#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]
৪২,,
রিয়া আত্মহত্যা করেছে, কথাটা তিলোর যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। রাতেও ওর সাথে কথা হলো। আর এখন সে নেই! দ্বিতীয়বারের জন্য হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে ও। অরিক ওর অবস্থাটা বুঝতে পেরে পাশে এসে দাঁড়ালো। ও চায়নি তিলোকে বলা হোক। কিন্তু সকলেই নিরুপায়। অফিসার ওর সাথেই এবিষয়ে কথা বলতে এসেছে। তিলো দুপা পিছিয়ে গেলো কথাটা ওর বোধগম্য হতেই। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে। অফিসার আরো যেটা বললো, সেটা শুনে তিলোর বোধ হলো তার হাড়গুলো ভস্ম হয়ে যাচ্ছে আর একটা হাড়ের কাঠামোহীন চামড়ার দেহটা দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। ও পড়ে যেতে নিতেই অরিক ওকে নিজে হাতে ধরে পুতুলের ন্যায় দাঁড় করিয়ে দিলো। অরিক মাঝে মাঝে চিন্তা করে, তিলো এতোটা আবেগপ্রবণ! বন্ধুদের কথা শুনে ওর এমন অবস্থা হয়, তাহলে আপন কারো বিয়োগব্যথা সহ্য করবে কি করে?
অফিসার আরো বলেছিলেন, রিয়া প্রায় তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলো। গতকালই ওর রিপোর্ট এসেছিলো। অফিসার এসেছেন শুধু তিলোকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে। এটা স্পষ্ট আত্মহত্যা, যার সাক্ষী রিয়ার বাবা-মা উভয়েই। তবে এরপরও পুলিশের কাজ তদন্ত করে অপঘাতে মৃত্যুর একটা পরিপূর্ণ নথি তৈরি করা। এটা ফর্মালিটি। যার কারণে তাদের তদন্তের স্বার্থে তিলোর সাথে কথা বলতেই হবে।
তিলো একটা ঘোরের মাঝে ছিলো। এরপরও আধো আধো যতটুকু পেরেছে উত্তর দিয়েছে। আবার ওর অবস্থা দেখে আর ওর উত্তরের ধরণে অফিসারও খুব বেশি প্রশ্ন করেননি। ওনারা তাড়াতাড়িই বাড়ি থেকে বিদায় হয়েছেন। অরিককে বলে গিয়েছেন, তিলো স্বাভাবিক হলে ওকে একবার থানায় নিয়ে যেতে।
ওনারা চলে যেতেই তিলো কান্নায় ভেঙে পড়লো আগেরবারের ন্যায়। ওর খেয়াল নেই আসলে ও এখন কোথায় আছে। অরিকের টিশার্ট খামচে ধরে ওর বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে। আকবর সাহেব আর অভ্র আগেই চলে গিয়েছে এখান থেকে। ফাহমিদা বেগম একবার ওর দিকে করুণার চোখে তাকিয়ে ভেতরে চলে গেলেন।
সাইদুর এহসান খুব চেষ্টা করছেন রিয়ার যাতে পোস্ট মর্টেম না হয়। নিজের মেয়েটাকে আর কষ্ট দিতে চাননা ওনি। থেতলিয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া শরীরটাকে আর কাটাছেঁড়া করতে দিতে চাননা। মুখের একটা পাশ পাবলো পিকাসোর অঙ্কিত ছবির ন্যায় হয়ে আছে। সরকারি হসপিটালে ওনাকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হলো রিয়ার পোস্ট মর্টেম বন্ধ করে লাশটা বাড়িতে নিয়ে আসতে।
