ভয়_আছে_পথ_হারাবার পর্ব 41

0
1039

#ভয়_আছে_পথ_হারাবার
ফারিশতা রাদওয়াহ্ [ছদ্মনাম]

৪১,,

তিলোকে ফোনটা রিয়া করেছে। প্রায় আড়াই মাসের ব্যবধানে রিয়ার ফোন পেয়ে তিলো যেমন অবাক হয়েছে, তেমনি ওর ভেতর অজানা ভয় জেঁকে বসেছে। পাশাপাশি অদ্ভুত একটা অনুভূতি। দমিয়ে রাখা কৌতুহল এবং আবেগ একইসাথে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে একটা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির হঠাৎ জেগে ওঠার মতো।
তিলো খুব বেশি না ভেবে দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
-কেমন আছিস রি…

আর কিছু বলার আগে চুপ করে গেলো। এতো জোরে বলায় অরিকের অসুবিধা হতে পারে ভেবে তিলো বিছানা ছেড়ে নেমে বারান্দার দরজা খুলে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো। ওপাশ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে তিলো নিভে যাওয়া কন্ঠে বললো,
-রিয়া! তুই আছিস?

এবার ভাঙা একটা কন্ঠে ‘হুম’ শব্দটা ক্ষীণভাবে তিলোর কানে এসে পৌঁছালো। এতগুলো দিন পর রিয়ার কন্ঠ শুনতে পেয়ে তিলোর শরীরে অদ্ভুত একটা শিহরণ বয়ে গেলো। গায়ের রোমগুলোকে খাড়া হয়ে যেতে অনুভব করলো সে। তিলো আবেগি কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো,
-কেমন আছিস তুই? এতোগুলো দিন যোগাযোগ কেন করিসনি। বাড়ি গেলেও দেখা করিস না। আমাদের কেমন লাগে তোর কোনো ধারণা আছে?

রিয়া ওর সম্পূর্ণ কথা অগ্রাহ্য করে মলিন কন্ঠে বললো,
-তুই বিয়ে করেছিস। তাই না?

তিলো দমে গেলো। নিজের অনুভূতিগুলো আড়াল করে বললো,
-হ্যাঁ।

-তোর বর তোর পাশেই ঘুমায়। তাই না?

রিয়ার প্রশ্নে তিলো বিব্রতবোধ করতে শুনতে করেছে। এরপরও ওকে এবিষয়ে কিছু না বলে কেবল ‘হুম’ বললো। রিয়া আবারও বললো,
-তোকে খুব ভালোবাসে সে?

-বাদ দে। আগে তো বল তোর কি অবস্থা?

রিয়া এবারও ওকে একইভাবে অগ্রাহ্য করে বললো,
-সত্যিই খুব ভালোবাসে?

তিলো চুপ করে গেলো। রিয়ার আচরণ ওর কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। ও আগে কখনো এভাবে কথা বলেনি। ওর কন্ঠে যেটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, সেটা কেবলই শূন্যতা। যেন খাঁ খাঁ মরুভূমি। তৃষ্ণার্ত কোনো পথিক পানির সন্ধ্যায় মরিয়া।
তিলোকে চুপ করে থাকতে দেখে রিয়া আবারও বললো,
-বল না। খুব ভালোবাসে তোকে? আদর করে?

তিলো এবার সত্যিই ওর কথায় খুব বেশি বিরক্ত। বিরক্তিমাখা কন্ঠে বললো,
-আমার ঘুম আসছে। রাখছি আমি।

রিয়া এবার মৃদু হেসে বললো,
-বিরক্ত হচ্ছিস?

তিলো উত্তর দিলো না। তবে ফোনও কাটলো না। রিয়া দীর্ঘ একটা নিশ্বাস নিয়ে বললো,
-জানিস তিল, আহান আমাকে বলেছিলো আমাকে ছেড়ে কখনো যাবে না। সস্তা যেসমস্ত প্রমিজ করে থাকে সস্তা সম্পর্কে। আমাদের সম্পর্কটা আসলে সস্তাই ছিলো। দেখ এখন, আমার পাশে এখন ফাঁকাই থাকে। ছেড়ে চলে গেলো। জানিস, ও বলেছিলো, আমাদের পড়াশোনা শেষ করার পর আমাদের বেবি আসুক পৃথিবীতে? কিন্তু আমি কি বলেছিলাম? ওকে বলেছিলাম, আমার এখনই বেবি চাই। আমাদের কোলে তাদের নাতি নাতনি দেখলে ওরা সবাই মেনে নেবে আমাদের।

