ভ্রমর (পর্ব – ১১)
সুমাইয়া আক্তার
__________________
মধ্যরাত।
চারপাশ নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে শুধু কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। স্নিগ্ধার চোখে ঘুম নেই। আগামীকাল তার গায়ে হলুদ। পর্ষুদিন সে অন্যকারো ঘরণী হয়ে যাবে! অন্য কাউকে স্বামীর স্থানে বসাতে হবে৷ ইসলাম ছোঁয়ার অধিকার দিয়ে দেবে। কিন্তু স্নিগ্ধা কি এই অধিকার দিতে পারবে? নিজের ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে অন্যের বাহুতে আবদ্ধ—এ তো কণ্টকে ভরা ভাবনা! এতসব ভেবে আবারও বিচলিত হলো স্নিগ্ধা। শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না তার। ঘুমন্ত তাওহিদার পাশ ছেড়ে, জানালা খুলে জানালার পাশে বসে পড়ল সে। নানার ভাবনা ভাবতে লাগল একা একা নিজ মনে। সব ভাবনা’ই বিরহের! আচ্ছা, ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে বেঁচে থাকা আদৌ সম্ভব? এখন’ই তো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হচ্ছে স্নিগ্ধার। পরে কী আর নিঃশ্বাস নেওয়া যাবে? না, ভালোবাসার মানুষকে ছাড়া বেঁচে থাকার চিন্তাও অসম্ভব। ঘুরন্ত সিলিং ফ্যানের দিকে তাকাল স্নিগ্ধা। তারপর আলনায় থাকা এক ওড়নার দিকে। কী এক ভাবনা মগজে বিদ্যুতের মতো খেলে যেতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। দ্রুত ফ্যান থেকে চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে গুমোট অন্ধকারে তাকাল সে। এমনিতেও তো মিন্টুকে ছাড়া মরে যেতে হবে। তবে অন্যের স্ত্রী হওয়ার আগে কেন সে মৃত্যুর আগমন নয়?
সকালের আলো ফুটেছে সেই কখন। পাখিদের কলকলানি জোরালো। জমিদার বাড়িতে মানুষের মৃদু গুঞ্জন। টেবিল থেকে মাথা সরালো স্নিগ্ধা। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখল সকালের আলো তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে অবলীলায়। চোখ কচলে চারপাশে তাকাল সে। তাওহিদা চুপচাপ খাটে পা ঝুলে বসে আছেন। তার দৃষ্টি স্নিগ্ধার মুখে। মেয়ের কষ্ট পুরোপুরি না হলেও কিছুটা বুঝতে পারছেন তিনি। কিন্তু কিছু করার নেই। এর মধ্যেই গত রাতে এশার সময় একটা ঘটনা ঘটে গেছে। স্নিগ্ধা তখন মিন্টুর সাথে দেখা করার জন্য জমিদার বাড়ির পেছনে! সে সময় চিৎকার করে বাড়িতে ঢোকেন সিকিন্দার। তাকে দেখে মোটামুটি সবাই অবাক হলেও, অবাক বোধটির সীমা পেরিয়ে ছিলেন শরিফ এবং তাওহিদা। তারা জানতেন, সিকিন্দার আসবেন। নিজের মেয়েকে তিনি খুব ভালোবাসেন; এত সহজে যার তার হাতে মেয়েকে তুলে দেওয়ার মানুষ তিনি নন।
শরিফকে দেখে সিকিন্দারের জোরালো কণ্ঠ হালকা মিইয়ে গেলেও তিনি বলে ওঠেন, ‘আমি আমার মেয়েকে নিতে এসেছি।’
শরিফ তখন’ই কিছু বললেন না। সাহস পেলেন সিকিন্দার। যা তা বলতে লাগলেন তিনি। একসময় শরিফ হুঙ্কার দিলেন, ‘তোর কী মনে হয়, ও শুধু তোর মেয়ে? আমার কেউ নয়? ওর খারাপ হোক, তা কি আমি চাইব?’
