#ভ্রমণ
#পর্বঃ১৮
লেখাঃসামিয়া খান
ইয়াদ বেডে আধশোয়া অবস্থায় বসে রয়েছেন।হাতে ক্যানোলা লাগানো।এমনিতে সে অনেকটা সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু নিজের বাবার মৃত্যুতে একটু বেশীই ভেঙে পড়েছেন।সাইরাহ্ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ইয়াদকে দেখছেন।ইয়াদের কাছে যেতে খুব বেশী ভয় করে এখন তার।হসপিটালে যখন সাইরাহ্ ইয়াদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন তখন ইয়াদ শুধু সাইরাহ্কে একটি প্রশ্নই করেন।কেন তাকে বিষ দেওয়া হয়।সেদিন সাইরাহ্ কোন জবাব দিতে পারেনি।যদিও ইয়াদের ব্যবহার অনেকটা ঠান্ডা তার প্রতি।
“ওখানে দাঁড়িয়ে না থেকে একটু আমার বুকে আসেন তো চাঁদ।”
সাইরাহ্ চমকে উঠলেও গুটিগুটি পায়ে ইয়াদের সামনে এসে দাঁড়ালেন।ইয়াদ হাত বাড়িয়ে দিলেন তার প্রতি।
“বুকে আসবেন?”
একটু দ্বিধা নিয়ে ইয়াদের হাত আঁকড়ে ধরলো সাইরাহ্।বুকে তার মাথা ঠেকালো ইয়াদ।
“ভয় পাচ্ছেন আমাকে দেখে?”
“হুহ।”
“তাহলে বিষ কেন দিলেন?আমি তো কোন ক্ষতি বা অন্যায় করিনি আপনার সাথে।”
সাইরাহ্ চুপ মেরে থাকলেন।
“সেদিন যখন জুস খেলাম তখুনি জুস থেকে একটা গন্ধ নাকে পাই।সন্দেহ হলেও মন থেকে দূর করে দেই।পরে রিয়াকশন শুরু হলে কোনকিছু চিন্তা না করে বমি করি।যাতে অন্তত আপনাকে বিধবা না হতে হয়।কী বলেন আপনি?”
কথাগুলো কৌতুকের মতো শুনালো।সাইরাহ্ কাঁদছেন।ইয়াদের বুকের কাছে কাপড়টা খামচে ধরলেন।
“আমি কোন অন্যায় করেছিলাম আপনার সাথে?”
“উহু।”
“তাহলে এমন কেন?আমার টাকার জন্য?”
“নাহ।”
“তাহলে?”
সাইরাহ্ কিছু জবাব দেওয়ার আগে রুমে ইয়াদের দাদু প্রবেশ করলেন।বৃদ্ধা সাইরাহ্কে ইয়াদের কাছে দেখে বেশ রাগান্বিত হলেন।
“তুই এখন যা এখান থেকে।আমার দাদুভাইকে একা ছেড়ে দে।”
“কেন?ও যাবে কেন?”
“যাবো না?তুই জানিস ও তোরে বিষ দিছিলো।”
“হুম জানি।”
“তাও তুই ওকে এতো আদর করছিস?”
“ও আমার স্ত্রী।আর আমার হবু বাচ্চার মা।”
“তার সাথে তোর বাবার খুনি এবং তোর খুনি প্রায় হয়ে গিয়েছিল।”
ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“মানে?”
“এক নচ্ছার মেয়েলোক, তোর বউ আর তোর বউয়ের ভাই কি যে সেদিন তোর বাবাকে বলল।তুই বলে খুনি,চরিত্রহীন আরো কতো কি।সেই শোকেই তো তোর বাপটা মরলো।”
“কোন মেয়ে?সাইরাহ্ কোন মেয়ের কথা বলছে দাদু।”
ইয়াদ বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে।
“কোন মেয়ে বলবি কি তুই?”
ইয়াদের মুখ থেকে তুই শুনে কেঁপে উঠলো সাইরাহ্।
“ইনায়া।”
ইয়াদ মাথাটা এলিয়ে দিলো বিছানায়।
“ইনায়ার সাথে দেখা করেছেন আপনি? ”
“হুহ।”
“কি কি বলেছে ও।”
“সব।”
“ওহ আচ্ছা।দাদু এখন তুমি যাও।আমি সাইরাহ্ এর সাথে কিছু কথা বলব।”
ইয়াদের দাদু গজরাতে গজরাতে চলে গেলেন।
“এদিকে আসেন।”
সাইরাহ্ ভয়ে ভয়ে ইয়াদের কাছে এসে বসলেন।
“কি কি বলেছে ইনায়া?”
“জেরিন..। ”
“এ ব্যাপারেও বলেছে?”
“হুম।”
“তারেক কেন আমাকে মারতে চেয়েছিল?”
“ইনায়া আপু বলেছিল তাই।আপনি যদি আমাদের মেরে ফেলেন।”
“এই আপনার ভালোবাসা সাইরাহ্?”
সাইরাহ্ কিছু বললেন না।তার বড্ড ক্লান্ত লাগছে।ইয়াদ বিষয়টি বুঝতে পেরে তাকে চুপচাপ ঘুমাতে সাহায্য করলেন।ইয়াদ এতো সব শোনার পরেও এতো ঠান্ডা রিয়াকশন কেন দিলেন তা বোধগম্য হলো না সাইরাহ্ এর।
,
,
“হাসছেন কেন প্রজাপতি আপনি?”
“হাসছি।এখন কি আমাকেও মেরে ফেলবেন?”
“আমাকে খুনি মনে হয় ইনায়া আপনার?”