রিয়া থামলো। তিলো চুপ করে ওর কথা শুনছিলো। রিয়া আবারও বললো,
-সরি। এতো রাতে আমার আজগুবি অমূলক কথাগুলো বলতে তোকে ফোন করে বিরক্ত করলাম। আসলে একটা ব্যাপার আছে, তোর বিবাহিত জীবনের জন্য আমার শুভকামনা। দেখিস, তোর খুব সুইট কিউট একটা বেবি হবে। মেয়ে হবে৷ তোর মতো মিষ্টি দেখতে আর গায়ের রং অরিক স্যারের মতো হবে। আহান বলতো। ও বলতো, আমাদের প্রথম সন্তান একটা মেয়ে হোক। তোর হবে দেখিস। খুব সুন্দর হবে সে।

তিলো এবারও কিছু বললো না। নির্বাক হয়ে ওর কথাগুলো শুনে ছলছল হয়ে ওঠা চোখজোড়ায় জমে যাওয়া পানি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিলো। রিয়ার কন্ঠ আরেকবার ভেঙে গিয়েছে। সে নাক টেনে বললো,
-ভালো থাকিস। আর ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের কাছে ধরে রাখিস। আঁকড়ে ধরে থাকবি একদম। কোনোদিনও ছাড়বি না যতক্ষণ তোর নিশ্বাস তোকে ছেড়ে না যায়। হারিয়ে ফেলিস না প্লিজ। তোকে খুব ভালোবাসি রে। আমার বন্ধুগুলো সবাইকে খুব ভালোবাসি। আমি চাই না, আর কারো আমার মতো কিছু হোক। আবারও তোর বিবাহিত জীবনের জন্য আমার শুভকামনা। হ্যাপি ম্যারিড লাইফ। আচ্ছা, রাখছি। তুই ঘুমিয়ে পড়। আমারও ঘুমের প্রয়োজন। আল্লাহ হাফেজ।

রিয়া ফোন কেটে দিলো তিলোকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। তিলোর হঠাৎই কেমন ফাঁকা ফাঁকা অনুভূত হচ্ছে নিজেকে। মনে হচ্ছে কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। দূরে চলে যাচ্ছে। কিন্তু ও নিজের এই অনুভূতির কোনো মানে খুঁজে পেলোনা।
তিলো বেশি ভাবলো না। আবার নিজের মনের মাঝেও কোনো একটা বিষয় কাঁটার মতো ফুটছে। তিলো রুমে ফিরে এসে অরিকের পাশে শুয়ে পড়লো। আবারও ঘুরে অরিকের দিকে ফিরে মাথার নিচে একটা হাত ভাজ করে পুরে দিলো। অরিক ওর দিকে ফিরেই ঘুমিয়ে আছে। রাস্তা থেকে আসার আলোটা একদম ওর মুখে পড়ছে। তিলো কয়েক মূহুর্ত ওর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে চোখ বুজে ফেললো। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হলোনা। বাকিটা রাত ওর মাঝে অবচেতন একটা অস্থিরতা কাজ করেছে। তিলো ভালো করে ঘুমাতে পারলোনা। ঘুমের মাঝেও একটা সতর্কতা। বারবার জেগে উঠেছে কোনো কারণ ছাড়াই। কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ ওর গলা ধরে এসেছে। মনে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদতে পারলে খুব শান্তি লাগতো। নিশ্বাস ঘন হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে গলার কাছে শ্বাস আটকে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত বাতাসের অভাব। ক্লান্তিতে পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে। তিলো যতোবারই চোখ মেলেছে পাশে অরিককে দেখতে পেয়ে স্বস্তি পেয়েছে। রিয়ার কথামতো তাকে আঁকড়ে ধরে থাকা প্রয়োজন। হারিয়ে যেতে দেবে না তিলো ততদিন পর্যন্ত যতদিন ওর হৃৎস্পন্দন থেমে না যায়। শেষবার তিলো চোখ মেলে অরিকের দিকে এগিয়ে এসে ওর বুকের ওপর হাত রেখে ঘুমালো। ক্ষণিকের জন্য নয় বরং বরাবরের মতোই সে কিছু একটা দ্বারা পরাভূত হলো, যেটাকে তার বোধ হলো প্রেম।

পরদিন ভোরে ফাহমিদা বেগমের ডাকাডাকিতে অরিকের ঘুম ভেঙে গেলো। ও চোখ মেলে নিজের পাশে তিলোকে ঘুমাতে দেখে মৃদু হেসে উঠে বসলো। ফাহমিদা বেগম উত্তেজিত হয়ে দরজা ধাক্কাচ্ছেন। যেন ভেঙে ফেলবেন। অরিক দ্রুত উঠে দরজা খুলে দিতেই ওনি রাগত্ব স্বরে বললেন,
-তোর বউ কোথায়?