রাফিদা এহসান শেষরাতে মেয়েটাকে নিজের চোখের সামনে পড়ে যেতে দেখার পর থেকেই একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছেন। নড়াচড়াও বন্ধ করে দিয়েছেন যেন। হয়তো পারলে শ্বাস নেওয়াটাও বন্ধ করে দিতেন হয়তো। আফসোস হচ্ছে, কেন তিনি একটু সতর্ক ছিলেননা যখন আগেও একবার তাঁর মেয়ে একই কাজ করতে গিয়েছিলো। আহানের মৃত্যুর পর রিয়া এবাড়িতে আসার পর থেকেই ওনি রিয়ার সাথে সাথেই থাকতেন। রিয়ার ধীরে ধীরে মানসিক অবনতি ঘটছিলো, সেটা সকলেই বুঝতে পারছিলো যারা ওর আশেপাশে থাকতো সবসময়। রাতে ওর পাশেই ঘুমাতেন রাফিদা এহসান। গতরাতেও ঘুমিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ঘুম ভেঙে ওনি রিয়াকে নিজের পাশে দেখতে না পেয়ে রুমের দরজা খোলা দেখতে পান। রুম থেকে বেরিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খোলা দেখে দ্রুত সাইদুর এহসানকে ডাকেন। দুজনে মিলে এরপর খোঁজাখুঁজি শুরু করে ছাদে গিয়ে একদম ছাদের ইটের রেলিঙের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। কি অবস্থা মেয়েটার! কয়েক মাস আগের রিয়া আর এখনের রিয়ার মাঝে আকাশপাতাল পার্থক্য। আগের মতো যৌবনের জৌলুশ সে কবেই হারিয়ে গিয়েছে চেহারা থেকে। ফ্যাকাসে চেহারার একটা অর্ধমৃত লাশের মতো তার উপস্থিতি ছিলো। এখন তো সেটাও নেই।
রিয়া তিলোর সাথে কথা বলেছিলো এখানে দাঁড়িয়েই। ফোনটা কাটার পর কয়েকবার মনে হয়েছে ওর বেঁচে থাকা উচিত ওর ভেতর বড় হতে থাকা আহানের শেষ স্মৃতির জন্য অন্তত। পরক্ষণে আবার মনে হয়েছে, এটা ওকে ঠকানো হবে। রিয়া দুচোখের পাতা ফেলে চোখে জমে থাকা পানি গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়তে দিলো। উদরে হাত মেলে রেখে নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তানের উদ্দেশ্যে তার শেষ বার্তা প্রেরণ করলো স্নেহভেজা মমতায় সিক্ত কন্ঠে,
-আ’ম সরি সোনা। তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি। আর তোমার বাবাকেও। তোমার তো অনেক দ্বায়িত্ব ছিলো আমাদের জীবনে আসা নিয়ে। তুমি পারতে তোমাকে যেমন আমরা তোমার বাবা মাকে উপহার দিতাম সেভাবে আমাদের ফেলে দেওয়া উপহারগুলো কুড়িয়ে দিতে। কিন্তু দেখো, তোমার আসার আগেই তোমার দ্বায়িত্ব শেষ। এখন সবাই আমাদের মেনে নিয়েছে কিন্তু তোমার বাবাই নেই। আ’ম সরি। আমি কখনো তোমাকে তোমার বাবাকে এনে দিতে পারবোনা তুমি চাইলেই। তোমাকে আমি তোমার ভালো একটা মা এনে দিতে পারবোনা তুমি চাইলেই। সমাজ তোমাকে অনেক কথা শোনাবে। জানো তো, তোমার মা খুব স্বার্থপর। খুব বেশি। তোমার বাবাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। আর তোমাকেও ছেড়ে কি করে থাকবে? তার থেকে চলো, আমরা তিনজন একসাথে থাকবো। সেটা সবচেয়ে ভালো হবে। আমরা সবসময় একসাথে থাকবো। সবসময়। কেউ কাউকে ছেড়ে যাবো না। উই উইল বি টুগ্যাদার ফর ইটার্নিটি। তোর স্বার্থপর মাকে ক্ষমা করে দিস। আমার পক্ষে শ্বাস নেওয়াটাও কষ্টকর হয়ে উঠেছে। আমি আর পারছিনা।
রিয়া ডুকরে কেঁদে উঠলো কথাগুলো বলতে বলতে। আরো কিছু সময় দাঁড়িয়ে ভোরটা দেখার অপেক্ষায় ছিলো। জীবনের শেষ ভোর। কিন্তু সেটা আর তার ভাগ্যে জুটলো না। রাফিদা এহসান এবং সাইদুর এহসান ছাদে এসে ওকে রেলিঙের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, রাফিদা এহসান চিৎকার করে ওঠেন। সাইদুর এহসানের এই মূহুর্তে একটা বোকা মহিলাকে বিয়ে করার জন্য আফসোস হচ্ছে। সারাজীবন ভেবেছিলেন ঘরের বউ বোকা হলে স্বামীদের