শরিফের কথাটা ঔষধের মতো কাজ করেছিল। সে সুযোগে এমন আরও কিছু বলেন শরিফ। এটাও বলেন, সিকিন্দারকে ত্যাজ্যপুত্র করলেও তাকে ভালোবাসেন তিনি। সিকিন্দারের আসার খবর শুনে চলে আসেন শাওনের মা-বাবা রাজিয়া এবং আতিক। আসে শাওনও। নিজের মেয়ে কোন ঘরের বউ হতে চলেছে তা নিজ চোখে দেখেন সিকিন্দার। অনেক কথা, বুঝ, আবেগে মন গলে তার। কিন্তু বাবা-ছেলের মান-অভিমান শেষ হয় না।
শেষমেশ সিকিন্দার দুইটি শর্ত দিয়ে বিয়েতে রাজি হন। প্রথমত, স্নিগ্ধা যদি রাজি থাকে তবেই এ বিয়ে হবে। দ্বিতীয়ত, বিয়ের পর মেয়ের সামান্য কান্নার শব্দ কানে এলে তৎক্ষনাৎ আতিকের বাড়ি থেকে মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন তিনি।
শরিফ রাজি হন। তিনি জানেন, দ্বিতীয় শর্তে যা বলা হয়েছে, তা কখনও হবে না। শাওনের মতো ছেলে কখনো চোখ রাঙিয়ে, রাগ দেখিয়ে স্নিগ্ধাকে বকবে না পর্যন্ত। সমস্যা বেঁধে গেল প্রথম শর্তে। যদি স্নিগ্ধা মিন্টুর কথা সিকিন্দারকে বলে দেয়?
তাওহিদাকে অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কষ্ট দ্বিগুণ বেড়ে গেল স্নিগ্ধার। সকালে এই অসময় তাওহিদা এত উদাশ কেন? কাল পর্যন্ত তো এত উদাশ, অন্যমনস্ক ছিলেন না তিনি! তাওহিদাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাবে, এমন সময় দরজায় ঠকঠক করে আওয়াজ তুলল কেউ। গম্ভীর মুখে দরজার দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল স্নিগ্ধা।
ঘোর ভাঙল তাওহিদার। দ্রুত উঠে দরজা খুলতেই সিকিন্দারের কন্ঠ, ‘স্নিগ্ধার ঘুম ভেঙেছে?’
স্নিগ্ধা এক মহূর্ত দেরি করল না সিকিন্দারের দিকে তাকাতে। অবশেষে তার বাবা এসেছে! সারাবিশ্ব যখন স্নিগ্ধার কাছে আলোকহীন, সিকিন্দার তখন মিটিমিটি আলো বয়ে বেড়া প্রদীপ হয়ে ধরা দিল।
ছুটে সিকিন্দারের কাছে গেল স্নিগ্ধা, ‘বাবা তুমি? তুমি এসেছ? কবে? কখন?’
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করলেন সিকিন্দার, ‘শান্ত হও মা।’
তাওহিদা ঘর থেকে প্রস্থান করলেন। বাবা-মেয়েকে একটু একা ছাড়া উচিৎ। তাওহিদা বেরিয়ে যাওয়া সঙ্গে সঙ্গে লাঠির ঠকঠকানি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন শরিফ। শরিফকে দেখে মাথা নামিয়ে ফেলল স্নিগ্ধা। কালকের জন্য অনুতপ্ত সে। বিবেকে লাগছে এখন। ওভাবে শরিফের সাথে বেয়াদবি করে কী লাভটা হলো? এটা স্নিগ্ধার মনের একপাশের কথা। উল্টোপাশ বলছে, গতকাল যা হয়েছে, ঠিক হয়েছে। কেন শুধু নিজেরটুকু ভাববে সবাই? যার বিয়ের জন্য এত সাজসজ্জা, এত শোরগোল—তার মন কী চায়, কেউ কি জানতে চেয়েছে?
সিকিন্দার প্রথমেই জানতে চাইলেন, ‘এই বিয়েতে কি তোমার মত আছে?’