অরিক একটু থমকে বললো,
-ও তো এখনও ঘুমাচ্ছে। কিছু হয়েছে আম্মু?

ফাহমিদা বেগম আরো রেগে কর্কশ গলায় বললেন,
-আর হয়েছে! তা তোর বউকেই জিজ্ঞাসা কর। ওর জন্য পুলিশ এসেছে বাড়িতে। কি করেছে জিজ্ঞাসা কর ওকে।

অরিক ওর মায়ের কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো। ও ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
-ও আবার কি করবে? পুলিশ কেন আসলো?

ফাহমিদা বেগম বিরক্ত হয়ে বললেন,
-এতো কথা না বলে ডাক। কি বলছেন তারা? ওকে কি জিজ্ঞাসাবাদ করবে। ওর কোন বান্ধবী কি করেছে?

-তুমি যাও। আমি দেখছি।

ফাহমিদা বেগম তবুও গেলেন না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেন। অরিক কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে মৃদুস্বরে তিলোকে ডাকতে শুরু করলো। তিলো না উঠে বরং আরো আরামে কম্বলটা দিয়ে মুড়ি দিলো। অরিক এবার বেশ জোরেই ডাকলো পাশাপাশি এটাও বললো যে পুলিশ এসেছে। তিলো পুলিশ শব্দটা কানে যেতেই উঠে পড়লো। চোখ ডলতে ডলতে জিজ্ঞাসা করলো,
-কে পুলিশ? কোন পুলিশ এসেছে? কেন এসেছে?

অরিক হয়তো ওর ঘুম থেকে উঠে আধো কন্ঠে হেসে দিতো। কিন্তু এখন ও সেই অবস্থায় নেই। চিন্তিত কন্ঠে বললো,
-তোমাকে চাচ্ছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসে দেখা করো।

তিলো চোখ ডলা থামিয়ে অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
-আমাকে মানে? আমি কি করেছি? অরিক, বিশ্বাস করো আমি কিচ্ছু করিনি যে পুলিশ আসবে। আমি তো আম্মুর ব্যাগ থেকে দশটা টাকাও কখনো চুরি করিনি।

ফাহমিদা বেগম বিরক্ত হলেন ওদের সম্পূর্ণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে। বিরক্ত হয়েই বললেন,
-কি করেছো তুমি তা তো ওনারা আর তুমিই বলতে পারো। এখন সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি নিচে এসো। আর পারি না। আর কতো যে দেখা লাগবে? এবাড়িতে অবশেষে কিনা পুলিশও ঢুকলো।

বলতে বলতে ওনি নিচে চলে গেলেন। অরিক চোখের ইশারায় ওকে দ্রুত আসতে বলে নিজেও নিচে চলে গেলো।
তিলো অবাক হলেও নিজের কৌতুহল মেটানোর তাগিদেই হোক বা বাধ্য হয়ে, দ্রুতই নিচে গেলো। লিভিং রুমে কয়েকজন পুলিশ। সাথে মহিলা কনস্টেবলও আছে। তিলোর ভয় ভয় লাগলেও ও চুপচাপ সবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। একজন আকবর সাহেবের সামনাসামনি সোফায় বসে চা পান করছে। অরিক চিন্তিত ভঙ্গিতে সোফার হ্যান্ডেলে কনুই ঠেকিয়ে কপালে আঙুল স্লাইড করে চলেছে। তিলো সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে অভ্র বলে উঠলো,
-এই তো তিল।

সোফায় বসে থাকা পুলিশ অফিসার তিলোর দিকে তাকিয়ে একবার ওকে চোখ দিয়ে মেপে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
-আপনি মিস…মিসেস তিলোত্তমা ইয়েসয়ি?

তিলো মৃদু কন্ঠে বললো,
-জ্বি।

-মিসেস রিয়া এহসান আপনার বন্ধু?

-জ্বি।

-কালরাতে আপনাকে ফোন করেছিলেন তিনি?

তিলো এবার সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছে। কম্পিত কণ্ঠে ও হ্যাঁ বোধক উত্তর দিলো। পুলিশ অফিসারটি আবারও বললেন,
-সেটাই হওয়ার কথা, ওনার কল লিস্টে শেষের নাম্বারটা আপনার৷ আমি বলতে দুঃখিত হচ্ছি যে, তিনি আর নেই। ভোরের আগেই ওনার বাবা মায়ের সামনেই ওনি ওনাদের বসবাসরত বারো তলা অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ছাদ থেকে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহনন করেছেন।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here