সংসারের আয়ত্ত নিজের হাতে রাখতে সুবিধা হয়। কিন্তু ওনার চিৎকারে রিয়ার সতর্ক হয়ে যাওয়ায় সাইদুর এহসানকে খুব দ্রুত মেয়েকে এই ভুল করা থেকে ফিরিয়ে আনতে ভাবতে হচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে ওঠার সময় রিয়াকে পেছনে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভেবেছিলেন পেছন থেকে ওকে টেনে নামাতে পারবেন। তবে সেটা আর এখন সম্ভব না। সাইদুর এহসান ব্যস্ত ভঙ্গিতে রিয়াকে নেমে আসতে বললেন। রিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে সেটা শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। রাফিদা এহসান কেঁদে দিয়ে ওকে নামতে বললেন। কাজ হলোনা। সাইদুর এহসান এগিয়ে আসতে গেলেই রিয়া ওনাকে সাবধান করলো যাতে এগিয়ে না আসে। কিছুক্ষণের ব্যবধানে একটা ছোটখাটো নাটক উপস্থাপন হলো সেখানে, যেখানে অভিনেতা অভিনেত্রী বিনা দর্শক আর কেউ ছিলোনা। অবশেষে রিয়া সামনে পা বাড়াতে যেতেই সাইদুর এহসান চিৎকার করে বলে ওঠেন,
-আর একটুও নড়লে তুমি আমার মরা মুখ দেখবে।
রিয়া মৃদু হেসে বললো,
-বোকা বাবা! আমি থাকলে তো দেখবো। ক্ষমা করে দিও তোমার এই স্বার্থপর মেয়েটাকে।
কথাটা শেষ করতে করতেই রিয়া সামনে পা বাড়িয়ে দিলো। সেখানে মাটি প্রায় আরো একশো ফুট নিচে। স্বাভাবিকভাবেই সে মাটিতে পড়েছে। সাইদুর এহসান রিয়ার নাম ধরে চিৎকার করে এগিয়ে এসে রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালেন। রিয়ার নিথর দেহের নিচে থেকে মাটিতে রক্তের ধারা বয়ে চলেছে। রাফিদা এহসান জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এরপর। আর যখন জ্ঞান ফেরে তখন থেকেই একদম নির্বাক একটা মূর্তি হয়ে বসে আছেন। চোখের মণিটা পর্যন্ত নড়ছে না যেন।
রিয়ার খবর পেয়ে ওর বড়ভাই রিয়াজ অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে এসেছে। একমাত্র ছোটবোনকে হারিয়ে তার অবস্থাও খুব একটা ভালো নেই। বাবার সাথে থেকে ক্লান্তি দূরে ঠেলে রিয়ার দাফন কাজে লেগে পড়েছে।
তিলো কয়েকবার অরিকের কাছে আবদার করেছে ওকে রিয়াদের বাড়িতে নিয়ে যেতে। অরিক শোনেনি। ও একা আসতে চাইলেও বাঁধা দিয়েছে। তিলোর মনের অবস্থা এমনিতেই ভালো নেই। এরপরের ঘটনাগুলো ওর প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা কতোটুকু সে সম্পর্কে অরিকের বেশ ভালোই ধারণা হয়ে গিয়েছে।
রিয়ার মৃত্যু পরবর্তী দিনগুলো আবারও অনেকটা কঠিন হয়ে উঠেছিলো। তবে এবার অরিক নিজ দ্বায়িত্বে খুব তাড়াতাড়িই সবকিছু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছে। অদ্ভুতভাবে ফাহমিদা বেগম অরিকের ফ্ল্যাটে ওদের সাথেই কয়েকমাস যাবৎ থেকেছেন আর তিলোকে সঙ্গ দিয়েছেন। বিষয়টায় অরিক অবাক হলেও তিলোর অবাক হওয়ার ক্ষমতা ছিলোনা। এটা ছিলো ওদের জন্য একটা চমকপ্রদ ব্যাপার। ফাহমিদা বেগমের সাথে তিলোর সম্পর্ক খুব ভালো না হলেও যথেষ্ট স্বাভাবিক। মেনে নিতে হয়েছে বলে মেনেছেন থেকে একটু উন্নত হয়েছে।