সিকিন্দারকে মিন্টুর কথা বলবে ভেবেও আর বলা হলো না। শরিফ এসে সিকিন্দারের পাশে বসলেন। স্নিগ্ধার সাথে স্বাভাবিক কিছু আলাপচারিতা শেষে শরিফের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হলেন সিকিন্দার।
কিছু মহূর্ত পেরোলো।
জন্মদাতা পিতাকে নিজের প্রিয় মানুষটির সম্পর্কে কিছু কীভাবে বলা যায়, তা ভেবে বিচলিত স্নিগ্ধা। এমন সময় বিভিন্নরকম বাজে চিন্তা স্নিগ্ধাকে কষ্ট দিতে শুরু করলে সে শরিফকে উপেক্ষা করে বলেই বসল, ‘আমার এই বিয়েতে মত নেই বাবা।’
শরিফ দাঁতে দাঁত চেপে চুপ থাকলেন। সিকিন্দার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন? শাওন কী ভালো ছেলে নয়? আতিক-রাজিয়া…’
মাঝখানেই সিকিন্দারকে থামিয়ে দিল স্নিগ্ধা, ‘ওরকম কোনো ব্যাপার না।’
‘তাহলে?’
‘আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি।’ মুখ আরও নিচু করল স্নিগ্ধা। আটকা কন্ঠে বলল, ‘আমি মিন্টুকে পছন্দ করি।’
সিকিন্দার মুখ গম্ভীর করলেন। বললেন, ‘অন্য কাউকে পছন্দ করলে আমি তোমার সঙ্গ দিতাম। কিন্তু তুমি এমন একজনকে বেছে নিয়েছ, যার হাতে তোমাকে সঁপে দিলে পরে আমি নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।’
স্তব্ধ স্নিগ্ধা। চারপাশে এত শোরগোলের মাঝে যেন নীরব কোনো ঘরে বন্দি সে। যে ঘরে কষ্টে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও কেউ শোনার নেই। পৃথিবীরও কী অদ্ভুত নিয়ম—যখন কেউ ভাগ্যে থাকে না, মাথা ঠুকে মরলেও তাকে পাওয়া যায় না। স্নিগ্ধার শেষ ভরসা তার অর্ধপ্রিয় বাবা ছিল। কিন্তু এখন? যে বাবা ছোটবেলাতেই প্রিয় মানুষদের থেকে আলাদা করেছিলেন, সে বাবা পুনরায় প্রিয় মানুষকে কেঁড়ে নেবেন না—কী করে ভেবেছিল স্নিগ্ধা? বুক ফেটে কান্না আসছে তার। দিকবিদিক ছুটে বেড়াচ্ছে আত্মাটা। অন্তরটা পুরোপুরি ভালোবাসা শূন্য হয়ে গেলেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে হয়তো। অপেক্ষা শুধু সেই সময়টার’ই!
__________
জমিদার বাড়িতে হৈ-হুল্লোড়। চার গ্রামসহ আত্মীয়-স্বজন প্রায় তিন শতাধিক মানুষ নয়ন জুড়িয়ে দেখছে স্নিগ্ধার গায়ে হলুদ। এত মানুষের ভীড়ে মিন্টুর ছলছল দুই চোখ তৃষ্ণাত্ব হয়ে খুঁজে চলেছে হলুদ মঞ্চে বসা স্নিগ্ধাকে। চোখের সফর শেষ হলো—হলুদ শাড়িতে স্নিগ্ধার দেখা মিলল। শাড়িটির লাল পাড়ে দুই আঙুল রেখেছে স্নিগ্ধা৷ আরেক হাত কোলে মুষ্টিবদ্ধ। দুই হাতের কব্জিতে বাঁধা গোলপ ফুল। মাথায়ও গোলাপ, গলায়ও গোলাপ। এত সব সজীব গোলাপের মাঝে স্নিগ্ধা নামক গোলাপটি একেবারে নির্জীব। তার চোখ, মুখ যেন শাওনের নামে ছোঁয়া এই হলুদকে অবরোধ করে বলছে, ‘আমি শেষপর্যন্ত মিন্টুকে চাইব! তোমরা আমার দেহকেই আটকে রাখ, মনকে তো আর পারবে না!’
