#ভ্রমণ
#পর্বঃ৯
লেখাঃসামিয়া খান
শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত রুমে খুব বেশী সময় বসে থাকতে পারেন না জেরিন।কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠে।কেমন একটা আঁশটে আঁশটে গন্ধ লাগে এসির হাওয়া তার নিকট।এটা আগে ছিলনা।প্রেগ্নেনসির সময় থেকে হওয়া শুরু করেছে।ইনায়া খুব মনোযোগ দিয়ে নোট প্যাডে তার বিস্তারিত লিখছে।মেয়েটাকে ভালো লেগেছে জেরিনের কাছে।কি সুন্দর দেখতে, স্মার্ট।এস্পেক্ট করার পর থেকে জেরিন একটু মুটিয়ে গিয়েছেন।এতে অবশ্য ইয়াদের ভালোবাসা কমেনি তার উপর।
“মিস.জেরিন!সরি আমি মিসেস বলিনা কাউকে।”
“সমস্যা নেই বলুন।”
“আসল কথা হলো আপনি দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।পুরো ব্যাপারটাতে মনে হলো এ সময় একা থাকতে আপনি আসলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না।”
জেরিন চুপ মেরে রইলো।
“আপনার স্বামীর বাড়িতে কে কে রয়েছেন?”
“আমি সঠিক জানিনা।”
“কেন?আপনি তাদের সাথে কখনো দেখা করেননি?”
“নাহ্।আসলে ইউসুফের দাদু প্রেম পছন্দ করেন না।তাই ইউসুফ এখনো জানাননি তাদের।”
“সেকী!এখনো জানায়নি?”
“না।”
“তাহলে না জানিয়ে বাচ্চা কেন নিলেন?”
“হুট করে হয়ে গেলো।এতে অন্তত একটা জিনিস ভালোই হলো।ইউসুফের অন্তত একটা জলদি থাকবে তার বাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার আমাকে।”
কথাটা বলে একটু মলিন হাসবার চেষ্টা করলেন জেরিন।ইনায়া খেয়াল করলেন নেহাত হাসার প্রয়াস ছাড়া এটা আর কিছু নয়।
“ওয়েল।আপনি আমার সাথে দেখা করতে কালকে আবার আসুন।আপনার ঘুম হওয়া সবথেকে বেশী প্রয়োজনীয়।”
“সেটা আমি নিজেও মানি।”
“মি.ইউসুফ মানে আপনার স্বামী আপনার সাথে থাকে তো?”
“প্রতিদিন আসে।এবং রাতে মাঝেমধ্যে থাকে এমনি না থাকলে রাতে প্রচুর কল করে খবর নেয়।”
একথা বলার সময় জেরিনের মুখে আর কোন মলিনতার ছাঁপ ছিলনা।বরং একটু গর্ব অনুভব করলো মনে হয় সে।
“আপনি বেশ ভাগ্যবতী এ ব্যাপারে।”
“তা বলতে পারেন।”
“আমি আপনাকে এখন স্লিপিং পিল দিতে পারবো না। কিন্তু আপনি নিজ থেকে ট্রাই করবেন ঘুমানোর।খুব বেশী ভালো হয় যদি রোজ রাতে মেডিটেশনে নিজেকে যুক্ত রাখেন।সেক্ষেত্রে নামায বেস্ট মেডিসিন।”
জেরিন মাথা নাড়িয়ে জ্বী বললেন।
“আপনি কাল একবার আসবেন।আর ভিজিট আমার এসিস্ট্যান্টের কাছে দিবেন।”
জেরিন উঠে যেতে নিলে ইনায়া কি মনে করে তাকে থামিয়ে দিলেন।
“আপনার যদি খুব বেশী সমস্যা না হয় তবে আপনার হোয়াটস এপ নাম্বার অথবা ফেসবুক একাউন্ট পেতে পারি?আসলে আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে।”