সময় চিরবহমান। পাশাপাশি মানিয়ে নেওয়ার একজন ভালো প্রশিক্ষকও বটে। কোনোকিছুই চিরস্থায়ী নয়। খারাপ দিনগুলোও। আবার ভালো দিনগুলোও একইসাথে। এই ভালো খারাপের মিশেলেই আমাদের জীবনটা। খারাপ সময়টুকু আসে বলেই ভালো সময়ের মর্যাদা আছে।
তুলি নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে পাশাপাশি নিজের ছেলেরও খেয়াল রাখছে। কাজটা কঠিন বলে নাসীরা পারভীন ইশানের খেয়াল রাখেন অধিকাংশ সময়। আনিস সাহেব তুলিকে বলেছেন, আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে যেমনটা তিলোকে বলতেন যদিনা হালিম সাহেব তিলোর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির না হতেন। তুষারের এসএসসির রেজাল্ট সন্তোষজনক। সে এখন কলেজে উঠেছে।
মীরার পরিবার, তার গোপন প্রেমিক সম্পর্কে এখন জানে। ছেলেটা আসলে বিদেশে থাকে বিধায় মীরা নিরবে নিভৃতে প্রেম চালিয়ে যেতে পেরেছে। দেখা করার ঝামেলায় পড়ে কারো হাতে কখনো ধরা পড়ে যায়নি। ছেলেটা ফিনল্যান্ডে পড়াশোনা করছে। পরিবার ভালো দেখে মীরার বাবা-মা বাঁধা দেয়নি। মেয়ে খারাপ, বখে যাওয়া কোনো ছেলে পছন্দ করেনি। মীরার বাবা ছেলে সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে রেখেছেন। তার পরিবারের সাথেও কথা বলেছেন। তাদেরও মীরাকে পছন্দ হওয়ায় ছেলেটার শেষ পরীক্ষাটার অপেক্ষায় আছে তারা। পরীক্ষা শেষে দেশে ফিরলেই খুব তাড়াতাড়িই তাদের চারহাত এক করে দেবে।
রিতার অবশেষে বিয়েটা হয়েই গেলো। ভালো একজন ব্যবসায়ীর সাথে রিতার ছেলেরা এবং নাতিনাতনিরা খুব ধুমধামের সাথে তার বিয়ে দিয়েছে। গ্রামে বিয়ের আয়োজনে প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিলো। অরিক আর তিলোও গিয়েছিলো সেই অজপাড়াগাঁ গ্রামটিতে। কিন্তু সেখানে নবাবি হালে ছিলো শহর থেকে যাওয়া প্রত্যেক অতিথি। রিতার বন্ধু হিসাবে আলাদা আপ্যায়নের দাবিদার ছিলো তারা।
অনিকেত অস্ট্রেলিয়ায় এক শ্বেত সুন্দরীর সাথে প্রায়ই ছবি তুলে ফিডে দেয়। ওর বন্ধুদের লাইকের পাশাপাশি কমেন্টে ওকে ওরা জ্বালিয়ে খায়। অনিকেত ওদের প্রশ্নের উত্তরও দেয়। মাঝে মাঝেই ফ্রেন্ডলিস্টটা চেক করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এখনো আহান আর রিয়ার যৌথভাবে পরিচালনা করা আইডিটা রয়েছে। আইডিটা কেউ ডিঅ্যাক্টিভেট করেনি৷ শুধু সেই আইডিটা দিয়ে এখন কিছু পোস্ট হয়না। কোনো ট্যাগ হয়না। কোনো রিঅ্যাক্ট পড়ে না। কোনো কমেন্ট আসে না। কেউ আলাদা করে নক করেও রাতে জ্বালায়না। ওদের দুজনের কাপল পিক আপলোড দিয়ে প্রেমময় কোনো ক্যাপশন থাকে না। রাত দুইটা তিনটার সময় তারা ব্রিজের হলুদ বাতির নিচে মোটরসাইকেলে হেলান দিয়ে কোনো ছবিই তো আসলে তোলে না। কোথাও ঘুরতে গিয়ে ভিডিও করে না। খাওয়ার ভিডিও পোস্ট করে ওদের লালা গ্রান্ডও ক্ষেপিয়ে তোলে না। মাঝে মাঝেই অনেকে ওদের পুরানো পোস্টগুলো বারবার দেখে। ওদের হাসিখুশি জুটিটা ওদের সকলের মনেই একবার হলেও উচ্চারণ করতে বাধ্য করেছিলো, ‘পার্ফেক্ট কাপল’, পাশাপাশি একটা আকাঙ্ক্ষা নিজেদের জীবনেও সেরকম একজনকে পাওয়ার, যেমনটা তিলোর মরুভূমি হৃদয়ে একবার মনে হয়েছিলো ওদের বিয়েরদিন ওদের দেখে। সবই এখন স্মৃতি।