আহা, কত সুন্দর দেখাচ্ছে স্নিগ্ধাকে! এই স্নিগ্ধার পাশে কি মিন্টুর মতো ছেলেকে মানায়? নিজেকে তাচ্ছিল্য করল মিন্টু। বুকটা মুচড়ে ধরল কেউ। তখন’ই স্নিগ্ধা চারপাশে তাকাল। সৃষ্টিকর্তা হয়তো তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, মিন্টু আশেপাশে আছে। সময়মতো লুকিয়ে পড়ল মিন্টু। আড়াল হয়ে রইল। আজ মিন্টু আড়াল হলো, আগামীকাল সারাজীবনের জন্য স্নিগ্ধা আড়াল হয়ে যাবে। সে কষ্ট মিন্টু সহ্য করতে পারবে তো?
মধ্যরাতে স্নিগ্ধাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আড়ালে থেকেছে মিন্টু। স্নিগ্ধার গায়ে হলুদ শেষে আড়াল থেকে বেরোয় সে। সবাই যে যার বাড়িয়ে যেতে শুরু করে। মিন্টু দাঁড়িয়েই থাকে। কে যেন তাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়, কে যেন পা খুঁচিয়ে চলে যায়—কোনো অনুভূতি হয় না মিন্টুর। ভালোবাসা সবার জীবনে আশির্বাদ নয়, কারো কারো জীবনে অভিশাপ। তাই বলে স্নিগ্ধার ভালোবাসা মিন্টুর জন্য অভিশাপ, এমন নয়। আজ যদি সে স্নিগ্ধাকে ভালো না বাসতো, তবে কি এমন হতো? এভাবে কষ্ট পেতে হতো? বেহায়া মন বোঝে না! এ পৃথিবীতে কিছু ভালোবাসার অধিকার তখন থাকা উচিৎ, যখন ভালোবাসার মানুষটিকে খাওয়ানো-পরানোর সামর্থ্য থাকে।
সবার প্রস্থান শেষে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় মিন্টু। না খেয়ে শুয়ে পড়ে সে। তহমিনা জোর করেও খাওয়াতে পারলেন না। অর্ধমৃত রোগীর মতো বিছানায় পড়ে থাকল মিন্টু। আগামীকাল পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ঝড় বয়ে যাবে। অথচ সেই ঝড়ের ভয়ঙ্কর রূপ দুইটি মানুষ ছাড়া কেউ দেখতে পাবে না!
__________
আজকে প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য। দিনের ফুটফুটে আলো, হালকা বাতাস সবার কাজের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। বাড়ির ডান পাশে গরু, ছাগলের মাংস রান্না করা হচ্ছে। শহরের যে প্রসিদ্ধ পাকনি (যে রান্না করে) তাকে নিয়ে আসা হয়েছে। সাথে তার তোরো-চৌদ্দজন সাহায্যকারী। বরযাত্রীদের জন্য খাবারের স্থানে আরও অতিরিক্ত সাজসজ্জা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে রমরমা অনুষ্ঠান। গ্রামের সবার মুখে এখন জমিদার বাড়ির প্রশংসা ঝুলছে। অন্যসময় হলে এসবে প্রচণ্ড খুশি হতো মিন্টু। কিন্তু আজ আর সম্ভব না। ইতিমধ্যে বারোটা বেজে গেছে। সকালে আরেকবার স্নিগ্ধাকে হলুদ মাখানো শেষ। আপাতত তাকে গোসল করাতে নিয়ে গেছে ক’জন মহিলা। নিজের যন্ত্রণার চেয়ে স্নিগ্ধার অসহায় অবস্থা দেখে মিন্টু বিপাকে পড়ছে বেশি। এই তো আর মাত্র কয়েক ঘন্টা! তারপর? তারপর স্নিগ্ধার বিদায়, অন্যের নির্ভরশীল হাত, অন্যত্র মন দিয়ে সংসার গোছানো।
রান্না যেন ভালো হয়, তার দায়িত্ব পড়েছে মিন্টুর ওপর। এ যেন কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা। কিন্তু কিছু করার নেই। শরিফ নিজে এসে রান্নার দিক সামলাতে বলে গেছেন। বারণ করা এখন অমূলক। তাই সকাল থেকে এসব দেখে বেড়াচ্ছে মিন্টু। তবে ভুলেও সিগ্ধার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়নি সে। যদি হঠাৎ মিন্টু নিজেকে সামলাতে না পেরে স্নিগ্ধাকে জড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদে দেয়!