“অবশ্যই পেতে পারেন।”
জেরিনের বেশ ভালো লাগলো ইনায়ার কাছে এসে।এবং সে ঠিক করে নিলো তার যখুনি খারাপ লাগবে সে ইনায়ার কাছে এসে নিজের মনকে হালকা করে নিবে।
,
,
ইনায়া নিজের চেম্বার থেকে এসে জামা কাপড় ছেড়ে ডিভানে বেশ আয়েশ করে বসলেন।ইয়াদ এখনো তাকে ফেসবুক থেকে ব্লক ছুঁটায়নি।এটাতে মন খারাপ হলেও জেরিনের ক্ষুদে বার্তায় তার বিক্ষিপ্ত মন বেশ কিছুটা স্বস্থি পেলো।ইনায়ার বেশ মজা লাগছে জেরিনের সাথে কথা বলতে।দুজনের প্রিয় মানুষটার নাম ইউসুফ।যদিও ইনায়া একবার ভেবেছিলেন যে জিজ্ঞেস করবেন পুরো নাম কি তবে কি মনে করে যেন আর করলেন না।জেরিনের সাথে কিছুসময় কথা বলে বেশ ভালো লাগলো ইনায়ার।ফোন রেখে চুলোয় পানি বসালো চায়ের জন্য।জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে।কতো শত কথা মনে হয়।অথচ বলতে পারেনা।মাঝেমধ্যে মনে হয় বুকটা ফেঁটে মারা যাবে কিন্তু পারেনা।বুকও ফাঁটেনা আর সে মরেও না।
“আচ্ছা তার কি আমার জন্য মায়া হয়না?”
“নাহ হয়না তো প্রজাপতি।”
কথাটা বলেই পিছন থেকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিলেন ইনায়াকে ইয়াদ।ইনায়া একবার ভাবলো অভিমানে পিছন ফিরবেনা।কিন্তু বিচ্ছেদের যে বরফ তার মনে জমেছিল ইয়াদের উষ্ণতায় তা পানিতে পরিণত হয়ে গিয়েছে।উল্টো ইয়াদকে ঝাপটে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সে।
“আমাকে মাফ করা যায়না প্রজাপতি?”
“এতো কষ্ট কেন দেন আমাকে আপনি?মানুষ বুঝি মনে হয়না।”
“উহু।আপনি তো আমার ভালোবাসার দেবী।”
কথাটা শুনে যতোটুকু ছিল অভিমান সেটাও আর অবশিষ্ট রইলো না।ইয়াদ ইনায়াকে নিয়ে কাউচে গিয়ে বসলেন।
“রাগ উঠেছিল রে প্রজাপতি।”
“বুঝেছি তো।”
“তাহলে এতো সময় কেন নিজেকে কষ্ট দিলেন?ঠিকমতো খাওয়া হয়নি যে তা আমি খুব ভালো করে জানি।”
“ইয়াদ!”
“বলেন ময়না পাখি।”
“চাঁদ কে?”
“চাঁদ!হলো আমার ভালোবাসা আমার অস্তীত্ব।”
“তবে আমি কে?”
“ভালোবাসার দেবী।”
“ধ্যাত।এসব হেয়ালী করবেন না তো।”
“খুব শীঘ্রই জানতে পারবেন চাঁদ এটা কি।”
“কোন মেয়ে নয় তো ইয়াদ?”
ইয়াদ কোন জবাব দিলেন না।মুখ ডুবিয়ে নিশ্বাসের দমকা ধাক্কা দিতে লাগলেন ইনায়ার গলায়।রোমাঞ্চকর হয়ে উঠলো ইনায়ার শরীর।
,
,
ইয়াদ যখন বাড়ীতে ফিরলেন তখন রাত আটটা বাজে।সাইরাহ্ তার দাদুর সাথে ড্রয়িং রুমে বসে বসে টিভি দেখছেন।ইয়াদ এসে কিছু না বলে দাদুর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লেন।
“দাদু বাবা কোথায়?”
“তার রুমে।”
“খেয়েছে।”
“হুম বহু আগে।তা ফাংশন কবে রাখছিস?”