ফিরোজ পড়াশোনাটাই মন দিয়ে করছে। তাকে তার বাবার একমাত্র ছেলে হিসাবে ব্যবসাটা সামলাতে হবে। খুব বড় দ্বায়িত্ব তার। ব্যবসাটা ওর দাদুর ছিলো। ফুফুর অংশটুকু সে ভাগ করে নিয়ে বেঁচে দিতে চাইলে ওর বাবাই সেটুকু কিনে নিয়েছেন। পুরোটা সামলাতে নিজেকেও যোগ্য প্রমাণ করার একটা তাগিদ সে অনুভব করছে। পাশাপাশি কেউ একজন তার জীবনে এসেও আসছে না। মেয়েটাকে সে ডাক্তারের চেম্বারে দেখেছিলো নিজের যখন জ্বর এসেছিলো তখন৷ এরপর খোঁজ নিয়েও খুঁজে পায়নি৷ তবে হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়।
তৌকির রয়েছে নিজের মতো। সারাদিন মেয়েদের সাথে ফ্লাট করেই দিন কাটছে। কিন্তু পাকাপোক্তভাবে কারো প্রতি ওর মন টিকছে না। একজনকে একদিন একটা দশ টাকার নেতিয়ে পড়া গোলাপ দিয়ে প্রপোজ করে তো দুদিন কথা বলে তাকে আর ভালো লাগে না। সবার মাঝেই কোনো না কোনো বিষয় তৌকিরের অপছন্দের। বিশেষ করে ও যাদেরকে প্রপোজ করে, তাদের দুদিন পর ন্যাকা কথাগুলো। ফিরোজ ওকে বলেছে, ভালো মেয়ে দেখে প্রপোজ করতে৷ ও তো করেও সেই ধরনের মেয়েদের সাথে যারা আহ্লাদে গদগদ হয়ে পড়ে। আসলে সেরকম না করলেও তো ওর নেতিয়ে পড়া ফুলগুলোতে কারাই বা রাজি হবে?
তিলো আর অরিকের মাঝে একদিন ভীষণ ঝগড়া লেগেছে। তিলো তো থাকবেই না অরিকের সাথে আর। নাসীরা পারভীন তিলোর পক্ষ নিয়ে অরিককে ইচ্ছামতো ঝেড়ে গিয়েছেন। নিজের রাগ সবটা ঝেড়ে গিয়েছেন। তিলো হঠাৎই রেজা সাহেবের কথা তুললো। সেটা তুলে নিজেও বুঝতে পারলো, আসলে ও গতানুগতিক একটা চাল চেলেছে ঝগড়ার সময়, যেটা নিয়ে লড়লে নিশ্চিত হার। অরিক হেসে দিয়ে জানালো যে, শামীম রেজা সাহেব একজন ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করেছেন। আশা করা যায়, খুব শীঘ্রই সুখী সুখী বাচ্চাদের জন্ম হতে চলেছে তাদের সংসারে।
অনি তিলোর সাথে একদমই সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছিলো অরিকের সাথে ওর বিয়ের আগেই। তবে কিছুদিন আগে ফোন করে কান্নাকাটি জুড়ে বসলো। সে বুঝতে পেরেছে, আসলে অরিক ওর সাময়িক মোহ ছিলো। বুঝতে পারার কারণ হলো ওর বর্তমানে নতুন করে কারো প্রেমে বুদ হয়ে ওঠা। তিলোকে তার ছবিও পাঠিয়েছে। তিলোর কেন যেন, ছেলেটাকে একদম পছন্দ হয়নি। তিলো ওকে সেটা বললে ও বলেছে, প্রতিশোধ নিচ্ছে নাকি তিলো? তিলো হতাশ হয়ে ওকে আর কিছু বললো না। মেয়েটা উল্টো বোঝে কেন সব? অনি ছেলেটা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানেও না। কিন্তু সে প্রেমে মাতাল। তিলোর ভয় হচ্ছে, আবারও অন্তরের মতো না ও কোনো ভুল করে বসে।
সানজিদ এবং রোৎশীর মাঝেমধ্যেই কথা হয়। রোৎশী প্রায়ই এখন অরিকের বাড়িতে বেড়াতে আসে। রোৎশীর মা, মেয়ের হঠাৎই অন্তর্মূখী স্বভাব ত্যাগ করে বহির্মূখী হয়ে ওঠার রহস্য আন্দাজ করতে পারলেও নিশ্চিত হতে পারছেন না। আগে রোৎশীকে টেনে নিয়েও বাড়ির বাইরে বের করা কষ্টকর ছিলো। এখন প্রায়ই সে অরিকের ফ্ল্যাটেই ঘুরতে আসে। রাকিব একদিন সরাসরি ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলো। রোৎশী নিজেকে বাঁচিয়ে বলেছে, তিলোর সাথে সময় কাটাতে ওর খুব ভালো লাগে বিধায় আসে এখানে।
#চলবে