রান্নার কাজ শেষ হলে কুঁড়েঘরে ফিরল মিন্টু। গোসল সেরে চুপচাপ বসে থাকল। ঘরে তহমিনা নেই। এই সুযোগে বুকের ভেতরে কফের মতো জমে থাকা কষ্টগুলোকে চোখের জল করে বইয়ে দিল সে। মাথা আঁকড়ে ধরে থাকল, হাতের আঙুল কাঁমড়ে ধরে থাকল কিন্তু কষ্ট কমল না। এই কষ্ট নিবারন হবে কী করে কে জানে! হঠাৎই কুঁড়েঘরে কারো আগমনের শব্দে চোখ মুছে ফেলল মিন্টু। সৈকত এসেছে শরিফের ফরমান নিয়ে। মিন্টুকে এক্ষুণি একবার ওই বাড়িতে যেতে হবে। উঠে দাঁড়াল মিন্টু। কষ্ট, ক্ষুধা নিয়ে একপ্রকার দুর্বল সে। কখন না জানি পড়ে গিয়ে আছাড় খায়!
জমিদার বাড়িতে ঢুকতেই শরিফ হাতে দামি পাঞ্জাবি, পায়জামা নিয়ে এগিয়ে এলেন। বললেন, ‘মিন্টু, এসব তোমার জন্য। ঝটপট এসব পরে নাও। একটু পরেই বরযাত্রী আসবে। শাওনের পাশে পাশে থাকতে হবে তোমায়।’
শরিফ এসব করছেন যাতে সুষ্ঠুভাবে বিয়েটা সম্পূর্ণ হয় এবং এসবে ব্যস্ত থেকে মিন্টুর যন্ত্রণা কমে। কিন্তু মিন্টুর জন্যে এসব হিতে বিপরীত হচ্ছে—জানেন না শরিফ।
হাসার চেষ্ট করল মিন্টু, ‘থাক-না দাদামশাই। আমি এভাবেই ঠিক আছি।’
‘আমার চোখে তুমি ওভাবে ঠিক নেই।’
শরিফের কন্ঠ রূঢ় শোনাতেই পাঞ্জাবি, পায়জামা হাতে নিল মিন্টু।
মিন্টু বেরিয়ে আসার সময় ওপরে ওঠার সিঁড়ির দিকে চোখ যেতেই স্নিগ্ধার দেখা মিলল। স্নিগ্ধাও তাকাল। মহূর্তে দুইটি মানুষের অন্তরে প্রবল ভূমিকম্প চলে গেল। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল ছোট বড় শহর। অথচ কেউ বুঝতেও পারল না। দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করল মিন্টু। কুঁড়েঘরে এসে হাঁফাতে লাগল সে। সময় নিয়ে পাঞ্জাবির ভাঁজ খুলতেই অনেক কয়টা রঙবেরঙের চিরকুট মেঝেতে পড়ল। সবগুলো হাতে উঠিয়ে নিল মিন্টু। প্রত্যেকটাতে স্নিগ্ধার হাতের এক’ই লেখা, ‘তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি মিন্টু।’