কথাটা শুনে সামনে বসে থাকা ইয়াদের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাঁকালেন ইনায়া।লোকটার চেহারা বিষের প্রতিক্রিয়ায় বেশ ভেঙে পড়েছে।
“বললে বিশ্বাস করবেন?”
“কি?”
“আমার না আপনাকে খুনি বলে বিশ্বাস করতে বেশ কষ্ট হয়েছিল প্রথমে।তারপর মারুফের প্রাক্তন এবং বর্তমানে আপনার ছায়া যখন সব প্রমাণ সহ দেখালো তখন আমি বিশ্বাস না করে পারিনি।”
“জুঁই তাহলে আপনাকে সব বলেছে?”
“হুহ।বলার দুই ঘন্টা পর ওর রোড এক্সিডেন্ট হয়।এবং স্পট ডেথ।কাকতালীয় লাগেনি আমার কাছে।”
“কাকতালীয় ছিলনা ওটা।”
“জানি।”
ইনায়া আর ইয়াদ বেশ স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে।এমন যে এদের মধ্যে কিছুই হয়নি।
“সাইরাহ্?ওকে কি করবেন?”
“কি করার আছে তাকে?”
“আমি জানি আপনি সাইরাহ্ কে কিছুই করবেন না।”
“এতো বিশ্বাস আমার প্রতি?”
“উহু!সে প্রথম মেয়ে যাকে ইয়াদ ইউসুফ নিজের সাথে পুরো দুনিয়ায় সামনে জড়িয়েছে।”
“আর আপনাকে?”
“রক্ষিতা আমি।”
“একথা জেরিনকে বলায় ও ক্ষেপেছিল অনেক।”
“মেয়েটাকে না মারলেও চলতো আপনার।”
“জানি আমার জীবনে প্রথম খুন যেটা করে আফসোস করেছি আমি।”
“বেশ।”
“আপনাকে মারবো বলে মনে হয়?”
“উহু।”
“কেন?”
“কেন যেন মনে হলো আমাকে মারতে আসেননি।”
“আমার বাবাকে ওগুলো বলে মৃত্যুর দিকে ঠেলেছেন আপনারা।”
“তাকে শুধু সত্য সম্পর্কে অবগত করেছি।”
“আমাকে মেরে ফেলতেন।”
“তাইতো করার চেষ্টা করছিলাম।”
ইয়াদ ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
“আপনি একটা বুদ্ধিমতী মেয়ে।আপনার ব্যক্তিত্ব দেখে আপনাকে কাছে টানি আমি।অথচ প্রেম শুরু হওয়ার পর দেখলাম আপনার ব্যক্তিত্ব আমার কাছে বড্ড ঠুনকো।”
“আমাকে না বেছে নিলেও পারতেন।পরিবারের কথা তো জানতেন সব।”
“এখন কি হওয়া উচিত বলেন।”
ইনায়া কোন জবাব না দিয়ে সোফা ছেলে উঠে গেলেন।একটু পর হাতে করে অনেকগুলো ঔষধ নিয়ে আসলেন।
“এটা ঘুমের ঔষধ না প্যারাসিটামল।বেশী মাত্রায় খেলে মানুষ বাঁচেনা।”
“আমি শুনে এখন কি করবো?”
“কারণ আমি এখন এগুলো খেয়ে আত্নহত্যা করবো।আপনি চলে যান।”
ইনায়ার কথাগুলো বড্ড অদ্ভুত শুনালো।যেন কোন ছোট বাচ্চা বলছে আমি চকলেট খাবো চলে যান।
“কিন্তু আমি তো আপনাকে মারার অভিপ্রায়ে আসিনি।”
“আমি বাঁচতে পারবো না এভাবে বেশীদিন।এবং জানি আপনি একদিন না একদিন আমাকেও মেরে ফেলবেন।আকস্মিত ও নির্দয় মৃত্যুর থেকে নিজে আত্নহত্যা করা ভালো।”
ইনায়া অন্তত সহজ ভঙিতে সবগুলো মেডিসিন পানি দিয়ে গিলতে শুরু করলেন।ইয়াদ মায়া চোখে তার দিকে তাঁকিয়ে রয়েছেন।
“আপনি অন্ত্যত সাহসী ছিলেন ইনায়া।”
সব ঔষধ খাওয়া শেষে সোফার দিকে হেলান দিয়ে বসলো ইনায়া।
“আমাকে বাঁচাবেন না ইয়াদ?”
“নাহ।”
হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ইনায়া।এ কান্নাতে কিছু একটা আছে।একজন ব্যক্তির মৃত্যুর আগে কান্না আর জন্মের সময় কান্না কতো পার্থক্য।
“আপনি চলে যান ইয়াদ।”
ইনায়ার অবস্থার ধীরে ধীরে অবনতি হওয়া শুরু করছে।
“আমি চিঠি লিখে যাবো যে এটা আত্নহত্যা।”
“তাতে আমার উপকার?”
“অন্তত আপনাকে পুলিশ ধরবেনা।”
“বুঝলাম।”
“আপনাকে অনেক ভালোবাসি ইউসুফ।”
“আমিও প্রজাপতি।”
“চলে যান।”
ইয়াদ ধীরগতিতে সোফা ছেড়ে উঠলেন।ইনায়ার কাছে গিয়ে তার মাথায় হালকা করে হাত বুলিয়ে দিলেন।
“আপনাকে আমি ভুলবো না প্রজাপতি।আপনি সুগন্ধিযুক্ত এক রঙীন প্রজাপতি।”
ইনায়া কিছু বলল না।শুধু চোখ বন্ধ করে রাখলো।হালকা করে নিশ্বাস উঠানামা করছে তার।হয়তো একটু পর পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যাবে সব।
চলবে,,,
আগামী পর্বে সমাপ্য।