“কালকের পরেরদিন।একটু বেশীই বড় করে করতে চাচ্ছি।”
“তোদের যা মনে হয়।”
দাদুর সাথে কথা বলতে বলতে তার দৃষ্টির অগোচরে ইয়াদ সাইরাহ্ এর হাত মুঠোয় ভরে নিলেন।সাইরাহ্ এর কেমন যেন লাগলো।অথচ কালকে রাতের পর থেকে তাদের মধ্যে কোন পর্দা নেই।
“রুমে যাই দাদু।সাইরাহ্ উঠো।”
ইয়াদের দাদুর দিকে একবার তাঁকিয়ে সাইরাহ্ বাধ্য মেয়ের মতো উঠে দাঁড়ালেন।ইয়াদের পিছন পিছন যাচ্ছে সে।রুমে এসে ব্লেজার,ঘড়ি এগুলো খুলতে খুলতে সাইরাহ্ কে প্রশ্ন করলেন ইয়াদ।
“খেয়েছেন? ”
“না।”
“আমি শুনেছি দুপুরেও কিছু খাননি।তা কেন?রান্না ভালো হচ্ছে না?”
“এমা তা হবে কেন?কিন্তু আমার খেতে ভালো লাগেনা।”
“আমি রাঁধলে খেতে ভালো লাগবে?”
সাইরাহ্ বেশ অবাক হলেন।
“আপন রাঁধবেন আমার জন্য?রাঁধতে পারেন?”
“অবশ্যই।কাপড় বের করো গোসল করে আসি তারপর নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবো আমার চাঁদকে।”
কথাটা বলে সাইরাহ্ কে একবার অধর চুম্বন করে ওয়াশরুমে চলে গেলেন ইয়াদ।সাইরাহ্ কাপড় বের করে রাখলেন।
গরম গরম ধোঁয়া উঠা ভাত তার উপর ঘি ছড়িয়ে দিলেন ইয়াদ।টমেটো পুড়ে তা কাঁচা মরিচ,কাঁচা পেঁয়াজ কুঁচি কুঁচি করে কেঁটে সরিষার তেল,নুন ও তেঁতুল দিয়ে মেখে নিলেন ইয়াদ।তারপর তা দিয়ে ভাত মেখে সাইরাহ্ এর মুখে তুলে দিলেন।সাইরাহ্ এর মনে হলো সে অমৃত মুখে দিলেন এতো স্বাদ লাগলো তার কাছে বলার বাহিরে।
“আপনি এটা কোথা থেকে শিখেছেন?”
“কেন ভালো লাগেনি?”
“অনেক ভালো লেগেছে।”
“আমাদের বাসায় একজন লোক ছিল সে খাওয়া শিখিয়েছিল এরকম তেঁতুল দিয়ে।”
“দারুণ খেতে হয়।”
“তারমধ্যে আরো দারুণ জানেন কেন লাগছে?এইযে মেঝেতে বসে তামার প্লেটে খাচ্ছি যে তাই।”
ইয়াদ আর সাইরাহ্ কিচেনের লাগোয়া বারান্দায় বসে খাচ্ছিলেন।
“বাসায় কথা বলেছেন?মায়ের সাথে তারেকের সাথে?”
“বলেছি।”
খাওয়ার মধ্যে নানান ধরণের কথা বলছেন ইয়াদ।এতে সাইরাহ্ কখনো মিটিমিটি তো কখনো জোরে হাসছে।
দূর থেকে ইয়াদের দাদু এগুলো দেখে বেশ খুশী হলেন।কি সুন্দর সবকিছু।ইয়াদ তার ছেলের রক্ত।বাবার মতোই দেখতে হয়েছে ছেলেটা।ইশ!তার ছেলে যদি আজ বেঁচে থাকতো!কতো সুখ তার জীবনে তখন আরো হতো।
বৃদ্ধার মনের কথা প্রকৃতি শুনতে পেলো।এজন্য হাসছে সে প্রকৃতি।অদ্ভুতমোহ হাসি।
চলবে,,,