তহমিনা কলপাড়ে কিছু একটা করছেন। তার উপস্থিতিতে মিন্টুর পাঞ্জাবি, পায়জামা পরে বেরিয়ে আসা ছাড়া আরেকবার কান্নার উপায় তৈরি হলো না।
__________
‘বর এসেছে, বর এসেছে!’ বলে মুখরিত হলো চারপাশ। মহূর্তে স্নিগ্ধার ঘর শূন্য হয়ে সবাই বেরিয়ে গেল বরকে দেখতে। মনি এসে ঘরে ঢুকল। স্নিগ্ধা চুপচাপ, গম্ভীর মুখে বসে আছে। গাল বেয়ে গড়াচ্ছে ঝকঝকে অশ্রু বিন্দু। ভীষণ মন খারাপ হলো মনির। স্নিগ্ধার আশপাশে যেতে পারছে না সে। শরিফ আপাতত স্নিগ্ধার কাছে যেতে নিষেধ করেছেন। সবার সামনে কেঁদে সে হুলুস্থুল না বাঁধিয়ে ফেললেই ভালো। নিচে নেমে গেল মনি। স্নিগ্ধা ডাকলও না।
স্নিগ্ধার ঘর ফাঁকা দেখে দরজায় দাঁড়াল মিন্টু। মনের সাথে আর বোঝাপড়া চলল না। সামনাসামনি স্নিগ্ধাকে দেখার আশা আর স্নিগ্ধাকে আরেকবার ছোঁয়ার ইচ্ছা সে দমাতে পারেনি। স্নিগ্ধা চোখ তুলে তাকাল। হতবাক হয়ে গেল মিন্টুকে দেখে। মিন্টুও হতবাক হলো। স্নিগ্ধার মুখে কোনো প্রসাধন নেই, হাসি নেই—অথচ কী সুন্দর’ই না দেখাচ্ছে! ছলছল দুই চোখ, সিক্ত দুই লালচে ফর্সা গাল, নাকে নোলক, মাথায় টিকলি, কপালে ছোট্ট টিপ, কান্নায় কাঁপতে থাকা ঠোঁট মিন্টুকে স্তব্ধ করে রেখে দিল। কিছু একটা মিরাকল হলেই এই মেয়েটিকে পেয়ে যেত সে। কিন্তু হায়! ভাগ্য যে এত নিষ্ঠুর!
ধীরপায়ে ঘরে ঢুকল মিন্টু। স্নিগ্ধার সামনে টুল টেনে বসল।
‘এই সময়টুকু পালিয়ে বেড়ালে না যে?’ অভিমানী কণ্ঠ স্নিগ্ধার।
মিন্টু কাঁপা কাঁপা হাতে স্নিগ্ধার হাত ধরতে গিয়েও ধরল না। হাত নামিয়ে ফেলার আগ মহূর্তে স্নিগ্ধা মিন্টুর শক্ত হাতটি আঁকড়ে ধরল। আঁতকে উঠল মিন্টু; এমন কিছু হবে ভাবেনি সে।
স্নিগ্ধা ডান হাতটা মিন্টুর কপালে ছুঁইয়ে বিমূঢ় হয়ে বসে থাকল। সহসা বলে উঠল, ‘খুব ভালোবাসো তাই না?’ মিন্টুর উত্তর পেল না স্নিগ্ধা। ফের বলল, ‘আর কত চুপ করে থাকবে? এখনও সময় আছে মিন্টু।’
ডানে-বামে মাথা নাড়ালো মিন্টু,‘না। আচ্ছা, তুমি আল্লাহ্কে বিশ্বাস করো?’
