণতি সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। হয়তো কোনো এক পরিত্যক্ত জায়গায় এমন ভাবেই পরে থাকবে তিস্তা।

গ্রামে তখন ভীষণ আলোড়িত খবর তিস্তা। তার সাথে সাথে একটা গাঁ কাটা দেওয়া খবরও আছে। পুরো একদিনের তুমুল বর্ষণে মধুসখী এখন পানিতে টইটম্বুর। কী সুন্দর জল তার। রূপ জেনো তার ধরে না। মধুসখী’র বিষ্ময় মাখা জীবন্ত রূপ দেখে জেলেদের মুখে তৃপ্তির হাসি। ঘরে আসবে সুখ। দু’হাত তুলে কেউ শুকরিয়া জানাচ্ছে সৃষ্টিকর্তার দরবারে।

তিস্তাদের বাড়িতে তখন শোকের ছায়া। বাড়ির অদুরে ছোট কন্যা বাড়িতে নেই। পুরো একরাত কেটে আরেকটা দিন কেটেছে। ধরণীর বুকে নেমেছে আঁধার। মেয়েটা কোথায়! বেঁচে আছে তো? মধ্যাহ্নের মাস্টারমশাই ফিরে এসে পাবে তার তিস্তাকে! নাকি এক আকাশ বিদ্যুৎময় খবর পাবে? আচ্ছা,মধ্যাহ্নের মাস্টারমশাই আদৌও ফিরবে তো?

{সমাপ্ত}?

[ভালোবাসা পাঠকমহল। #মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই উপন্যাস টার প্রথম খন্ডের সমাপ্তি টানলাম এখানেই। প্রায় শ খানেক প্রশ্ন আর ডজন খানিক অনিশ্চয়তা দিয়ে শেষ হলো,প্রথম খন্ড। সব প্রশ্নের উত্তর আর একবারে সমাপ্তি নিয়ে আসবে দ্বিতীয় খন্ড বা অন্তিম খন্ড। প্রায় সপ্তাহ খানেক পর আমি অন্তিম খন্ড আনবো। সেখানেই সব রহস্য জটিলতা খুলবে। প্রথম খন্ডের তুলনায় অন্তিম খন্ড বড় হবে। মাস্টারমশাই আর তিস্তার সকল সমাপ্তি হবে সেখানে। আর হ্যাঁ, অবশ্যই এটাকে কেউ স্যাড এন্ডিং বলে আমায় বকা দিবেন না। কারণ এখানে সব ধোঁয়াশা। ততদিন অব্দি আমার পাঠকমহলের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ ধৈর্য ধরার। এই সপ্তাহে আমি কোনোভাবেই নতুন পর্ব আনতে পারবো না। আশাকরি বকা না দিয়ে ভালোবাসা দিবেন। ভালো থাকুন সবাই। আর দোয়া রাখবেন আমার জন্য। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here