‘বিশ্বাস করি বলেই এখনও জীবিত আছি।’
স্নিগ্ধার মুখনিঃসৃত এমন ভয়ঙ্কর কথায় ভীত হলো মিন্টু। তৎক্ষনাৎ সে বলে উঠল, ‘একদম চুপ। তুমি আল্লহর উপর ভরসা রাখ। তিনি তোমাকে সেটাই দেবেন, যা তোমার জন্য সঠিক। যদি সেটা শাওন হয়ে থাকে, তবে শাওনকে। আর যদি সেটা আমি হয়ে থাকি, তবে আমাকেও।’
মিন্টুর কথায় কী ছিল স্নিগ্ধা জানে না। কিন্তু কথাটা কষ্ট একটু কমালো তা বোধ হলো। ঘরের দিকে শোরগোল বাড়তেই স্নিগ্ধার হাত ছেড়ে দিল মিন্টু। বলল, ‘আমি তোমাকে ছেড়ে ভালো থাকব। একসময় তুমিও আমাকে ছেড়ে ভালো থাকতে পারবে। যদি তুমি আমাকে বিশ্বাস করে থাক, তবে নিজের ক্ষতি করতে যেও না।’
‘আত্মহত্যার কথা বলছ? আজকেই সেই চেষ্টা করেছিলাম।’
স্নিগ্ধার কথায় চমকে উঠল মিন্টু। বুক হাহাকার করে উঠল তার। স্নিগ্ধার ইশারায় সিলিং ফ্যানের দিকে তাকাল সে। দেখল, একটা লাল ওড়না ঝুলছে ওতে। মাথা ঘুরে উঠল মিন্টুর। দ্রুত ওড়না খুলে বিস্ময় নিয়ে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে থাকল সে।
স্নিগ্ধা আওড়ালো, ‘তোমাকে ছাড়া আমি বিরান ঘরের মতো। বলেছিলাম না, আল্লাহকে বিশ্বাস করি বলেই এখনও জীবিত আছি!’
কাজিকে নিয়ে অনেক লোকজন ঘরে ঢুকল। মিন্টুর চোখের আড়াল হলো স্নিগ্ধা। তারপর কত সময় পেরিয়ে গেছে কে জানে! একসময় কাজি বেরিয়ে গেল। ঘরের সব পুরুষরাও বেরিয়ে গেল। ঘোর ভাঙল মিন্টুর। স্নিগ্ধা ‘কবুল’ পড়েছে জেনে বাইরে খুশি হলো সে; ভেতর ঠিক’ই কষ্টে জর্জরিত হলো। মিন্টু জানে, স্নিগ্ধা তার উপর প্রচুর অভিমান করেছে। এ অভিমান কখনো শেষ হবে কিনা তার জানা নেই। তারাও তো পারত একটা সুন্দর সংসার গড়তে! একবার স্নিগ্ধার কথা শুনে সেই চেষ্টা করলে কি খুব খারাপ হতো? শেষ মহূর্তে এসে এমন হাজারও কথা কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগল মিন্টুকে।
স্বাভাবিক হওয়ার বৃথা চেষ্টা করে, ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পূর্বে হাহাকার কন্ঠে মিন্টু বলে উঠল, ‘আল্লাহ্ শাওনকেই তোমার জন্য সঠিক জেনেছেন।’
কষ্টে নিঃশ্বাস ভারী হলো স্নিগ্ধার। মুখ থেকে তখন অস্ফুট স্বর বেরিয়ে এলো, ‘কিছু জিনিস বিশ্বে মানানসই হওয়ার জন্য অপূর্ণ থেকে যায়। ভালোবাসাও এমন। তাই…’ স্নিগ্ধার কন্ঠনালী থেকে আর কোনো শব্দ বেরোলো না।
বিচলিত হয়ে উঠল মিন্টু। ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সারাজীবনের জন্য স্নিগ্ধাকে হারানোর আশঙ্কায় ফের নতুন করে ভীত সে। এত শোরগোল, চিৎকারের মাঝেও মহূর্তে এক আকাশ নীরবতা নেমে এলো তার জীবনে। একসঙ্গে স্নিগ্ধা-মিন্টুর মন যেন বলে উঠল, ‘এই শেষ দেখা, এই শেষ ছোঁয়া।’
(চলবে)
(পরের পর্বে সমাপ্তি টেনে দেবো। জানি না কেমন হচ্ছে। নিজেকে ঠিক লাগলেও যারা পড়ছেন, তাদের কেমন লাগছে সেটা অজানা। কারণ গল্পটি কেমন লাগছে তা জানাতে প্রচুর অনীহা আপনাদের। এবার অনীহা ছেড়ে আশা করি কিছু জানাবেন। ভুল হলে ধরিয়ে দেবেন, আমি শুধরে নেব ইনশাআল্লাহ।)